চর্যাপদের আবিষ্কর্তা মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন যে, চর্যাপদে ব্যবহৃত ভাষাটি আসলে বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কিছুই নয়, আর সেই কারণেই তিনি চর্যাপদের পরিচয় দিতে গিয়ে নির্দ্বিধায় জানিয়েছিলেন যে, চর্যাপদের কবিতাগুলি— “হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা” ও “বৌদ্ধ সহজিয়া মতের অতি পুরাণ গান”। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রচলিত অর্থে কোন ভাষাবিজ্ঞানী ছিলেন না। তবে তিনি বিনা কারণে নিজের সহজ বুদ্ধির বশবর্তী হয়ে চর্যাগীতির ভাষাকে বাংলা বলেন নি। তিনি সুস্পষ্টভাবেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, বাংলা ভাষার যে সমস্ত শব্দ বাগভঙ্গি এবং প্রকাশভঙ্গী ভাষাটির নিজস্ব বিশেষত্ব, বাংলাভাষার ‘spirit’–এর সমধর্মী সেই সমস্ত শব্দের বাগভঙ্গি এবং প্রকাশপদ্ধতি চর্যাপদেও উজ্জ্বলভাবে উপস্থিত রয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ের ভাষাবিজ্ঞানীরা চর্যাপদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ‘vocables’ বা শব্দতত্ত্ব নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন নি, অথবা শুধুমাত্র ‘vocables’–এর উপরে নির্ভর করেই কোনো ভাষার অনুশীলন বা জাতিনির্ণয় করা সম্ভব, কিংবা তেমন কিছু নির্ণয় করা হলেও সেটা যে সঠিক হতে পারে— এরকম কথায় বিশ্বাস করেন নি। তাঁরা জানিয়েছিলেন যে— কোনো ভাষার অনুশীলন করতে গেলে সেটার স্বরবিজ্ঞান বা ‘phonology’ এবং পদগঠনরীতি বা ‘morphology’–ও শব্দতত্ত্বের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। এই কারণেই ভাষাবিজ্ঞানী আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘Origin and Development of the Bengali Language’ গ্রন্থে চর্যাপদে ব্যবহৃত হওয়া ভাষা বাংলা কিনা— সেবিষয়ে ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক আলোচনা করে শেষে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতকেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে দেখা যায়।
কিন্তু অন্যদিক থেকে এই আলোচনা আবার অন্য ভাষাভাষীদের চর্যাপদের ভাষাকে ভুল বুঝতে সুযোগ করে দিয়েছে বলে দেখা যায়; যার ফলে অতীত থেকেই এবিষয়ে একটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, যেটি এখনও বর্তমান রয়েছে। এই বিতর্কের মূল কারণ হল যে— চর্যাপদের কোনো কোনো শব্দ ও পদ সেযুগের বাংলা বা সেই সময়কার বাংলা ভাষায় প্রচলিত থাকলেও পরে কিন্তু বাংলা ভাষাতে সেগুলি আর ব্যবহৃত হয়নি। এপ্রসঙ্গে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন যে, সেগুলি মূলতঃ শৌরসেনী অপভ্রংশের প্রভাবজাত ছিল এবং চর্যাপদে দুটি ক্রিয়াপদ— ‘ভণথি’ ও ‘বোলখি’ —মৈথিলীভাষা থেকে চর্যাপদে এসেছিল। কিন্তু তাঁর এই সিদ্ধান্তের সুযোগ নিয়ে পরবর্তী সময়ে পূর্বভারতের চারটি প্রধান ভাষাভাষীরা চর্যাপদকে তাঁদের নিজেদের ভাষার প্রাচীনতম রূপ বলে দাবি করেছিলেন, এবং আজও তাঁরা নিজেদের দাবিতে অটল রয়েছেন বলেই দেখা যায়। এই চারটি ভাষাভাষীরা হলেন— হিন্দি, মৈথিলী, উড়িয়া এবং অসমীয়া। এছাড়া চর্যাপদের উপরে বাংলা ভাষার নিজস্ব দাবি তো রয়েছেই। কিন্তু ঠিক কি কারণে এই চার ভাষার মানুষেরা চর্যাপদকে তাঁদের নিজেদের বলে দাবি করে থাকেন? তাঁদের মতে— চর্যাপদে যেমন বহু হিন্দি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি এতে মৈথিলী, উড়িয়া ও অসমীয়া শব্দের প্রয়োগও দেখতে পাওয়া যায়। তাই বাংলা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে বলে চর্যাপদকে যদি বাংলা ভাষার রচনা বলা চলে, তাহলে সেই একই যুক্তিতে এটিকে হিন্দি বা উড়িয়া, মৈথিলী কিংবা অসমীয়াও বলা চলে। এসব দাবির মধ্যে ভাষাবিজ্ঞানীরা অসমীয়ার দাবিকে সম্পূর্ণভাবে নস্যাৎ করেননি, কারণ— তাঁদের মতে, খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা এবং অসমীয়া প্রায় একইরকমের ভাষা ছিল। সুতরাং কোন আধুনিক অসমীয়া যদি দাবি করেন যে, চর্যাপদ আসলে তাঁদের ভাষায় লেখা হয়েছে, তাহলে সেবিষয়ে কোন আপত্তি করা চলে না। কিন্তু এবিষয়ে হিন্দি, মৈথিলী ও উড়িয়া ভাষার দাবি কতটা যুক্তিসংগত?
আরও পড়ুন: প্রাকৃত ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস
ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে বর্তমানের কোনো কোনো শব্দ অতীতের একই সূত্র থেকে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় গিয়েছিল। যেমন— পানি বা জল। এই শব্দটির মূল হল সংস্কৃত— পানীয়, অর্থাৎ— পানের যোগ্য। সংস্কৃত মত অনুযায়ী শরবত যেমন পানীয়, তেমনি জল ও দুগ্ধও পানীয়। কিন্তু হিন্দি ও বাংলা ভাষায় এই শব্দটি যোগরূঢ়ার্থে— শুধুমাত্র জল হিসাবেই ব্যবহৃত হয়। চর্যাপদের ৬ নং চর্যায় পাওয়া যায়—
“তিন ন দ্রুপই হরিণা পিবই ন পানী”
কিন্তু এখানে শুধু পানি শব্দটি দেখে কেউ সমগ্র পঙক্তিটিকে হিন্দি বলে দাবি করতে পারেন না। বিশেষজ্ঞদের মতে, নব্য ভারতীয়-আর্যভাষার প্রথম স্তরের সমস্ত ভাষার মধ্যেই মোটামুটিভাবে একটা মিল ছিল। কারণ— প্রাকৃত ভাষা যেমন নব্য ভারতীয়-আর্যভাষার জননী, তেমনি লৌকিক রূপে পরিবর্তিত বৈদিকও (যেটির মধ্যে সংস্কৃতও অন্তর্ভুক্ত) হল প্রাকৃতভাষা।
মধ্য ভারতীয়-আর্যভাষার ক্রমপরিণতির শেষ স্তরটির নাম হল অপভ্রংশ। প্রাকৃত ভাষার সরলতর, সহজতর ও লৌকিক রূপটি অপভ্রংশে দেখতে পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের মতে, আনুমানিক খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যেই এই স্তরটি একটি সুস্পষ্ট পরিণতি লাভ করেছিল। অতীতে পণ্ডিত গ্রীয়ার্সন জানিয়েছিলেন যে, মধ্যস্তরের প্রাকৃতের শেষ অবস্থাটিই ছিল অপভ্রংশ। কিন্তু এই অপভ্রংশ ভাষা কোনোদিনই তৎকালীন সমাজের উচ্চস্তরে মানুষের মুখের বা জ্ঞানবিজ্ঞানমূলক সাহিত্যের বাহন হিসাবে গৃহীত হয় নি। কিন্তু সেযুগের সমাজের নিম্নস্তরে, যেটাকে গবেষকরা আর্যেতর ‘substratum’ অভিহিত করেছেন— সেখানে সাধারণ মানুষের প্রাণের ভাষা এবং লোক-সাহিত্যের প্রধান বাহক হিসাবে অপভ্রংশের একটি ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল। এই অপভ্রংশ আবার প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের কালগত ও স্থানগত রূপান্তরের মাধ্যমে শেষে আধুনিক ভারতীয়-আর্য ভাষার অন্তর্গত— বাংলা, হিন্দি, উড়িয়া, পাঞ্জাবী, মারাঠী, গুজরাটি —প্রভৃতিতে পরিণত হয়েছিল। গবেষকরা জানিয়েছেন যে, অপভ্রংশের পরের এবং আধুনিক বা নব্য ভারতীয়-আর্যভাষার ঠিক আগের স্তরটির নাম হল অবহটঠ।
ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, আনুমানিক ৮০০ থেকে ১১০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে নব্য ভারতীয়-আর্যভাষার মধ্যে অন্যতম প্রধান ভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখনও পর্যন্ত বঙ্গদেশে— সংস্কৃত, শৌরসেনী এবং প্রাকৃত — এই তিন ধরণের ভাষাই সাহিত্য রচনা করবার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হত। সেযুগে জ্ঞানবিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র ও সাহিত্য রচনা করবার জন্য তখনকার শিক্ষিত, মার্জিতরুচি ও খ্যাতিলোলুপ বাঙালিরা সংস্কৃত ভাষাই ব্যবহার করেছিলেন। একাজের জন্য তাঁরা কোনো কোনো সময়ে প্রাকৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থকেও সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করে নিয়েছিলেন। অন্যদিকে তখনকার মহাযানী বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা তাঁদের ধর্ম-দর্শন আলোচনা করবার জন্য প্রাকৃত-মিশ্রিত সংস্কৃত বা বৌদ্ধ-সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করেছিলেন, এবং তৎকালীন সমাজের নিম্নস্তরের লৌকিক-সাহিত্য রচনা করবার জন্য লোককবিরা অপভ্রংশ ভাষার ব্যবহার করেছিলেন। গবেষকদের মতে— প্রাচীন বাংলায়— মাগধী ও শৌরসেনী —এই দুটি প্রাকৃত থেকে জাত অপভ্রংশেই কাব্য রচনা করা হত, এবং এই দুটির মধ্যে খুব বেশি পার্থক্যও ছিল না। সেযুগের বহুজন-ব্যবহৃত এই অপভ্রংশ দুটির প্রভাব তৎকালীন লৌকিক জনসমাজে ব্যাপক ও গভীর ছিল। শৌরসেনী প্রাকৃতের অপভ্রংশ শুধু বাংলায় নয়, সমগ্র উত্তর-ভারতেই ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও ব্যবহৃত ছিল। এই কারণেই প্রাচীন বাংলার সহজযানী সিদ্ধাচার্যরা তো বটেই, এমনকি ব্রাহ্মণ-কবিদের মধ্যেও কেউ কেউ অপভ্রংশ ভাষাতেই নিজেদের কাব্য রচনা করেছিলেন। চর্যাপদের কাহ্নপাদ, সরহপাদ প্রমুখ সিদ্ধাচার্যরা শৌরসেনী প্রাকৃতের অপভ্রংশেই তাঁদের দোহাগুলি রচনা করেছিলেন। খৃষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকের মিথিলার কবি বিদ্যাপতি তাঁর ‘কীর্তিলতা’ কাব্যটি শৌরসেনী অপভ্রংশে রচনা করেছিলেন। এমনকি কোন কোন পণ্ডিতের মতে— জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যটিও গোড়ার দিকে শৌরসেনী অপভ্রংশেই রচিত হয়েছিল। একথা ইতিহাসগতভাবে সত্যি হোক বা না হোক, তবে কবি জয়দেবও যে অপভ্রংশ ভাষায় গীতি-কবিতা রচনা করেছিলেন, সেটার প্রমাণ কিন্তু ইতিহাসে পাওয়া যায়। অতীতে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় গুর্জরী ও মারূরাগে গেয় জয়দেবের দুটি গান শিখদের শ্রীগুরুগ্রন্থ থেকে উদ্ধার করেছিলেন।
আরও পড়ুন: মধ্যযুগের বাংলা কাব্য: মধ্যযুগের কবিদের চোখে ৪
ড. সুকুমার সেনের মতে— শৌরসেনী অপভ্রংশ— যেটা অবহটঠ স্তরের ভাষা ছিল, সেটা অতীতের কোন একসময়ে সমগ্র উত্তরভারতে সংস্কৃতের পরেই সাধুভাষার মর্যাদা পেয়েছিল। সুতরাং সমগ্র উত্তরভারতে আনুমানিক খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে শুরু করে দশম শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত সময়ে যতগুলি কাব্য সেখানকার বিভিন্ন প্রদেশে রচিত হয়েছিল, সেগুলিতে শৌরসেনী অপভ্রংশের কিছু কিছু শব্দ থাকাটাই স্বাভাবিক এবং না থাকাটা অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, যেহেতু পরবর্তী সময়ে এই শব্দগুলিকে— বাঙালি, হিন্দি, উড়িয়া, মৈথিলী —সকলেই ব্যবহার করেছিলেন, সেহেতু এই কারণেই চর্যাপদের ভাষাগত মালিকানা নিয়ে বর্তমান সময়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু আগেই বলা হয়েছে যে, ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে— শুধুমাত্র ‘vocables’–এর সাহায্যেই একটা ভাষার জাতি নির্ণয় করা সম্ভব নয়। বিষয় পরিবেশ, পদ, ইডিয়ম, শব্দরূপ, ধাতুরূপ, কারক-বিভক্তি সমস্ত কিছুকে বিচার করে তবেই সিদ্ধান্ত করা সম্ভব যে, চর্যাপদের ভাষা আসলে বাংলা নাকি হিন্দি নাকি উড়িয়া নাকি মৈথিলী। এদিক থেকে বিচার করে গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন যে— চর্যাপদে উল্লেখিত বিষয়-পরিবেশ কিন্তু বাংলার, এবং এটির ব্যাকরণগত বিশেষত্বও আধুনিক বাংলার পূর্বগামী, যা পরবর্তী স্তরের পরিণত বাংলার মধ্যে মুক্তি পেয়েছিল।
ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, চর্যাপদের ভাষায় স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের ধ্বনিগত বিশেষত্ব অনেকটা আধুনিক বাংলা ভাষার মতোই। তবে এতে যেসমস্ত সংস্কৃত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছিল, সেগুলির বানানে অনেক গরমিল দেখতে পাওয়া যায়। যেমন— সবর→ শবর; পানি→ পাণী; উন্মত্তো, পুন্ন ইত্যাদি। এই অসংগতি সম্পর্কে ডঃ সুকুমার সেন বলেছিলেন—
“তদ্ভব ও অর্ধ-তৎসম শব্দের বানানে কখনই সংগতি ছিল না, তাহার উপরে নেপালে লেখা পুঁথি, সুতরাং লিপিকর প্রমাদ তো বানানকে জটিলতর করিয়া তুলিবেই। তাহাই হইয়াছে এবং তৎসম শব্দও বাদ যায় নাই। হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বরের ব্যবহারে গোলমাল আছে আর আছে তিন স-কারের ও দুই ন-কারের ব্যবহারে। অ-কার, ই-কার, এ-কারের মধ্যে বিপর্যয়ও কম নাই। বিশেষ লক্ষণীয় হইতেছে পদান্ত ই-কার স্থলে য়-কার বা অ-কার।”
আরও পড়ুন: আজকের বাংলায় লেখকদের পরিস্থিতি
আধুনিক সময়ের বাংলায় যেমন হ্রস্ব ও দীর্ঘস্বরের উচ্চারণের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায় না, তেমনি প্রাচীন এইধরণের কোন পার্থক্য ছিল না। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে যে— এখন কাগজে কলমে পাত্রী লিখলেও উচ্চারণ করবার সময়ে রাত্রির সঙ্গে সেটার কোনো পার্থক্য করা হয় না। চর্যাপদেও এইধরণের অনেক উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়; যথা— ‘চুম্বী চ্ছাড়ী চ্ছিনালী উজু’ (উজু→ সংস্কৃত ঋজু), ‘বিআতী বহুড়ী ডোম্বী’। আবার শবরি (ডোম্বি গাতি) ইত্যাদি হ্রস্ব-ইকারান্ত বানানও চর্যাপদে রয়েছে। শ, য, স— এই তিনটি শব্দই চর্যাপদের ভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে বলে দেখা যায়; যেমন— ১৯ নং চর্যায় করণ্ডকশালা ও অহনিসি; এবং ৫০ নং চর্যায় শবর ষবরালী। অন্যদিকে ২০ ও ৩০ নং চর্যায়— মণ এবং মন —দুটো শব্দই দেখতে পাওয়া যায়। চর্যাপদে পদান্তে ই-কারের অ-কারে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার উদাহরণ হল ২নং চর্যার— ‘দুলি দুহি পিঠা ধরণ ন জাই। রুখের তেন্তলী কুম্ভীরে খাঅ।’ এখানে ‘খাঅ’ শব্দটি এভাবে এসেছে— খাদিতম্→ খাইঅ→ খাআ। সম উদহরণ হল— জাগঅ, মাগঅ, জাঅ ইত্যাদি।
চর্যাপদে একবচনে কর্তৃ, কর্ম, করণ ও অধিকরণ কারকে যেমন কোনো বিভক্তি ব্যবহৃত হয়নি, তেমনি আজও বাংলা ভাষায় এক্ষেত্রে কোন বিভক্তি ব্যবহৃত হয় না। যেমন— ‘সসুরা নিস্ গেল বহুড়ী জাগঅ’; এখানে— সসুরা, বহুড়ী —হল একবচন কর্তৃকারক, এতে কোন বিভক্তি নেই। তেমনি বিভক্তিহীন কর্মকারকে একবচনের উদাহরণ হল— ‘রূপা থোই নাহিক ঠাবী। করণে— ‘বাঢ়ই সো তরু সুভাস্থভ পানী’; এখানে পানী অর্থ হল— জলের দ্বারা। এতে কিন্তু কোন বিভক্তি ব্যবহৃত হয়নি। এরকম একটি আধুনিক বাংলা বাক্য হল— ‘ছেলেরা ফুটবল খেলে।’ চর্যায় অধিকরণকারকে— ‘বেঢ়িল হাক পড়অ চৌদীস (চৌদিকে)’–এর সঙ্গে আধুনিক বাংলায়— ‘সকালবেলা এস’ —তুলনীয়। অতীতে বহুবচন বোঝানোর জন্য বহুত্ববোধক শব্দগুলিকে চর্যাপদের বাংলায় ব্যবহার করা হয়েছিল, যেমন— ‘সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই’, ‘তা সুনি মার ভয়ঙ্কর রে বিসঅ-মণ্ডল সঅল ভাজই’। এখানে সঅল অর্থ হল— সকল। আবার অনেক জায়গায় সংখ্যাবাচক শব্দ দিয়েও বহুবচন বোঝানো হয়েছিল; যেমন— ‘কায়া তরুবর পঞ্চ-বি ডাল’; ‘বেড়ল চৌদিস’; ‘তিনা সাঁঝে’; ‘চৌষঠঠী পাখুড়ী’ (চৌষট্টি পাপড়ি) ইত্যাদি। এমনকি পরপর দু’বার বিশেষণ শব্দ ব্যবহার করে বহুবচন বোঝানোর নিদর্শনও চর্যাপদে পাওয়া যায়, যেমন— ‘উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই শবরী বালী’। এছাড়া সংস্কৃত ভাষার অনুসরণে বহুবচনে বিভক্তি ব্যবহার করবার উদাহরণও ২৩ নং চর্যায় দেখা যায়; যথা— ‘জই তুহ্মে ভুসুকু অহেরি জাইবে মারিহসি পঞ্চজণা’। তবে আধুনিক বাংলা ভাষার— রা, এরা —প্রভৃতি বিভক্তির ব্যবহার চর্যাপদে বিশেষ পাওয়া যায় না।
আরও পড়ুন: চর্যাপদের রচয়িতাদের ধর্মমত
গবেষকদের মতে, চর্যাপদে ব্যবহৃত বাংলাভাষায় পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রীলিঙ্গ ব্যবহারের নিয়ম অপভ্রংশের প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হলেও তাতে কোন ক্লীবলিঙ্গ শব্দ ব্যবহৃত হয়নি। গ্রন্থিতে বিশেষ্য স্ত্রীলিঙ্গ হলে বিশেষণটিও স্ত্রীলিঙ্গ করা হয়েছিল; যেমন— ‘নিশি অন্ধারী মুষার চারা’। এছাড়া ‘ইল’ প্রত্যায়ান্ত কিংবা ‘এর’ প্রত্যয়ান্ত বিশেষণও কখনো কখনো স্ত্রীলিঙ্গের রূপ নিয়েছিল; যেমন— ‘সোনে ভরিলী করূণা নাবী’, ‘সুজ লাউ সসী লাগেলি তাম্বী’, ‘ণাণা তরুবর মউলিল রে গঅণত লাগেলী ডালী’, ‘নগর বাহিরে ডোম্বী তোহোরি কুড়িআ’, ‘তোহোর অন্তরে মোএ ঘলিলি হাড়েরি মালী’। গ্রন্থটিতে ঈ (ই) বা আ যুক্ত করে স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ করবার উদাহরণ হল— হরিণী, শবরী, হরিণা, কঠিণা; এবং নি (নী) যুক্ত করে স্ত্রীলিঙ্গ করবার উদাহরণ হল— শুণ্ডিনি।
অতীন্দ্র মজুমদার জানিয়েছিলেন-
“চর্যাগীতির মধ্যে ব্যবহৃত ভাষার শব্দরূপের গঠনে একবচন এবং বহুবচনের তফাত নেই। সম্বন্ধ বোঝানো ছাড়া স্ত্রীলিঙ্গ-পুংলিঙ্গেরও তফাত নেই।”
এসব বিশ্লেষণ থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, চর্যাপদে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটি আসলে বাংলাই ছিল। তাই অন্যরা এবিষয়ে যে দাবিই তুলুন না কেন, ইতিহাস ও ভাষাগত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তাঁদের সেই দাবি কখনোই ধোপে টেকা সম্ভব নয়।#