সমগ্র ভারতে একই উৎসব প্রচলিত রয়েছে, এমন উদাহরণ মোটামুটিভাবে তিনটির বেশী পাওয়া যায় না। সেই উৎসব তিনটি — হলদশেরা, দেওয়ালী এবং দোল। লোকসাংস্কৃতিক গবেষকদের মতে, প্রথম দুটির মধ্যে মানুষের ধর্মীয় অনুষঙ্গটুকু উৎসবমনস্কতার থেকে প্রবলতর হয়েছে, কিন্তু দোলযাত্রার ধর্মানুষঙ্গটি এর উৎসব-মুখরতার কাছে প্রকৃতপক্ষে গৌণই হয়ে গিয়েছে। সেদিক থেকে দেখলে এটিই হল একমাত্র সর্বজনীন সর্বভারতীয় উৎসব, যেখানে ধর্ম-বর্ণ সম্প্রদায়ের বিভেদটা আবীরের রঙে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। এই একই উৎসব অবশ্য সমগ্র ভারতে বিভিন্ন নামে পরিচিত ও প্রচলিত রয়েছে। বাংলায় যা দোলযাত্রা, উড়িষ্যায় সেটাই দোলোৎসব, উত্তর ও মধ্যভারতে সেটারই নাম হল হোলি বা হোরি, গোয়া এবং কোঙ্কন অঞ্চলে এর নাম হল শিমাগা, এবং দক্ষিণ ভারতে এই একই উৎসবের নাম হল মদন দহন বা কামায়ন। কিন্তু নামের মধ্যে যত পার্থক্যই থাকুক না কেন, উৎসবের আঙ্গিকটা সর্বত্রই এক ধরণের। আগুন জ্বালিয়ে কিছু পোড়ানো, রঙ মাখানো, নাচ-গানের সঙ্গে নারী-পুরুষের মধ্যে কিছু পরিমাণে বাধাহীন ঘনিষ্ঠতা— এগুলি এই উৎসবের অনিবার্য উপকরণ হিসেবে সর্বত্রই স্বীকৃত। হোলি-পার্বণের ঐ কামায়ন (কামের যাত্রা), শিমাগা (যৌবনোৎসব), মদন দহন (ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন), দোলযাত্রা (দোলায় গমন বা মিলন) প্রভৃতি নামগুলিই এই উৎসবের মূল চরিত্রের ঐতিহাসিক নির্দেশক। এই সমস্ত দিকগুলি বিশ্লেষণ করলে সেই আদিমকাল থেকেই এই ধরণের বিভিন্ন যেসব উৎসবের প্রচলন পৃথিবীর সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায়, এবং বিভিন্ন প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে শাবরোৎসব জাতীয় যেসব উপলক্ষ্যের বিবরণ পাওয়া যায়— দোলের মূল চরিত্রের সঙ্গে সেসবের বিশেষ কোন পার্থক্য কিন্তু গবেষকরা খুঁজে পাননি। ইউরোপের মে ফেয়ার, ফ্লাওয়ার ডে ফেস্টিভ্যাল বা অতীতকালের ব্যাকানালিয়া প্রভৃতি উৎসবের কিংবা বড়দিন উপলক্ষ্যে কিসিং আণ্ডার মিসলটো প্রভৃতি সব উৎসবের রেওয়াজও এই শাববোৎসব-দোল ইত্যাদির সমধর্মী বলে দেখতে পাওয়া যায়।
তবে ধর্মের ভাবনাকে সরিয়ে রেখে সমাজ বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে দেখলে এই উৎসবকে বসন্ত ঋতু উপলক্ষ্যে আয়োজিত উৎসব বলেই গণ্য করতে হবে। এটিকে একইসাথে শস্য কেন্দ্রিক উৎসব বলে মনে করবার কারণও রয়েছে। অতীতের কোনো কোনো পণ্ডিত দোল বা হোলিকে নতুন বছরের সূচনা সম্পর্কিত উৎসবরূপেও গণ্য করেছিলেন। কেননা, ভবিষ্যপুরাণের মতে ফাল্গুন হল বছরের শেষ মাস। তবে এটা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে; কারণ— মাঘ মাসের পূর্ণিমায় উত্তরায়ণ শুরু হলে সেদিন থেকেই নতুন বছর ধরবার তাৎপর্য বুঝতে পারা যায়; কিন্তু সেদিক থেকে দেখলে ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা হোলির দিনের ক্ষেত্রে সেই ধরণের কিছু ভাববার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। হোলি উপলক্ষ্যে আগুন জ্বালিয়ে বুড়ীর ঘর ওরফে মেড়ার ঘর পোড়ানোর যে প্রথাটি চালু রয়েছে, সেটিকে অবলম্বন করেও অতীতে কেউ কেউ এই উৎসবকে নববর্ষের মুখপাত বলেছিলেন। ভারতের হিন্দীভাষী অঞ্চলে সংবৎ-জ্বালানা বলে এই রীতিটি অনেক জায়গাতেই পরিচিত রয়েছে, এবং এটাও তাঁদের স্বপক্ষে অন্যতম প্রামাণিক বক্তব্য। কিন্তু এটি সম্ভবতঃ ফসল উৎসবেরও দ্যোতক। বর্তমানে এই দোল বা হোলির অগ্ন্যুৎসব তথা চাঁচর উপলক্ষ্যে জীবন্ত মেড়া (ভেড়া) দগ্ধ করবার রেওয়াজ প্রচলিত না থাকলেও, উত্তর ভারতে এখনও কলাগাছ কিংবা ভেরেণ্ডা গাছ দগ্ধ করবার রীতি প্রচলিত রয়েছে। এবং সেখানে আগে সেগুলিকে যথারীতিভাবে পুজো করে তবেই ঐ দাহনকার্য সমাধা করা হয়। অন্যদিকে বর্তমানে বঙ্গদেশে চাঁচাড়ি এবং বাঁশের ঘর পুড়িয়ে ছাই করবার রীতি প্রচলিত রয়েছে। একইসঙ্গে খড়ের ভেড়ার মূর্তি পোড়ানো কিংবা জ্যান্ত ভেড়ার গায়ে আগুন ছুঁইয়ে সেটাকে প্রতীকীভাবে দগ্ধ করবার রীতি ইত্যাদিও কমবেশি প্রচলিত রয়েছে। আবার সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে এই উপলক্ষ্যে মানুষের কুশপুত্তলিও জ্বালানো হয়ে থাকে।
প্রশ্ন হল যে, এই অগ্নিদাহনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য কি? আসলে অতীতে এটি একইসঙ্গে নববর্ষের উৎসব, মদনোৎসব এবং শস্যোৎসব ছিল। মানুষ এবং ভেড়ার প্রতীকী দাহন কিম্বা জ্যান্ত ভেড়া কিংবা তাজা গাছ পোড়ানো খুব সম্ভবতঃ শস্যদেবতার উদ্দেশ্যে বলি নিবেদন করবার আদিম প্রথার ধারাবাহী। এই উৎসবের আগুনে যেসব ফলমূল ফুল ইত্যাদি ভুজ্যি ছড়ানো হয়, সেগুলিকে অর্ধদগ্ধ অবস্থায় তুলে নিয়ে গিয়ে শস্যক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেওয়া কিংবা প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করবার রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে বলে দেখা যায়। সেই ছাইয়ের কিছুটা ঘরে নিয়ে গিয়ে যত্ন করে রাখলে সারা বছর ধরে অন্নাভাব হয় না বলে একটি সংস্কারও প্রচলিত রয়েছে। ওই ছাই সংগ্রহ করে অনেকে মাঠে-প্রান্তরে ছড়িয়েও থাকেন। স্পষ্টতঃই এই রীতি ঝুম চাষের ঐতিহ্যকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। পাহাড়-জঙ্গলে আগুন দিয়ে বন হাসিল করে সেই ছাইয়ের গাদার সার জমা জমিতে খন্তা দিয়ে গর্ত করে বীজ ছড়িয়ে চাষ করবার প্রথা— ভারতের কোনো কোনো আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে কিছুকাল আগেও প্রচলিত ছিল। বুড়ীর ঘরের আগুনের শিখার ঢাল দেখে, সেদিকেই এই বছর ভাল ফসল ফলবে— এমন ধরণের সংস্কার গড়ে উঠবার পিছনেও একই ধরণের তাৎপর্য রয়েছে। সেই আগুনের ছাই ঘরে রাখলে চাষীর মঙ্গল হবে, অর্থাৎ— ভাল ফসল ফলবে ইত্যাদি ধরণের সংস্কারও সেই একই উৎসজাত। এথেকেই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যায় যে, গবেষকরা কেন একইসাথে এটিকে নববর্ষের উৎসব এবং শস্য উৎসব বলে থাকেন।
এই উৎসবের কৃষিকেন্দ্রিত সংস্কারের সঙ্গে উর্বরতাকেন্দ্রিক ধর্মসংস্কারের অন্যতম দিকটি, অর্থাৎ —সন্তান-আকাঙ্ক্ষার কথাও বিদ্যমান রয়েছে। দোল বা হোলি উপলক্ষ্যে নারী-পুরুষের হাতে দু’-একদিনের জন্য — এমনকি নিতান্ত রক্ষণশীল গ্রামীণ সমাজেও যে ধরণের সামাজিক ছাড়পত্র তুলে দিতে দেখা যায়, সেটা থেকে মনে করবার কারণ রয়েছে যে, বসন্ত উৎসব উপলক্ষ্যে নারী-পুরুষের অবাধে মেলামেশা করবার যে রীতি অতীতে সারা পৃথিবীতেই প্রচলিত (এই প্রসঙ্গে ইউরোপের কিছু উৎসবের কথা একটু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এবং এই একই জিনিষ পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেরই পুরোনো সংস্কৃতিতে রয়েছে) ছিল, সেই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য এখানে বর্তমানেও টিকে রয়েছে। আজও উত্তর ভারতের, বিশেষতঃ — বৃন্দাবন অঞ্চলের, কোনো-কোনো গ্রামে হোলি উপলক্ষ্যে ভিন্ন গ্রামের নারী-পুরুষের মধ্যে নকল মারপিট ও আসল মাতামাতির রেওয়াজ— এর স্বপক্ষে ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দেয়। ঐসব অঞ্চলে অশালীন শব্দ ও অঙ্গভঙ্গী সহযোগে নাচগান করাকেও হোলির আনুষঙ্গিক হিসেবে গণ্য করা হয়। গবেষকদের মতে সেই নকল যুদ্ধের শেষে সন্ধির শর্তরূপে কিছুটা পরিমাণে যৌন উচ্ছৃংখলতাও বিগত শতকে প্রচলিত ছিল। এই কারণেই প্রাচীন পণ্ডিতেরা এই উৎসবকে মদনোৎসব বলেও অভিহিত করেছিলেন। দোল বা হোলির চাঁচরের ছাই পরিষ্কার করে সেখানে পদ্ম আঁকা আলপনা (সমাজবিজ্ঞানে যেটি নারীত্বসঙ্কেত বলে গণ্য) দেওয়ার, এবং ছাইমাটি দিয়ে গৌরী (গৌরীপট্ট = নারীত্বসূচক প্রতীকী চিহ্ন) গড়ে পুজো করবার আঞ্চলিক প্রথায় এরই আরেক প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে একথাও স্মরণযোগ্য যে, ভারতের দ্রাবিড় বলয়ে আগুন জ্বালিয়ে একই ধরণের যে উৎসবটি করা হয়, সেটার নাম হল— কামায়ন (কাম + অয়ন = মদনের যাত্রারম্ভ) বা মদন দহন (কাম-নিবৃত্তি)।
একই প্রসঙ্গেই দোল বা হোলির রঙ খেলার কথাও চলে আসে। দোল বা হোলিতে ব্যবহৃত প্রধান দুটি রঙ হল— লাল ও সবুজ; এগুলি মূলতঃ যথাক্রমে রক্ত এবং সবুজ বাসন্তিক পাতার বর্ণপ্রতীক। গবেষকদের মতে এগুলি স্পষ্টতঃই তারুণ্যের এবং যৌবনোৎসবের দ্যোতনা বহন করে চলেছে। মনোবিজ্ঞানীরা এই দুটি রঙকে যথাক্রমে কামনার ব্যঞ্জনাবাহী এবং যৌবনের অনুভূতিসঞ্চারী বলে গণ্য করে থাকেন। এই কারণেই দোল বা হোলিতে রঙ মাখানোকেও গবেষকরা এক ধরণের প্রচ্ছন্ন যৌনাচার হিসেবেই গণ্য করে থাকেন। সুতরাং, দোল বা হোলি যে আদিতে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর প্রথাসিদ্ধ যৌনাচারভিত্তিক উৎসব, তথা মদনোৎসব এবং উর্বরতা কেন্দ্রিত ধর্মধারার সমন্বিত বিবর্তন, —সেই বিষয়ে বোধ হয় সন্দেহ করবার বিশেষ কিছুই নেই।
উত্তর ভারতের হোলি যে বঙ্গদেশে দোলে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে, সেটার পিছনেও এই ধারণাই প্রচ্ছন্ন রয়েছে। বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মের ব্যাপক প্রসারের ফলশ্রুতিতে রাধা ও কৃষ্ণের বসন্ত রাসলীলা এবং হোলি এখানে সমন্বিত হয়ে গিয়েছে। বাঙালীর যেহেতু— ‘কানু ছাড়া গীত নেই’, তাই বাংলার তরুণ-তরুণীদের মদনোৎসব স্বভাবতঃই রাধা কৃষ্ণের দোলের ব্যঞ্জনায় রক্ষণশীল বাঙালী সমাজমনে প্রতিভাসিত হয়েছে। কৃষ্ণ রাধার— দোলায় গমন— কথাটি এখানে সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ঐ দোলা থেকেই দোল শব্দটি এসেছে।
এই বৈষ্ণব ভাবানুষঙ্গই হিরণ্যকশিপুর ভগিনী হোলিকা দানবীর অগ্নিদাহনের সেই পুরাণবৃত্তান্তের সৃষ্টি করেছে, যেখানে প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে অগ্নিতে প্রবেশ করে তাঁকে পুড়িয়ে মাবতে গিয়ে হোলিকা নিজেই শেষপর্যন্ত পুড়ে মরেছিল। চাঁচরের সঙ্গে এই গল্পকে খাপ খাইয়ে নিয়ে অবশ্যই রাধাকৃষ্ণের দোললীলার প্রসারের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার করা হয়েছে। হোলির অঙ্গস্বরূপ গালাগালিকে বৈষ্ণবমতে জলচল করতে আরেক রাক্ষসীর— ঢুনটিকা–র কথা কল্পনা করা হয়েছে। বিশ্বাস যে, গালাগালির অশুচিতা নাকি তাঁর আক্রমণকে ঠেকাবে! স্পষ্টতঃই সামাজিক নীতির স্বাস্থ্যকে রক্ষা করবার জন্য এইসব কাহিনীকে — ‘আই ওয়াশ’—রূপেই ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু উৎসবটিব মূল তাৎপর্য তাতে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।
মদন দহনের যে ভাবানুষঙ্গ দোলোৎসবের মধ্যে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যতে সেটার মধ্যে শিব-পার্বতীর মিলনও অভিব্যঞ্জিত। একইসঙ্গে তাতে— বৈষ্ণবীয়, শৈব এবং শাক্ত— এই তিনটি প্রধান ধর্মধারা বা কাল্ট এর মধ্যে বিমিশ্রিত হয়ে গিয়েছে। নতুন রবি-শস্যের আসন্ন প্রত্যাশা, বাসন্তিক যৌবন-উৎসব এবং হয়ত নতুন বছরের আবাহন— এসব কিছুই হয়ত এই দোলযাত্রার মহোৎসবের মধ্যে সমারূঢ় হয়েছে।#