ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ১৪

।।চৌদ্দ।।

নবীন মাস্টারের হঠাৎ মনে পড়ে গেল মহাশ্বেতা দেবীর নাম। উনি ওঁদের ত্রৈমাসিক নাট্যপত্রের উপদেষ্টা। যে কোনও বিষয় নিয়ে ওঁর সঙ্গে আলোচনা করা যায়। বিখ্যাত লেখিকা হলেও, মানুষ হিসেবে উনি আরও বড়। লোধাদের নিয়ে যে কাজ করছেন, তা আজ কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। পিছিয়ে পড়া, হেরে যাওয়া, অচ্ছুৎ, অবাঞ্ছিত মানুষদের নিজের পায়ে দাঁড় করানোর জন্য উনি লড়াই করে যাচ্ছেন। আজ উনি যদি রাজ্য সরকারের এই আচরণের কথা শোনেন, এখানকার দরিদ্র কৃষকদের এই ভয়াবহ অসহায়তার কথা শোনেন, তিনি কি স্থির থাকতে পারবেন? নড়েচড়ে উঠবেন না!
দরকারে-অদরকারে, এমনিই, শরীর কেমন আছে, জানার জন্য যে কোনও ছুটিছাটার দিন, কাউকে সঙ্গে পেলে ভাল, না পেলে একাই সরাসরি চলে যান গল্ফ গ্রিনের ফেজ টু-তে। তাঁর বাড়িতে। তিনি বাড়িতে আছেন কি না কিংবা যে দিন যাবেন বলে ঠিক করেছেন, সেই দিন আদৌ থাকবেন কি না, জানার জন্য অথবা খুব প্রয়োজন ছাড়া তাঁকে সচরাচর ফোন করেন না নবীন মাস্টার। কিন্তু এখানে যা ঘটছে, সেটা কি ঠিকঠাক মতো ফোনে জানাতে পারবেন তিনি? সামনাসামনি বসে বলতে পারলে ভাল হত না? কিন্তু অত সময় কোথায়? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁকে এটা জানানো দরকার। তাই ফোন করবেন কি করবেন না, দোনোমোনো করতে করতে শেষ পর্যন্ত পকেট থেকে মোবাইলটা বার করলেন নবীন মাস্টার।
মোবাইল যখন প্রথম বেরোয়, তখন গাদা-পেনসিল বক্সের মতো কালো কুচকুচে প্রায় আধমনি ওজনের ছিল। ফোন করলে বিল তো উঠতই, রিসিভ করলেও গচ্চা দিতে হত। প্রথম প্রথম মিনিট পিছু লাগত ন’টাকা করে। তাও কথা বলতে বলতে বারবার লাইন কেটে যেত। দশ গ্রাম সোনার দাম যখন চার হাজার আটশো চল্লিশ টাকা। তখন সেই ১৯৯৫ সালেই ওই সব বিচ্ছিরি-দর্শন হ্যান্ডসেটগুলোর দাম ছিল চল্লিশ হাজার, পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা। সোনার দাম দিয়ে রেশিও করলে আজকের দিনে ওই টাকার পরিমাণটা কত, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। তাই তখন কারও কাছে মোবাইল থাকলে আশপাশের লোকেরা তাঁর দিকে সমীহর চোখে তাকাত। গাড়িওয়ালা লোক ছাড়া তখন কেউ মোবাইল ব্যবহার করত না। একবার এক বাসযাত্রীর পকেটে মোবাইল বেজে উঠতেই, গোটা বাসের লোককে সেই বাসযাত্রীর দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ঘুরে ঘুরে তাকাতে দেখেছিলেন উনি।
বিপদ-আপদের সময় ফোন করলে না হয় ন’টাকা দিতে অতটা গায়ে লাগে না। কারণ, এমারজেন্সি তো আর সর্বক্ষণ লেগে থাকে না। কিন্তু রিসিভ করলেও টাকা দিতে হবে! এটা বড় বিচ্ছিরি ব্যাপার। যদি কোনও দিন ইনকামিং কলের চার্জ উঠে যায়, তখন না হয় ভাবা যাবে! এখন ফোন নেওয়ার কোনও মানেই হয় না। আরও অনেকের মতো নবীন মাস্টারও এটা ভাবতেন।
এক সময় রেডিও রাখার জন্য বাৎসরিক একটা এন্টারটেনমেন্ট ট্যাক্স দিতে হত লোকদের। ট্যাক্স দেওয়ার সময়, রেডিওর সঙ্গে দোকান থেকে দেওয়া পাস বইতে, সম-পরিমাণ ডাকটিকিট লাগিয়ে দিত ওরা। ডাকটিকিটগুলোর কোনওটায় ছাপা থাকত তবলা, কোনওটায় ঢোল, তো কোনওটায় হারমোনিয়াম। বাঁশি ছিল কি না, এখন ওঁর আর তা মনে নেই। ওই ডাকটিকিটগুলো বোধহয় শুধু ওই জন্যই ছাপা হত। তাই বুঝি ওই টিকিট লাগিয়ে চিঠি পোস্ট করা যেত না। কারণ, উনি কোনও দিনই ওই রকম কোনও ডাকটিকিট-সাঁটা খাম চোখে দেখেননি।

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ১৩

কিন্তু পরবর্তিকালে ঘরে ঘরে এত রেডিও হয়ে গেল, বিশেষ করে মহালয়ার দিন ভোর চারটে থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ কিংবা ইস্টবেঙ্গল- মোহনবাগান-মহামেডান-এর খেলার ধারাবিবরণী শোনার জন্য আগের দিন মুড়ি-মুড়কির মতো এত রেডিও বিকোতে লাগল, এত লোকের পকেটে পকেট-ট্রানজিস্টর ঘুরতে লাগল, অলিতে-গলিতে গজিয়ে ওঠা রেডিও সারানোর দোকানগুলো নিজেরাই এত রেডিও বানাতে লাগল যে, খুব কম দামে ঘরে ঘরে রেডিও পৌঁছে গেল। ওই রেডিও কিনলে যে শুধু দামেই সস্তা হত, তা নয়। এন্টারটেনমেন্ট ট্যাক্স দেওয়ারও কোনও ঝামেলা থাকত না। ফলে কারও বাড়িতে রেডিও থাকলেও বোঝার উপায় ছিল না কে এন্টারটেনমেন্ট ট্যাক্স দেয় আর কে দেয় না।
তাই সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন এলাকায় কিছু লোককে নিয়োগ করা হল। যাঁদের বাড়িতে রেডিও আছে, তাঁদের শনাক্ত করার জন্য তারা হঠাৎ হঠাৎ এর ওর বাড়িতে হানা দিলেও, তাতে কাজের কাজ খুব একটা কিছু হল না।
কারণ, যাঁদের বাড়িতেই হানা দেয়, তাঁরা কড়া নাড়ার শব্দ শুনলেই, এখানে বলে রাখা ভাল, তখনও ফ্ল্যাট-কালচার শুরু হয়নি। কলিংবেল বোতামও শোভা পেত না দরজায় দরজায়। বাড়ির লোককে ডাকার জন্য হয় দরজা ধাক্কাতে হত, নয় তো কড়া নাড়তে হত। আর সেই শব্দ শুনলেই, যাঁদের রেডিওর লাইসেন্স ছিল না বা থাকলেও এন্টারটেনমেন্ট ট্যাক্স মেটানো থাকত না, বাজেয়াপ্ত হয়ে যাওয়ার ভয়ে তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে রেডিও লুকিয়ে ফেলত। আর রেডিও তখন এত ছোট আকারের হয়ে গিয়েছিল যে, কেউ লুকোলে অন্য কারও পক্ষে সেটা খুঁজে বার করা ছিল খড়ের গাদা থেকে সোনামুখী সুচ খুঁজে বার করার মতো।
ফলে আকাশবাণীর কর্তৃপক্ষকে সঙ্গে নিয়ে সরকার পক্ষের লোকেরা বেশ কয়েক দিন ধরে আলোচনা করে অবশেষে ঠিক করলেন, এন্টারটেনমেন্ট ট্যাক্স তাঁরা তুলে দেবেন। তার পরিবর্তে অনুষ্ঠানের মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপন দিয়ে, অনুষ্ঠান করার জন্য পনেরো মিনিট কি আধ ঘণ্টা, বিভিন্ন স্লটে নির্দিষ্ট কিছু সময় বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি করে তাঁরা টাকা তুলে নেবেন। এটা জানার পর সাধারণ মানুষও তাতে সানন্দে সায় দিলেন।
রেডিওর মতো মোবাইলও যখন অনেক, অনেক বেশি লোকের হাতে চলে আসবে, আরও অনেক ব্যক্তিমালিকানাধীন মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু হবে, তখন গ্রাহকদের কে কত পরিষেবা দিতে পারে, তা নিয়ে নিশ্চয়ই প্রতিযোগিতা শুরু হবে, তখন কি আরও গ্রাহক টানতে বিভিন্ন নেটওয়ার্ক ইনকামিং কলের চার্জ উঠিয়ে দেবে না!
না, ইনকামিং কলের চার্জ ওঠাব অনেক আগেই নতুন একটা অফার ছাড়ল বিভিন্ন মোবাইল নেটওয়ার্ক সংস্থা। ন’শো নিরানব্বই টাকা দিলেই এক বছরের জন্য ইনকামিং ফ্রি। ন’শো নিরানব্বই! মানে এক হাজারেরও কম। ভাবা যায়! যাঁরা তক্কেতক্কে ছিলেন, কিন্তু ইনকামিং কল চার্জের জন্য মনস্থির করতে পারছিলেন না, তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। মোবাইল দোকানগুলোর সামনে লম্বা লাইন পড়ে গেল। রাতারাতি বিক্রি হয়ে গেল বিভিন্ন কোম্পানির হাজার-হাজার হ্যান্ডসেট।
এর মধ্যেই বাজারে এসেছিল পেজার। ছোট্ট একটা মেশিন। তার মাধ্যমে যে কোনও সংক্ষিপ্ত ম্যাসেজ আদান-প্রদান করা যেত। তবে সরাসরি নয়। ওটা পাঠাতে হত পেজারের ‘মাদার’ কোম্পানিতে। কোম্পানিই পাঠিয়ে দিত নির্দিষ্ট লোকের কাছে। মানে, যা-ই হত, সবটাই হত ভায়া পদ্ধতিতে। খরচ খুবই সামান্য। কিন্তু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল বলে, সেটাতে কেউই তেমন আগ্রহ দেখাননি। অথচ নবীন মাস্টার সেটাই কিনেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ন’শো নিরানব্বই টাকায় এক বছরের ইনকামিং ফ্রি-র অমন লোভনীয় অফার দেখে আর লোভ সামলাতে পারেননি তিনি। তখনই প্রথম মোবাইল কিনেছিলেন।
তার পর কত সেট যে হারিয়েছেন, কোনও ঠিক নেই। কিছু দিন আগে কিনেছিলেন এই সেটটা। এটায় আবার ক্যামেরা আছে। ক্যালকুলেটার আছে। ঘড়ি আছে। এমনকী টর্চও আছে। ইচ্ছে করলে ইন্টারনেটও ব্যবহার করা যায়। এ সব ফেসিলিটি দেখেই উনি ফোনটা কিনেছিলেন ঠিকই, কিন্তু আজ পর্যন্ত ফোন করা আর ফোন ধরা ছাড়া কিছুই করেননি। এমনকী একটা ম্যাসেজও পাঠাননি কাউকে।
নবীন মাস্টার সেই সেটটা বার করে ফোন লাগালেন মহাশ্বেতা দেবীকে। শিবু, কানাই, রতনদের কাছে যা যা শুনেছিলেন, খুব সংক্ষেপে সবই বললেন তিনি। বললেন, কী ভাবে ওঁদের জমি জোর করে কেড়ে নিয়ে এই সরকার তুলে দিতে চাইছে টাটাদের হাতে। এখানকার লোকেরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে কী ভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। বললেন, ঊনত্রিশে মে শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন যখন তাঁর দলবল নিয়ে আঁধারগ্রামে সভা করতে এসেছিলেন, তখন সভাস্থলের খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে হাজারখানেক স্থানীয় কৃষক তাঁকে কালো পতাকা দেখিয়েছিলেন। কেউ কেউ কাছে গিয়েও প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ আর ক্যাডার-বাহিনীর ঘেরাটোপ টপকে ওঁরা তাঁর কাছেই ঘেঁষতে পারেননি। তাই দূর থেকেই বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন তাঁরা।
সেটা নিয়ে পর দিন খুব ঝামেলা হয়েছিল। ওই সব ক্যাডাররা তাঁদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুব শাসিয়েছিল। খুব ঠান্ডা মাথায় বলেছিল, জলে থেকে কেন কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করতে যাচ্ছেন? বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন, তারা এ দিকে ও দিকে যায়, কখন কী হয় কিছু বলা যায়! ওদের কথা তো একটু ভাববেন, না কি! কে আপনাকে কী বোঝাল, আর অমনি দলে পড়ে আপনি ওদের পিছু পিছু ছুটলেন। নিজের ভাল নিজে বুঝবেন না?
এ সব কথায় যেখানে কাজ হচ্ছিল না, সেখানে সরাসরি কড়া ভাষায় তারা বলেছে, আর কোনও দিন যদি ওদের সঙ্গে তোকে দেখি, খুব খারাপ হয়ে যাবে। কী হবে এখন বলব না, কী বলতে চাইছি, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস? সাবধানে থাকবি।
কাউকে কাউকে তো ভয়ও দেখিয়েছে। বলেছে, এখনও বলছি, সন্তান শোক না-পেতে চাইলে সরে আয়। যে ভাবে আছিস, সে ভাবে থাক। না হলে পরে আফসোস করতে হবে। কেঁদেও কুল পাবি না।
তবে একাত্তর-বাহাত্তর সালের নকশাল আমলের মতো কারও বউকেই ওরা সাদা থান দিয়ে বলেনি, এটা দিয়ে গেলাম। কাল থেকে তো লাগবে। সেই বউ হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করলেও, সে দিকে কর্ণপাত না করে, রাতবিরেতে ফেরার সময় তার স্বামীকে একা পেয়ে গলার নলি কেটে দেয়নি কিংবা শ্বাসরোধ করে মেরে কোনও গাছের ডালে ঝুলিয়েও দেয়নি। অথবা তুলে নিয়ে গিয়ে গুম করে দেয়নি চিরকালের জন্য।
তবু, যাঁদের বলেছে, তাঁরা তাদের মুখের উপরে কিছু বলতে পারেননি। শুধু ভিতরে ভিতরে ফুঁসে উঠেছিলেন রাগে-ক্ষোভে-যন্ত্রণায়। ঠিক করেছিলেন, বি ডি ও অফিসে গিয়ে একসঙ্গে সবাই মিলে ডেপুটেশন দেবেন। তাই যত লোক নিরুপম সেনকে কালো পতাকা দেখাতে জড়ো হয়েছিলেন, তার থেকেও অনেক অনেক বেশি সংখ্যক কৃষক চাষের যন্ত্রপাতি, হেঁসো, লাঙল, হাল টানার বলদটলদ নিয়ে এক জায়গায় জড়ো হয়েছিলেন। সেখান থেকে রীতিমত মিছিল করে তাঁরা হাজির হয়েছিলেন বি ডি ও অফিসের সামনে। ডেপুটেশন দেওয়ার জন্য। সেই মিছিলে অর্ধেকেরও বেশি ছিলেন মহিলা। তাঁদের মুখে ছিল প্রতিবাদের স্লোগান। হাতে ছিল ঝাঁটা, মুড়োঝাঁটা।

আরও পড়ুন: কৃষ্ণামিনী দাসী 

বি ডি ও সাহেব তখন অফিসেই ছিলেন। কিন্তু তাঁদের কথা শোনা কিংবা তাঁদের ডেপুটেশন নেওয়া তো দূরের কথা, তাঁদের সামনে তিনি একটি বারের জন্যও যাননি। এমনকী তাঁদের সন্তুষ্ট করার জন্য তাঁর অধস্তন কর্মীদের মাধ্যমেও তাঁদের সামান্য কোনও আশ্বাসবাণীও শোনাননি। উপরন্তু তাঁদের হটিয়ে দেওয়ার জন্য ফোন করেছিলেন স্থানীয় থানায়। দশ-পনেরো মিনিটও হয়নি ঝড়ের বেগে ছুটে এসেছিল বিশাল এক পুলিশ-বাহিনী।
তাদের তৎপরতা দেখে বোঝা গিয়েছিল, বিশ্বস্ত সূত্রে আগাম খবর পেয়ে তারা একদম তৈরি হয়েই ছিল। তাই ফোন পাওয়ামাত্র মুহূর্তের মধ্যে এসে পড়েছে। এসেই, ওই সব গ্রামবাসীদের প্রথমে ভাল মুখে চলে যেতে বলে। কিন্তু তাতে তেমন কোনও কাজ না হওয়ায় তারা লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে যায়। এ রকম যে হতে পারে, ওই কৃষকেরা তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি। তাই সে ভাবে তাঁরা প্রস্তুতও ছিলেন না। বা এ রকম কিছু হলে, তার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা যে কী পদক্ষেপ নেবেন, তার আগাম কোনও কর্মসূচিও তাঁদের ছিল না। ফলে আচমকা পুলিশি হানায় তাঁরা দিশেহারা হয়ে যান। ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন।
এই ঘটনার পর অসহায় গ্রামবাসীরা খুব ভেঙে পড়েন। তাঁরা বুঝতে পারেন, এই ভাবে ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার হয়ে তাঁরা কিছুই করতে পারবেন না। শুধু পড়ে পড়ে মার খেতে হবে। যথাযথ প্রতিবাদ করতে গেলে এই ভাবে এগোলে হবে না। সংগঠিত ভাবে এগোতে হবে। আর তার জন্য প্রথমেই দরকার– একটা দল।
তাই ওই ঘটনার ঠিক সপ্তাহখানেক পরে তাঁরা সবাই মিলে জড়ো হয়েছিলেন একটা জায়গায়। সেই জমায়েতেই প্রশ্ন উঠেছিল, দল তো দরকার। কিন্তু কোন দল?
প্রশ্নটা যে কে করেছিলেন, ভিড়ের মধ্যে কেউই তাঁকে শনাক্ত করতে পারেননি। তবে তার উত্তর দিয়েছিলেন একজন– বেচারাম। তিনিই বলেছিলেন, আমাদের সমস্যা আমরা যতটা বুঝব, বাইরে থেকে এসে কেউ সেটা বুঝতে পারবে না। তাই আমাদের সমস্যা নিয়ে আমাদেরই ভাবতে হবে। আমাদেরই তার মোকাবিলা করতে হবে। আর তার জন্য আমাদের নিজেদেরই সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে। আমরাই একটা নতুন দল গড়ব।
তখন কে যেন বলেছিলেন, দল নয়। দল মানেই রাজনীতি। আর এর মধ্যে একবার রাজনীতি ঢুকলেই… আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তিনি, কিন্তু তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বেচারাম বলেছিলেন, সবাই রাজনীতি করে। রাজনীতি ছাড়া কোনও লোক পাবেন না। আর লোক ছাড়া তো আন্দোলন হয় না। দলও হয় না। আমরা যে দলটা তৈরি করব, সেখানে যে-কোনও রাজনীতির লোকই আসতে পারেন, তাতে আমাদের কোনও অসুবিধে নেই। তবে আমাদের এই জমি আন্দোলনের শরিক হতে গেলে, তাঁকে তাঁর সেই রাজনীতিটাকে গা থেকে আগে ঝেড়ে ফেলে আসতে হবে।
তখন ও দিক থেকে আর একজন বলেছিলেন, এটা তো এখানকার সমস্যা। স্থানীয় কোনও সমস্যা সমাধানের জন্য কি কোনও দল তৈরি করা যায়? তখন বেচারাম বলেছিলেন, দল মানে কি আর রাজনৈতিক দল? দল মানে দল। একটা কমিটি।
অনেক চাপানউতোরের পর সে দিনই সর্বসম্মতিক্রমে একটি কমিটি গঠন করা হল। আর তার নাম দেওয়া হল– আঁধারগ্রাম কৃষিজমি বাঁচাও কমিটি। তার যুগ্ম আহ্বায়কদের একজন হলেন তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী বেচারাম মান্না। আর দ্বিতীয় জন এস ইউ সি-র স্থানীয় সংগঠক শংকর জানা। ওই কমিটিতে যোগ দেন গ্রামের আরও অনেকের মতো কার্তিক, শিবু, রতনও।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!