ধারাবাহিক উপন্যাস উত্তাল ১৫

ও দিক থেকে মহাশ্বেতা দেবী প্রশ্ন করলেন, তুমি এ সব জানলে কী করে?
নবীন মাস্টার বললেন, আপনাকে বলেছিলাম না… আমাদের বাড়িতে একটা ছেলে থাকে। আঁধারগ্রাম থেকে এসেছে। সেই তেরো নম্বরই তো আমাকে সব বলেছে।
– তেরো নম্বর! সেটা আবার কী?
– ওটাই তো ওর নাম।
– এ রকম আবার কারও নাম হয় নাকি?
– না, নাম নয়, আসলে এখানকার লোকেরা ওকে ওই নামেই ডাকেন।
– কেন?
– আসলে এই জমি অধিগ্রহণ শুরু হওয়ার পর যাঁরা জমি দিতে অনিচ্ছুক, তাঁরা তো এককাট্টা হচ্ছিলেন, তাঁদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য শুধু পুলিশ নয়, সি পি এম তাদের ক্যাডার-বাহিনীকেও ময়দানে নামিয়েছিল। যাঁরা জমি দিতে চাইছিলেন না বা ঘোঁট পাকাচ্ছিলেন, ওরা সেই সব পথের কাঁটাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চাইছিল। তাঁদের নামের তালিকা পর পর লিখে একটা হিস্ট লিস্টও তৈরি করেছিল। কে বা কারা নাকি বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছিল, ওই লিস্টে ওর নাম আছে। আর সেটা তেরো নম্বরে। তাই তার পর থেকেই ওর নাম হয়ে গেছে তেরো নম্বর।
– জমি দিতে রাজি নয় বলে মেরে ফেলবে? মানে? আমরা কি জঙ্গলের রাজত্বে বাস করছি নাকি?
– তাই তো করছি। এর মধ্যে বেশ কয়েক জনকে ওরা অলরেডি মেরেও ফেলেছে।
– মেরে ফেলেছে? মহাশ্বেতা দেবীর গলায় আতঙ্ক ফুটে উঠল।
– এই তো ক’দিন আগে ওদের সংগঠনেরই একজন সক্রিয় কর্মী, কী নাম যেন! হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বীজেশ। সে হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিল। অনেক খোঁজখবর করেও তার কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। তার পর তার দেহ পচা-গলা অবস্থায় উদ্ধার হল গ্রামের একদম শেষ সীমানা থেকে। দেহ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। কেউ বা কারা তাকে খুন করে ফেলে রেখে গেছে। অথচ এখনও পর্যন্ত পুলিশ খুনের কোনও মামলাই রুজু করেনি।
– সে কী! কী বলছ! আঁতকে উঠলেন মহাশ্বেতা দেবী। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখন কোথায়?
নবীন মাস্টার বললেন, আমি এখন ওদের গ্রামে।
– ওদের গ্রাম মানে… কোথায়?
– আঁধারগ্রামে।
– ওখানে কী করছ?
– ওদের দুর্দশার কথা শুনে ছুটে এসেছি।
– খুব ভাল করেছ। তুমি আরও ভাল ভাবে খোঁজখবর নাও। পুরো ব্যাপারটার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখো। আর সে রকম কোনও খবর পেলেই আমাকে জানিও। আমি দেখছি, কী করতে পারি।
– আপনি এখানে একবার আসতে পারলে খুব ভাল হত। ওরা মনে জোর পেত।
– আমার শরীরের যা অবস্থা… তাও দেখছি। আমি হয়তো এক্ষুনি ওদের ওখানে যেতে পারছি না। তবে ওদের বলে দিও, আমি ওদের পাশে আছি। ওদের সঙ্গে আছি। আমি দেখছি, কী করতে পারি।
মহাশ্বেতা দেবীর কথা শুনে নবীন মাস্টারের ভিতরে কী যেন একটা হল। মনে হল, তাঁর শরীরের মধ্যে বুঝি কোনও এক ঐশ্বরিক শক্তি ভর করেছে। মনে হল, যে মাটির ওপরে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, সেটা কোনও এক মন্ত্রবলে হঠাৎ করেই কেমন যেন শক্ত হয়ে উঠেছে। চনমনে হয়ে গেছে মন।
তাই মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে সামনে বসা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে, উনি উপরের দিকে শক্ত-মুষ্টি ছুড়ে দিলেন। বললেন, আমরা আর একা নই।
Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!