।।পর্ব – ষোল।।
শুধু বড়রাই নয়, বাবা-মায়েদের মুখের দিকে আর তাকানো যাচ্ছে না দেখে আঁধারগ্রাম কৃষিজমি বাঁচাও কমিটিতে এসে একে একে নিজেদের নাম লেখাতে শুরু করল গ্রামের তরুণ-তরুণীরাও। এইট-নাইনে পড়া ছেলেমেয়েরাও বাদ গেল না। প্রাইমারি স্কুলে পড়া ক’টা ছেলেও নাকি তাদের নাম লেখানোর জন্য কাকে ধরাধরি করেছিল। শেষ পর্যন্ত তাদের নাম না লেখানোয় তাদের সে কী অভিমান। ওদের মধ্যে থেকে দু’-একজন আবার নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। গুমরে গুমরে কাটাচ্ছিল। অবশেষে তেরো নম্বর ও তার দলবলের লোকেরা ওদের যখন জানাল, অত ভেঙে পড়ার কিছু নেই, তাদের কথাও ভেবে দেখা হচ্ছে, তখন তারা আশ্বস্ত হয়। সেটা অবশ্য অন্য কথা।
ও দিকে জমির উপরে থাবা বসানো লোকগুলোর দৌরাত্ম্য দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তাদের চালচলন, হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, দেশে কোনও আইন-শৃঙ্খলা নেই। ওরা যেন ওদের মতো করে এই জায়গাটায় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটা সমান্তরাল শাসন চালাচ্ছে। যা ইচ্ছে তাই করছে। তাদের পোষা গুন্ডা-বাহিনী দিয়ে গোটা এলাকা ঘিরে রেখেছে। বাইরের কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। গ্রামের কেউ যে বাইরে গিয়ে কাউকে কিছু জানাবে, তারও উপায় নেই। কাউকেই বাইরে বেরোতে দিচ্ছে না। বাইরে থেকে মাসলম্যান এনে, জেল থেকে দাগি আসামিদের ছাড়িয়ে এনে, ওরা লেলিয়ে দিয়েছে গ্রামবাসীদের পিছনে।
তারা ভয় দেখিয়ে, অত্যাচার চালিয়ে, গ্রামের লোকজনদের কোণঠাসা করে ফেলেছে। পুরো তল্লাটটাকে পৃথিবী থেকে যেন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। তবু, ওরা আঁধারগ্রামটাকে যতই বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, মহাশ্বেতা দেবী মারফত ওই গ্রামের কথা, গ্রামের লোকজনদের অসহায়তার কথা, অত্যাচারের কথা কিন্তু মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে লাগল কবি, লেখক, শিল্পী, নাট্যকর্মীদের কাছে। খবর পৌঁছে গেল বিভিন্ন খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলোর দফতরেও। জানতে বাকি রইলেন না বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদেরাও।
আরও পড়ুন: মধ্যযুগের বাংলা কাব্য: মধ্যযুগের কবিদের চোখে ১
নড়েচড়ে বসলেন তাঁরাও। কলকাতার সিটি কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপিকা, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চের সদস্যা, নারী আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী, বিশেষ করে নারীমুক্তি বিষয়ক নানা নিবন্ধের বিশিষ্ট লেখিকা বোলান গঙ্গোপাধ্যায় আঁধারগ্রামের খবর শুনে আর ঠিক থাকতে পারলেন না।
ঠিক কী ঘটছে ওখানে? কী ভাবে গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে, তা স্বচক্ষে দেখার জন্য, ওখানকার লোকদের সমস্ত অভিযোগ অসহায়তার কথা নিজেদের কানে শোনার জন্য অনেকেই দু’-চার জন মিলে, কেউ কেউ দলবদ্ধ ভাবে, আবার কেউ কেউ একদম ব্যক্তিগত উদ্যোগে একাই সোজা চলে যেতে লাগলেন ওই অঞ্চলে। ওখানকার লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
ওই লোকগুলোর মতোই শুধু সত্যটুকু জানার জন্য একদিন সক্কালবেলায় কাউকে কিছু না জানিয়েই গাড়ি নিয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে বোলান দেবী সোজা পৌঁছে গেলেন মস্ত বড় এক ঝকঝকে আকাশের নীচে। জানালা দিয়ে বাঁ দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল আদিগন্ত সীমানা জুড়ে শুধু সবুজ আর সবুজ।
চোখ জুড়িয়ে গেল তাঁর। বর্ষার জল পেয়ে সদ্য রোয়া আমনের চারাগুলো তখন তাঁকে দেখে যেন খিলখিল করে হাসছে। একটা চারা যেন আর একটা চারার গায়ে খুশিতে ডগমগ হয়ে ঢলে ঢলে পড়ছে।
এ দৃশ্য দেখে কোনও মানুষই ঠিক থাকতে পারেন না। আর ইট-কাঠ-লোহা-কংক্রিটের মধ্যে যাঁরা থাকেন, সেই কারাগার থেকে বেরোলে সবাই চান বুক ভরে একটু শ্বাস নিতে। সেটা নেওয়ার জন্যই বুঝি উনি গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। এ দিকে ও দিকে তাকালেন। দেখলেন, যত দূর চোখ যায় শুধু সবুজ ধানের খেত। সেই খেতের লকলকে শিসগুলো যেন আনন্দে নাচছে। দু’হাত তুলে যেন আকাশকে ছুঁতে চাইছে।
উনি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দু’চোখ ভরে সেটাই দেখছিলেন। হঠাৎ মাঠি ফুঁড়ে হাতে-পায়ে কাদা মাখা, মাথায় গামছা বাঁধা, হেঁটো কাপড় পরা এক বৃদ্ধ তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন। বোলান দেবীর পোশাকআশাক আর চেহারা দেখেই লোকটা বুঝি বুঝতে পেরেছিলেন, উনি এখানকার লোক নন। হয়তো কাউকে খুঁজতে এসেছেন। এটা আন্দাজ করেই উনি বললেন, আপনি কি কাউরে খুঁজতাছেন নাকি?
বোলান বললেন, না। সে রকম নির্দিষ্ট কাউকে খুঁজছি না। আসলে একটা গ্রামে যেতে চাই। এখানে গাড়ি কারখানার জন্য যে জমিটা বাছা হয়েছে, সেটা ঠিক কোন দিকে একটু বলতে পারবেন?
লোকটার চোখে-মুখে ঘোর সন্দেহ। উনি উত্তর তো দিলেনই না। উলটে ভুরু-টুরু কুঁচকে, চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন করলেন, কেন্ কন তো?
বোলান বললেন, না, এমনিই জানতে চাইছি।
– এমনি! অবাক হলেন বৃদ্ধ। বললেন, এমনি এমনি তো এখানে কেউ আসেন না! আপনার কী উদ্দেশ্য খোলসা কইরা কন তো।
বোলান বললেন, আসলে একটা খবর পেলাম…
– কী খবর?
– গাড়ি কারখানার জন্য যাঁদের জমি চিহ্নিত করা হয়েছে, তাঁদের অনেকেই নাকি জমি দিতে রাজি হচ্ছেন না…
– অ। বুঝতে পারসি। তাই কন। আপনে তাদের রাজি করাইতে আইসেন। কী, তাই তো?
বোলান বললেন, না না, একদম তা নয়। শুনলাম, যাঁরা জমি দিতে রাজি হচ্ছেন না, তাঁরা নাকি খুব খারাপ অবস্থায় আছেন। জমি দেওয়ার জন্য তাঁদের ওপরে কিছু কিছু লোক নাকি রীতিমত জুলুম করছে। অত্যাচার করছে। তাই আমি তাঁদের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
– কী কথা কইবেন?
– কিছু বলব না। শুনব।
– কী শুনতে চান?
– এখানে যা ঘটছে, সেটা।
– আপনে কি টাটা গো লোক, না পুলিশের লোক?
প্রশ্ন শুনে বোলান বুঝতে পারলেন, মার খেতে খেতে এঁরা এখন এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছেন যে, কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারছেন না। বুঝতে পারছেন না, কে তাঁদের পাশে দাঁড়াতে চায় আর কে তাঁদের উৎখাত করতে চায়। তাই তাঁর সংশয় কাটাতে তিনি বললেন, আমি ওই দু’দলের কারওরই লোক নই।
– তাইলে?
– আমি এই দেশের একজন নাগরিক। আমি মনে করি, অন্য কোনও নাগরিক বিপদে পড়লে বা অত্যাচারিত হলে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ানো আমার কর্তব্য। তাই তাঁদের পাশে দাঁড়াতে এসেছি।
বৃদ্ধ কী বুঝলেন কে জানে, গলার স্বর নামিয়ে বললেন, আপনে কোতথিকা আইতাছেন?
বোলান বললেন, কলকাতা থেকে।
– কোলকাতা থিকা? কী জানতে চান কন?
– বলছি, গাড়ি কারখানা করার জন্য যে জমিটা বাছা হয়েছে, সেই জমিটা ঠিক কোন দিকে একটু বলতে পারবেন?
বৃদ্ধ বললেন, কেন বলতে পারুম না? বলেই, পিচরাস্তার ও পারের সবুজ ধানখেতের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, এই যে দেখতাছেন, এই গোটাটাই। এর পরেও ওই দিকে আরও অনেক জমি আছে। পুরা জমিটাই তিন হাজার বিঘার মধ্যে পড়সে। এটাই পজেকটের জমি।
তিন হাজার বিঘে জমি! তিন… হাজার… বিঘে! বোলান জানেন, কুড়ি কাঠা মানে এক বিঘে। এক-দেড়শো বিঘে নয়, এখানে একসঙ্গে তিন হাজার বিঘে! সে তো বিশাল জমি! তার মানে উনি যতটা দেখতে পারছেন, তার বাইরেও আছে আরও আরও আরও অনেক জমি! এটা সেই জমি, টাটা কোম্পানি যেটা পছন্দ করেছে এক লাখ টাকা দামের গাড়ি তৈরির কারখানা বানাবে বলে! থমকে দাঁড়ালেন বোলান দেবী। তিনি জানেন, ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যায় এক-একটা জায়গা হঠাৎ হঠাৎই ‘বিশেষ’ হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস উত্তাল ১৫
ষাটের দশকের মাঝামাঝিতেও পশ্চিমবঙ্গের আর পাঁচটি গ্রামের মতোই অত্যন্ত সাদামাঠা ছিল উত্তরবঙ্গের তিন তিনটি গ্রাম– নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি আর ফাঁসিদেওয়া। কিন্তু ১৯৬৭ সালে কৃষক-আন্দোলনের জেরে মাত্র ক’দিনের মধ্যেই গোটা পৃথিবীর নজর কেড়ে নিয়েছিল ওই তিনটি গ্রাম। রাতারাতি সারা বিশ্বের কাছে নকশালবাড়ি হয়ে উঠেছিল একটি জলন্ত আন্দোলনের নাম। আজও বিভিন্ন লোকেরা সমীহের সঙ্গে ওই নামটি উচ্চারণ করেন।
জমি পছন্দ করার পর টাটা কোম্পানি ও তার সাগরেদ এই রাজ্য সরকার নানা ফন্দিফিকির করে, বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে, টোপ দিয়েও কাজ না হলে জোর জবরদস্তি করে জমি কেড়ে নেওয়ার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আঁধারগ্রামের অধিবাসীরা এককাট্টা হয়ে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, সেটা একদিন ওই নকশালবাড়ির মতোই সমাজের বিশিষ্ট লোকজনদের কাছে সমীহের কারণ হয়ে উঠবে।
ইতিমধ্যেই খোঁজখবর নিতে শুরু করেছেন কবি তরুণ সান্যাল, শিল্পী শুভাপ্রসন্ন, গায়ক কবির সুমন, নাট্যকার ব্রাত্য বসু, শিক্ষাবিদ সুনন্দ সান্যাল, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির সুজাত ভদ্ররা। বোলানও খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, এই কারখানা হলে হুগলি জেলার আঁধারগ্রাম ব্লকের খাসেরভেড়ি, সিংহেরভেড়ি, গোপালনগর, বাজেমেলিয়া আর বেড়াবেড়ি গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার, আর জন হিসেবে গুনলে প্রায় পনেরো হাজার মানুষ একদম পথে বসে যাবেন। ফলে এই পনেরো হাজার মানুষ বুক দিয়ে তাঁদের পূর্বপুরুষের এই জমি আগলাবার চেষ্টা করছেন। প্রাণ থাকতে এ জমি তাঁরা কিছুতেই দেবেন না। তাঁরা প্রতিবাদ করবেন। প্রতিরোধ গড়বেন। ধরনায় বসবেন। দরকার হলে লড়াই করবেন। আর সেই লড়াই করতে যাওয়ার আগে একটু তলিয়ে দেখতেই তাঁরা টের পেয়েছেন, এই জমি কেড়ে নেওয়ার পিছনে শুধু টাটারাই নন, পুরোদস্তুর শক্তি নিয়ে সরাসরি মাঠে নেমেছে এই রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার। তলে তলে তাদের সঙ্গে টাটা গোষ্ঠীর কী হিসেব-নিকেশ হয়েছে, কী রফা হয়েছে, ওঁরা জানেন না। তবে ওঁরা বুঝতে পারছেন, তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও একটা সমঝোতা বা আঁতাত হয়েছে। তাই তাঁরা মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন নানা কথা।
এই বৃদ্ধও তারই পুনরাবৃত্তি করলেন। আমরা জমি দিমু না। জোর কইরা নিলে, কী নেবে সরকার? প্রাণের বেশি তো আর কিছু নেবার নাই। আমরা প্রাণ দিমু, তবু জমি দিমু না। কত রক্ত চায় ওরা? কত? আমরা দিমু।
লোকটার কথা শুনে চমকে উঠলেন বোলান। ওরা সত্যিই রক্ত চায়! আজ থেকে বহু বছর আগে বক্রেশ্বর গড়বে বলে জনগণের কাছে ওরা আবেদন করেছিল, আমাদের ক্ষমতা নেই। কেন্দ্রও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আমরা আর অন্ধকারে থাকতে চাই না। আলো চাই, আলো। আপনারা আমাদের রক্ত দিন। আমরা সেই রক্ত বিক্রি করে বক্রেশ্বর গড়ব।
সে-ই বক্রেশ্বর, বাবার মুখে স্বামীর নিন্দে সহ্য করতে না পেরে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন সতী। সেই খবর শুনে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে মহাদেব যখন প্রলয় নাচন নাচছেন, পৃথিবী টলোমলো। যে কোনও সময় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তখন শিবের সেই উন্মাদ নৃত্য থামাবার জন্য সমস্ত দেবতারা এক জায়গায় জড়ো হলেন। নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, যে করেই হোক, শিবের কাঁধ থেকে সতীর দেহটাকে সরাতেই হবে। না হলে ও শান্ত হবে না।
কিন্তু ওই ভয়ংকর শিবের কাছ থেকে সতীর দেহ সরাবে কে! শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এলেন স্বয়ং বিষ্ণু। তিনি তাঁর সুদর্শনচক্র ছেড়ে শিবের পিঠের দিক থেকে ঝুলে থাকা সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে কাটতে লাগলেন। তার কোনও অংশ পড়ল কামরূপ-কামাখ্যায়, কোনও অংশ পড়ল তারাপীঠে, তো কোনও অংশ কালীঘাটে। তখন সতীর মন পড়েছিল বক্রেশ্বরে।
সেই বক্রেশ্বরেই ওরা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়তে চেয়েছিল। ওদের কথায় তখন জাদু ছিল। লোকেরা ওদের বিশ্বাস করত। ভসরা করত। তাই ছেলে-বুড়ো-যুবক-যুবতীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তখন রক্তদান শিবিরের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। রক্তদানের ন্যূনতম বিধিনিষেধও মানা হত না। আঠারো বছরের নীচে কিংবা পঞ্চান্ন বছরের উপরের বয়সিরা তো বটেই, সুগার রোগীরাও রক্ত দেওয়ার জন্য ছুটে যেতেন। ছুটিছাটার দিন হলে তো কথাই নেই, মোড়ে মোড়ে, অলিতে গলিতে, ক্লাবে ক্লাবে রক্তদানের লাইন পড়ে যেত। কাজের দিনগুলোও বাদ যেত না। এত রক্ত সে সময় জমা পড়েছিল যে, এখন ভাবতে গেলে শিউরে উঠতে হয়। তবে সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ যতই আবেগে পড়ে এগিয়ে আসুক না কেন, কত লোকের রক্ত যে সত্যি সত্যিই কাজে লেগেছিল, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ, রক্ত কখনও একুশ দিনের বেশি মজুত করে রাখা যায় না। একুশ দিন পেরিয়ে গেলেই সেই রক্ত ফেলে দিতে হয়। সে সময় পিজি হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের পিছনের ডাস্টবিনে যে শত শত সিল করা রক্তের পাউচ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল, সংবাদের শিরোনাম হয়ে উঠেছিল যেটা, সেটা কিন্তু কারও ভুলবশত কিংবা গাফিলতিতে অথবা কারও নজরদারির অভাবে ওখানে ফেলা হয়নি, রক্তের পাউচগুলোর এক্সপায়ারি ডেট অনেক আগেই পেরিয়ে গিয়েছিল। ওই রক্ত কাউকে দিলে সেই রক্ত কোনও মুমুর্ষু রোগীর জীবন তো ফিরিয়ে দিতই না, উলটে কেড়ে নিত। তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওগুলো ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছিল।
তো, তখন না হয় একটা উদ্দেশ্য সামনে দাঁড় করানো ছিল। বক্রেশ্বর গড়তে হবে। কিন্তু এখন? এখন এই গরিব-গুর্বো মানুষদের রক্ত নিয়ে এরা কী করবে। এরা কি নিজেদের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ভাবছে নাকি! আরে বাবা, তিনি যে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’, সেটার মানে তো অন্য। এরা সেটুকুও জানে না!
কথায় কথায় বৃদ্ধ লোকটার সঙ্গে বোলান দেবীর বেশ জমে উঠেছিল। বোলান দেবী তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম কী?
বৃদ্ধ বললেন, আমার নাম আদিত্য পাঁজা।
– কোথায় থাকেন?
উনি ফের আঙুল তুলে শস্য-শ্যামল মাঠের একদম শেষ সীমানা দেখিয়ে বললেন, ওই যে জমি দেখতাছেন, ওই জমির শেষে…
– ওখানে! এখান থেকে তো কোনও রাস্তা নেই দেখছি। কী ভাবে যান?
– কেন? আলপথ ধইরা।
– সে তো বহু দূর। অতটা পথ হেঁটে যান!
– খেতের মধ্যে দিয়া হাঁইটা যামু না তো কি এরোপ্লেনে কইরা যামু? ও আমাগো অভ্যাস হইয়া গেছে।
– এখানে আপনার কতটা জমি আছে?
– দুই বিঘার একটু বেশি।
– আপনি কি গাড়ি কারখানার জন্য ওদেরকে জমি দিচ্ছেন নাকি?
মুহূর্তের মধ্যে বৃদ্ধর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। তিনি বললেন, না। আমি কিছুতেই জমি দিমু না। মরলে না হয় আমি মরুম। কোনও ক্ষতি নাই। আমি তো অনেক দিন বাঁইচা আছি। পৃথিবীটারে দেখছি। সুখ-ভোগ করসি। পুলিশ আইলে আমরা বুড়োরাই আগাইয়া যামু। তবু ছেলেপিলেরা বাঁইচা থাক। ওরা বাঁচলেই আমাগো বাঁচা হইব। জমি গেলে যে সব্বাই একসঙ্গে মরুম। আমরা কিছুতেই জমি ছাড়ুম না।
বোলান বুঝতে পারলেন, তিনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। এঁরা জমি বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। আন্দোলন করছেন। আর এই আন্দোলনটাকে নিছক একটা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নোংরা কৌশল বলে সরকারের প্রধান শরিক দল যে প্রচার চালাচ্ছেন, পুরো ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, লোকজনের চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য নানা রকম ভেলকি দেখাচ্ছেন, সেটাও কিন্তু আসলে রাজনীতিরই একটা কৌশল। বৃদ্ধর কাছ থেকে বোলান শুনলেন, সরকারি গুন্ডাদের দৌরাত্ম্য অগ্রাহ্য করে কী ভাবে এই অঞ্চলের বিপন্ন ভূমিজীবীরা হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে আন্দোলনে সামিল হচ্ছেন। কী ভাবে একসঙ্গে জোট বেঁধে প্রতিবাদ করছেন।
আরও পড়ুন: যা যা সে কোন দেশে
বৃদ্ধ আরও বললেন, কেবল ছেলেরাই না, প্রতিবাদে গলা মিলাইতে দলে দলে মাইয়ারাও বাইরাইয়া আইতাছে। ঘরের কাজকর্ম সাইরা বা না সাইরা তারা বাচ্চা কোলে নিয়া প্রত্যেকটা প্রতিবাদ সভায় যোগ দিতাছে। এত মাইয়া আইতাছে যে, গুইনা দেখলে হয়তো দেখা যাইব, ছেলেদের থিকা মাইয়াদের সংখ্যাই বেশি। বৃদ্ধ নিজে থেকেই বললেন, চলেন না, দেইখা আসবেন আমাদের গ্রাম।
বোলান জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের গ্রামের নাম কী?
বৃদ্ধ বললেন, আঁধারগ্রাম।
– আঁধারগ্রাম! এই নামটাই তো তিনি শুনেছিলেন মেধা পাটেকরের কাছে, তাই না! মনে মনে বিড়বিড় করছেন দেখে লোকটা বললেন, হ্যাঁ, আঁধারগ্রাম। চলেন না, ভিতর দিয়া হাঁইটা গেলে বেশিক্ষণ লাগব না।
কথা বলতে বলতে বোলান দেবী হঠাৎ দেখলেন, তাঁরা যেখানে দাঁড়িয়ে কথা এলছেন, তার থেকে বিশ-পঁচিশ হাত দূরে ঢালু জমির এ দিক ও দিক থেকে কতকগুলো মাথা যেন উঁকিঝুঁকি মারছে। সচকিত হলেন তিনি। আগেই শুনেছিলেন, গোটা গ্রামটাকে ঘিরে রাখার জন্য শুধু এ রাজ্যের দাগি আসামি বা দুষ্কৃতীদেরই নয়, ভিন রাজ্য থেকেও বিভিন্ন অপরাধীদের ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়েছে। ওটা মনে পড়তেই চমকে উঠলেন তিনি। তা হলে কি ওরাই ফলো করছে তাঁকে!
চলবে…