।।পর্ব – ২৪।।
ওঁরা জমি দিতে চাইছেন না কেন? এত বিক্ষোভ, এত সমাবেশই বা কীসের জন্য? ওঁদেরকে কি কেউ বা কারা ভুলভাল বোঝাচ্ছে? বোঝাচ্ছে, একবার জমি দিয়ে দিয়ে দিলে ক্ষতিপূরণের একটা কানাকড়িও পাবেন না? নাকি অন্য কিছু?
হতে পারে। না হলে ২০০৬-এর ২২ অগস্ট আঁধারগ্রামের বি ডি ও অফিসের পাশেই অস্থায়ী শিবির তৈরি করে সরকারি উদ্যোগে জমি অধিগ্রহণের যে শুনানি শুরু হয়, সারা দিন অবস্থান-বিক্ষোভ করে ওখানকার চাষিরা তা অমন ভাবে বানচাল করে দেন? বাধ্য হয়ে তার তিন দিনের মাথায়, ২৫ অগস্ট বি ডি ও অফিস-মারফত জমি মালিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের জমি অধিগ্রহণের নোটিশ ধরানোর আপ্রাণ চেষ্টা ওই ভাবে মাঠে মারা যায়? জমি দিতে ইচ্ছুক চাষিদের সম্মতিপত্রে সই করানোর জন্য অত ধুমধাম করে একটানা সাত দিন ধরে শিবির খুলে রাখলেও, একজনও আসেন না? কেউ আসতে চাইলেও অন্যরা তাঁদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন? দুঁদে অফিসারদের ওই ভাবে বসে বসে মাছি তাড়াতে হয়? গ্রামবাসীদের তরফ থেকে সে রকম কোনও সাড়া না পেয়ে আধিকারিকরা যখন ভাবছেন, জমি মালিকদের ধরে ধরে বোঝাবেন, জমি দিলে তাঁরা যে শুধু বাজার দরের চেয়ে অনেক বেশি দামই হাতে পাচ্ছেন, তাই-ই নয়, পরোক্ষে এই মাতৃভূমি, এই রাজ্যের আরও উন্নতির জন্য সাহায্যও করছেন, বহু বেকার ছেলেমেয়ের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন, দেশকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিচ্ছেন এবং এ ভাবে একজন মানুষ হিসেবে নিজের নম্বর আরও কিছুটা বাড়িয়ে নিচ্ছেন। এটাও কি কম বড় প্রাপ্তি?
তেমন লোক পেলে বুঝিয়ে ছাড়বেন, সামান্য স্বাধীনতার জন্য কত মানুষ কত কী ত্যাগ করেছেন। বাড়ির বউরা তাঁদের শেষ সম্বল, হাতে-কানে-গলার অলংকার খুলে দিয়েছেন স্বদেশিদের ঝোলায়। বুক পেতে গুলি নিয়ে কত তরতাজা যুবক-যুবতী প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। আর আপনি এইটুকু জমি ছাড়তে পারছেন না? দেশের বা রাজ্যের উন্নতির আন্দোলন কি স্বাধীনতার আন্দোলনের চেয়ে কোনও অংশে কম?
প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্তারা যখন নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে এই রকম নতুন নতুন সব পরিকল্পনা করছেন, তখন যদি গ্রামবাসীদের কেউ না-ই উসকাবেন, অমন ভাবে কেন উন্মত্ত হয়ে উঠবেন চাষিরা? ২৮ ও ২৯ অগস্ট বি ডি ও অফিসের সামনে কেন তাঁরা শুরু করে দেবেন রিলে প্রথায় আমরণ অবস্থান? থেকে থেকেই কেন ধারণ করবেন রুদ্রমূর্তি? হয়ে উঠবেন মারমুখী?
আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ২৩
সেই বিক্ষোভের মুখে পড়ে যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত সরকারি ওই সব লোকদের রাতের অন্ধকারে তল্পিতল্পা গুটিয়ে কেন পিছনের রাস্তা দিয়ে কোনও রকমে হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে চুপিচুপি পালিয়ে আসতে হবে?
পাছে কোনও গন্ডগোল হয়, তাই আগাম সতর্কতাস্বরূপ বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে জেলা আধিকারিকেরা সেপ্টেম্বরের ১ আর ২ তারিখে জমি অধিগ্রহণ শুনানির চূড়ান্ত নোটিশ বিলি করতে গিয়েছিলেন বেড়াবেড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতে। সেখানে প্রবল বিক্ষোভের সামনে পড়েন তাঁরা।
কৃষিজীবী পরিবারের পুরুষেরা নন, সেই বিক্ষোভের প্রথম সারিতে ছিলেন মহিলারা। তাঁরা ওঁদের কোনও কথাই শুনতে চাননি। শুনলে তো বোঝাবেন। সেই বিক্ষোভ এতটাই উত্তপ্ত ছিল যে, ওই আধিকারিকেরা শেষমেশ পিছু হটতে বাধ্য হন। নোটিশ বিলি করতে পারেন না। সরকারি আমলারা মাথায় হাত দিয়ে বসেন। এ বার তা হলে কী করা যায়!
কী করা যায়! কী করা যায়! কী করা যায়! আবার ফোন বেজে উঠল নিরুপম সেনের। মুখ তেতো হয়ে গেল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। তেতে উঠলেন গৌতম দেব। শুধু মহাকরণের অলিন্দে বা এই কক্ষে সেই কক্ষে ফিসফাস কিংবা গভীর আলোচনা নয়, জরুরি তলব পেয়ে আবার সবাই ছুটে গেলেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে।
বামফ্রন্টের বড় বড় নেতারা কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই আঁধারগ্রামের সমর্থনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোরাম ফর পিপিলস ইনিশিয়েটিভ একটা আলোচনাসভার আয়োজন করে। তাতে অংশ নেন শুধু এ রাজ্যেরই নয়, ভারতের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানী, গবেষক, বুদ্ধিজীবী এবং ল্যান্ড কমিশনাররা পর্যন্ত।
আঁধারগ্রামের জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে নানান অসন্তোষ, ঝামেলা আর আতঙ্কের খবর যখন তেরো নম্বরের মাধ্যমে সুভাষগ্রামের নবীন মাস্টার আর নবীন মাস্টারের মাধ্যমে শুধু মহাশ্বেতা দেবী জেনেছিলেন, তারও অনেক আগেই সবার প্রথমে ওখানে পা রেখেছিলেন এক সময়ের তরুণ তুর্কি ‘তোমার প্রিয় আমার প্রিয়’ প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। তিনি চেয়েছিলেন, সরকারি এই সন্ত্রাস অবিলম্বে বন্ধ হোক। ওখানকার মানুষদের উনি কথা দিয়েছিলেন, আমি আপনাদের পাশে আছি। সরকারি থাবা থেকে আপনাদের জমি রক্ষা করার জন্য যা যা করণীয়, আমি সব করব।
উনি সুস্থ থাকলে হয়তো এত দূর জল গড়াত না। তার আগেই কিছু না কিছু একটা হত। কিন্তু ওঁর শরীর সায় দিচ্ছিল না। তবু মূলত তাঁরই উদ্যোগে কংগ্রেসের তরফ থেকে ১১ এবং ১২ সেপ্টেম্বর পর পর দু’দিন আঁধারগ্রামে বিশাল বড় জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেই জমায়েতেই সরকারের এই জমি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে জোরদার সওয়াল করেন কংগ্রেসের নেতারা। প্রবল বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় গ্রামবাসীরাও। ওই মঞ্চ থেকেই আওয়াজ তোলা হয়, কোনও কিছুর বিনিময়েই সূচ্যগ্র-জমি দেবেন না তাঁরা। যদি সরকারি গুন্ডারা তাঁদের জমি জোর করে ছিনিয়ে নিতে আসে, তা হলে তাঁদের লাশের উপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে ওই জমি দখল করতে হবে।
সে দিন কংগ্রেসের ডাকে ওখানকার চাষিদের অমন স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেওয়া দেখে নড়েচড়ে বসেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী। সি পি এমের রাঘব-বোয়ালেরা। তবু তড়িঘড়ি ডাকা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ওই জরুরি মিটিংয়ে বুদ্ধদেব বললেন, ওঁরা তিরিশ। আমরা দুশো পঁয়তিরিশ। মানুষ আমাদের নির্বাচন করে নিয়ে এসেছেন। মানুষ আমাদের চান। মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন। কিন্তু কিছু কিছু লোক, ওঁদের ভুলভাল বোঝাচ্ছেন। বিরোধিতা করতে হবে বলে, শুধু শুধু বিরোধিতা করছেন। বলার সময় বলছেন, আমরা নাকি এ রাজ্যে কোনও লগ্নি আনতে পারছি না। নতুন কোনও শিল্প গড়তে পারছি না। আর যখন এ রাজ্যে কেউ লগ্নি করতে আসছেন, সেটা আটকাবার জন্য ওঁরা একেবারে মরিয়া হয়ে উঠছেন। লোকেদের উলটোপালটা বোঝাচ্ছেন। এ সব বেশি দিন সহ্য করা যায় না। আমাদেরও পালটা চাল দিতে হবে। জমির যা দাম ধার্য হয়েছে, যাঁর যতটা জমি সেই মতো যত দ্রুত সম্ভব তার প্রাপ্য টাকা জমির মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি পারা যায়।
নিরুপম সেন বললেন, টাকাটা কী ভাবে দেবেন?
– কেন? নগদে।
– নগদে?
বুদ্ধদেব বললেন, হ্যাঁ, তাতে অসুবিধে কোথায়? বহু রাজ্য আছে, যারা জমি অধিগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নগদ টাকা তুলে দিয়েছে জমির মালিকদের। আমরাও দেব। এতে সমস্যা কম। চেকে দিলে ওঁরা আবার বোঝাতে পারে, চেক দিয়ে কাগজে সই করিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু ওই চেক কোনও দিনই ক্যাশ হবে না। আরও যে কী কী বলতে পারে তার কোনও ঠিক আছে! আমি কোনও রিস্ক নিতে চাই না। টাকাটা নগদেই দিন। নগদে টাকা দেওয়ার এই রেওয়াজ প্রথম শুরু করেছিল ওড়িশা সরকার।
গৌতম দেব বললেন, সে তো দেওয়াই যায়। কিন্তু ওটা হচ্ছে ওড়িশা আর এটা পশ্চিমবঙ্গ।
– তাতে কী হল?
– যেখানে একটা বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে গেলে ডোনেশনের নামে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ নেওয়া হয়, সমস্ত বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও, কোনও কিছু না পেলে, শুধু হেলমেটটা ঠিক নেই বলে ট্রাফিক পুলিশেরা কেস দেওয়ার ভয় দেখিয়ে, দু’চাকার চালকদের সঙ্গে পঞ্চাশ-একশো টাকায় রফা করেন, যেখানে পাঁচ লিটারের জায়গায় কেন সাড়ে চার লিটারেরও কম তেল দিয়েছেন জিজ্ঞেস করলে, কেরোসিন তেলের দোকানদার ভ্রু কুঁচকে তাকান, সেখানে, যিনি যে পোস্টেই কাজ করুন না কেন, যত বড় আমলাই হোন না কেন, তাঁদের হাতে অতগুলো নগদ টাকা ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?
বুদ্ধদেব বললেন, তার মানে? নিচুতলার কর্মীদের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমরা কি জেলা আধিকারিকদেরও বিশ্বাস করতে পারব না? বি ডি ও-দেরও বিশ্বাস করতে পারব না? তা হলে কাদের করব?
– নিচুতলার কর্মীদের নিয়ে কোনও ভয় নেই। যাঁদের হাতে কোনও ক্ষমতা নেই, তাঁরা আবার কী করবে? আমার ভয়, ওই সব বি ডি ও, জেলা আধিকারিক, ল্যান্ড কমিশনারদের নিয়ে। একটু খোঁজ নিয়ে দেখবেন, আজ পর্যন্ত যত ঘোটালা হয়েছে, তার পিছনে আছে সরকারি মদতপুষ্ট ওই সব উচ্চপদস্থ কর্মীরাই।
বুদ্ধদেবের চোখ-মুখ পালটে গেল, তা হলে কি কাউকেই বিশ্বাস করতে পারব না?
– আপনাকে বিশ্বাস করতে বারণ করছি না। কিন্তু যেখানে বিশ্বাস করে ঠকার সম্ভাবনা নাইনটি নাইন পয়েন্ট নাইন পার্সেন্ট, সেটাকে একটু এড়িয়ে গেলে হয় না?
– নগদ টাকা হলে কি জমির মালিকদের ওঁরা টাকা দেবেন না?
– নাও দিতে পারেন।
বুদ্ধদেব বললেন, না দিলে তো প্রমাণ থাকবে।
– কীসের প্রমাণ?
– সই। সই কোথায় পাবে? টাকা না দিলে কেউ সই করবে?
– সই? সে তো যে কেউই করতে পারে।
– যে কেউ?
গৌতম দেব বললেন, আপনি কি জানেন, গ্রামেগঞ্জে এমন অজস্র লোক আছে, যারা শুধু একবার আপনার সই দেখে নিয়ে এমন ভাবে হুবহু নকল করে দেবে যে, আপনি নিজেও বুঝতে পারবেন না, ওটা আপনার সই, না অন্য কারও।
– তাই?
– হ্যাঁ, ও রকম একজন কাউকে দিয়ে সই করিয়ে অন্তত দশ জনের টাকাও যদি কেউ আত্মসাৎ করে, আপনি কিছু করতে পারবেন?
– পারব। কারণ, একদিন না একদিন তা জানাজানি হবেই।
– যখন জানাজানি হবে, তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে। কয়লা কেলেঙ্কারির কথা মনে আছে? সুন্দরবনের রাক্ষসখালিতে বাঁধ কেলেঙ্কারির কথা ভুলে গেছেন? সরকারি ফ্ল্যাট কেলেঙ্কারির কথা একবার মনে করে দেখুন। সব ক’টার ক্ষেত্রেই অপরাধী শনাক্ত হয়েছিল। কিন্তু যখন হয়েছিল, তখন হয় বয়সজনিত কারণে অপরাধীরা ইহলোক ত্যাগ করেছেন, অথবা তত দিনে তাঁরা বিছানায় শয্যাশায়ী। আর এ ক্ষেত্রে… তা ছাড়া…
ভ্রু কুঁচকে গেল বুদ্ধদেবের, তা ছাড়া কী?
– জমির যা বাজার দর, তার থেকে বেশি টাকা তাঁদের দেওয়া হচ্ছে আর সেটা ওঁরাই তাঁদের পাইয়ে দিচ্ছেন, এই সব বলে, গ্রামবাসীদের কাছ থেকে ওঁরা কাটমানি চাইতে পারেন। তাঁদের প্রাপ্য টাকার একটা অংশ কেটেও রাখতে পারেন কেউ কেউ।
– পাইয়ে দিচ্ছেন মানে? ওঁরা পাইয়ে দেওয়ার কে? আমরাই তো ঠিক করেছি, চাষিদের এমন টাকা দেব, যাতে ভবিষ্যতে তাঁদের কোনও আর্থিক অসুবিধে না হয়। ছোটখাটো কোনও ব্যবসা না করতে পারলেও, যাতে ওই টাকা ব্যাঙ্কে রেখে তার সুদেই সারা জীবন তাঁরা খেয়ে-পরে বাঁচতে পারেন। ওঁরা তাঁদের টাকা পাইয়ে দেওয়ার কে?
– কেউ না হলেও মুখে বলতে কী আছে?
– গ্রামের লোকেরা বিশ্বাস করবে?
গৌতম বেশ জোরের সঙ্গেই বললেন, করবে।
বুদ্ধদেব বললেন, গ্রামের লোকদের অত বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই।
– গ্রামের লোকেরা বোকাই। না হলে এক বিঘত জমির জন্য ভাইয়ে ভাইয়ে খুনোখুনি করত না। একটা বাঁশ কাটা নিয়ে পাশের বাড়ির লোকের সঙ্গে বিবাদ করত না। থানা-পুলিশ করত না। প্রতিবেশীর পুকুরে প্রচুর মাছ হচ্ছে দেখে হিংসায় জ্বলেপুড়ে গভীর রাতে চুপিসাড়ে গিয়ে কীটনাশক ঢেলে দিত না।
বুদ্ধদেব বললেন, সে নয় হল। কিন্তু আপনি যে বলছেন, জমির মালিকদের টাকা দেওয়ার সময় টাকার একটা অংশ ওঁরা কেটে রাখতে পারেন। সেটা কী করে রাখবে? ওখানে তো আর একজন থাকবেন না। অন্য যাঁরা থাকবেন, তাঁরা কি বসে বসে গাবজ্বাল দেবেন? ধরবেন না?
– কেউ ধরবে না। টাকার ব্যাপার হলে দেখবেন, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, মতাদর্শ, ভাল, মন্দ, রাজনৈতিক রং– সব, সব মিলেমিশে এক হয়ে গেছে।
বুদ্ধদেব উদাসীন ভাবে বললেন, সে হতে পারে! আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু সবাই তো আর সমান হন না। এখনও অনেক ভাল মানুষ আছেন। যাঁরা অন্যায় বা দুর্নীতি দেখলে প্রতিবাদ করেন। ওখানে কি তেমন একজনও থাকবেন না? এটা হতে পারে না। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই রুখে দাঁড়াবেন।
গৌতম বললেন, কেউ দাঁড়াবে না।
– কেন?
– কারণ, টাকার ব্যাপারে সবাই এক গোয়ালের গরু।
– তা হলে উপায়?
নিরুপম সেন বললেন, সবচেয়ে যেটা সহজ উপায়, সেটাই করুন।
বুদ্ধদেব জানতে চাইলেন, কী?
– চেকে প্রেমেন্ট করুন।
– তাতে কি কাজের কাজ কিছু হবে?
গৌতম দেব বললেন, হবে।
বুদ্ধদেব তাকালেন গৌতম দেবের দিকে। আপনি যা বলছেন, তাই যদি হয়, তা হলে তো চেক দেওয়ার সময়ও ওঁরা টাকা চাইতে পারেন।
– চাইতে পারেন। সে ক্ষেত্রে জমির মালিকেরা বলতে পারেন, হাতে তো এখন কোনও টাকা নেই। চেকটা আগে ক্যাশ হোক। তার পরে দেব। এবং যথারীতি তার পরে সেটা নাও দিতে পারেন। এখানে না দেওয়ার একটা অপশন থাকছে। কিন্তু নগদ টাকা হলে কোনও উপায় নেই। জমির মালিকরা দিতে না চাইলেও টাকা দেওয়ার সময় ওঁরাই তাঁদের ইচ্ছে মতো টাকা কেটে নিতে পারেন।
– ঠিক আছে। তা হলে চেকে দেওয়ারই ব্যবস্থা করুন… বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন বুদ্ধদেব।
– চেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেও সেটা যে খুব একটা সুষ্ঠু ভাবে হবে, আমার মনে হয় না।
নিরুপম মুখ তুললেন, কেন?
গৌতম বললেন, চার দিকে যা শুরু হয়েছে, এখন কোনও একটা কিছু পেলেই…
বুদ্ধদেব বললেন, কী হবে?
– ওঁরা নানা রকম চাল দেবে।
– যে চালই দিক, সেটা উলটে দিতে আমার সময় লাগবে না।
– কী করবেন?
– আমার হাতে প্রশাসন আছে। পুলিশ আছে। দরকার হলে ক্যাডার বাহিনী নামিয়ে দেব। আমরা দুশো পঁয়তিরিশ। ওরা শুধু তিরিশ। মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন। আমাদের বিশ্বাস করেন। ভরসা করেন। জানেন, আমরা কাজের মানুষ। কাছের মানুষ। আর আমরা যদি ওঁদের বিশ্বাস ধরে রাখতে পারি, তাঁদের পাশে থাকি, তাঁদের জন্য ভাবি, তাঁদের জন্য কিছু করি, তাঁরা আমাদের সঙ্গেই থাকবেন। এ বিশ্বাস আমার আছে।
– বিশ্বাস থাকা খুব ভাল। কিন্তু হিতে আবার বিপরীত হবে না তো!
বুদ্ধদেব বললেন, কিচ্ছু হবে না। দরকার হলে একটু কড়া হতে হবে। একটু কড়া দাওয়াই দিতে হবে। আপনি বরং দেখুন, কত তাড়াতাড়ি জমির মালিকদের হাতে চেক তুলে দেওয়া যায়। দু’-চার জন চেক নেওয়া শুরু করলেই দেখবেন, অন্যদের দেখাদেখি বাকিরাও সুরসুর করে লেজ নাড়তে নাড়তে এসে, মাথা মুড়িয়ে চেক নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। আর একবার ওঁরা চেক নেওয়া শুরু করলেই আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। বিরোধীদের ছড়িয়ে রাখা পথের সমস্ত কাঁটা ভোঁতা হয়ে যাবে। যত দ্রুত পারেন, চেক দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। খুব তাড়াতাড়ি। পারলে দু’-তিন দিনের মধ্যেই।
চলবে…