।। পর্ব – ২৫ ।।
যে সব চাষিবাড়িতে মাঠে খাটার লোক আছে, চাষের কাজে তাঁদের জনমজুর লাগে কম। কারও কারও তো লাগেই না। ফলে ধান বিক্রির পুরো টাকাটাই ঘরে থেকে যায়। কাউকে দিতে হয় না। অর্থাৎ তাঁরা লাভের মুখ দেখেন অনেক বেশি। আর সেই লাভের টাকা প্রতি বছর কিছু কিছু করে জমিয়ে বেশির ভাগ চাষিই তাঁদের সাধ্য মতো জমি কেনার চেষ্টা করেন। ক’ফসলি জমি তার ওপর জমির দরদাম নির্ভর করলেও প্রথমেই সবাই চেষ্টা করেন তিন ফসলি জমি কেনার, না পেলে দু’ফসলি, তাও না পেলে শেষ পর্যন্ত এক ফসলি। এবং সব সময় চেষ্টা করেন খালের ধারের জমি কেনার। কারণ, তাতে তাঁদের সেচের অনেক সুবিধে হয়। না হলে সেই জমিই কেনেন, যেখানে সেচের ব্যবস্থা খুব ভাল।
জমি বিক্রি করেন একমাত্র সেই সব চাষিই, যাঁরা যে কোনও কারণেই হোক না কেন, নিজে মাঠে গিয়ে কাজ করেন না বা করতে পারেন না। গোটাটাই লোক দিয়ে করান। তার ফলে চাষ থেকে খুব একটা পয়সার মুখও দেখতে পারেন না। তাঁরাই কেবল তেমন খদ্দের পেলে জমি ছেড়ে দেন।
যাঁরা কেনেন, তাঁদেরও জমি কেনার নিজস্ব একটা হিসেব আছে। সেই হিসেব তৈরি হয়েছে বংশপরম্পরায় দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা থেকে। ওঁরা জানেন, পরিবারের এক-একজন কর্মঠ পুরুষ খুব বেশি হলে পাঁচ বিঘে জমিতে চাষ করতে পারেন। তার বেশি জমি হলেই লোক লাগাতে হয়। অথচ সেই বাড়তি জমি থেকে তেমন কোনও লাভ হয় না। উপরন্তু জনমজুর দিয়ে কাজ করালেও যাঁর জমি তাঁকে সেই জমির দেখভাল করতেই হয়। সব সময় উদ্বিগ্ন থাকতে হয়, ওরা কাজে ফাঁকি দিচ্ছে না তো! একটার পর একটা বিড়ি ধরিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খোশগল্প করছে না তো! ঠিক মতো বীজধান ছড়িয়েছে তো! ধান রোয়া ঠিকঠাক হয়েছে তো! ভাল করে সার দিয়েছে তো! সেচের জল কম দেয়নি তো! কীটনাশক নিয়মিত ছড়াচ্ছে তো! হাজার একটা জিনিস মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করে। দু’পয়সা আয় না হলেও বাড়তি ওই জমির ফসল নিয়ে দুশ্চিন্তা লেগেই থাকে। ফলে কেনার সামর্থ্য থাকলেও বুদ্ধিমান চাষিরা তাঁদের ছেলে পিছু পাঁচ বিঘের বেশি জমি কিছুতেই কিনতে চান না। আর মেয়ে থাকলে, জমি বিক্রি করে বিয়ের খরচ তোলার জন্য মেয়ে পিছু দু’-এক বিঘে জমি রাখলেই যথেষ্ট।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যেহেতু গ্রাম এবং জমির দামও কাঠা হিসেবে নয়, বিক্রি হয় বিঘে হিসেবে, আর তার থেকেও বড় কথা, বাস্তু জমির তুলনায় যেহেতু মাঠের জমির দাম অনেক কম এবং এক-একটা পরিবার ছ’-সাত পুরুষ ধরে এখানেই বসবাস করছেন, সবাই সবাইকে চেনেন। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও পাশাপাশি থাকতে থাকতে কেমন করে যেন রক্তের চেয়েও অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়ে গেছে। কেউ কারও কাছে কাকা, কেউ জ্যাঠা, কেউ আবার মামা, তো কেউ ভাইপো, বোনঝি, দাদা কিংবা দাদু। আর তা ছাড়া আগে কখনও কোনও দিন জমিজমা নিয়ে সে ভাবে কোনও ঝামেলা হয়নি বলে, জমি কিনলেও সঙ্গে সঙ্গে সেটা মিউটেশন করার চল এখানে খুব একটা নেই। জমি হাতে পেলেই হল। চাষ করে ফসল গোলায় তুলতে পারলেই হল। কার নামে জমি, সেটা বড় কথা নয়। আর সেটা নিয়ে এখানকার লোকেরা সে ভাবে মাথাও ঘামান না। ফলে ‘আজ করছি, কাল করছি’ করে যুগ যুগ ধরে আগের মালিকের নামেই জমির মালিকানা থেকে যায়। সুতরাং আঁধারগ্রামের বি ডি ও অফিসে যখন ক্ষতিপূরণের চেক এল, দেখা গেল, পরে যাঁরা জমি কিনেছেন, কিন্তু মিউটেশন করেননি, তাঁদের নামে নয়, যাঁদের নামে পরচা আছে, মানে আগে যাঁরা জমির মালিক ছিলেন, সরকারি খাতাপত্রে এখনও যাঁদের নাম মালিক হিসেবেই আছে, তাঁদের নামেই চেক এসেছে।
আগে জমি বেচে দিলেও সেই একই জমির জন্য ফের সরকারি টাকা পাওয়া যাচ্ছে, খবর পেয়েই ছুটে এলেন ওই সব জমির মালিকরা। ছুটে এলেন তাঁদের কাছ থেকে যাঁরা জমি কিনেছেন, অথচ নানা কারণে মিউটেশন করে উঠতে পারেননি, সেই সব প্রকৃত এখনকার মালিকেরাও। এ ছাড়াও যাঁরা নিজেরা চাষ করেন না বা ছেলেরা চাকরিবাকরি পেয়ে শহরে চলে গেছে কিংবা নিজেও গ্রাম ছেড়ে ছেলেদের কাছে গিয়ে থাকার কথা ভাবছেন, ক্ষতিপূরণের চেক নিতে বি ডি ও অফিসের সামনে হাজির হলেন তাঁরাও। সবাই-ই ভাবছেন, গ্রামে পাশাপাশি থাকতে হত বলে মন না চাইলেও শুধুমাত্র পর দিন ন্সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ দেখাদেখি হবে, সেই তো একসঙ্গেই থাকতে হবে বলে, অনেক সময় অনেক কিছু সহ্য করে থাকতে হত। কিন্তু জমি বিক্রি হয়ে গেলে তো আর এখানে থাকার কোনও ব্যাপার নেই। কে কোথায় ছিটকে যাবে! সারা জীবনে হয়তো আর কোনও দিন দেখাই হবে না। তা হলে কীসের সংকোচ? কীসের লজ্জা? একসঙ্গে অতগুলো টাকা যদি পাওয়া যায়, না হয় এত দিনের এই সম্পর্কে একটু চিড় ধরলই। তাতে কার কী এসে যায়! আর আগেই যাঁরা জমি বেচে দিয়েছেন, তাঁরা ভাবছেন, মুফতে পাচ্ছি যখন, চেকটা নিয়েই নিই। তাতে যদি প্রতিবেশীর সঙ্গে একটু মুখ কালাকালি হয় তো হোক। তাঁরা মরিয়া হয়ে উঠলেন।
এ দিকে, যাঁরা জমি দিতে চান না, তাঁদের সামনে দেখা দিল সমূহ বিপদ। দশ-বিশ জন নয়, যদি একজন লোকও ক্ষতিপূরণের চেক নিয়ে নেন, তা হলে জনগণের কাছে ভুলবার্তা গিয়ে পৌঁছুবে। এটা বুঝতে পেরে, আশপাশের সব ক’টা গ্রামই ঝাঁপিয়ে পড়ল বি ডি ও অফিসের সামনে। যাঁরা চেক নিতে যাচ্ছিলেন, গেটের মুখেই তাঁদের আটকানোর চেষ্টা করলেন তাঁরা। ফলে চাষিদের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল দুটো দল। এক দল চেক নেওয়ার পক্ষে। আর এক দল নিজেরা তো চেক নেবেনই না, অন্যরাও যাতে চেক নিতে না পারেন, তার পক্ষে। ফলে শুরু হয়ে গেল হইহট্টগোল। স্লোগান। নেতানেত্রীদের ভাষণ। ধ্বস্তাধ্বস্তি। হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের ভূমিকা কি?
কেমিক্যাল হাব ঠিক কোন জায়গায় হবে তখনও সরকারি ভাবে ঘোষণা করা হয়নি। কিন্তু এই রাজ্যের যেখানেই হোক, দেখতে হবে, তার থেকে জনবসতি কতটা দূরে। ওই হাবের প্রভাবে সরাসরি না হলেও, পরোক্ষ ভাবে এখনই বা অদূর ভবিষ্যতে মানুষের কোনও ক্ষতি হবে কি না। তেমন কোনও কিছু হওয়ার সামান্যতম সম্ভাবনা থাকলেও ঝাঁপিয়ে পড়বেন নবীন মাস্টার। তাই বেশ কিছু দিন হল হলদিয়ায় ঘাঁটি গেড়েছেন তিনি। কারণ কানাঘুষোয় যা শোনা যাচ্ছে, তাতে হাব হলে এই এলাকার আশপাশেই হবে। কারণ এখানকার মুকুটহীন সম্রাট হলেন সি পি এমের ডাকসাইটে নেতা কাম হলদিয়ার হত্তা-কর্তা-বিধাতা– লক্ষ্মণ শেঠ। তাঁর দাপটে এখানে বাঘে-হরিণে এক ঘাটে জল খায়। তাই নবীন মাস্টার সেখানকার বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে কথা বলছেন। আলাপ আলোচনা করছেন। জনমত গঠন করছেন। যাতে তাঁদের প্ল্যাটফর্মটা আগে থেকেই কিছুটা তৈরি হয়ে থাকে।
দেশের একজন নাগরিক হিসেবে এটা তাঁর অবশ্যই করণীয় একটি কাজ বলে তিনি মনে করেন। এবং তাঁর কাছে বাচ্চাদের পুঁথিগত বিদ্যায় শিক্ষিত করে তোলার চেয়েও এটা অনেক বেশি জরুরি কাজ। ফলে সুভাষগ্রামে উনি যাদের পড়াতেন, যার জন্য তাঁর নামের পরে পদবি নয়, যুক্ত হয়েছিল ‘মাস্টার’ শব্দ, সে সব ভুলে গিয়ে উনি মেতে উঠলেন জীবনহানিকর ওই কেমিক্যাল হাব শেষ পর্যন্ত কোথায় হয়, তা জানার জন্য।
ওঁর সঙ্গে আছে আঁধারগ্রামের তেরো নম্বর। ইতিমধ্যেই তার গ্রাম নিয়ে গোটা রাজ্য জুড়ে যে হইচই শুরু হয়েছে, ঊনত্রিশ-তিরিশ বছরের একচ্ছত্র একটা প্রশাসন যে কারণে মহাফাঁপড়ে পড়েছে, অনেক দিন পরে দলের লোকেরাই নেতৃবৃন্দের দিকে যা নিয়ে আঙুল তুলছে, বিরোধী দলগুলো যার দরুন হাতে পেয়েছে একটা জোরদার ইস্যু, তা তো তার জন্যই।
সে চেয়েছিল, যত দিন না তার গ্রাম থেকে সরকার হাত গুটিয়ে নিচ্ছে, যত দিন না অন্যত্র চলে যাচ্ছে একলাখি গাড়ি প্রকল্প, তত দিন সে তার গ্রাম ছেড়ে যাবে না। কিন্তু নবীন মাস্টার তাকে বলেছিলেন, তুমি কি শুধু গ্রামের? এই রাজ্যের কেউ নও? এই দেশের কেউ নও? তোমার গ্রামের লোকেরা যেমন তোমার, এই রাজ্যের লোকেরাও তো তোমারই। তোমাকেই তো তাদের কথা ভাবতে হবে, তাদের ভাল-মন্দ দেখতে হবে, না কি? তুমি আমার সঙ্গে চলো। দেখি, কোথায় আবার মারণফাঁদ তৈরি করতে চলেছে এই সরকার।
নবীন মাস্টারের মুখের ওপরে কিছু বলতে পারেনি তেরো নম্বর। মনটা শুধু খচখচ করছিল। কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না, সে যাবে কি যাবে না। তার পর নিজেকেই নিজে বুঝিয়েছিল, তার গ্রামের লোকেরা আর আগের মতো নেই। এখন যথেষ্ট সচেতন হয়েছেন। প্রতিবাদ করতে শিখেছেন। কী করে প্রতিরোধ করতে হয়, তাও জেনে গেছেন। আর তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে শুধু এ রাজ্যের নয়, গোটা দেশের তাবড় তাবড় সব মানুষ। যে ধুনি সে জ্বালিয়ে দিয়েছে, সেটা জ্বালিয়ে রাখার জন্য তার গ্রামে এখন বহু মানুষ জড়ো হয়ে গেছেন। এখানে এখন তার আর না থাকলেও চলবে। বরং যেখানে তার দরকার, তার এখন সেখানেই যাওয়া উচিত।
এটা ভেবে নবীন মাস্টারের সঙ্গে সে চলে এসেছিল হলদিয়ায়। খোঁজখবর নিচ্ছিল, কেমিক্যাল হাব গড়ার জন্য কোন অঞ্চলটাকে চিহ্নিত করতে চলেছে তাদের সরকার। কিন্তু দিন গেল, সপ্তাহ গেল, মাসও গড়াতে চলল, একবার এই জায়গার নাম শুনল, একবার ওই জায়গার। কিন্তু ঠিক কোন জায়গাটাকে যে সরকার বেছেছে, সেটার হদিশ পেল না। বুঝতে পারল, আঁধারগ্রামের জমি নিয়ে অমন একটা ভয়াবহ সমস্যা হওয়ার পর সরকারের টনক নড়েছে। ফলে কেমিক্যাল হাব সংক্রান্ত পুরো ব্যাপারটাকে অত্যন্ত গোপন রাখতে চাইছে তারা। তাই এত লুকোছাপা।
কোন জায়গায় যে হাবটা হবে, সেটা জানতে আরও কত দিন লাগবে কে জানে! অথচ মেয়েটার জন্য তার মন বড় ছটফট করছে। বউটাও কত দিন ধরে একা-একা আছে। তাই নবীন মাস্টারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তেরো নম্বর চলে এল তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা– আঁধারগ্রামে।
সে আসতেই হঠাৎ করে যেন গোটা গ্রাম আরও চাঙ্গা হয়ে উঠল। প্রতিরোধ আরও জোরদার হয়ে উঠল। একবাক্যে সবাই আরও জোরের সঙ্গে বলল, আমরা কিছুতেই ক্ষতিপূরণের চেক নেব না। আর এই দেহে প্রাণ থাকতে কাউকে এই চেক নিতেও দেব না। দরকার হলে পুরো বি ডি ও অফিস দিনের পর দিন ঘেরাও করে রাখব। কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেব না। বেরোতেও দেব না। দেখি, কার ঘাড়ে ক’টা মাথা। কে চেক নেয়, আর কে বিলি করে।
তেরো নম্বরের বাড়ির দাওয়ায় বসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল গ্রামবাসীরা। সায় দিল তেরো নম্বরও। সরকারের এই জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারটা তাকে শুধু উৎখাত হওয়ার আতঙ্কই ধরায়নি, প্রতি মুহূর্ত কুরে কুরে খাচ্ছেও। এ কোন রাজ্যে বাস করছি আমরা! জঙ্গলের রাজত্বে!
পুরো ব্যাপারটা নিয়ে সে এতটাই বিচলিত হয়ে ছিল যে, এত দিন পর বাড়ি ফিরেও বউয়ের সঙ্গে নিভৃতে দু’দণ্ড কথাও বলতে পারল না। মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করতে গিয়েও কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকল। এরা, এই বাচ্চারাই তো দেশের ভবিষ্যৎ। এরাই তো বড় হয়ে ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, বিজ্ঞানী হবে। এদের জন্য কী রেখে যাচ্ছি আমরা! কী! এরা বড় হলে কী কৈফিয়ত দেব আমরা! এরা যদি কোনও দিন জিজ্ঞেস করে, সরকারের চাপিয়ে দেওয়া এত বড় একটা অন্যায় তোমরা মাথা পেতে নিলে কী করে? আটকাতে পারলে না? ওদের একটু বোঝাতে পারলে না? প্রতিবাদ করতে পারলে না? তখন কী জবাব দেব আমরা? মুখ দেখাতে পারব এদের কাছে!
আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস উত্তাল ২৪
তখনও মাথার উপর সূর্য গনগন করে ওঠেনি। গাছপালা-মানুষের ছায়া ছোট হতে হতে পায়ের কাছে এক চিলতে হয়ে পড়েনি। শুধু আঁধারগ্রাম নয়, চার-চারটে মৌজার সব ক’টা গ্রাম এককাট্টা হয়ে ঘিরে ফেলল বি ডি ও অফিস। ধরনায় বসলেন প্রায় সাত হাজার মানুষ। তার মধ্যে শুধু মেয়ে-বউদের সংখ্যাই প্রায় আড়াই হাজারের ওপর। বাচ্চাকাচ্চাও কম নয়। প্রথমে ঠিক হয়েছিল, বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে পালা করে ধরনায় বসবেন। কিন্তু সব লোক জড়ো হতেই জনজোয়ারে আপ্লুত হয়ে গেলেন সবাই। আবেগে ভেসে যেতে লাগলেন। তাঁরা বুঝতে পারলেন, আমরা কেউ আর একা নই। আমরা সবাই একসঙ্গে আছি। কারওরই আর কাউকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করল না। তাই যে যেখানে পারলেন সার দিয়ে বসে পড়লেন বি ডি ও অফিসের সামনে।
সেখান থেকেই মহাদেব দাস ঘনঘন ফোন করছিলেন বেচারাম মান্নাকে। তাঁদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, এই মুহূর্তে তাঁদের কী করা উচিত, বারবার তিনি তা জেনে নিচ্ছিলেন। আর বেচারাম ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রতিবার একটা কথাই বলছিলেন, মানুষকে জাগিয়ে রাখো। ওদের ভিতরের আগুনটাকে জ্বালিয়ে রাখো। ওই আগুনেই পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে সরকারি সমস্ত কু-চক্রান্ত।
মহাদেব বলছিলেন, আমাদের লোকজন সব ঠিক আছে। আমরা বি ডি ও অফিস ঘেরাও করে রেখেছি দেখে ওরা বোধহয় থানায় খবর দিয়েছিল। কারণ, বড় রাস্তার উপরে নাকি পুলিশের দুটো ভ্যান এসে দাঁড়িয়েছে। তাতে নাকি বেশ কয়েক জন পুলিশও আছে।
বেচারাম বললেন, তাতে কী হয়েছে? ওই বিশাল জনসমাগমকে বাগে আনতে গেলে, দুটো ভ্যান নয়, দুশো ভ্যান লাগবে। আশপাশের সব ক’টা থানা মিলিয়েও ওরা তা জোগাড় করতে পারবে না। একদম ভয় পাবে না। জানবে, পুলিশদেরও প্রাণের ভয় আছে। ওরা যখন দেখবে এত লোক, তখন লাঠি-সোঁটা ফেলে নিজেরাই লেজ গুটিয়ে পালাবে।
মহাদেব একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ওরা যদি গুলি চালায়?
বেচারাম বললেন, চালাবে না। ওরা অত বোকা নয়। ওদের কাছে কত গুলি আছে? ক’জনকে মারবে? ওরা জানে, ওরা যদি একটা গুলিও চালায়, ওরা কেউ আর বেঁচে ফিরবে না। মনে রাখবে, ওরা লড়ছে চাকরি বাঁচানোর জন্য আর তোমরা লড়ছ, তোমাদের পায়ের তলার মাটি আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য। বেঁচে থাকার জন্য। এটা একটা নীতির লড়াই। এটা একটা নৈতিকতার লড়াই। এটা একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই। এটা একটা কয়েক জন রাজনৈতিক নেতার ভুলভাল, অবান্তর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লড়াই। জানবে, গোটা পৃথিবীতে সব সময় ন্যায়েরই জয় হয়েছে। তোমাদের জয় হবেই। কেউ আটকাতে পারবে না।
তার পর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বেচারাম বললেন, বাচ্চাদের কান্না শুনতে পাচ্ছি মনে হচ্ছে… ওখানে কি বাচ্চারাও এসেছে নাকি?
মহাদেব বললেন, এসেছে তো। চাষিভাইদের সঙ্গে প্রচুর মা-বোনেরাও এসেছেন। তাঁদের মধ্যে যাঁদের বাচ্চা একদম ছোট, বুকের দুধ খায়, তাদের তো আর বাড়িতে রেখে আসা যায় না। কখন ফিরবেন, তার তো কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। তাই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। তারাই কান্নাকাটি করছে।
– ওদের কিছু খাবারদাবারের ব্যবস্থা করেছ?
মহাদেব চুপ। উনি আন্দোলনটাকে নিয়েই ভেবেছেন। কিন্তু এ দিকটা তাঁর মাথাতেই আসেনি। তিনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই বেচারাম অবাক হয়ে বললেন, এত লোক এসেছে, তাদের কোনও খাবারের ব্যবস্থা করোনি? সে কী!
– না, মানে… ওঁরা বোধহয় বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসবেন।
– বাড়ি গেলে আর আসবে? এক্ষুনি ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি দেখছি, কী করতে পারি। যতক্ষণ না কিছু পাঠাচ্ছি, যারা ওখানে নেতৃত্বস্থানীয় আছে, আপাতত তাদের একটা কিছু ব্যবস্থা করতে বলো। দরকার হলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল-ডাল জোগাড় করতে বলো। তেমন হলে যে যা দেয়, চাঁদা তুলে সবার খাবারের ব্যবস্থা করো। এত বেলা হয়ে গেল! কখন রান্না হবে! কখন খাবে! পেটে কিল মেরে কখনও আন্দোলন করা যায় না। আর দেরি কোরো না। যা হোক একটা কিছু করো।
মহাদেব বললেন, ঠিক আছে, দেখছি।
বেচারাম বললেন, দেখছি না, ইমিডিয়েট করো। ইমিডিয়েট।
তার পরেই মূলত মহাদেব দাসের উদ্যোগেই কয়েক জনের তৎপরতায় ধরনায় খানিকটা দূরে পর পর ক’টা তিন ইটের উনুন তৈরি হয়ে গেল। এর ওর বাড়ি থেকে চেয়েচিন্তে যা চাল-ডাল পাওয়া গেল, সেগুলোই হাঁড়িতে করে চাপিয়ে দেওয়া হল। ফুটতে লাগল খিচুড়ি। কেউ কেউ গাঁটরি বেঁধে বেঁধে তুলে নিয়ে এলেন কচু-কচুরলতি। মেয়ে-বউরা শুরু করে দিলেন কাটাকাটি। শুধু প্রতিবাদ করার জন্য নয়, এই রান্নাবান্নার কর্মযজ্ঞের মধ্যে দিয়েও একজনের সঙ্গে আর একজনের সম্পর্ক নিবিড় থেকে আরও নিবিড় হয়ে উঠতে লাগল। যেন প্রতিবাদ-উৎসব শুরু হয়ে গেল আঁধারগ্রামে।
মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। তাদের মাধ্যমে বড় রাস্তার ধাবায়। চটিতে। সেখান থেকে লড়ির চালক, খালাসি। কলকাতামুখী গাড়ি। বেজে উঠল এর-তার ফোন। চালাচালি হতে লাগল মেসেজের পর মেসেজ। ওবি ভ্যান নিয়ে ছুটে এল স্টার আনন্দ, তারা নিউজ, কলকাতা টিভি।
তরতর করে টি আর পি পড়তে থাকায় নড়েচড়ে বসল সি পি এমের ব-কলমে জনগণের নিউজ চ্যানেল ২৪ ঘণ্টা। শেষ পর্যন্ত দর্শকদের চাহিদার কথা ভেবে তারাও আসতে বাধ্য হল। ফুল স্পিডে গাড়ি ছুটিয়ে হাজির হল আনন্দবাজার, বর্তমান, সংবাদ প্রতিদিন। বাদ গেল না সন্মার্গ, জনসত্তা, স্টেটসম্যান, হিন্দুস্থান টাইমস, এমনকী সি পি এমের একমাত্র মুখপত্র– গণশক্তিও।
আসতে শুরু করল এ পি ডি আর থেকে শুরু করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। একে একে হাজির হল কংগ্রেস, বি জে পি, তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরাও। পিছু পিছু জড়ো হতে লাগল শুধু স্থানীয় থানা নয়, আশপাশের বিভিন্ন থানা। এমনকী বিশেষ ভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত লালবাজারের বিশেষ সেলও। উচ্চপদস্থ কর্তাদের নির্দেশে রওনা হয়ে গেল এনকাউন্টার স্পেশালিস্টরাও। কাছাকাছি গিয়ে আড়ালে-আবডালে গা ঢাকা দিয়ে পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল দাগি আগামি থেকে শুরু করে গা হিম-করা সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী সি পি এমের গুন্ডা বাহিনী, আন্ডারগ্রাউন্ড সেকশনও।
উপর মহলের অত্যন্ত গোপন নির্দেশে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল, দমদম সেন্ট্রাল জেল থেকে চুপিসাড়ে তড়িঘড়ি ভ্যানে তোলা হল হাত-কাটা দিলীপ, কানা বাদশা, ক্ষুর রাজু-সহ পাঁচ-দশটা খুনের আসামি, বিভিন্ন এলাকার সন্ত্রাস, দিনেদুপুরে প্রকাশ্য রাস্তায় এক কোপে এক প্রোমোটারের মাথা নামিয়ে, সেই মাথাটাকে ফুটবলের মতো খেলতে খেলতে পাঁচশো ফুটেরও বেশি নিয়ে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অবলীলায় চলে যাওয়া হাওড়ার আতঙ্ক, যাবজ্জীবন জেল খাটতে থাকা ভয়ংকর আসামি, কেউই বাদ গেল না।
যাঁরা ও সব দেখতে পেলেন না, তাঁরা জানতেই পারলেন না, কী অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে আঁধারগ্রামে। যে কোনও সময়, যে কোনও বড় ধরনের মারাত্মক কোনও ঘটনা ঘটে যেতে পারে ওখানে। এটা জেনেও কয়েক জন বামপন্থী নেতা-নেত্রী নিজেদের মধ্যে গোপন বৈঠক করে লালবাজারে পাঠিয়ে দিলেন মোক্ষম নির্দেশ।
এ রকম কোনও নির্দেশ যে বড় মাপের কোনও নেতা-নেত্রী বা কোনও জনপ্রতিনিধি কিংবা কোনও মন্ত্রী-আমলারা দিতে পারেন, তা কল্পনাও করতে পারেননি পুলিশ কমিশনার। নির্দেশ শুনে নড়েচড়ে বসলেন তিনি। আমতা আমতা করে বললেন, আজকেই?
ও প্রান্ত থেকে যে উত্তর ভেসে এল, সেটা শুনে তাঁর শিরদাঁড়া দিয়ে তিরতির করে নামতে লাগল হিমশীতল একটা শিরশিরানি।
– হ্যাঁ। আজকেই।
চলবে…