ধারাবাহিক উপন্যাস উত্তাল ২৭

।। পর্ব- ২৭।।

কয়েক জন মিলে রাজকুমারকে কোনও রকমে ধরাধরি করে ভ্যানরিকশায় চাপিয়ে, একজন তো প্যাডেল করছিলই, বাকিরা পিছন থেকে উন্মাদের মতো ঠেলতে ঠেলতে বড় রাস্তায় নিয়ে এল। হাত দেখালেও কোনও গাড়ি থামছে না দেখে, গাড়িরাস্তার মাঝখানে বুক চিতিয়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল তেরো নম্বর। প্রচণ্ড জোরে ছুটে আসা একটা গাড়ি বাধ্য হয়ে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়তেই, আর কোনও কথা নয়, দরজা খুলে যত দ্রুত সম্ভব চ্যাংদোলা করে রাজকুমারকে গাড়ির ভিতর ঢুকিয়ে, যত জন ঢোকা যায়, ঠেলেঠুলে, চেপেচুপে, এর কোলে ও, ওর কোলে সে বসে, চালককে আঁধারগ্রাম হাসপাতালের দিকে গাড়ি ছোটাতে বলল।
হাসপাতালটা ওদের খুব পরিচিত। কোথায় কী থাকে, সব জানে। শ্যামল ছুটে গিয়ে কোথা থেকে মুহূর্তের মধ্যে বহু পুরনো ধ্যাড়ধেড়ে একটা স্ট্রেচার নিয়ে এল। হুটোপাটি করে তার মধ্যে ওকে শুইয়ে, সোজা এমারজেন্সি বিভাগের দিকে নিয়ে গেল ক’জন। বাকিরা হইহই করে সারা হাসপাতাল তোলপাড় করে খুঁজে খুঁজে ধরে নিয়ে এল নার্স, হাসপাতাল-লাগোয়া কোয়ার্টারে ঘুমিয়ে থাকা ডাক্তারকে।
একজন ডাক্তার ঘুম-জড়ানো চোখে বললেন, এত রক্ত! কী হয়েছে? অ্যাক্সিডেন্ট?
এই হাসপাতালের ডাক্তারেরা জানেন, মধ্যরাতে কিংবা ভোর রাতে কোনও রক্তাক্ত পেশেন্ট আসা মানেই জাতীয় সড়কে অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনা। এটা এখানে আকছারই ঘটে। দিনের বেলায় যত জোরে গাড়ি ছোটে, রাতে ছোটে তার চেয়ে বেশি জোরে। আর তার মধ্যে কোনও চালক যদি নেশা করে স্টিয়ারিং ধরে, তা হলে তো কথাই নেই। প্রায়ই সকালে দেখা যায়, জাতীয় সড়কের পাশ দিয়ে নেমে যাওয়া ঢালু পথে, এ দিকে ও দিকে উলটে পড়ে আছে কত মারুতি-অ্যাম্বাসাডর। মুখোমুখি ধাক্কায় একেবারে তুবড়ে গেছে মাল বোঝাই দুই লড়ির মুখ। খালাসি আহত। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় হয়-চালক চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে মারা গেছে, নয় তো উধাও। শেষ মুহূর্তে কী ভাবে যে ওরা দরজা খুলে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যায়, আরও অনেকের মতো এই ডাক্তারও তা বুঝতে পারেন না।
এ রকম আহত ব্যক্তি প্রায় প্রতিদিনই দু’-একটা করে আসে। ফলে দেখতে-দেখতে এই ব্যাপারটা খুব গা-সওয়া হয়ে গেছে তাঁদের। কিন্তু এই হাসপাতালে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত তিনি কখনও কোনও আহত ব্যক্তির সঙ্গে এতগুলো স্থানীয় লোককে একসঙ্গে আসতে দেখেননি। তাঁর মনে হল, এ নিশ্চয়ই এখানকার বড় কোনও কেউকেটা কিংবা নেতা-টেতা কেউ হবেন। না হলে এই ভোরবেলায় এঁর সঙ্গে এত লোক আসবেন কেন! তাই আচামকাই তিনি বলেছেন, এত রক্ত! কী হয়েছে? অ্যাক্সিডেন্ট?
সেটা শুনে কেউ কিছু বলার আগেই স্বপনখুড়ো বললেন, না না, অ্যাক্সিডেন্ট-ফ্যাক্সিডেন্ট না। মারসে।
– মেরেছে! কে?
স্বপনখুড়ো বললেন, ওরা।
– ওরা মানে? কারা?
কথায় কথায় সময় নষ্ট হচ্ছে। চিকিৎসা শুরু করতে যত দেরি হবে, ততই সংকটময় হবে রাজকুমারের জীবন। তাই তেরো নম্বর বলল, ডাক্তারবাবু, আপনাকে সব বলব। তার আগে ওকে একটু দেখুন।
ডাক্তার বললেন, মেরেছে যখন, এ তো পুলিশ কেস। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। আগে পুলিশকে ইনফর্ম করি, পুলিশ আসুক। জিজ্ঞাসাবাদ করুক। তার পর ট্রিটমেন্ট শুরু হবে।
ওই কথা শুনে, যারা রাজকুমারকে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের তো মাথায় হাত। কেউ চড়া গলায়, কেউ নরম সুরে, কেউ আবার হাত জোড় করে বারবার কাকুতি-মিনতি করতে লাগল, আগে চিকিৎসা শুরু করেন ডাক্তারবাবু। থানা-পুলিশ যা করার পরে করবেন। পুলিশ কখন আসবে, তার অপেক্ষায় বসে থাকলি ওরে আর প্রাণে বাঁচাইতে পারুম না আমরা। আপনে কোনও চিন্তা করবেন না। পুলিশকে আমরাই কমু। আমরা তো আছি। আপনে আগে ওরে বাঁচান।
মূলত ওদের আকুল আর্তিতেই খানিকটা দয়াপরবশ হয়ে, ওই হাসপাতালের যা পরিকাঠামো, তা দিয়েই চিকিৎসা শুরু করে দিলেন ডাক্তারবাবু। রক্ত লাগবে শুনে, ওদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল, কে আগে রক্ত দেবে। সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইন দেওয়া শুরু হল। লাগিয়ে দেওয়া হল অক্সিজেন। প্রত্যেকেই উদ্বিগ্ন। কেউ ঈশ্বরকে ডাকছেন। কেউ আল্লার কাছে প্রার্থনা করছেন। কিন্তু এত চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বুকের ধুকপুকানি থেমে গেল। নিথর হয়ে গেল সে।
এ খবর পৌঁছতেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন কৌশিক সেন, জয়া মিত্র, ব্রাত্য বসু, অর্পিতা ঘোষ, সমীর আইচ, জয় গোস্বামী, দোলা সেনেরা। কিছু দিন আগেই ধর্মতলা থেকে কয়েকটি ম্যাটাডরে চেপে আরও অনেকের সঙ্গে দল বেঁধে ওঁরা গিয়েছিলেন আঁধারগ্রামে। সেখানে গিয়ে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তাঁরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন বিভিন্ন গ্রামে। কিন্তু স্থানীয় কেউ সঙ্গে না থাকলে যেখানে যেতে চান, সেখানে ওঁরা চিনে চিনে যাবেন কী করে! তাই আগে থেকে ব্যবস্থা করা ছিল। সেই মতো তাঁরা পৌঁছনো মাত্র বেশ কিছু স্থানীয় লোক ওঁদের বিভিন্ন দলকে নানা গ্রামে নিয়ে গিয়েছিল।
তাঁদের দলটাকে দোবাঁদি গ্রামে নিয়ে গিয়েছিল এই রাজকুমারই। ও গোপালনগরে থাকলেও ওকে যে একডাকে সবাই চেনেন, সেটা ওর সঙ্গে পথ চলতে শুরু করার সময় থেকেই ওঁরা বুঝতে পেরেছিলেন। তার সঙ্গে ওঁদের খুব ভাল ভাব হয়ে গিয়েছিল। পরেও বেশ কয়েক বার তার সঙ্গে ওঁদের যোগাযোগ হয়েছে। দারুণ লড়াকু ছেলে। সব সময় যেন টগবগ করে ফুটছে। ভরপুর প্রাণশক্তি। আর সেই ছেলেটাকেই কিনা…
ওর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই সারা রাজ্য জুড়ে শুরু হয়ে গেল প্রতিবাদ। প্রতিরোধ। তৃণমূলের ডাকে সারা দিন ধরে চলল, রাস্তা রোকো, রেল রোকো। যোগ দিল এস ইউ সি, সি পি আই (এম এল), কংগ্রেস-সহ নানান রাজনৈতিক দল এবং সমাজ সচেতন বিভিন্ন সংগঠন।
শুধুমাত্র নিজেদের জমি কেড়ে নেওয়া আটকানোর জন্য গ্রামবাসীদের শান্তি অবস্থানের ওপর সরকারের এমন জঘন্য আক্রমণের উপযুক্ত জবাব দিতে, আর সরকার যাতে ফের এ রকম কোনও ঘটনা কখনও ঘটাতে না‌ পারে, তার নানান কর্মসূচি নেওয়ার জন্য বিভিন্ন দল ও সংগঠন তাদের নিজেদের মধ্যে যাবতীয় বিরোধিতা দু’হাতে ঠেলে দূরে সরিয়ে, এককাট্টা হয়ে আলোচনায় বসল। সবাই মিলে গড়ে তুলল– সংহতি উদ্যোগ।
শুধু সে দিনই নয়, সি পি আই (এম এল) লিবারেশন পার্টি এবং এস ইউ সি-র ডাকে তার পর দিনই আঁধারগ্রামে স্বতঃস্ফূর্ত বনধ পালিত হল। বেরোল প্রতিবাদ মিছিল। সারা গ্রাম ঘুরল। যাঁরা মিছিলে অংশ নিলেন, তাঁদের মুখে কোনও স্লোগান ছিল না। ছিল না কোনও কটূক্তিও। শুধু সারা মুখ জুড়ে ছিল ঘৃণা। কোনও সভ্য দেশের কোনও রাজ্য সরকার যে শুধু নিজেদের আখের গোছানোর জন্য এ রকম কোনও কাণ্ড ঘটাতে পারে, তা ছিল তাঁদের কল্পনারও বাইরে।
তাই আঁধারগ্রাম ও তার আশপাশের বিভিন্ন পুজো কমিটিগুলোর কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এক অভূতপূর্ব, অভিনব প্রতিবাদ দেখালেন। পুজোর সব রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়ে গিয়ে থাকলেও, ঠাকুর এবং প্যান্ডেল ইতিমধ্যে বায়না করে দিয়ে থাকলেও, তাঁরা সবাই মিলে একজোট হয়ে তাঁদের পুজোগুলো বন্ধ করে দিলেন।
শুধু আঁধারগ্রামেই নয়, এই ঘটনার নিন্দায় সরব হলেন গোটা রাজ্যের মানুষ। তৃণমূলের ডাকে কলকাতার ধর্মতলায় বিশাল সমাবেশে হাজির হলেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোক। দেখানো হল বিক্ষোভ। নেওয়া হল নানান কর্মসূচী। মুখর হলেন লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরাও।
এই ঘটনার জেরে যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে গোটা দেশ। তাই থমকে দাঁড়াল বুদ্ধ-বাহিনী। তারা ভাবতেই পারেনি, ও রকম একটা ঘটনা এ ভাবে মোড় নেবে। তাই আঁধারগ্রামের ওই ঘটনার জন্য বাধ্য হয়ে ২০০৬ সালের অক্টোবরের ১ তারিখে গভীর দুঃখপ্রকাশ করলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আর তাঁর দুঃখপ্রকাশ করার ভঙ্গিমা দেখে বহু লোকেরই মনে হল, ওটা নিছক একটা অভিনয়। নতুন কোনও কু-মতলবে আছেন তিনি। তাই আঁধারগ্রামের পাঁচটি মৌজার সমস্ত গ্রামবাসী একসঙ্গে মিলিত হয়ে এক অভিনব প্রতিবাদে সামিল হলেন। তাঁরা সবাই ওই দিন তাঁদের ঘরদোর নিষ্প্রদীপ রাখলেন।
এই রকম অভাবনীয় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দেখে রাজ্য সরকার বুঝতে পারল, আন্দোলনটা অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। এ রকম চলতে থাকলে, জনগণের কাছে তাঁদের সম্পর্কে ভুল বার্তা পৌঁছবে। তাই সব কিছু হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই তারা ঠিক করল, গ্রামবাসীরা তাঁদের ঘরগুলোকে অন্ধকার করে রাখলে কী হবে, দরকার হলে আমরা শ’য়ে শ’য়ে জেনারেটর বসিয়ে প্রত্যেকটা পাড়ার মোড়ে মোড়ে, যত দিন না ওরা আলো জ্বালায়, আমরা লাইট জ্বালিয়ে রাখব।

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস উত্তাল ২৬

গ্রামের লোকেরা সবাই মিলে আবার আলোচনায় বসল। এক-একজন এক-একটা বুদ্ধি দিতে লাগল। কেউ বলল, না হয় বিদ্যুতে শক খেয়ে মরব, তাও ভাল। দেখবি, গভীর রাতে ওদের পাহারাদারেরা ঘুমে ঢলে পড়লেই আমি চুপিচুপি পাইপ বেয়ে উপরে উঠে, যে-ক’টা পারব লাইট খুলে নেব।
আর একজন বলল, ক’টা খুলবি? যে দিন খুলবি, দেখবি, তার পর দিন সকালেই, যে ক’টা খুলেছিস, তার দশ গুণ লাইট লাগিয়ে দিয়েছে ওরা।
– লাগাবে না ছাই। বাসরাস্তায় একটা ডুম কেটে গেলে ছ’মাসেও লাগায় না। তারা আবার আমাদের গ্রামে… ধুস। যা বলবি, একটু ভেবেচিন্তে বলবি।
– আমি ভেবেচিন্তেই বলছি। ওখানে লাইট লাগায় না। কারণ, ওখানে ওদের লাইট লাগাতে বয়ে গেছে। তাই কেউ গা করে না। দেখেও দেখে না। না দেখার ভান করে বসে থাকে। কিন্তু এ গ্রামের ব্যাপারটা এখন এক্কেবারে আলাদা। এটা ওদের প্রেস্টিজ ইস্যু। মরণ-বাঁচন সমস্যা।
অন্য আর একজন বলল, দশ গুণ কেন, একশো গুণ লাগাক না। আমরা এক-একটা ঢিল মেরে ওদের সব ক’টা লাইট ভেঙে দেব।
কেউ বলল, অবনদার ছেলে রতন, ও তো ইলেকট্রিকের কাজ জানে। ওকে দিয়ে মেন সুইচটা অফ করে দিলে হয় না? তা হলেই তো আর কোনও লাইট জ্বলবে না।
প্রদীপ বলল, এ ভাবে হবে না। এ ভাবে হবে না। অন্য কিছু ভাবতে হবে, অন্য কিছু। এমন একটা কিছু করতে হবে, যাতে ওরা একদম কুপোকাত হয়ে যায়।
– কিন্তু সেটা কী?
তখন তেরো নম্বর বলল, এত বড় অন্যায়! এত বড় শোক! সেটুকু পালন করার অধিকারও কেড়ে নেবে ওরা! ঠিক আছে, আমরা বরং একটা কাজ করি। কাল আমরা বাড়িতে কেউ রান্না করব না। খাব না।
এই কথা শুনে দু’-একজন গাঁইগুঁই করছিল। বলছিল, আমাদের কথা আমি বলছি না। কিন্তু বাচ্চারা আছে, দুধের শিশুরা আছে। তাদের না খাইয়ে রাখা…
একজন বলল, দুধের শিশুরা মায়েদের বুকের দুধ খেয়ে থাকবে। তার থেকে যারা বড়, একটা বড় কাজের জন্য তারা না হয় একটা দিন না খেয়েই থাকল, কী আছে!
অগত্যা, শেষ পর্যন্ত রান্না না করার পক্ষেই সায় দিল সবাই। ফলে ৩ অক্টোবর সারা আঁধারগ্রামে পালন করা হল অরন্ধন কর্মসূচী।
বিশাল করে খবর হল সেটা। খবরের কাগজ থেকে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া। সবাই মুখর হল। গোটা পৃথিবীর মুখ ঘুরে গেল আঁধারগ্রামের দিকে। ভারত নামক তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশের পশ্চিমবঙ্গ নামের ছোট্ট একটি রাজ্যের, ওইটুকু একটা গ্রাম, সরকার তাঁদের জমি কেড়ে নিচ্ছে দেখে, সবাই এককাট্টা হয়ে এ রকম একটা আন্দোলন ঘটিয়ে ফেললেন!
থমকে দাঁড়াল প্রশাসন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল সরকার। ফের ওঁরা নতুন কোনও পদক্ষেপ নিলে, তাদের যে কী ক্ষতি হবে, কে জানে! আঁধারগ্রামের লোকজন যে কাদের বুদ্ধিতে কী করবে, নতুন কী কর্মসূচী নেবে, আর তার ফলে শুধু এ রাজ্য নয়, গোটা দেশের জনগণ কী ভাবে সুরুৎ করে ওঁদের দিকে ঢলে পড়বে, তা ভাবতে গিয়েই দিশেহারা হয়ে পড়লেন সি পি এমের তাবড় তাবড় নেতারা।
তাই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে মিটিং করে তার পর দিনই, অর্থাৎ ৪ অক্টোবর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তড়িঘড়ি সরকারি উদ্যোগে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকলেন। আমন্ত্রণ জানালেন তৃণমূলকেও। কিন্তু তৃণমূলের সর্বময় কত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি জানিয়ে দিলেন, যারা ও রকম ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটাতে পারে, তাদের সঙ্গে বসতে আমি ঘৃণা বোধ করি।
সারা দেশ তখন উত্তাল। তারই মধ্যে বিভিন্ন সংগঠনকে নিয়ে গড়ে ওঠা সংহতি উদ্যোগ আর আঁধারগ্রাম কৃষিজমি বাঁচাও কমিটির উদ্যোগে প্রাক্তন বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত, লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী আর সমাজসেবী মেধা পাটেকরকে সবার উপরে বসিয়ে গঠন করা হল একটি তদন্ত কমিশন।
২৫ সেপ্টেম্বর রাতে জেলা শাসকের অফিসের সামনে অবরোধ করার সময় মধ্যরাতে পুলিশ, র‍্যাফ আর ক্যাডার বাহিনীর বেধড়ক মারে যার মৃত্যু হয়েছিল, সেই রাজকুমার ভুলের জন্মগ্রাম, গোপালনগরের মধ্যপাড়ার দুর্গাবেদিতে এসে হাজির হলেন তদন্ত কমিশনের সেই দলটি। শুরু হল জনশুনানি।
শুনানির পর এ দিন বিকেলেই আঁধারগ্রাম হাসপাতাল ময়দানের এক বিশাল জনসভায় ওঁরা বক্তৃতা দিলেন। মহাশ্বেতা দেবী বললেন, আঁধারগ্রাম আন্দোলন এর মধ্যেই যে পিপলস মুভমেন্ট হয়ে উঠেছে, সেটা দেখে আমি খুব খুশি। শেষ বয়সে এসে আমার মনে হচ্ছে, ঝিমিয়ে পড়া বাঙালি জুলুমের বিরুদ্ধে আবার প্রতিবাদে সরব হতে শুরু করেছে। তিনি আহ্বান জানালেন, এই আন্দোলনে আরও বেশি করে ছাত্র-যুবকদের সামিল হওয়ার জন্য।
মেধা পাটেকরের গলায় ফুটে উঠল একটাই কথা, অন্যান্য রাজ্যে সি পি এম যা করছে, এখানে করছে ঠিক তার উলটোটা। নানান উদাহরণ টেনে উনি সেটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। সে দিন হাসপাতাল ময়দানে যাওয়ার আগে দুর্গাবেদিতে জনশুনানির সময় স্থানীয় লোকের মুখে গত ২৫ সেপ্টেম্বরের রাতের ভয়াবহ যে বর্ণনা, যে আতঙ্ক, যে অভিযোগ আর অভিজ্ঞতার কথা তাঁরা শুনেছিলেন, তার ভিত্তিতেই নানান প্রশ্ন তুললেন তিনি। একই সুর ছিল ওঁদের সঙ্গে যাওয়া সুনন্দ সান্যালের কথাতেও।
ক’টা গাছ পর পর লাগানো মাইকের মাধ্যমে মিটিংয়ের সব কথা বহু দূর দূর পর্যন্ত ভেসে যাচ্ছে। বাড়ির দোতলার ছাদে মোবাইল অন করে তখন টানটান হয়ে বসে আছে নতু। না, কারও সঙ্গে সে কথা বলছে না। শুধু ফোনটা শূন্যে ধরে আছে। আর সেই ফোন মারফত, মিটিংয়ে কে কী বলছে, সব কথা মন দিয়ে শুনছেন ফোনের ও প্রান্তে বসে থাকা সি পি এমের এক তুখোড় নেতা।
সে দিন একটু বেশি রাতে ওই নেতা ফোন করে নতুকে জানালেন, শুধু মারলে হবে না। দেখছ তো, একটাকে মারলে কেমন দশ জন ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমন কিছু করো, যাতে ওদের মাজা ভেঙে যায়। ভয়ে হোক, আতঙ্কে হোক, ওই আন্দোলন থেকে যাতে গ্রামবাসীরা সরে যায়, তার ব্যবস্থা করো।
নতু বলল, ওরা এখন মরিয়া হয়ে যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে আর কোনও কিছুকেই ভয় পায় না ওরা। যারা মরতে ভয় পায় না, তাদের আপনি ভয় দেখাবেন কীসে?
– ভাবো ভাবো ভাবো। নিজে মরার ভয় না পেতে পারে, কিন্তু নিজের সন্তান মরতে পারে, এটা জানলেও কি ওদের বুক এতটুকু শিউরে উঠবে না!
– মানে?
– মানে একটাই, আন্দোলন যারা করছে, তারা নয়, টার্গেট করো তাদের ছেলেমেয়েদের। দু’-একটা ছেলেমেয়ের দেহ গ্রামের পুকুরে ভেসে উঠলে কিংবা সকালে কোনও গাছের ডালে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় ঝুলতে দেখলে, তাদের বাবা-মায়েরা কি ঠিক থাকতে পারবে? তখন দেখবে, ওদের দেখাদেখি বাকি আন্দোলনকারীরাও তাদের সন্তান হারানোর ভয়ে সুড়সুড় করে পিছন দিকে সরতে শুরু করবে। এই ভাবে কিছু কিছু করে কয়েক জন আন্দোলনকারী নিজে থেকে গুটিয়ে গেলেই, দেখবে, আস্তে আস্তে পুরো আন্দোলনটাই থিতিয়ে যাবে। লোক না থাকলে, কে আন্দোলনটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে শুনি? আর তা হলেই….
নতু বিস্ময় মাখানো গলায় বলল, তাদের ছেলেমেয়েদের মারব। ওরা তো আমাদের সন্তানের মতোই। আমাদের সামনেই বড় হয়েছে! আমাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই খেলাধুলো করেছে। ওদের মারব!
সেই তুখোড় নেতা বললেন, এর নাম রাজনীতি। লক্ষ্য স্থির রাখো। কী চাইছ, সেটা ভাবো। কী ভাবে পাচ্ছ, সেটা ভেবো না। তুমি যদি ওদের প্রাণে মারতে না চাও, মেরো না। একটা হাত কেটে দাও। দুটো চোখ উপড়ে নাও কিংবা জিভটা টেনে বার করে ফেলো। যা হোক, কিছু একটা করো।
আমতা আমতা করে নতু বলল, সে নয় করব। কিন্তু এ কাজ করতে গেলে তো…
– একটু সাবধানে করতে হবে। তবে এ কাজে কিন্তু বাইরের লোককে লাগানো যাবে না। স্থানীয় লোক দিয়েই করাতে হবে। আর যাদের দিয়ে করবে, তারা যেন একদম বিশ্বস্ত এবং বাছাই করা হয়। এটা মনে রেখো। বুঝেছ?
– কিন্তু তেমন লোক!
– কেন? তপন আছে তো… তপন, সমীর, অনিল, তাপস, সুহৃদ…
নামগুলো শুনে নেচে উঠল নতু। বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, সুহৃদদা! সুহৃদদা কিন্তু এ সব ব্যাপারে একেবারে এক নম্বর। দলের জন্য সব করতে পারে ও।
– তা হলে ওকেই দায়িত্বটা দিয়ে দাও। দরকার হলে ওকে ওর মতো করে কাজটা করতে বলো। তুমি শুধু ওভারঅল ব্যাপারটা একটু দেখো, কেমন?
নতু বলল, ঠিক আছে, আমি সুহৃদদাকে বলছি।
সি পি এমের সেই তুখোড় নেতা বললেন, বলছি না, ওকে এক্ষুনি বলো। এক্ষুনি। বলো, যত তাড়াতাড়ি পারে কাজটা যেন শুরু করে দেয়। না হলে আমাদের সামনে কিন্তু সমূহ বিপদ। বুঝেছ?
নতু বলল, হ্যাঁ বুঝেছি। কোনও চিন্তা করবেন না। আমি আজই সুহৃদদার সঙ্গে কথা বলছি।
ও পার থেকে লাইনটা কেটে দিলেন সেই নেতা। নতু ভাবতে লাগল, সবার চোখ এড়িয়ে কী ভাবে ও সুহৃদদার কাছে যাবে। কারণ, ২৫ সেপ্টেম্বরের ওই ঘটনার পর থেকে ওদের সবার ওপরে এখন আঁধারগ্রাম কৃষিজমি বাঁচাও কমিটির লোকেরা খুব নজর রেখেছে। কিন্তু কী করা যাবে! উপর তলার নির্দেশ বলে কথা! অমান্য তো করা যাবে না। যা হয় দেখা যাবে… মা কালীর নাম নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল নতু।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!