।।পর্ব- ২৯।।
২০০৬-এর ১৮ ডিসেম্বর মধ্যরাতে উঠে এ ওকে সে তাকে ডেকে নিয়ে আগের দিনের কথা মতো অন্ধকার থাকতে-থাকতেই পাঁচ জনের দলটা চুপিচুপি বাজেমেলিয়া গ্রামে এসে পৌঁছল। ফাঁকা মাঠের একটা বড় গাছের আড়ালে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করতে লাগল, কে আসে! কে আসে!
জোনাকি মিটমিট করে জ্বলছে। হঠাৎ হঠাৎ ডেকে উঠছে দু’-একটা পাখি। একটু একটু করে অন্ধকারে চোখ সয়ে আসছে। দশ মিনিট গেল। কুড়ি মিনিট গেল। আধ ঘণ্টাও পার হয়ে গেল। মশা কামড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে পা বেয়ে উঠে আসছে ডেঁয়ো পিঁপড়ে। কিন্তু এমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না, যার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়।
ওরা চুপচাপ বসে আছে। বারবারই ওদের মনে হতে লাগল, তাদের উদ্দেশ্য বুঝি আজ আর সফল হবে না। কেউ এলেও, সে হয়তো আন্দোলনকারীদের ছেলেমেয়ে হবে না। হবে স্বয়ং আন্দোলনকারীই। তখন? দ্বিতীয় স্টেপ হিসেবে যেটা ওপর মহল থেকে নির্দেশ আছে এবং যেটার জন্য তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা চতুর্গুণ বেড়ে গেছে, মধ্যরাত থাকতে উঠে এখানে আসার জন্য ছটফট করেছে, সেটাও বুঝি তাদের মাঠেই মারা যাবে। শেষ পর্যন্ত কোনও মেয়ে নয়, ছেলেই আসবে। তা হলে কী করব! তৃতীয় স্টেপ হিসেবে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে জাপটে ধরে, আমাদের মধ্যে থেকেই কেউ তার গলা টিপে ধরব! তার পর কাজ হাসিল হয়ে গেলে, গলায় দড়ি বেঁধে লটকে দেব কোনও গাছের ডালে!
কিন্তু সে যদি আন্দোলনকারী হয়! কিংবা অন্য কোনও সাদামাঠা গ্রামবাসী! অথবা বয়স্ক কেউ! তখন? ওপর থেকে নির্দেশ আছে, আন্দোলনকারীদের কাউকে নয়, তাতে আন্দোলনকারীদের একজন কমবে ঠিকই, কিন্তু আখেরে আন্দোলনটা আরও জোরদার হবে। গ্রামের অন্য কাউকে মেরেও কোনও লাভ নেই। মারতে হবে সক্রিয় আন্দোলনকারীদের ছেলে বা মেয়েকে। তাদের খতম করেই তাদের বাবা-মায়েদের শিক্ষা দিতে হবে। সুতরাং…
তপন হঠাৎ ঠোঁটের কাছে আঙুল নিয়ে ইশ…শ…শ… করে চাপাম্বরে বলে উঠল, চুপ চুপ চুপ।
তপনের ইশারায় বাকিরাও দেখল, অন্ধকার ভেদ করে ছায়া ছায়া মতো কে যেন একজন দূর থেকে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। একে অন্ধকার, তার উপরে ঘন কুয়াশা। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ছেলে! না মেয়ে! মাথা-মুড়ি দেওয়া। গায়ে চাদর জড়ানো। আরও কাছে আসতেই অনিল বলল, এটা ইয়ের মেয়ে না?
তপন বলল, হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে!
প্রদীপ বলল, বড্ড বাড় বেড়েছে। কাল তো ও সারা দিন ওখানেই ছিল। বাচ্চাদের ওই অনশনের ওখানে।
সমীর বলল, ও-ই তো সে দিন ঝাঁটা-হাঁসুয়া নিয়ে মেয়েদের মিছিলের সবার প্রথমে ছিল। আবার স্লোগান দিচ্ছিল।
প্রদীপ বলল, স্লোগান কী রে, ও-ই তো সে দিন পুরো দলটাকে লিড করছিল।
তপন বলল, ও এখন নেত্রী হয়েছে।
সুহৃদ বলল, আস্তে বল। শুনতে পাবে। ওই ভাবে মুখ বাড়াচ্ছিস কেন? দেখে ফেলবে যে! আড়ালে আয়। বলে, নিজেও গাছের আড়ালে চলে গেল। তার পর উকি মেরে-মেরে দেখতে লাগল। জিজ্ঞেস করল, কী নাম যেন মেয়েটার?
তপন বলল, কী… তাপসী… না কী যেন নাম।
ততক্ষণে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মেয়েটা। মেয়েটার হাতে একটা হাতলওয়ালা পাঁচ কিলো রঙের ডিবে। প্রদীপ বলল, হাতে ওটা কী রে?
অনিল বলল, বুঝতে পারলি না?
প্রদীপ বলল, না।
সমীর বলল, এত সকালে লোকে কী করতে মাঠে যায়?
প্রদীপ বলল, ও, তাই বল।
আফসোসের গলায় নিচুস্বরে তপন বলে উঠল, কোনও বাচ্চাই তো এল না! কী করবি? একে ধরবি?
অনিল বলল, না ধরার কী আছে? আন্দোলন করলেও ও তো বাচ্চাই।
প্রদীপ মুখ বিকৃত করে বলল, বাচ্চা! না চৌবাচ্চা? আজ করলে, কালকে মা হয়ে যাবে… বাচ্চা…
সমীর বলল, অ্যাই, চুপ করবি? শোনো তপনদা, ওর বাবা-মা কিন্তু মিটিং-মিছিলে যায়। পঁচিশে সেপ্টেম্বরের রাতেও বি ডি ও অফিসের সামনে ছিল। আমি দেখেছি। সেই সুবাদে ও তো আন্দোলনকারীদের বাচ্চাই হল, না কী বলো? কী, ধরব?
এই মিশনের শেষ কথা বলবে সুহৃদ। তাই কেউ কিছু না বলে সবাই সুহৃদের মুখের দিকে তাকাল। সুহৃদ বলল, ঠিকই বলেছিস। ধর। এতক্ষণ ধরে মশার কামড় খেয়েছি, এ বার আমরা খাই। ও পাশ দিয়ে মেয়েটা মাঠের দিকে চলে যেতেই পিছু পিছু পা টিপে টিপে ওরা পাঁচ জনই এগোতে লাগল।
খানিকটা যেতেই তপন দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে জাপটে ধরার আগেই মেয়েটি হঠাৎ ছুটে আসা কয়েকটা পায়ের শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়ানোর মুহূর্তেই, জাপটে ধরল তপন। ফলে একেবারে সামনাসামনি। মেয়েটা চিৎকার করে ওঠার আগেই সমীর এসে চেপে ধরল মুখ। জল-ভরা হাতের ডিবেটা দিয়ে বাড়ি মারতে যাওয়ার আগেই সুহৃদ সেটা কেড়ে নিয়ে ফেলে দিল।
নিশ্চয়ই ওরা কোনও কু-মতলবে এসেছে, বুঝতে পেরে, ওদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য তাপসী তখন হাত-পা ছুড়ে পালানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। প্রদীপের গায়ে জড়ানো ছিল পাতলা চাদর। মেয়েটিকে ও রকম করতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে গা থেকে চাদরটা খুলে, সেটাকে দড়ির মতো করে নিল সে।
সামনের দিকে মেয়েটি যখন এলোপাথাড়ি হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে পিছন দিকে ফিরে দৌড়তে যাবে, তখনই ওদের তিন জন ছুটে গিয়ে পিছন দিক থেকে ফের ধরে ফেলল ওকে। চাদরটা দিয়ে ওর হাতটা পিছমোড়া করে বাঁধতে যাচ্ছিল প্রদীপ, তপন বলল, আরে গাধা, হাত বাঁধছিস কেন? তাতে অসুবিধে হবে। ছাড় ছাড়।
– ছাড়লে, দাদা সামলাতে পারবে? এ যা মেয়ে…
– খুব পারবে। না পারলে আমরা আছি কীসের জন্য? দরকার হলে দু’দিকে দু’জন হাত ধরে থাকবি।
মেয়েটিকে ওরা জাপটে ধরে ছিল। কথা বলতে বলতে বুঝি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। তাই সুযোগ বুঝে, ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই, এক ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুট দিল সে। পিছনে পাগলা কুত্তার মতো তাড়া করল ওরা। কিছুটা যেতেই মেয়েটা হুমড়ি খেয়ে ছিটকে পড়তেই ওরাও ঝাঁপিয়ে পড়ল। মেয়েটা যদি চিৎকার করে ওঠে! তখন?
অনিল ঝটপট পকেট থেকে রুমাল বার করে মেয়েটির মুখে জোর করে ঠেসে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, বড্ড বাড় বেড়েছিস, আন্দোলন করবি, না? জমি দিবি না, না? তোর জমি আমরা দখল করব।
ধস্তাধস্তি করতে করতে রীতিমত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে মেয়েটির সালোয়ার-কামিজ ছিঁড়ে ফালাফালা করে ফেলল সমীর আর প্রদীপ।
অনিলের দিকে তাকিয়ে সুহৃদ বলল, দখল করবি, না ভোগ করবি?
আকাশ তখন অনেকটা পরিষ্কার হয়ে এসেছে। মেয়েটি আর পারছে না। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসার জোগাড়। হাত ছুড়ছে। পা ছুড়ছে। ঠিক তখনই তপনের ইশারায় অনিল ওর হাত দুটো মাথার উপর দিকে জোর করে টেনে নিয়ে মাটির সঙ্গে চেপে ধরল। আর প্রদীপ ওর পা দুটো।
কিন্তু কে আগে যাবে! তপন বলল, দাদা, থালি তো রেডি। এ বার কাঁটা-চামচ বার করো। সুহৃদ কোনও কথা বলল না। সটান ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটির ওপরে। মেয়েটার শরীরে তখন আর কোনও সাড় নেই। ফলে, সুহৃদ একাই কাবু করতে পারবে বুঝতে পেরে, যে-দু’জন মেয়েটির হাত-পা চেপে ধরে ছিল, তারা ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল।
তপনের দিকে তাকিয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে সমীর বলল, দাদা লাইনে থাকুন। এর পর কিন্তু আপনার পালা।
তপন বলল, আর তোরা?
ও বলল, আপনি আগে খান। আপনি এঁঠো না করলে ভাইয়েরা প্রসাদ খায় কী করে?
আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস উত্তাল ২৮
একে একে পাঁচ জনেই যখন উঠে দাঁড়িয়েছে, তখন আর মেয়েটির ওঠার ক্ষমতা নেই। মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরোতে শুরু করেছে। তবু তারই মধ্যে গোঙাতে গোঙাতে বলল, আমি তোদের ছাড়ব না। আমি তোদের অবস্থা কী করি দ্যাখ, দাঁড়া, তোদের হচ্ছে।
সুহৃদ বলল, এ কী রে, ও নাকি আমাদের দেখবে।
তপন বলল, এতক্ষণ ধরে পাঁচ জনকে দেখলি, তাতেও আশ মেটেনি? আবার দেখবি?
অনিল বলল, ও কিন্তু আমাদের চেনে। ও যদি সবাইকে বলে দেয়!
সুহৃদ বলল, হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল! আরে গাধা, মেয়েদের সঙ্গে তুই যতই এ সব কর না কেন, মেয়েরা কখনও মুখ ফুটে এগুলি কাউকে বলবে না। আর সে যদি অবিবাহিত হয়, তা হলে তো কোনও কথাই নেই। নিজের একটা মানসম্মান আছে না? বিয়ে-থা করতে হবে তো… নাকি?
মেয়েটি বলল, তোরা আমাকে চিনিস না, আমি তোদের ছাড়ব না। আমি থানায় যাব।
হো হো করে হেসে উঠল তপন, এ কী বলে রে, ও নাকি থানায় যাবে। থানায় কার কাছে যাবি? যার কাছে যাবি, সে-ই তো আমাদের লোক। আমাদের একেবারে কেনা গোলাম রে। আমরা উঠতে বললে, উঠবে। বসতে বললে, বসবে। কার কাছে যাবি? উরিব্বাবা রে, আমাদের ভয় দেখাচ্ছে… বিকৃত মুখভঙ্গি করে রসিকতা করল সে।
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে যাচ্ছিল মেয়েটি। দাঁতে দাঁত চেপে কোনও রকমে বলল, আমি ভয় দেখাচ্ছি না, আমি তোদের ছাড়ব না।
ওর কথা শুনে হঠাৎ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল তপনের। মেয়েটি ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। তপন ঝট করে তার থুতনি চেপে বলল, এই মাগি, তুই আমাদের ছাড়বি না কী রে, কী করবি? কী করবি? বল, কী করবি?
ও টলতে টলতে বলল, আমি সবাইকে বলে দেব।
– কাকে বলবি? কাকে? কাকে? কাকে?
– আমি তোদের ছাড়ব না। দেখিস কী করি…
– আবার কথা? আর একটা কথা বললে, একেবারে টুঁটি চেপে দেব।
– তোরা কিচ্ছু করতে পারবি না। দেখিস, আমি কী করি…
– কী করবি? কী করবি তুই? দেখলি তো আমরা কী করলাম। এর পরেও যদি ফের জমি নিয়ে কোনও রকম নক্কা-ছক্কা করিস তো একেবারে জানে মেরে দেব।
ভাল করে কথা বলতে পারছে না। তবু কেটে কেটে মেয়েটা কোনও রকমে বলল, দেখিস, কে কাকে জানে মারে।
– কে মারবে? তুই? তুই মারবি আমাদের? এত সাহস…
প্রদীপ বলে উঠল, অত কথা কীসের? দে না শালিকে শেষ করে।
হাতের তালুর উলটো পিঠ দিয়ে ঠোঁটের কোল মুছতে মুছতে মেয়েটি বলল, তোরা এটুকুই করতে পারিস। তার থেকে বেশি কিছু করার ক্ষমতা তোদের নেই।
– ক্ষমতা নেই? দেখবি? দেখবি? বলতে বলতে মেয়েটির গলা টিপে ধরল তপন।
মেয়েটা তখনও ঘোরের মধ্যে সেই একই কথা বলে যাচ্ছে।
সুহৃদ বলল, দে না শালা শেষ করে।
তপন আরও জোরে গলা টিপে ধরতেই মেয়েটি দু’হাত দিয়ে ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল। পিছন দিকে সরতে সরতে মাটিতে পড়ে গেল সে। সঙ্গে সঙ্গে তপনও হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে দু’হাত দিয়ে টিপে ধরল তার গলা।
মেয়েটা একেবারে কাবু হয়ে গেছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। তবু, দম বন্ধ হয়ে আসছে দেখে, কাটা পাঁঠার মতো দাপাদাপি করতে করতে, কয়েক মুহূর্ত তিরতির করে কেঁপে একদম স্থির হয়ে গেল।
তপনের সে দিকে হুঁশ নেই। তখনও প্রচণ্ড রাগে সে ফুঁসছে। গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে টিপে আছে মেয়েটির গলা। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে।
সমীর বলল, ওঠো। কাজ হয়ে গেছে।
তপনের দিকে তাকিয়ে সুহৃদ বলল, শেষ তো?
মেয়েটির নাকের কাছে আঙুল নিয়ে তপন দেখল, শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে কি না। তার পর বলল, শেষ।
– তা হলে ওঠ। বসে আছিস কেন?
– ও হ্যাঁ… বলেই, উঠে দাঁড়িয়ে তপন বলল, একে কিন্তু এখানে এ ভাবে ফেলে রেখে যাওয়া ঠিক হবে না।
অনিল বলল, তা হলে?
তপন বলল, আহা, বেচারি ঠান্ডার মধ্যে কষ্ট পাবে না?
প্রদীপ বলল, ঠিক বলেছ। কিন্তু লেপ-কাঁথা কোথায় পাব?
সুহৃদ বলল, লেপ-কাঁথা না পা, আগুনের একটু উত্তাপ তো দিতে পারিস, নাকি?
সুহৃদ কী বলতে চাইছে, সেটা বুঝতে আর বাকি রইল না কারও। সমীর ছুটে গেল খানিক দূরে। যেখানে টাটাদের ঘেরা জমি পাহারা দেয় বেশ কিছু ছোকরা। এটা তো কোনও গোডাউন নয় যে, মালপত্র আছে। ফাঁক পেলেই কেউ কিছু নিয়ে পালাবে। সেই ভয়ে যক্ষের মতো বুকে আগলে সব কিছু পাহারা দিতে হবে! এখানে কিচ্ছু নেই। সীমানা ঘিরে শুধু বেড়া দেওয়া। যে দিকে চোখ যায়, সব খাঁ খাঁ। এই শীতে খোলা আকাশের নীচে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। তবু সরাসরি মাথায় হিম পড়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য তাদের বসার মতো সামান্য একটু ছাউনিও করে দেয়নি কেউ। তাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পাহারা দেওয়ার কথা থাকলেও, রাত নামলেই সব এক জায়গায় এসে জড়ো হয়। কাঠকুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহায়। গালগল্প করে।
এত সকালে সমীরকে দেখে তারা অবাক। ওরা জানে, কনট্র্যাক্ট নিয়ে দৈনিক পঁয়ষট্টি টাকা রোজে যে তাদের এই রাত-পাহারাদারের কাজ দিয়েছে, সেই তপনদার খুব কাছের মানুষ এ। ওরা ভেবেছিল, মাঝে মাঝেই রাত-বিরেতে যেমন তপনদার লোকেরা হানা দিয়ে দেখে যায়, ওরা কী করছে, আজও হয়তো সে রকম ভাবেই এ এসেছে, সারা রাত ওরা ঠিকঠাক মতো পাহারা দিচ্ছে কি না কিংবা পালা করে কেউ ডুব দিচ্ছে কি না অথবা শুধু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রোজের টাকা নিয়ে যাচ্ছে কি না, সেটা দেখার জন্য। তাই একজন বলল, আমরা সবাই জেগে আছি সমীরদা। কেউ ঘুমোইনি। দেখে নিতে পারো।
সমীর বলল, না রে, সে জন্য নয়। তোরা তো কাঠকুটো জ্বালাবার জন্য কেরোসিন তেল আনিস। আছে নাকি?
ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, কেন থাকবে না দাদা? আজই তো পাঁচ লিটার কেনা হয়েছে। কীসে নেবেন?
সমীর বলল, কিছু তো আনিনি।
সে তড়িঘড়ি উঠে গিয়ে ক’হাত দূরে রাখা জারিকেনটা নিয়ে এসে তার হাতে দিতে দিতে বলল, ঠিক আছে, এই জারটা ধরেই নিয়ে যান। সকাল তো হয়ে গেছে। একটু পরেই আমরা চলে যাব। আমাদের আর লাগবে না। বেলার দিকে আমরা কেউ গিয়ে না হয় আপনার কাছ থেকে জারটা নিয়ে আসবখ’ন।
ফেরার সময় মুখ কাঁচুমাচু করে ওদের দিকে তাকিয়ে সমীর বলল, এটা আবার কাউকে বলাবলি করিস না কিন্তু…
আগুন পোহাতে পোহাতে ও দিক থেকে অন্য আর একজন বলে উঠল, এটা আবার বলার কী আছে? নিয়ে যান দাদা, নিয়ে যান।
আরও পড়ুন: সাহিত্যে নোবেল পেলেন দক্ষিণ কোরিয়ার হান কাং
সমীর গিয়ে দেখে, অনিল আর প্রদীপ মিলে গাছের বেশ কিছু ডালপালা জোগাড় করে রেখেছে। ওর হাতে কেরোসিনের জার দেখে তপন বলল, এখানে জ্বালালে কিন্তু দূর থেকেও লোকে আগুন দেখতে পাবে।
সমীর বলল, তাতে কী হয়েছে? লোকে ভাববে, পাহারাদাররা বুঝি আগুন পোহাচ্ছে।
– না রে, রিস্ক নেওয়ার কী দরকার? সন্দেহ করতে পারে!
– তা হলে?
– আশপাশে বড় কোনও গর্তটর্ত নেই?
সমীর বলল, আসার সময় কিন্তু টর্চের আলোয় দেখেছিলাম, ওই দিকটায় বেশ ডিপ করে একটা গর্ত খোঁড়া আছে। কেন? পুঁতে দেবে নাকি?
অনিল বলল, হ্যাঁ, পোঁতার জন্যই তো সুহৃদটা তোকে দিয়ে কেরোসিন তেল আনাল!
– তবে?
তপন বলল, কথা বাড়াস না। চল চল। কোন দিকে?
সমীর বলল, চলো দেখাচ্ছি।
– অ্যাই, তোরা ধরাধরি করে বডিটা নিয়ে আয় তো, নিয়ে আয়, নিয়ায়। চল চল। পা চালা। পা চালা। একদম সময় নষ্ট করিস না। চল চল। আলো ফুটতে শুরু করে দিয়েছে। এক্ষুনি লোকজন সব বেরিয়ে পড়বে। বলেই, হনহন করে সমীরের পিছু পিছু হাঁটা দিল তপন। তপনের পিছু পিছু সুহৃদ।
দ্রুত পা ফেলে সবার আগে যেতে যেতে সমীর ভাবল, দুম করে কথাটা না বললেই ভাল হত। ঠিক কোনখানটায় যে গর্তটা দেখেছিল, সেটা খুঁজে পেলে হয়! ভাবছে আর এ দিকে ও দিকে দেখতে দেখতে এগোচ্ছে।
আচ্ছা, সবাই তার পিছনে পিছনে আসছে তো! নাকি কেউ আবার কেটে পড়ল! মনে হতেই, সমীর পিছন ফিরল। দেখল, সবাই-ই তার পিছু পিছু আসছে। একদম সবার পিছনে অনিল আর প্রদীপ। একজন মেয়েটির দুটো হাত, আর একজন মেয়েটির দুটো পা ধরে চ্যাংদোলা করে কোনও রকমে কুঁততে কুঁততে নিয়ে আসছে। যে ভাবে ওরা আসছে, তাতে মনে হচ্ছে, ওটা কোনও রোগাপটকা মেয়ে নয়, একটা দশমনি বস্তা। মানুষ মরে গেলে যে কেন এত ভারী হয়ে যায়, কে জানে!
কিছুটা যেতেই ওই গর্তটা নয়, কারণ সমীরের যত দূর মনে পড়ছে, ওই গর্তটা ছিল খুবই সরু। এমনিই লম্বা পা ফেলে ওটা ডিঙিয়ে পার হয়েছিল সে। ওটা না হলেও, ঠিক ওই রকমই আর একটা গর্ত পেয়ে গেল ও। এটা আরও চওড়া। লম্বায়ও এক মানুষের বেশিই হবে। কে বা কারা, কেন যে এই গর্তগুলো খুঁড়ে রেখেছে, ও তা জানে না। জানতেও চায় না।
গর্তটার একদম পাশে দাঁড়িয়ে তপন বলল, শোন, হুটপাট করে কাজ করিস না। এমন ভাবে পোড়া, যাতে মুখটা ঠিকঠাক থাকে।
অনিল বলল, কেন? মুখটা ভুলতে পারছিস না, না?
– এই, এখন একদম ইয়ার্কি মারিস না তো… কাজ কর। কাজ কর। ফিরছে না দেখে সকালে যখন ওর বাড়ির লোকেরা ওকে খুঁজতে বের হবে, খুঁজতে খুঁজতে যখন এখানে আসবে, তখন যাতে ওর মুখটা দেখে সবাই ওকে চিনতে পারে, সে জন্য বলছি।
– তাতে লাভ?
– ওরা বুঝতে পারবে, আন্দোলন করার পরিণামটা কী। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। কী? এ বার বুঝেছিস?
সুহৃদ বলল, তোর মাথায় এত বুদ্ধি!
তপন বলল, দাদা, এটুকু বুদ্ধি না থাকলে এখানে কি রাজনীতি করতে পারতাম?
ওরা যখন কথা বলছে, সমীর, প্রদীপ, অনিলরা তখন মেয়েটির নিথর দেহটাকে ওই গর্তের মধ্যে ফেলে, তার হাঁটুর উপর থেকে বুক অবধি কাঠকুটোগুলো চাপিয়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিল।
চলবে…