ধারাবাহিক উপন্যাস: উত্তাল তৃতীয় পর্ব

গোটা পৃথিবী জুড়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জমি নিয়ে যত কেলেঙ্কারি ঘটেছে, তার সালতামামী দিয়ে একটি অসামান্য উপন্যাস ‘উত্তাল…

তৃতীয় পর্ব

ভিজে কাক হয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘর-লাগোয়া মাটির উঁচু দাওয়ায় উঠে পড়ল তেরো নম্বর। দাওয়াটাও খানিকটা ঘরের মতো। এ পাশে ও পাশে দরমা দিয়ে ঘেরা। যাতায়াতের জন্য মাঝখানে বেশ খানিকটা ফাঁকা। দরজা মতো। কত বছর আগে যে বাবা এটা লাগিয়েছিলেন ওর মনেই পড়ে না। একেবারে তেলকাষ্টি পড়ে গেছে। ভেঙে ভেঙে পড়ছে। এক দিকে রান্না হয়। অন্য দিকে একটি তক্তপোশ। পায়ার নীচে ইট-টিট দিয়ে উঁচু করা। তার নীচে উনুন ধরানোর কাঠকুটো, শুকনো পাতা-টাতা ডাঁই করে রাখা। এমনি দিনে কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু মুষলধারে এ রকম বৃষ্টি হলে দু’টালির ফাঁক চুঁইয়ে কিংবা ভাঙা টালির ফাটল দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে ঘর ভাসিয়ে দেয়। তখন এখানে সেখানে হাঁড়ি-পাতিল পাততে হয়। দেওয়াল বেয়ে তিরতির করে জল পড়ে খাটের বিছানাপত্র, নীচে রাখা এটা ওটা সেটা, সব, সব ভিজিয়ে দেয়। ভিজিয়ে দেয় এলোপাথাড়ি জলের ঝাপটাও।
তেরো নম্বর কত বার তার বউকে বলেছে, জোরে বৃষ্টি নামলে খাটের উপরে বড় প্লাস্টিকটা বিছিয়ে দিতে। ঘরে যে প্লাস্টিক শিট নেই তা তো নয়। তখন অত টাকা দিয়ে ওয়েল ক্লথ কেনার সামর্থ্য ছিল না। তাই মেয়ে হওয়ার পর হাট থেকে নগদ পয়সা দিয়ে বড় একটা প্লাস্টিক শিট নিয়ে এসেছিল সে। যাতে গোটা খাট জুড়ে চাদরের তলায় ওটা বিছিয়ে দিতে পারে। তা হলে মেয়ে হিসি করলেও আর ভয়ের কিছু নেই। চাদর ভিজলেও লেপ-কাঁথা ভিজবে না। সব কিছু নামিয়ে শুকোতেও দিতে হবে না।
ওটা দেখে খুব খুশি হয়েছিল বউ। শুধু ওটা কেন, ঘরে যে কোনও জিনিস আনলেই ও খুশি। এমনিতে তো সচরাচর কিছু আনতে পারে না। কিন্তু প্লাস্টিক শিটটা ধরেই বউয়ের মুখটা কেমন পানসে হয়ে গিয়েছিল– এ মা, এটা কী এনেছ? এত পাতলা!
ও বলেছিল, পাতলা তো কী হয়েছে? অনেক বড়। ডবল করে পাতবে। শেষ বেলায় একজনের কাছে এটুকুই পড়েছিল বলে কম দামে দিয়ে দিল।
– টিকবে?
– টেকালেই টিকবে। সবই তোমার হাতে।
বউয়ের হাতে গোটা সংসারের ভার তুলে দিয়ে, কী ভাবে বউ-বাচ্চার মুখে দুটো খাবার তুলে দেওয়া যায়, একটু হাসি ফোটানো যায়, সে জন্য দিন-রাত প্রাণপাত করত সে। তাতেও বাধ সাধল সরকারি সিদ্ধান্ত।
এক লপ্তে প্রচুর জমি চাই। সেখানে গড়ে উঠবে বিশাল গাড়ি কারখানা। যেখানে পুরোনো ধ্যাড়ধেড়ে গাড়ির দামই দেড়-দু’লাখ টাকা। সেখানে ওরা নতুন গাড়ি দেবে মাত্র এক লাখ টাকায়। ভাবা যায়! সেই কারখানায় চাকরি পাবে এলাকার হাজার হাজার ছেলেমেয়ে। তা, গোটা ভূ-ভারতে আর কোথাও জমি খুঁজে পেল না তারা। নজর পড়ল তাদের এই জমির উপরেই!
একদিন নোটিস জারি করে জানিয়ে দিল, তাদের জমি অধিগ্রহণ করা হবে। বর্তমানে যা দাম যাচ্ছে, তার থেকে একটু বেশিই দেবে প্রশাসন।
কেউ রাজি হল। কেউ হল না। যারা রাজি হল না, প্রশাসনিক মহল থেকে তাদের বোঝানো হল, এখানে কারখানা হলে তোমাদেরই লাভ।
কেউ কেউ প্রশ্ন করেছিল, লাভ মানে? আমাদের ছেলেমেয়েরা কি ওখানে চাকরি পাবে?
ওরা বলেছিল, আপনারা এত দিন চাষবাস করতেন। স্বাধীন ছিলেন। আপনারা চাকরি করতে যাবেন কেন? এখনও স্বাধীন ভাবেই ব্যবসা করবেন। জানবেন, কোথাও যখন কোনও বড় শিল্প গড়ে ওঠে, তার আশপাশে গড়ে ওঠে বহু অনুসারি শিল্প। সেগুলোর কোনও একটা করবেন। যদি তাও করতে না চান, কারখানার গেটের কাছে চা-পান-বিড়ি, আলুর দম-পাউরুটি-ঘুঘনির দোকান করে বসে যাবেন।
বীজেশ বলেছিল, আমি না-হয় বসলাম। কিন্তু বাকিরা?
– আপনি একা কেন? আপনারা সবাই মিলে বসবেন।
– এত লোক যদি পর পর দোকান করে বসে, কিনবে কে?
– কেন? এখানে যারা চাকরি করবে, তারা।
বীজেশ জানতে চেয়েছিল, ক’জন চাকরি করবে?
– হাজার বারোশো তো হবেই।
– আমরা এখানে কত জন চাষি আছি জানেন?
– কত জন?
– সব মিলিয়ে তো প্রচুর। আমাদের মতো যারা জমি দিতে চাইছে না, তাদের সংখ্যাই তো কম করে চার হাজারের ওপর।
ওরা বলেছিল, সে হতে পারে! আগে টাকা দেওয়া শুরু হোক। তখন দেখবেন পুরো ছবিটাই পালটে গেছে। যারা জমি দিতে চাইছে না, তারাও তখন সুরসুর করে টাকা নিতে ছুটে আসবে। আর অনিচ্ছুক চাষিদের সংখ্যাটা দিনকে দিন কমতে কমতে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকবে।
– কত কমবে?
– কত কমবে, সেটা বড় কথা নয়। যদি একজনও না কমে, তাতেই বা কী? সবাই তো আর দোকান করবে না।
– হ্যাঁ, কিছু লোক দোকান করবে, আর বাকিরা আঙুল চুষবে, তাই তো?
বীজেশকে গলার স্বর চড়াতে দেখে ওদের মধ্যে থেকেই একজন বলেছিল, দেখুন, আপনাকে একটা কথা বলি, আমরা তো এই সব কাজই করি। বহু লোককে দেখেছি, আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। হাতে যেই একসঙ্গে আচমকা অনেকগুলো কাঁচা টাকা চলে আসবে, দেখবেন, সবাই এখান থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে, অন্য জায়গায় পাড়ি দেবে। এ দিকে ফিরেও তাকাবে না।
বীজেশ মুখে কিছু বলেনি। মনে মনে বলেছিল, সেটা আপনারা ভাবছেন। কারণ, আপনাদের সঙ্গে তো মাটির কোনও যোগ নেই। থাকলে বুঝতেন। এটা আমাদের কাছে শুধু মাটি নয়, আমাদের মা।#

চলবে…

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস: উত্তাল দ্বিতীয় পর্ব  

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!