ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ৭

গোটা পৃথিবী জুড়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জমি নিয়ে যত কেলেঙ্কারি ঘটেছে, তার সালতামামী দিয়ে মাত্র আড়াই দিনে লেখা ৮৬,৩৮৫ শব্দের অসামান্য একটি উপন্যাস ‘উত্তাল’ নিয়মিত প্রকাশ করা হবে।

।।সাত।।

একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেছিল তেরো নম্বর। ভেবেছিল, গোপালদা তার সামনে গরম গরম এক কাপ চা ধরবেন। এখান থেকে যাওয়ার পরে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সুভাষগ্রামের নবীন মাস্টারের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল সে। লোকটা পড়াশোনা করা লোক। তিন মাস অন্তর একটা নাটকের পত্রিকা বার করেন। সে পত্রিকার উপদেষ্টা বিখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী।
সেই পত্রিকাকে ঘিরে প্রতি মাসের শেষ রবিবার তাঁদের বাড়িতে একটা সাহিত্যসভা বসে। সেখানে যেমন স্থানীয় নাট্যপ্রেমী, নাট্যমোদীরা আসেন, আসেন দূর-দূরান্ত থেকে অনেক বিশিষ্টজনেরাও। কেউ সদ্য লেখা কোনও নাটকের অংশ পড়ে শোনান। কেউ অন্য ভাষায় লেখা বিখ্যাত কোনও নাটকের বাংলা তর্জমা করে নিয়ে আসেন। কেউ শোনান, এই মুহূর্তে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী নাটক কোনটি। কেউ আবার নাট্য সমালোচনাও করেন। কেউ কেউ নিয়ে আসেন গণনাট্য, গ্রুপ থিয়েটার, বহুরূপী, এপিক থিয়েটার, নাট্যচিন্তা, সায়ক নাট্যপত্র, নাট্যসৃজনী-র মতো এক-একটা নাটকের পত্রিকা। একজন তো ক’দিন আগে নিয়ে এসেছিলেন পথ নাটিকার একটা পাণ্ডুলিপির ফোটো কপি। মুখে ‘সাহিত্যসভা’ বললেও মূলত নাটকই হচ্ছে ওঁদের প্রধান আলোচ্য বিষয়। যখন ওঁদের আলোচনা চলে, তখন ডিমের অমলেট, মুড়িমাখা, সিঙ্গারা যত বার আসে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আসে দুধ চা। লিকার চা। লেবু চা।
চা-টা খুব চলে ওখানে। দুপুর বারোটাতেও চা হয়। রাত এগারোটাতেও চা হয়। আর সকালে তো কথাই নেই। ঘুম ভাঙার আগেই মুখের কাছে এক কাপ চা হাজির। আর সেই চা-টা ওকে দিয়ে যান ওর গোপালদা। ও বাড়ির বহু পুরোনো কাজের লোক। তিনি যে ও বাড়ির কাজের লোক, সেটা ও জেনেছে অনেক পরে। কারণ, শুধু ও নয়, ও বাড়িতে যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে আসছেন, বা মাঝেমধ্যে যাঁরা রাত্রে থেকেও যান, তাঁরাও অনেকে এটা জানেন না। কাউকে বলে না দিলে কেউই বুঝতে পারবেন না যে, ও এ বাড়ির কাজের লোক। মাস্টার মশাইও কখনও সে কথা মুখ ফুটে কাউকে বলেন না। সেই গোপালদাই এই বুড়ো বয়সে ওকে চায়ের নেশা ধরিয়ে দিয়েছেন। এ ক’মাসে এমন হয়েছে, সকালে চা না হলে ওর চোখ থেকে যেন ঘুমই যায় না।
কিন্তু এ বাড়িতে চায়ের কোনও পাট নেই। তার বউ বড় এক জাম বাটিতে করে দুধ-মুড়ি দিয়ে গেল। সে তো অবাক। মুড়ি না‌ হয় ঠিক আছে। কিন্তু ও দুধ পেল কোথায়!
তার খাওয়া যখন শেষের দিকে, তখন তার বউ সামনের মাঠ থেকে কোঁচড় ভরে কলমিশাক তুলে এনে দাওয়ায় বসে সেগুলো বাছতে বাছতে মুখ না তুলেই বলল, একটা খারাপ খবর আছে।
– কী?
– এই সাতসকালেই বলব কি না ভাবছি!
বাটিতে চুমুক দিয়ে দুধ খেতে খেতে তেরো নম্বর বলল, বলো, বলো।
– বীজেশ নাকি মারা গেছে!
সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল তেরো নম্বরের। কী বললে? খুব ধীরে ধীরে কথাটা তার বউ বললেও ওর মনে হল, সে বুঝি ভুল শুনছে। তাই ফের বলল, কী বললে?
– এখান থেকে সবাই দল বেঁধে বেঁধে যাচ্ছিল। তারাই বলাবলি করছিল, বীজেশ মারা গেছে।
– মারা গেছে! তার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল দু’টি শব্দ। গোটা শরীর মুহূর্তের মধ্যে অবশ হয়ে গেল। মনে হল, এক্ষুনি সে দুম করে পড়ে যাবে। মনে হল, কতগুলো সাদা পাতা যেন খসখস করে সরে যাচ্ছে। মনে পড়ে গেল, সেই সব দিনের কথা। তখন এ রকম কোনও সমস্যা এ গ্রামে ছিল না। সবাই খুব সুখে-শান্তিতে বসবাস করত। বছরে যে কত বার উৎসব হত! সামান্য ঝুলন পূর্ণিমাতেই সে কী এলাহি ব্যাপার!সব সময়ই যে প্রচুর টাকা খরচ করে উৎসব হত, তাও নয়। তবে যাই হোক না কেন, গোটা গ্রাম আনন্দে মেতে উঠত।
বীজেশের বাড়ি ওদের বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয়। দু’জনে একই স্কুলে পড়ত। তাই বন্ধুত্বও ছিল খুব। স্কুলে যাওয়ার পথে কত দিন পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে খাতার পাতা ছিঁড়ে দু’জনে নৌকো বানিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে জলে। কারও বাড়িতে টোপা কুল হয়েছে, খবর পেলেই হল, ভরদুপুরে সেখানে গিয়ে কী ভাবে যে কুল পেড়ে আনত! যাদের গাছ, তাদের তাড়া খেয়ে কত বার যে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে গোটা শরীর কুলগাছের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে, রক্ত ঝরেছে, সে দিকে ওদের নজরই পড়ত না। কুল খাওয়ার চেয়েও কুল পাড়ার আনন্দেই ওরা মশগুল হয়ে থাকত বেশি।
ওরা একবার স্কুল থেকে ফেরার পথে একটা বেড়ালছানা রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিল। সেটাকে নিয়ে ওদের সে কী চিন্তা। কোথায় রাখবে! কী খাওয়াবে! শীতের সময় ওকে কী দিয়ে ঢাকা দেবে!
তেরো নম্বর খেজুর রস খেতে খুব ভালবাসত দেখে শীতের মধ্যে ভোররাতে চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে খেজুর গাছে উঠে ওর জন্য রস পেড়ে নিয়ে আসত বীজেশ। দোলের দু’দিন আগে থেকে এ গাছে সে গাছে উঠে পেড়ে নিয়ে আসত কাকের ডিম। কোকিলের ডিম। জড়ো করে রাখত দোলের জন্য। আবির-টাবির নয়, সে দিন ওই ডিমগুলো লুকিয়ে নিয়ে পিছন দিক থেকে গিয়ে আচমকা বন্ধুদের মাথায় দুম করে ফাটিয়ে দিত। যাদের মাথায় ফাটাত, কুসুম আর আঠা আঠা সাদা লেইগুলো কিছুক্ষণের মধ্যেই জট পাকিয়ে দিত চুলে। তাই বন্ধুরা যখন বলত, মাথাটা একটু ধুইয়ে দে। তখন ওরাই, ‘ঠিক আছে, দাঁড়া। মাথা ঝুঁকে দাঁড়া। দিচ্ছি।’ বলেই, মাথা ধোয়ানোর নাম করে আগে থেকে রেডি করে রাখা গোবর গোলা জল ঢেলে দিত মাথায়। ভীষণ বিচ্ছু ছিল দু’জনে। কোনও কোনও দিন স্কুলে না গিয়ে ভরদুপুরে ডাংগুলি খেলত। এক একটা মারে মাঠের বাইরে করে দিত বীজেশ। একবার দু’জনে মিলে পাড়ার ক’জনকে নিয়ে একটা ফুটবল খেলার ক্লাবও করেছিল। সে আজ নেই! ও ভাবতেই পারছে না। তবু অবাক হয়ে ও বলল, মারা গেছে মানে! তুমি তো কালকেই বললে, ও ক’দিন ধরে নিখোঁজ।
– হ্যাঁ, বলেছিলাম তো।
– তা হলে?
বউ বলল, নিখোঁজের খবরটা কাল রাত অবধি জানতাম। এটা আজ সকালের খবর।
– আজ সকালের! কে বলল তোমাকে?
– ওরা।
তেরো নম্বর জিজ্ঞেস করল, ওরা মানে কারা?
– এই গ্রামেরই লোক।
– এত সকালে তোমার সঙ্গে ওদের দেখা হল কোথায়?
তেরো নম্বর জিজ্ঞেস করল, ওরা মানে কারা?
– এই গ্রামেরই লোক।
– এত সকালে তোমার সঙ্গে ওদের দেখা হল কোথায়?
– ওরা তো এখান দিয়েই যাচ্ছিল।
তেরো নম্বর জানতে চাইল, কোথায়?
– পোড়ো শিবমন্দিরের দিকে।
– ওখানে কী?
– ওখানে একটা বিশাল পাকুড় গাছ আছে না?
– হ্যাঁ।
– ওরা বলল, ওটার পাশেই নাকি বীজেশের বডি পড়ে আছে। সবাই বলছে, ক’দিন আগেই নাকি মেরেছে। এখন পচে গন্ধ বেরোচ্ছে।
– পচে গন্ধ বেরোচ্ছে! কথাটা শুনেই ওর মনে পড়ে গেল, গত কাল রাতের কথা। ও যখন গ্রামে ঢুকছিল, ওদিকটায় লোকজন কম যায় বলে ও ওই রাস্তাটাই ধরেছিল। তখন তুমুল ঝড়। যে কোনও সময় যে কোনও গাছ বা গাছের ডাল ভেঙে মাথায় পড়তে পারে। ওর চোখের সামনেই একটা বড় ডাল মড়মড় করে ভেঙে পড়তেই ও থমকে দাঁড়িয়েছিল ওই পাকুড় গাছটার তলায়। তখনই ওর নাকে ভক্ করে এসে ধাক্কা মেরেছিল একটা পচা গন্ধ। সেই বিদঘুটে গন্ধে ওর প্রায় বমি এসে গিয়েছিল। ভাগ্যিস তখন থেকে থেকে দমকা বাতাস দিচ্ছিল। তাই গন্ধটা বেশিক্ষণ থাকেনি। ওর মনে হয়েছিল, কেউ বোধহয় কোনও কুকুর বা বিড়াল মরা আশপাশে ফেলে গেছে। তা হলে ও যা ভেবেছিল, তা নয়! ওটা বীজেশের মৃতদেহের গন্ধ ছিল!
হ্যাঁ, ওর মনে পড়েছে। সে সময় গাছের আড়ালে ও যেন ছায়া ছায়া মতো কাদের সরে সরে যেতে দেখেছিল। তা হলে কি যারা ওকে মেরেছে বা ফেলে গেছে, তাদেরই ও দেখেছিল!
পুকুর থেকে কলমিশাকগুলো ধুয়ে আনার জন্য দাওয়া থেকে নামতে নামতে বউ বলল, ওরা বলছিল, তোমাকে একবার ওদের সঙ্গে দেখা করতে।
তেরো নম্বর জিজ্ঞেস করল, কারা?
– আমার মনে হয়, ওরা বীজেশের লোক। ওই জমি রক্ষা কমিটির।
– ও… তা, ওদের এখন পাব কোথায়?
বউ বলল, ওই তো, যেখানে বীজেশের বডি পড়ে আছে, সেখানেই তো সব দল বেঁধে গেল। এখনও তো কাউকে ফিরতে দেখলাম না। আমার মনে হয়, ওরা এখনও ওখানেই আছে, ওখানে গেলেই ওদেরকে পাবে।
তেরো নম্বর বলল, ঠিক আছে।

চলবে…

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ৬

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!