ধারাবাহিক উপন্যাস: এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ৭)

মাঝে দুটো রবিবার পার হয়েছে সময়ের স্রোতের টানে। সোমবার সন্ধের ঝাপসা ভ্রূকুটি থানার সামনের চত্বরে লুটোপুটি খেলছে। নিজের চেম্বারে বসে আকাশ সাম্প্রতিক ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ত। টেবিলের উপরে উঁচু উঁচু টাকার বান্ডিল। সেদিকে একবার চোখ রেখে আকাশ একমনে ফাইলগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে শুরু করল। টানাপোড়েনের দেওয়াল টপকে বেশ ভালোমতোই বুঝেছে, থানার আইন মোতাবেক কাগজপত্র ঠিক থাকলে পাবলিকের কিছুই করার নেই। সামনে সাময়িক বিক্ষোভ এলেও আইনের চোখে তা খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। টেবিলে রাখা রিসিভারে রিং বেজে উঠলেও নিজের ভাবনার জগতে পড়ে থাকল। দ্বিতীয় রিং বাজতেই রিসিভার কানের পাশে ধরে বলল, হ্যালো, কে বলছেন?
আমি বাবু বোস।
অনেকদিন পরেই ফোন করলেন, বলুন কী বলতে চাচ্ছেন?
শুনেছি, লক-আপে শ্রমিকটার মৃত্যু নিয়ে সিবিআই তদন্ত শুরু হবে। বিরোধী নেতাদের দাবি মেনে ঘটনাস্রোত নাকি সে দিকেই এগিয়ে চলেছে। প্রাকটিক্যালি আপনাকে নিয়ে একটা অবস্থান তৈরি হয়ে গেল।
আপনিও এ ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন।
না না, আমাকে আবার জড়াচ্ছেন কেন। থানার ব্যাপার, সব কিছু আপনাকেই সামলাতে হবে। লক-আপের ভিতরে আমি তো শ্রমিকটাকে পিটিয়ে খুন করি নি। আই মিন….।
বাবু বোস ফোন কেটে দিলেন।
আকাশের মধ্যে নতুন পর্যালোচনার ঢেউ। কয়েকদিন আগেকার ইতিহাস এত তাড়াতাড়ি ভুলে যেতে পারলেন? এই ভদ্রলোক নিজেকে সেভ করার জন্যে মোটা টাকার অফার দিয়েছিলেন, ফোনে বার বার খোসামোদ করেছেন। কত বার যে স্যার বলেছেন। তিনিই ইচ্ছে করে মোবাইল ছিন্ন করে দিয়ে কী প্রমাণ করতে চাচ্ছেন? সব দায় তার একার, হাত ধুয়ে সরে পড়েছেন আড়ালে। চলতি টানাপোড়েনের সঙ্গে আর যোগ রাখতে চান না?
আকাশ চরম অসুন্তুষ্ট হয়ে গুম মুখে বসে থাকল। সীমাছাড়ানো স্পর্ধা ছাড়া কিছুই নয়। আবার টেলিফোনে রিং বেজে উঠল। —বাবু বোস নয় তো? এক চক্করে ভিন্ন চিন্তা মাথার ভিতরে। ধরব, না ধরব না ভাবতে গিয়ে রিং কেটে গেল। আকাশ ভাবল, বাবু বোস ফোন করলে ভালোমতো কথা শুনিয়ে দিতে হবে। তাকে এত সস্তা ভাবলে চরম ভুল করবেন। আবার রিং বেজে উঠল। রিসিভার তুলে নিয়ে আকাশের প্রশ্ন, হ্যালো, কে বলছেন?
এস ডি ও বলছি।
বলুন স্যার, কোনো জরুরি খবর?
জরুরি বলতেই পারো, শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনাটা মরেও মরছে না। প্রতিদিন নতুন নতুন জট পাকিয়ে উঠছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় চাপ বাড়ছে। চারদিক থেকে নতুন প্রশ্ন উঠে আসছে। তাই জানতে চাচ্ছি, লোকটাকে কী সত্যি সত্যি পিটিয়ে মারা হয়েছিল?
একেবারে মিথ্যে প্রসঙ্গ স্যার। ওর গায়ে কেউ হাত পর্যন্ত তোলে নি। তাছাড়া পিটিয়ে মারার প্রসঙ্গ আসছে কেন?
তাহলে লোকটা মরল কী করে?
সে তো স্যার তদন্ত সাপেক্ষ ব্যাপার। আমার যেটুকু জানা আছে, তা আপনাকে জানাচ্ছি। কোনো প্রমাণপত্র মেলে নি বলেই লোকটাকে থানার লক-আপ থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
তাহলে কী অন্য কোথাও মরে পড়েছিল?
ঠিক তাই স্যার, একটা ঝোপের মধ্যে।
এ নিয়ে তুমি কী ভেবেছ, তা একটু শেয়ার করবে?
স্যার, পুরো ঘটনাটা তদন্তসাপেক্ষ ব্যাপার, তাই বেফাস মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে বেশ বুঝতে পারছি, বাবু বোসের ষড়যন্ত্র ছাড়া এত বড়ো কাণ্ড ঘটতে পারে না। উনি টাকার জোরে অনেক কিছু করতে পারেন। আর্থিক টোপ দিয়ে শ্রমিকটাকে মার্ডার করে দিলে তাতে আশ্চর্যের কিছুই থাকতে পারে না। আগেও অনেক খারাপ রেকর্ড লোকটার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। তাই আমার সন্দেহ বাবু বোসের দিকে ঝুঁকে আছে স্যার।
কথাটা এক অর্থে মন্দ বলো নি তুমি। তাহলে তো তোমাকে আরও খোঁজখবর নিতে হবে। কোনো ক্লু পেলে তৎক্ষণাৎ তা আমাকে জানাবে। ঘটনার পিছনে প্রকৃত যে চিত্র রয়েছে, তা জানা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। একটা তুচ্ছ শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে যে এত বেশি প্রশাসনিক বিড়ম্বনা সৃষ্টি হতে পারে, এই প্রথম সেই জটিলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে সকলকে। শুধু তুমি নও, আমিও ঘটনাটার গতিবিধি নিয়ে বেশ চিন্তার মধ্যে রয়েছি। নতুন কোনো পরম্পরা দেখা দিলেই তা আমাকে জানাবে।
আকাশও কম চিন্তিত নয়। থানার মূল আধিকারিক হয়ে যাবার পরে কোনো খুনের ঘটনা এত বেশি ক্রনিক হয়ে ওঠে নি তার জীবনে। এ ঘটনার আকর্ষণ ঠিক মরা বাঘের মতো। যারা জীবন্ত বাঘকে বেশি ভয় পায়, মরা বাঘ দেখতে তারাই বেশি সংখ্যায় আসে। আকাশের মধ্যে একটা প্রশ্ন বার বার মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। যে খুন হয়েছে, তার কোনো সামাজিক প্রতিপত্তি নেই। তারপরেও কেন যে তাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এত টানাটানি শুরু হয়েছে তা যুক্তিতে মাথায় আসছে না আকাশের। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চেম্বারের মধ্যে পায়চারি করতে থাকল। কন্সটেবল বদন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আসব স্যার?
এতে বলাবলির কী আছে?
আপনার নামে একটা চিঠি এসেছে।
ভিতরে ঢুকে টেবিলের উপর রেখে যাও, সময়মতো দেখে নেব।
একটা কথা জিজ্ঞেস করব স্যার?
কেন করবে না? তুমি তো আমার একমাত্র ছায়াসঙ্গী।
বাবু বোস লোকটা তত সুবিধের নয়।
কী করে বুঝলে?
অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে সব কোয়া নিজেই খেতে চায়। ভারি অদ্ভুত স্বভাবের মানুষ, ওকে এতটুকু বিশ্বাস করবেন না।
তুমি যা বলছ, ও সব আমি জানি।
তাহলে কী করবেন স্যার?
নতুন কিছু ঘটনার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছ নাকি?
স্যার, লোকটা যে আপনার বিরুদ্ধে নানা টালমাটাল অবস্থান তৈরি করতে ব্যস্ত, তা বেশ বুঝতে পারছি।
একটা কথা শুনে রাখো বদন, যেদিন থেকে থানার মূল চেয়ারে বসেছি, কাউকে তেলিয়ে চলতে হয় নি আমাকে। আরও বড়ো কথা, উপরের প্রশাসন সব সময় আমার সঙ্গে থেকেছে। ভাবছ কী, তাঁরা চলতি ঘটনায় উল্টোপথে হাঁটবেন? মনে রেখো বদন, কোনো টালবাহানা আমাকে আগে স্পর্শ করতে পারে নি, আজও পারবে না। ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করতে আজও এতটুকু ভুল করি না।
আমার কেবল মনে হচ্ছে, বাবু বোস আপনাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্যে ভীষণ জটিল পথে হাঁটছেন।
এত কিছু জানলে কী করে?
সিকিউরিটি গার্ড তপন আমাকে সব কিছু জানিয়ে দিয়েছে। বাবু বোস নাকি এখন আপনার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের খেপিয়ে দিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। সকলকে তাতিয়ে দিচ্ছেন যাতে আপনি বিপদে পড়ে যেতে পারেন।
আকাশ হাতে রাখা খামটা খুলতে খুলতে বদনের কথাগুলো শুনছিল। খামের ভিতর থেকে লেখাটা বের করে পড়ার পরে মুখের বলিরেখায় গর্বের হাসি ফুটিয়ে তুলল।
স্যার, নতুন কোনো খবর?
দারুণ সুখবর।
একটু বলবেন।
আমি যে বাবু বোসের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিধর, তা এই চিঠির ভাষা প্রকাশ করছে। বদন, এটাই আমার ট্রান্সফার অর্ডার। শুধুমাত্র ফোনে আবেদনটুকু পাঠিয়ে দিয়েছিলাম তাতেই কাজ হয়ে গেছে। এত তাড়াতাড়ি হাতে পাব, ভাবতে পারি নি।
কাইন্ডলি বলবেন, কোন্ থানাতে জয়েন করছেন?
তোমাকে সব বলব বদন। এ তো চেপে রাখার বিষয় নয়। তাছাড়া এতদিন একমাত্র তুমিই আমাকে আন্তরিকভাবে সঙ্গ দিয়ে আসছ। এর কী কোনো মূল্য নেই? যেখানে যাব, তোমাকে সঙ্গে নিয়েই যাব। ইতিমধ্যে তোমার ট্রান্সফারের জন্যে দরখাস্তও করে দিয়েছি।
স্যার, আমার জন্যে এত ভাবেন?
সঙ্গী-সাথীদের জন্যে ভাবতেই হয়। সকলের মাথার উপরে থাকব অথচ তাদের সমস্যা মাথায় নেব না, এমন তো হতে পারে না।
কোন্ থানায় যাচ্ছেন, এখনও বললেন না তো?
আমার পরবর্তী ঠিকানা স্বরূপনগর।
তাহলে তো স্যার আমাকে সঙ্গে নিয়ে স্বরূপনগর যেতে পারছেন না।
এভাবে ভাবছ কেন?
আপনি বদলির অর্ডার হাতে পেয়ে গেছেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন কী করে?
এই নিয়ে ভাবছ? যারা আমার অনুরোধ মেনে নিয়ে ট্রান্সফারে সই করে দিতে পারেন, তাঁরা আমার কথায় তোমাকে নিয়ে কনসিডার করতেই পারেন। পুলিশ লাইনে এ সব খুব সহজে সম্ভব। এখনও বোধ হয় বুঝতে পারো নি, শুধু আমার রেকমেন্ড কত বড়ো ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। তোমাকে না জানিয়ে গতকাল সেই অনুরোধ করে দিয়েছি। তাই আশা করছি, দু-এক দিনের মধ্যে তোমার ট্রান্সফার অর্ডার হাতে পেয়ে যাব।
বদন ভিতরের কৃতজ্ঞতায় একুল সেকুল হতে থাকল। মুখের বলিরেখায় যে আনন্দের ছায়া পড়েছে, তাও আকাশের পক্ষে জেনে ফেলা সম্ভব হল। বদনের একটাই ভাবনা, বাবু বোসের কারণে ওসিকে আটকে যেতে হবে না তো? লোকটা যে কী সাংঘাতিক, তা ইতিমধ্যে তার জানা হয়ে গিয়েছে।
আকাশ সিগারেট ধরিয়ে চেম্বারের মধ্যে দুলকি চালে পায়চারীতে ব্যস্ত। একটা নতুন প্লট মাথার ভিতরে খেলা শুরু করেছে। ট্রান্সফার অর্ডারের সংবাদ বাবু বোসকে জানিয়ে চমকে দেওয়া সম্ভব কিনা, সেই চিন্তা মাথার ভিতরে চরকির মতো ঘুরছে। এ অভিজ্ঞতা তার অনেক পুরনো। কখনো কখনো কোনো সংবাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় দারুণভাবে কিস্তিমাত করা সম্ভব। সেই সুযোগ যেন তার মাথার উপর এসে গিয়েছে, শুধু সদ্ব্যবহার করতে পারলেই হল। আর এতটুকু সময় ব্যয় না করে রিসিভারের বোতাম টিপতেই রিং বেজে উঠল।
হ্যালো, কে বলছেন? বাবু বোসের কণ্ঠস্বর।
আমি রঙপুর থানা থেকে বড়বাবু বলছি।
কেমন আছেন বলুন?
ওই চলে যাচ্ছে, আপনার মতো ভালো নই।
কী যে বলেন স্যার?
ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ থাক। একটা সুখবর দিতেই আপনাকে ফোন করলাম। ট্রান্সফার অর্ডার হাতে পেয়ে গিয়েছি। বদলি হয়ে স্বরূপনগর যাচ্ছি, শুধু ভাবছি, যাওয়ার আগে যদি আপনার সঙ্গে একবার দেখা হয়ে যেত।
কবে যাচ্ছেন, নির্দিষ্ট দিন জানতে পারি কী?
আপনাকে অবশ্যই জানাবো। তার আগে আমার পরিকল্পনাগুলো আপনাকে একটু জানিয়ে রাখি। এতদিন দুজনে পাশাপাশি চলেছি, আপনি আমার পাশে থেকেছেন, আমিও আপনার পাশে। সেই সব স্মৃতি আজও অমলিন হয়ে রয়েছে। এখানে থাকাকালীন আপনার কাছ থেকে অনেকগুলো চিঠি পেয়েছি। সবগুলো যত্নে রেখে দিয়েছিলাম। সেগুলো অবশ্যই সঙ্গে নিয়ে যাব। ফোনে দুজনের অনেক কথা হয়েছে। বিপদ থেকে বাঁচতে অনেক অনুরোধ করেছেন আমাকে। সবই রেকর্ড করে রেখেছিলাম। এখন ভাবছি, এগুলো কাজে লাগানো প্রয়োজন। তাই সমস্ত কিছু সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।
বাবু বোস ভিতরে ভিতরে চমকে না উঠে পারলেন না। ভালো করেই বুঝলেন, ওসি সাব তাকে নিয়ে কী করতে চাচ্ছেন। এখনিই নরম করে দিতে না পারলে সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। নিজেই ফোন করলেন। গলার স্বরে কী ভীষণ নতজানু ভাবচেতনা। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, নতুন করে এসবের দরকার ছিল কী?
আমাকে বোকা ভাবছেন বোসবাবু? ভাবছেন কী, কাজ সারা হয়ে গেছে যখন নো পেমেন্ট পলিসি নিয়ে চললে আপনার সামনে কোনো বিপদ আসতে পারে না? বিপরীত গতির টানাপোড়েনে এত বেশি বিশ্বাস করেন? আমাকে এভাবে নিষ্কর্মা ভাবছেন? আগে আপনার পক্ষে যত কাজ করেছি, তাতে কী মনে হয় নি, ইচ্ছে করলে আমি আরও অনেক কিছু করতে পারি। ভুলে যাবেন না, আমার নাম আকাশ, কাজের পরিধি দিগন্তহীন আকাশের মতোই। যেখানে যেমন খুশি খেলতে পারি।
স্যার, এভাবে ভাবছেন কেন? নানা কাজে জড়িয়ে থাকার কারণে হয়তো একটু দেরি হয়ে গেছে। তার মানে এ হতে পারে না যে আমি আপনাকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছি। আমার জন্যে আপনি যা করেছেন, তা কী কোনোদিন ভুলে যেতে পারি? সম্পূর্ণ নিজের উপর আস্থা রেখে কেবলমাত্র আমাকে বাঁচাতে যা করেছেন, তার তুলনা হয় না। আপনার এ সাহস ও কর্মদক্ষতা নিয়ে আমি অনেকের কাছে প্রশংসা করেছি।
বোসবাবু, আপনার নেতি প্রশংসা সত্যি মনে রাখার মতো। নিজের প্রয়োজনে কতই না নরম, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে যেভাবে গরম দেখাতে পারেন, তাও তুলনাহীন। ইচ্ছে করে ফোন কেটে দেওয়ার দৃষ্টান্ত কী আমি ভুলে যেতে পারি? আপনি ম্যাজিক দেখালে আমিও পাল্টা ম্যাজিক দেখাতেই পারি।
অনুনয় করে বোসবাবু কিছু বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু সেই সুযোগ না দিয়ে আকাশ রিসিভার নামিয়ে রাখল।
হ্যালো স্যার, হ্যালো স্যার, আমার কথাটুকু একবার শুনুন। রিং করে বোসবাবু আবার কী বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু সেই সুযোগ না দিয়ে ওসি আকাশ রিসিভার নামিয়ে রাখল। মানসিক টানাপোড়েনের এক অপূর্ব সন্ধিক্ষণ। বদন চা নিয়ে চেম্বারের ভিতরে ঢুকে বলল, স্যার, এতক্ষণ কী বাবু বোসের সঙ্গে কথা বলছিলেন?
ব্যাটার ছেলে একদম সিঁটিয়ে গেছে রে বদন। জানেন না, এক ঢিলে দুই পাখি মারার যোগ্যতায় আমার মস্তিষ্ক কতটা ক্ষুরধার হয়ে উঠতে পারে। বাবু বোসের পাতা জালে বাবু বোসকেই জড়িয়ে দিতে পেরেছি বলে বিশেষ সুখ অনুভব করতে পারছি। এখন বুঝুক, থানার ওসি হিসেবে আমি কী পারি, আর কী পারি না।
কিন্তু স্যার, স্বরূপনগর থানার আভ্যন্তরীণ অবস্থান তো ভালো নয়।
এভাবেই বলছ কেন?
খুব ডেঞ্জার প্লেস স্যার।
তাতেই তো সমস্ত সুবিধে পাওয়া যেতে পারে।
এভাবে বলছেন?
আমরা পুলিশ লাইনের লোক। জায়গা যত খারাপ হবে, আয়ের উৎস তত বাড়বে। গোলমাল শব্দটা ভারি অদ্ভুত বদন। গোল বাধলেই ভালো করে ট্যাকেল করতে হবে, তাতেই মাল চলে আসবে। অবশ্য বাম হাতের হিসেবটা পরিকল্পনা মতো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, তাতেই কিস্তিমাত করা সম্ভব।
বুঝতে পেরেছি স্যার, আপনার পরিকল্পনা কত সূক্ষ্ম, কত নিপুণভাবে সাজানো হয়েছে। খুব ইচ্ছে করছে আপনার সঙ্গে স্বরূপনগর থানাতে জয়েন করতে। কিন্তু ট্রান্সফার অর্ডার না পেলে তো….।
বিষয়টা আমার উপর ছেড়ে দাও বদন। কথা যখন দিয়েছি, যাওয়ার আগে তোমার ট্রান্সফারের ব্যবস্থা পাকা করে ফেলবই। এখন থেকে মনে মনে প্রস্তুতি নিতে কোনো অসুবিধা আছে বলে মনে করি না।
শুনতে শুনতে বদনের মধ্যে অভিনব স্পন্দন শুরু হয়ে গেছে। স্যার বলেছেন যখন….। কী ভাষায় অভিনন্দন জানিয়ে স্যারকে খুশি করা যায়, তা খুঁজে পাচ্ছে না। মুখ নীচু করে শুধু বলল, আপনি পাশে ছিলেন বলেই….।
এভাবে এত গদগদ হওয়ার কী আছে? থানার বড়বাবু হিসেবে আমি তোমার বস্। কিসে তোমার ভালো হবে, সেই হিসেব নিশ্চয় আমার মাথায় থাকা উচিত। এটুকু করতে না পারলে তো বাস্তব অর্থে বস্ হওয়া যায় না। তাছাড়া, এতদিনের ছায়াসঙ্গী, তাকে ফেলে রেখে আমার দিন চলবে কী করে? চাকরিতে আসার পর দেখেছি, সর্বক্ষণ আমার ভালোর জন্যে লেগে থেকেছ, দুঃসময়ে আমার জন্যে তোমার ভাবনায় বার বার আপ্লুত হয়েছি। এসবের নিশ্চয় উপযুক্ত প্রতিদান থাকা উচিত। তোমার জন্যে আমি কেবল সেটুকু করতে চাই। তুমি এক কাজ করো বদন, এই টাকা নাও, পাশের দোকান থেকে প্যাকেট পাঁচেক সিগার কিনে নিয়ে এস। সময় যখন ভালো এসেছে, সেসবের অনুভূতি ধোঁয়ায় না ছাড়তে পারলে নয়।
বদন ঘর থেকে বের হয়ে খুশি মনে দোকানের দিকে হেঁটে চলল। ভিতরের মাদকতায় কেমন যেন দুলতে বাধ্য হচ্ছে। তাকে নিয়ে ওসিসাব এত কিছু ভাবেন? নিজের বিশ্বাসে গড়ে তোলা জীবনভাবনায় এভাবে অবিচল থাকতে শিখেছেন? নামে আকাশ, কর্মপরিধিতেও আকাশ হয়ে উঠতে চাচ্ছেন। নামে কামে সামঞ্জস্য রক্ষার এক অদ্ভুত যাদুকর। বাবু বোসকে টেক্কা দেওয়ার খেলায় যেভাবে জিতে যেতে বসেছেন, তাতেও বদনের সমর্থন আকাশমুখি হয়ে উঠছে।
আকাশ চেয়ারে বসে আত্মবিশ্লেষণের মগ্নতায় ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। অতীত এসে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে দুচোখের সামনে। কত কথা মনে পড়ছে পর পর। মনে পড়ছে পাপানকে। কতদিন ছেলেটার মুখ থেকে বাপি ডাক শুনতে পায় নি সে। একবার মনে পড়ল হেনাকে কিন্তু সেই স্মৃতি তার মনের পাতায় খুব বেশি সময় স্থায়ী হল না। হেনাকে বাড়ির পরিমণ্ডলে সুগৃহিণী হয়ে থাকতে তো কোনোদিন বাধা দেওয়া হয় নি। বরং সুখে থাকার সব রকম ব্যবস্থা করেছে সে। হেনার পক্ষে তা গ্রহণ করা সম্ভব হল না কেন? অতিরিক্তভাবে সে তার কাজেকর্ম্মে নাক গলাতে আরম্ভ করেছিল, বুঝতে চায় নি, নিজের গণ্ডির বাইরে গিয়ে এভাবে স্বামীর কর্মক্ষেত্রে নাক গলানো ঠিক নয়। কোনোদিন জানতে চায় নি, স্বামী ওসির দায়িত্বের কোন্ কোন্ দিক থেকে তার মুক্ত থাকা উচিত। ফলে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। হয়তো হেনা ভাবছে, তার জন্যেই এতকিছু ঘটে গেল। ভাবতেই পারে, বড়ো গাছে ঝড়ের প্রকোপ বেশি করে লাগে।
চেয়ারে হেলান দিয়ে আকাশ সিগারে সুখটান দিতে দিতে চোখ বুঝিয়ে একটু বিরতি নিল। ভাবল, হেনাকে ছাড়াই তার জীবন এখন বেশ তরতরিয়ে চলছে। অন্তত বাড়ি থেকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। এখন নিজের মতো করে সব কিছু করতে পারছে। নিজেই পদ্ধতি উদ্ভাবন করছে, রূপায়ণের জন্যে মাস্টারপ্ল্যানও নিজের, রূপায়ণ করার সব দায়িত্ব নিজেই পালন করছে। জীবনে যে এত অবাধ স্বাধীনতা থাকতে পারে, তা বেশ অনুভব করতে পারছে, আজ কাল পরশুর ভাবনায় তার জীবন দিব্যি এগিয়ে চলেছে জোয়ারের স্রোতের মতো। নিজেকে সমুদ্র ভাবতে পেরে বেশ গর্বিত হল আকাশ। এমনি স্বাধীনতা সে তো খুব করেই চেয়েছিল।
দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বদন থমথমে পরিবেশের মধ্যে যে তীব্র নেতি মনোভাব রয়েছে তা আরও বুঝতে পারছিল। সমবেত স্লোগান শুরু হতেই তা বেশ পরিস্কার হয়ে গেল। উদ্বিগ্ন বদন সিগারের প্যাকেট হাতে দ্রুত পা চালিয়ে ওসির ঘরে ঢুকে বলল, স্যার, একটা খারাপ খবর জানতে পেরে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি।
কী খবর বলো তো?
থানা ঘেরাও করতে শ’পাঁচেক লোক একটু দূরে জড়ো হয়েছে। নেতৃত্ব দিচ্ছে বাবু বোসের পোষা গুন্ডাগুলো। আমি ওদের চিনি স্যার। এমন সব অঙ্গভঙ্গী করছে যেন জয়লাভ করা সম্ভব করে ফেলেছে। অশ্রাব্য ভাষায় যা তা বলছে। ঘেরাও করার আগে লোকগুলো ভীষণ উৎসাহের মুডে রয়েছে। বোধ হয় বাবু বোসের কাছ থেকে টাকা খেয়ে….।
আকাশ উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে দিয়ে, একবার বদনের দিকে কটমট করে তাকিয়ে নিল, তারপর পায়ে পায়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, বুঝে নিতে চাইল বিক্ষোভের ভিতরের প্রকৃত চেহারাটুকু। মনে মনে ভাবল, লোকজনের সংখ্যাতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। স্লোগান শুরু হয়ে গেছে। মুখে মুখে প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা। স্লোগানের উত্তাপও কানে আসছে, আকাশের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। কেন নির্দোষ শ্রমিককে খুন করা হল, জবাব চাই, জবাব দাও।
সিদ্ধান্ত নিতে এতটুকু বিলম্ব করল না আকাশ। বদনকে হুকুম দিল, ভিতর থেকে সব গেট বন্ধ করে দাও। ভেরি কুইক, মুখে আস্ফালনের তুবড়ি, ওরা কে শুনি? ওদের কথা কেন শুনতে হবে আমাকে? আকাশের মুখে ক্রুর হাসি। বাবু বোসের মতো রাতকানা লোককে ঘায়েল করতে তার পক্ষে যে এতটুকু অসুবিধা হবে না, তা নিয়ে আকাশ যেন অনেকখানি নিশ্চিন্ত ছিল। অস্ফুটে হুমকি দিল, মনে রেখো বাবু বোস, আজকের দিনের জন্যে তোমাকে অনেক বেশি খেসারত দিতে হবে। আজ থেকে তোমার খেলখতম পর্ব শুরু করে দিলাম। শ্মশানযাত্রা সম্পন্ন করতে হয়তো একটু সময় লাগবে কিন্তু তা শেষ না করে ছাড়ছি নে। আকাশের মতো পোড়খাওয়া ওসি বেশ ভালোভাবেই জানে, মরার আগে একটা মরফিন ইঞ্জেকশনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া কতক্ষণ স্থায়ি হতে পারে।#

চলবে…

ধারাবাহিক উপন্যাস: এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ৬)

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!