নারী-জীবনের অনিশ্চিত অন্ধকারের পাঠ

“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।”

কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ কবিতাটি ছোটবেলায় মুখস্থ করেছিলাম। নারী ছাড়া পুরুষ অসম্পূর্ণ, আবার পুরুষ ছাড়াও নারী অসম্পূর্ণ। দুইয়ের মিলনেই গড়ে উঠেছে সংসার। আবার দুইয়ের মিলনেই গড়ে উঠেছে সত্য-শিব-সুন্দরও। জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’য় এই রূপ পেলাম:

“কৃষ্ণা যমুনায় নয় – যেন এই গাঙুড়ের ঢেউয়ের আঘ্রাণ
লেগে থাকে চোখে মুখে–রূপসী বাংলা যেন বুকের উপর
জেগে থাকে; তারি নিচে শুয়ে থাকি যেন আমি অর্ধনারীশ্বর।”

সত্য-শিব-সুন্দর যদি অর্ধনারীশ্বর হয়, তাহলে পুরুষের মধ্যেও নারীসত্তা বিরাজ করে। আবার নারীর মধ্যেও পুরুষসত্তা বিরাজ করে। আর আমাদের সংসার ভরিয়ে তোলে এই দুই সত্তা। আনন্দে-বেদনায় কন্যা-জায়া-ভগিনী-মাতা কতরূপ থাকে নারীর মধ্যে। আমরা মাতৃঋণের কথা জানি। আমরা ভগিনীর স্নেহ জানি। আমরা কন্যার ভক্তি জানি। আমরা জায়ার প্রেমকেও উপভোগ করি। কিন্তু তবু কেন এই নারী সমাজে অবহেলিত হবে? তবু কেন তাকে পণের বলি হতে হবে? তবু কেন তাকে রাস্তাঘাটে, কর্মস্থলে ধর্ষিতা হতে হবে? একবিংশ শতাব্দীতে যখন সবকিছু আপটুডেট হয়, তখন পুরুষ সমাজ কেন আপটুডেট হবে না? আমরা কি এসব একবারও ভাবব না?

যুগে যুগে যেসব ধর্মগ্রন্থ লেখা হয়েছে, আচার-বিধিসর্বস্বর প্রচলন ঘটেছে—তাতে সবগুলিতেই পুরুষকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিধি-বিধান নির্দেশ করা হয়েছে। নারীকেও সেখানে ভোগ্যপণ্য এক বস্তু হিসেবে দেখানো হয়েছে। এখনো মধ্যপ্রাচ্যে এমনকী আমাদের দেশেও নারী কেনাবেচা হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের দরদাম হয়। পঞ্চপাণ্ডবরা পাশা খেলতে গিয়ে দ্রৌপদীকেই বাজি ধরে। শ্রীলংকা জয় করে ফিরেও সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়। কোথায় নারীর সম্মান? আজও সমানভাবে এই ট্রেডিশন চলে আসছে। নারীকে এতই অচ্ছুত ভাবা হল যে নজরুলও লিখতে বাধ্য হলেন:

“পুরুষ প্রভুর লক্ষ পাপও সমাজখাতায় নেই জমা
অথচ দস্যু এসে অঙ্গ ছুঁলে নারীর বেলা নেই ক্ষমা।”

রাতের অন্ধকারে চোর এসে নারীর অঙ্গস্পর্শ করলেও সেই নারীর সতীত্ব হারায়। কিন্তু পুরুষ গোপনে শতশত নারীর সতীত্ব হরণ করে এসেও সে সাধু। তসলিমা নাসরিন এই কারণেই বলেছেন: বেশ্যা শব্দটি শুধু নারীদের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। পুরুষরা কখনো বেশ্যা হয় না। আম পচা, ডিম পচার মতো নারীও পচে নষ্ট হয়, কিন্তু পুরুষের পচন নেই। নারী শুধু সেক্স দমন করতেই জন্মেছে। আর পুরুষ শুধু সেক্স উপভোগ করতেই ছাড় পেয়েছে। এই দ্বিচারী সমাজব্যবস্থায় এই কারণেই নারীকে হীন চোখে দেখা হয়। বিয়ে দিতে গেলে নারীর জন্য পণ দাবি করা হয়। তার বুদ্ধিমত্তা, সৌন্দর্য, রুচিশীলতা এমনকী শিক্ষা ও চাকুরির পর্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এসব কিছু থাকা সত্ত্বেও তাকে টাকা দিয়ে পুরুষ কিনতে হয়। আবার সেই পুরুষের মন জুগিয়ে চলতে হয়। নিজস্ব স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয়। কখনো কখনো পিতৃকুল-মাতৃকুলের সম্পর্কও ছিন্ন করতে হয়। পুরুষ যত ইচ্ছে তাকে উপভোগ করবে। যখন ইচ্ছে তখন করবে। দাসীর মতো কাজ করাবে। যা খাবার দিবে তাই খেয়ে বাঁচতে হবে। রাগ করা যাবে না। অভিমান করা যাবে না। সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে বিলীন করে দিতে হবে তার পুরুষটির কাছে। কিন্তু এসব করেও তার জীবনের ছাড় নেই। তার প্রিয় পুরুষটি যদি অন্য নারীতে আসক্ত হয়, তাহলে তার কপালে নেমে আসে অসীম দুঃখ। হয় গলা টিপে হত্যা, কিংবা বিষ প্রয়োগে হত্যা, কিংবা অগ্নিসংযোগে। তারপর সেই মৃতদেহকে আত্মহত্যা বলে চালানো। থানা তৈরি করেছে পুরুষ, অর্থাৎ রাষ্ট্রপুরুষ। সেখানে হত্যাকারী পুরুষটিকে বাঁচানোরও সবরকম ব্যবস্থা আছে। নারী যন্ত্রণা ভোগ করুক, কিংবা মরে যাক, কিংবা পলায়ন করুক—তার বিচারের বাণী চিরদিন নীরবে-নিভৃতে কাঁদতেই থাকবে। নারীর জন্য কখনোই সুবিচার হবে না।

একটি পরিবারে ভাই-বোন একইসঙ্গে বড় হতে থাকে। একই পিতা-মাতার স্নেহ-আদর পায়। তবু বোনটি বুঝে ফেলে তার দাদা বা ভাই তার থেকে শ্রেষ্ঠ এবং পিতা-মাতার কাছেও বেশি আদরের পাত্র। তাকে প্রথম থেকেই জানানো হয় সে পরের বাড়ি যাবে, এই বাড়িতে তার কোনো অধিকার নেই। এই বাড়িতে যা কিছু আছে সব পুত্র সন্তানের জন্য। খাবার বন্টন করার সময়ও পিতা-মাতার এই পক্ষপাতিত্ব কখনো কখনো প্রকট হয়ে পড়ে। যার জন্য কন্যাসন্তানটির আত্মসত্তা ব্যাহত হয়। পদে পদে ঠোক্কর খায়। হীনমন্যতা জেগে ওঠে। মানসিকভাবেই তাকে বিকলাঙ্গ করে দেওয়া হয়। এরকম সমাজ অথবা পরিবার কখনো স্বাস্থ্যকর হতে পারে না। যে পিতা-মাতারা তাদের সন্তানদের লালন-পালনের দায়িত্ব পালন করে, তারা যদি চতুর্দিকে সচেতন না হয় তাহলে সর্বনাশের ভাইরাস তো সেখানেই উপ্ত হতে থাকে। মানসিক বিচ্ছিন্নতার জন্ম হয় এবং ভবিষ্যতে তা-ই একটা বিরাট গ্রাফ্ সৃষ্টি করে।

আমাদের গ্রাম বাংলার অখ্যাত অচেনা নানা প্রান্তে কত করুণ কাহিনি জমে আছে তা কেউ জানি না। তখন আমি ছাত্র।যে গ্রামে বড় হচ্ছিলাম আশির দশকে সেই গ্রামেরই এক দুঃখী মা সন্ধ্যেবেলা লন্ঠন জ্বেলে আমার কাছে আসতেন। এসে শুধু কাঁদতেন। কাপড়ের আঁচল থেকে একটা চিঠি বের করে দিয়ে পড়তে বলতেন। আমি যতদূর পড়ে শোনাতাম তার কান্না তত প্রগাঢ় হত। চিঠিতে লেখা থাকত: উত্তর প্রদেশ রাজ্যের যে পুরুষটি তাকে বিবাহ করে নিয়ে যায়, সে নিজের কাছে ছয় মাস রেখে নানা ভাবে উপভোগ করে,তারপর বেশি দাম পেয়ে আর এক বৃদ্ধকে বিক্রি করে দেয়। সেই বৃদ্ধও কিছুদিন থাকে নিজের কাছে রেখে নানাভাবে তার যৌন শোষণ করে। তারপর সেও বেশি দাম পেয়ে অন্য আরেকজনকে বিক্রি করে দেয়। এইভাবে বিক্রি হতে হতে তার দুটি মেয়ে বহু হাত বদল হতে থাকে। গ্রামের স্কুলে তারা ছিল সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। নারী পাচারকারী দালাল দুজন হিন্দিভাষী সুদর্শন পুরুষকে জামাই হিসেবে পরিচয় দিয়ে তার মেয়েদের বিয়ে করার টোপ দেয়। দিন-আনা দিন-খাওয়া কুমোর পরিবারের মেয়ে দুটিকে সুখে রাখার জন্য তার বাবা-মাও তাদের হাতে সমর্পণ করে। বিনিময়ে কয়েক হাজার টাকাও পায়। কিন্তু পরবর্তীতে পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে থাকে। দুই বোনেই সুযোগ পেলে একটা চিঠি লিখে ডাকবাক্সে ফেলে দেয়। চিঠি এসে পৌঁছায় বহু দেরিতে। তখন তাদের আরও হাতবদল হতে থাকে। ফলে চিঠির প্রত্যুত্তর দেবার ঠিকানা হয় চলমান। সুতরাং শুধু চিঠি আসে, কিন্তু চিঠি যায় না। তাই মেয়ের মা-টি অঝর নয়নে কাঁদতে থাকে। তার অশ্রুমোচন নিবারণের কোনো ব্যবস্থাই কেউ করতে পারে না। কিন্তু এও বেশি দিন চলে না। বছর তিনেক চিঠি আসার পর সব যোগাযোগই ছিন্ন হয়ে যায়। আর কোনো খবর নেই তাদের।

একটা অখ্যাত স্টেশনে সকালবেলা ট্রেন ধরতে এসে একটা অচেনা ভিন্ন প্রকৃতির নারীকে কাঁদতে দেখলাম। ছিন্নভিন্ন পোশাক কিন্তু শারীরিক কাঠামো জৌলুস বেশ উজ্জ্বল। বাংলায় কথা বলে জানলাম সে বাংলা জানে না। তৎক্ষণাৎ ইংরেজিতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথা থেকে আগমন এবং কী কারণে এখানে আগমন। উত্তরে সে যা জানাল তা লোমহর্ষক ব্যাপার। মেয়েটির বাড়ি মুম্বাই শহরে। নাম সুজাতা সোয়ান্ট। গ্রাজুয়েট। একটা কোম্পানিতে ক্লার্ক এর চাকরি করে। তাদের পাশের বাড়িতেই এদেশীয় এক রাজমিস্ত্রি থাকতেন। রাজমিস্ত্রি হলে কী হবে! তিনি বেশ সুদর্শন এবং স্মার্ট যুবক। কুমারী সুজাতাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে এদেশে উড়িয়ে এনেছেন। তারপর কয়েকদিন দিনরাত এক করে তাকে উপভোগ করেছেন। তার কাছে যা-কিছু ছিল অলংকারপাতি,অর্থকড়ি এমনকী পরনের কাপড় পর্যন্ত সবকিছু হাতিয়ে নিয়েছেন। এবং রাতের অন্ধকারে এই স্টেশনে ফেলে গেছেন। সুজাতা রাস্তা চেনে না, ভাষা সমস্যা, তার কষ্টের কথা কাউকে বোঝাতে পারছে না। যে লোকটি তাকে এনেছিল, সে মোটেও ভালো লোক ছিল না। পূর্বেও সে বহু মেয়ের সর্বনাশ করেছে। পরপর চারটে বিয়ে করেছে। বর্তমানে তার কাছে দুজন থাকে। এইভাবে পয়সা রোজগার করে সে সংসার চালায়।

গ্রামের ক্ষুদ্র চাষি। ৩০-৩৫ বছর বয়স। ধান রোপণ করা এবং কাটা ও মাড়াই করার সময় মহিলা মজুরদের ভিন গ্রাম থেকে আমদানি করে। এরকম করেই দিব্যি চলে যায়। সেবার হঠাৎ কালো রঙের এক গৃহবধূ মজুরের প্রেমে পড়ল চাষি। কিন্তু তার স্ত্রী তাদের সম্পর্কের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। কিছুতেই এ প্রেম চলতে পারে না। চাষির ১২ বছরের বিবাহিত জীবন। দুই সন্তান বর্তমান। তা সত্ত্বেও পরকীয়া? স্ত্রীটি বলল: আমি পাড়ার লোককে জানাব। এর বিচার চাই।

না, তার আর পাড়ার লোককে জানানোর সুযোগ হয়নি। সেই রাতেই তার গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দুই পা ধরে টান দিতে লাগল চাষি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে স্তব্ধ হয়ে গেল।

না তার বিচারও হয়নি। চাষি বলল: ওতো আত্মহত্যা করেছে! আমার কোনো দোষ নেই। সমাজ জানে পুরুষের কোনো দোষ থাকে না। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়ের পিতা-মাতাকে ভিক্ষাও করতে হয়। আবার ভিক্ষা করে বিয়ে দিয়েও নির্ঘুম রাত্রি কাটাতে হয়। কখন তার মৃত্যুর খবর আসবে, কখন তাকে বের করে দেবে, কিংবা কখন তাকে বিক্রি করে দেবে। পুরুষ সমাজ নিজের স্বার্থে নারীকে ব্যবহার করবে আবার ছুঁড়েও ফেলে দেবে—এভাবেই চলতে থাকবে। আমরা কি কখনোই সভ্য হতে পারব না?

হয়তো পারব না বলেই এই নিয়মেরও ব্যত্যয় ঘটে না। শপথ বাক্য পাঠ করানো হয়, সচেতন করা হয়, ধর্মীয় দোহাই দেওয়া হয়, মানবিক বোধ জাগ্রত করা হয়, সাম্যবাদের আলো ফেলা হয়, প্রগতিশীলতার পাঠ দেওয়া হয়, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। ছোটবেলায় পড়া একটা ছড়া বারবার মনে পড়তে থাকে:

“করেছি পণ নেব না পণ বউ যদি হয় সুন্দরী
কিন্তু আমায় বলতে হবে স্বর্ণ দেবে কয় ভরি!”

সুতরাং মানব সন্তানদের প্রতি আর ভরসা করতে পারি না। আমরা অন্ধকারেই নিমজ্জিত হতে ভালোবাসি।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!