মানব সমাজে প্রায় সমসাময়িক ভাবে দেখা দিয়েছে তিনটি অভিশপ্ত ধারা- ধর্ম, শ্রেণী-বৈষম্য ও পুরুষতন্ত্র। এই তিনটি ধারা পরস্পরের পরিপূরক হয়ে এগিয়ে এসেছে। ইন্দ্রজাল ও প্রার্থনার আদিম বৈজ্ঞানিক ধারা রূপ নিয়েছে ধর্মে; শ্রমবিভাজনের আদিম সাম্য অবস্থা রূপ নিয়েছে শ্রেণী বিভাজনে। স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্কের নিছক জাতিগত বিভেদ রূপ নিয়েছে পিতৃতন্ত্রে। ধর্মীয় ভাবধারা, শোষণমূলক ব্যবস্থা এবং পুরুষতন্ত্র- এই তিনটির ভিতরেই পিতৃতান্ত্রিক দার্শনিক বীক্ষা কাজ করছে।
ধর্মের পূর্বাবস্থায় যে ঐন্দ্রজালিক আচার অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। তার জনক ও পরিপোষক ছিল নারী ও পুরুষ উভয়েই। সেই সব অনুষ্ঠানে উভয়েই ছিল সমান ভূমিকা। অজ্ঞতা থেকে নারীকে উর্বরতার প্রতীক, নতুন জীবনের প্রতীক মনে করে নানা ধরনের ঐন্দ্রজালিক বিষয় অনুষ্ঠিত হয়েছে। গাছপালা-নদী-আকাশকে বিস্ময়বোধে দেবদেবীরূণে স্ততি করার প্রাথমিক ধারণাগুলি এলেও সেই অজ্ঞ মানবজাতি তাদের আকাঙ্খিত ক্ষমতা অর্জনের জন্য স্বৈরাচারী চরিত্রের কোন পুরুষাত্মক ঈশ্বরের কল্পনা করে নি। শ্রেণীবিভাজনের আগে, পুরুষতন্ত্রের আগে তাই পুরুষাত্মক ঈশ্বরের দেখা মেলা সম্ভব ছিল না। ঈশ্বর এসেছে পুরুষবেশে, সর্বনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে। ঈশ্বরবোধের মধ্যে নারী অনুপস্থিত। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পরমব্রহ্ম, খ্রীষ্টধর্মের গড, বা ইসলামের আল্লার ধারণার মধ্যে পুরুষ সত্ত্বার আরোপণ অবধারিত। তাই গডের সস্তান হয় যীশু, আল্লার দূত হয় মহম্মদ। নবী আর অবতারেরা অবশ্যম্ভাবী রূপে হয় পুরুষ। ইন্দ্র থেকে কৃষ্ণ, শঙ্করাচার্য থেকে চৈতন্য, নানক সকলেই পুরুষ। ধর্ম তাই আদিম সাম্যবাদী সমাজে ছিল না। যেমন ছিল না পুরুষতন্ত্র।
নিপীড়ণমূলক মানসিকতার ফলশ্রুতি হল পিতৃতত্রে। আদিম সমাজে স্বল্পায়ু মানুষের কাছে নারীর গর্ভের মূ্ল্য ছিল অপরিসীম। কিন্তু নারীর এই প্রাধান্য পীড়নমূলক চিন্তার জন্ম দিতে পারে নি। সম্ভবতঃ শিকারের দীর্ঘদিনের অভ্যাস পুরুষের মানসিকতায় আক্রমণাত্বক দমনমূলক আচরণ, পীড়নমূলক জীবনবোধের জন্ম দিয়ে থাকবে। যুদ্ধক্ষেত্রে বন্দী করে আনা ক্রীতদাসদের উপরে দমনমূলক আচরণ ও পীড়নমূলক জীবনবীক্ষার পথে পুরুষ সমাজকে পরিচালিত করে থাকতে পারে। সম্পত্তির অধিকার, আর এক পতি/পত্নী বিবাহ প্রথা পুরুষকে স্বেচ্ছাচারী পীড়নমূলক সত্ত্বায় পরিণত হতে সাহায্য করে। এই মনোভাবই নারীকে অবদমন করে পুরুষতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে।
পিতৃতন্ত্র স্ত্রীজাতিকে সম্পূর্ণভাবে পদানত করে সেই অবস্থাকে চিরস্থায়ী করতে ধর্মীয় বিধিনিষেধের নানা ধারা রচনা করল এবং মেয়েদের ওপর সামাজিক ও রাষ্ট্রিক শ্রেণী-নিপীড়নের বোঝাকে ক্রমাগত বাড়িয়ে যেতে লাগল। পুরুষ শোষকশ্রেনি হিসাবে ধর্মকে শাসন ও শোষণের স্বার্থে ব্যবহার করতে শুরু করল। নারীকে অবদমিত করে রাখতে ধর্মীয় বিধান গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিল। সামাজিক আচার-আচরণ-প্রথা-নিয়ম- যা শোষণের স্বার্থে রচিত হল তা নারীকে ‘স্থায়ীভাবে পিঞ্জরাবদ্ধ করল।
পুরুষ আধিপত্য স্থাপনের পর পরিবার যে আকার ধারণ করল, উৎপাদনের একক হিসাবে যে পরিবর্তন ঘটল পরিবারের চেহারায় তাতে নারী ও শিশুরা সর্বক্ষেত্রে হয়ে পড়ল শোষিতের পর্যায়ে। শোষিত শ্রেণীর পরিবারে সামাজিক শোষণের সঙ্গে নারীর উপর বর্তাল আর এক প্রস্থ শোষণ-পুরুষের শোষণ।
নরনারীর যৌন জীবনের ক্ষেত্রেও দুটি বিপরীত যোনির সমতার ভিত্তিতে স্বাভাবিক মিলনের পরিবর্তে স্থান নিল শোষক মুক্ত-পুরুষ কর্তৃক শোষিত পরাধীন নারীর পীড়ন। পুরুষতন্ত্রের সাথে সাথে সুস্থ স্বাভাবিক যৌন জীবন মানব সমাজ থেকে বিদায় নিল। পরিবারের পাশাপাশি এল রাষ্ট্র যে কেবল ব্যক্তিগত সম্পত্তিকেই পবিত্র বলে প্রতিষ্ঠিত করল না, পরন্ত সম্পত্তি সৃষ্টির জয় শোষণ ব্যবস্থাকে সযত্বে রক্ষা করল। অর্থনৈতিক শোষণ বাবস্থার রক্ষক রাষ্ট্র, পুরুষ কর্তৃক নারীকে শোষণের পাহারাদার হয়ে দেখা দিল।
আরও পড়ুন: বাংলা নববর্ষ ও হালখাতা: ঐতিহাসিক উৎসের সন্ধানে
সভ্যতা যত এগোতে লাগল স্ত্রী-পুরুষ ভেদাভেদ ততো বৃদ্ধি পেতে লাগল। যত আইন, কানুন, প্রথা, আচার, বিচার সৃষ্ট হতে লাগল, পুরুষ হল তা থেকে মুক্ত, আর নারী পড়ল তার বাঁধনে আটকা। শ্রমবিভাজন যত বেশী হতে লাগল, পুরুষ পেতে লাগল ততো ছাড়- নারী পড়ল জড়িয়ে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ যত স্পষ্ট হল, পুরুষ হল আরো বড় ব্যক্তিত্ব। নারী পরিণত হল ব্যক্তিত্বহীন সত্ত্বায়। যৌন জীবনে যত বৈচিত্র্য এল, পুরুষ তাকে দখল করল ভোগী হিসাবে। নারী হয়ে দাঁড়াল ভোগ্য যৌন পন্য। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যত বিকাশ লাভ করল, নারী ততো নিজেকে হারিয়ে ফেলল।
ধর্ম শোষণ- পিতৃতন্ত্র মানব জীবনে নিয়ে এল মহাবিচ্ছিন্নতা। শ্রেণী শোষণের যাঁতাকলে শ্রমজীবী মানুষ তার শ্রমশক্তিকে শোষকের ঘরে জমা দিয়ে নিজের শ্রমশক্তি থেকে নিজেই হয়ে পড়ল বিচ্ছিন্ন। শ্রম করা তার কাছে নিজের ইচ্ছার ব্যাপার না হয়ে, পরিণত হল বাধ্যতামূলক কাজে।
ধর্ম এমন এক চেতনা ও বোধকে প্রতিষ্ঠা করল যা মানুষের বাস্তব জীবনে অস্তিত্বহীন। ঈশ্বর নামক এক পরম সত্তার অধীনস্ত ধর্মবোধের মধ্যে মানুষ তার নিজস্ব সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। ধর্ম হয়ে উঠল প্রকৃতির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিমান মানুষের উল্টো করে ধরা বিশ্ববীক্ষা। আর পুরুষতন্ত্র নারীর নিজ দেহকে পর্যন্ত করে তুলল পরবস্তু। নারীর গোটা জীবন ধারায় নিজের কোন সার্থকতা নেই। সে নিজ সত্ত্বা ও দেহ থেকে নিজেই হয়ে পড়ল বিচ্ছিন্ন।
পুরুষতন্ত্রের মাঝখানে নারী হারিয়ে গেল, শোষণতন্ত্রের যাঁতাকলে শ্রমিক হারিয়ে গেল, আর ধর্মের বিশ্ববীক্ষার মধ্যে গোটা মানব প্রজাতিই হারিয়ে গেল। পুরুষতন্ত্রের এই স্বরূপই প্রমাণ করে যে ভবিষ্যতে তার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। শ্রমজীবী মানুষ যখন নিজেকে ফিরে পাবে সমাজ বদলের মধ্যে দিয়ে, তখন শ্রেণী-নিপীড়নের অবসান হবে। নারী যখন নিজের উপর নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারবে সমাজের কাঠামো ও উপরিকাঠামো বদলের মধ্যে দিয়ে তখন পুরুষতন্ত্রের অবসান ঘটবে। মানুষ যখন নিজেকে সম্পূর্ণভাবে জানতে পারবে জীবন ধারার বর্তমান শর্তের বদলের মধ্যে দিয়ে তখন ধর্মের অবসান হবে।
পুরুষতন্ত্র অতীতে ছিল না। পুরুষতন্ত্র ভবিষ্যতেও থাকবে না। স্বাভাবিক স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্কের সাম্যাবস্থা ছিল পুরুষতন্ত্রের পূর্বে। চেতনা-সঞ্জাত স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্কের সাম্যাবস্থা। পুরুষতন্ত্রের পরে আবার প্রতিষ্ঠিত হবে।#
আরও পড়ুন:
পিতৃতন্ত্রের পূর্বাপর (প্রথম পর্ব)
পিতৃতন্ত্রের পূর্বাপর (দ্বিতীয় পর্ব)
পিতৃতন্ত্রের পূর্বাপর (তৃতীয় পর্ব)
পিতৃতন্ত্রের পূর্বাপর (চতুর্থ পর্ব)
পিতৃতন্ত্রের পূর্বাপর (পঞ্চম পর্ব)