বন্দিত বৈজ্ঞানিক

অতীতে ডঃ মেঘনাদ সাহা প্রসঙ্গে স্বয়ং আইনস্টাইনের মত বৈজ্ঞানিক বলেছিলেন— “Dr. M. N. Saha has won an honoured name in the whole scientific world.”

কিন্তু তখন তাঁকে যাঁরাই দেখেছিলেন, তাঁদের তাঁকে সেই সহজ ও সাধারণ মানুষ বলে মনে হয়েছিল যিনি নিজের জ্ঞান ও গরিমা সম্পর্কে পরম উদাসীন ছিলেন। ডঃ মেঘনাদ সাহা পূর্ববঙ্গে জন্ম নেওয়ার জন্য আমৃত্যু তাঁর জিভের সঙ্গে নিজের দেশের ভাষা জড়িয়ে ছিল। ১৮৯৩ সালে বা ১৩০০ বঙ্গাব্দে ঢাকা জেলার সেওড়াতলী গ্রামে তাঁর জন্ম হয়েছিল। তাঁর পিতা জগন্নাথ সাহা সেই গ্রামে সামান্য ব্যবসা করতেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল ভুবনেশ্বরী দেবী। তাঁর পিতার উপরে বিরাট একটি সংসার-পালনের ভার থাকলেও তাঁর আয় খুবই সামান্য ছিল। আর একারণেই তাঁকে অনটনের মধ্যে মানুষ হতে হয়েছিল, এবং শৈশবে খুবই অসুবিধের মধ্যে লেখাপড়া শিখতে হয়েছিল। তখন তাঁদের গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোনো স্কুল ছিল না বলে, গ্রাম থেকে মাইল সাতেক দূরে অবস্থিত শিমুলিয়া গ্রামের মধ্য-ইংরেজি স্কুলে তাঁকে পড়াশোনা করতে হয়েছিল। কিন্তু তাঁর পিতার আর্থিক অবস্থা এমন কিছু ছিল না যে, তিনি অন্য কোথাও তাঁর ছেলেকে খরচ দিয়ে রেখে পড়াতে পারতেন। তখন শিমুলিয়ার ডাক্তার অনন্তকুমার দাস নিজের বাড়িতে তাঁকে বিনা-খরচে থাকবার ও খাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এরপরে এখান থেকেই পড়াশুনা করে মধ্য-ইংরেজি পরীক্ষায় মেঘনাদ ঢাকা-বিভাগের মধ্যে প্রথম-স্থান অধিকার করেছিলেন ও তারপরে ১৯০৫ সালে ঢাকায় গিয়ে কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন।

ঠিক এর পরের বছর থেকেই স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। মেঘনাদ তখন ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। ওই সময়ে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী প্রতিবাদ-সভায় যোগদান করবার অভিযোগে কলেজিয়েট স্কুল থেকে ছাত্রদের পাইকারি হারে বিতাড়িত করা আরম্ভ হলে তিনি ঢাকার জুবিলি স্কুলে গিয়ে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে বিনা বেতনে পড়বার সুযোগ পেয়ে এবং একইসঙ্গে বৃত্তিলাভ করে তাঁর পড়াশুনা করবার অনেকটা সুবিধা হয়েছিল। এসময়ে তিনি এসব সুবিধা না পেলে তাঁর লেখাপড়ায় আরো বাধার সৃষ্টি হত; কেননা, তাঁর পিতা তাঁকে কোনো ধরণের খরচ দিতেই অসমর্থ ছিলেন। একইসাথে তিনি এসময়ে ব্যাপটিস্ট মিশনের বাইবেল-ক্লাসেও যোগ দিয়েছিলেন। যদিও তিনি তখন স্কুলের ছাত্র ছিলেন, কিন্তু তবুও মিশনের পরীক্ষায় বি. এ. ক্লাসের ছাত্রদেরও পরাজিত করে বাংলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। এরফলে তখন তিনি যে নগদ একশো টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন, তাতে তাঁর অনেক সুবিধা হয়েছিল। এরপরে ১৯০৯ সালে তিনি পূর্ববাংলার ছাত্রদের মধ্যে প্রথম হয়ে এনট্রান্স পরীক্ষা পাস করেছিলেন। এবারে ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত এবং অঙ্কে তিনি বিশ্ববিদ্যালেয়ের সব ছাত্রদের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি তাঁর এই সাফল্যের পিছনে স্কুলের শিক্ষকদের অবদান প্রসঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন— “আমার স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাক প্রবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত—পরে ইনি কলকাতায় বেথুন কলেজে যোগ দেন, সতীশচন্দ্র মুখার্জি, সংস্কৃতের মহাপণ্ডিত রজনীকান্ত আমিন ও অধ্যক্ষ মথুরামোহন চক্রবর্তীর নামই আজ বেশি করে মনে পড়ছে।”

যাই হোক, স্কুল থেকে বের হয়ে তিনি ঢাকা কলেজে আই.এস-সি. পড়েছিলেন। যদিও এবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় তিনি তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন, কিন্তু তবুও চতুর্থ বিষয়ের নম্বর বাদ দিলে তিনিই সব ছাত্রদের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন। এবারে চতুর্থ বিষয়ে তাঁর কম নম্বর পাওয়ার কারণ ছিল যে, তিনি অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে জার্মান ভাষা নিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে এভাষা শেখাবেন—এমন কাউকে তিনি খুঁজে পাননি। তবে শেষের দিকে অবশ্য অধ্যাপক ডক্টর নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত তাঁকে কিছুদিন জার্মান ভাষা পড়িয়েছিলেন। আর একারণেই তিনি জার্মানে খুব কম নম্বর পেয়েছিলেন এবং এরই ফলে আই. এস-সি.তে অন্যান্য বিষয় মিলিয়ে প্রথম হলেও তাঁকে তৃতীয় স্থান পেতে হয়েছিল। এরপরে মেঘনাদ কলকাতায় চলে এসেছিলেন। ১৯১৩ সালে তিনি গণিতে অনার্স-সহ প্রথমশ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এস-সি. পাস করেছিলেন। এখানে যাঁরা তাঁর অধ্যাপক ছিলেন, তাঁদের মধ্যে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯১৫ সালে ফলিত-গণিতে প্রথমশ্রেণীতে দ্বিতীয় হয়ে তিনি এম. এস. সি. পাস করেছিলেন। এসময়ে যাঁরা তাঁর অন্তরঙ্গ ছিলেন, তাঁদের বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, পরবর্তীকালে তিনি জানিয়েছিলেন—
“আমার অন্তরঙ্গদের মধ্যে প্রথমেই ডক্টর নীলরতন ধরের নাম মনে পড়ছে—ইনি আমার চেয়ে দু’বছরের সিনিয়র ছিলেন। আর, আমার সহপাঠীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ডক্টর জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জে, এন. মুখার্জি ও নিখিলরঞ্জন সেন।”

বস্তুতঃ এঁদের সকলেই পরবর্তীকালে প্রখ্যাত স্কলার হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে চারজনই বিজ্ঞান-কংগ্রেসের সাধারণ সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন; যথা—মেঘনাদ সাহা (১৯৩৫), জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ (১৯৩৭), সতেন্দ্রনাথ বসু (১৯৪৪) জে. এন. মুখার্জি (১৯৫১)।

এভাবেই তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন শেষ হয়েছিল, আর এসময়েই তিনি নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ঘোরতর সংকট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছিলেন। আসলে ছাত্রাবস্থাতে বিপ্লবী যতীন্দ্র মুখোপাধ্যায় বা বাঘা যতীন ও পুলিনবিহারী দাসের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল—একথা পুলিশের কানে যাওয়ার জন্য তিনি ফাইনান্স পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি পাননি। পরবর্তীকালে এপ্রসঙ্গে তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন— “আমরা ১১০ নম্বর কলেজ স্ট্রীটের একটা মেসে তখন থাকি। বাঘা যতীন প্রায়ই সেখানে আসতেন। তাঁর পরনে সব সময় থাকত সাহেবী পোশাক। তিনি আমাকে সব সময় বলতেন বিজ্ঞান নিয়ে লেগে থাকতে, বিপ্লব-আন্দোলনে যোগ না দিতে। একদিনের কথা আজ মনে পড়ে। বাঘা যতীন আমাদের মেস থেকে খাওয়া-দাওয়া সেরে তাঁর আহেরীটোলার আড্ডায় রওনা হয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে পড়ার জন্যে সঙ্গে নিয়ে গেলেন একটা বই। একজন পুলিশ-অফিসার (তাঁর নাম কি-যেন হালদার) বাঘা যতীনকে অনুসরণ করেন যতীন তা টের পান। আহেরীটোলায় গিয়ে যতীন তাঁকে গুলি করে গা-ঢাকা দেন। পুলিশ-অফিসার মারা যান না, তিনি যতীনের নাম বলে দেন। বাঘা যতীন পলাতক হয়ে উড়িষ্যায় যান। এদিকে আমরা পড়ি সংকটে। যে বইটা তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন, তাতে নাম লেখা ছিল—জ্ঞান ঘোষ। কে এই জ্ঞান ঘোষ, পুলিশ তা হদিশ করতে পারে না; কিন্তু এ-খবর শুনে আমরা ভয়ে-ভয়ে দিন কাটাই। শেষ পর্যন্ত জ্ঞান ঘোষ যে কে, পুলিশ তা বুঝতে পারে নি, তা না হলে আমাদেরও রেহাই ছিল না। … লোকে শের শার নাম করে, যতীন ভোজালি নিয়ে বাঘ মারতেন। তাঁর মামা ডক্টর হেমন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় সুরেশ সর্বাধিকারীর অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। কুষ্টিয়ায় এই মামার কাছে যতীন একবার গিয়েছিলেন। সেখানে এক বাঘের সঙ্গে যতীনের সাংঘাতিক লড়াই হয়। বাঘের মস্ত থাবার দাগ ছিল যতীনের উরুতে। সেই থেকেই তার নাম হল বাঘা-বাঘা যতীন।”

বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ থাকবার অভিযোগে মেঘনাদ ফাইনান্স পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি না পাওয়ার ফলে তাঁর জীবনে যখন সংশয় ও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল, ঠিক তখনই স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ডাক পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি যে বিজ্ঞান কলেজের নিউক্লিয়ার ফিজিক্স গবেষণাগারের পরিচালক হয়েছিলেন, স্যার আশুতোষের আগ্রহে সেই বিজ্ঞান-কলেজেই তাঁর অধ্যপনা জীবনের হাতেখড়ি হয়েছিল। ১৯১৮ সালে তিনিই তাঁকে এই নবগঠিত বিজ্ঞান-কলেজের পদার্থবিজ্ঞান-বিভাগে লেকচারার হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এখানে যোগ দেওয়ার পরে তিনি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে গবেষণাকার্যে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন এবং পরের বছরই ডি. এসি. ডিগ্রি লাভ করেছিলেন; আর এর পরের বছর প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি পেয়েছিলেন। এই দুটি সম্মান তিনি রিলেটিভিটি, প্রেশর অব লাইট (বা আলোর ভর) ও অ্যাস্টোফিজিক্স সম্বন্ধে মৌলিক গবেষণার জন্য পেয়েছিলেন। আর এরপরেই ১৯২০ সালে তাঁর বিখ্যাত গবেষণা লোকচক্ষুগোচর হয়েছিল ও তাঁর নাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তীকালে তাঁর এই গবেষণা ‘থিয়োরি অব থারমাল আয়োনাইজেশন’ বলে খ্যাত হয়েছিল; তাপের প্রভাবেও কিভাবে বৈদ্যুতিক শক্তিসম্পন্ন অণু গঠিত হয়—এটাই ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়। এই গবেষণায় নিজের নবাবিষ্কৃত পদ্ধতি প্রয়োগের দ্বারা তিনি সূর্যের ও নক্ষত্রসমূহের স্বাভাবিক গঠন সম্বন্ধে বিশদ ব্যাখ্যা করে সমগ্র বিজ্ঞান-জগৎকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিলেন। তাঁর এই আবিষ্কার বিজ্ঞানজগতে তাঁকে সম্মানের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। বর্তমানে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব যেমন বিজ্ঞানের একটি মূলসূত্র, মেঘনাদের এই আবিষ্কারও তেমনি বিজ্ঞানের একটি মূলসূত্র বলেই গণ্য হয়েছে। বস্তুতঃ তাঁর এই আবিষ্কারটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এখন থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে, ১৬১০ সালে গ্যালেলিয়োর দূরবীন-আবিষ্কারের পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁর এই আবিষ্কারটি পৃথিবীর বড়-বড় দশটি আবিষ্কারের মধ্যে জসেগা করে নিতে পেয়েছে।

তবে তাঁর এই আবিষ্কারটি শুধুমাত্র একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ছিল না, এটি তাঁর জীবন-আবিষ্কারেরই তুল্য হয়ে উঠেছিল। এরফলে তাঁর জীবনের সংশয় ও অনিশ্চয়তা দূরীভূত হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি যেন তাঁর জীবনের নতুন দিগন্ত দেখতে পেয়েছিলেন। সেবছরই ১৯২০ সালে তিনি বিলেতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে লণ্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজ অব সায়ান্স অ্যান্ড টেকনলজিতে প্রফেসর এ. ফাউলারের ল্যাবরেটরিতে তিনি প্রথমে প্রায় দেড় বছর, আর তারপরে বার্লিনে প্রফেসর নার্নস্ট–এর ল্যারেটরিতে কিছুদিন গবেষণা করেছিলেন। তখন যে পদ্ধতি তিনি কাগজে-কলমে আবিষ্কার করেছিলেন, ব্যবহারিক পরীক্ষা দ্বারা সে সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হওয়ার জন্যই তাঁর ল্যাবরেটরিতে কাজ করবার দরকার হয়েছিল। সেখান থেকে ভারতবর্ষে ফিরে এসে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের খয়রা অধ্যাপক-পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন; কিন্তু এরপরে কিছুদিন বাদেই, ১৯২৩ সালে, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর কাছে আহ্বান এসেছিল। আর তাই তারপরে একটানা পনেরো বছর ধরে তিনি এলাহাবাদেই নিজের জীবন অতিবাহিত করেছিলেন এবং এসময়ে এলাহাবাদই তাঁর দেশ ও প্রধান কর্মকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।

যখন তিনি পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের যুবক, ঠিক সেই সময়েই, ১৯২৭ সালে, বিজ্ঞানে তাঁর দানের পুরস্কারস্বরূপ তিনি লণ্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়াও সমকালে তিনি আরও বিভিন্ন জায়গা থেকে সম্মানিত পদ লাভ করেছিলেন; যেমন—ফ্রেঞ্চ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, বস্টন অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস তাঁকে নিজেদের অনারারি ফেলোরূপে নির্বাচিত করেছিল এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রনমিকাল ইউনিয়ন তাঁকে নিজেদের সদস্যপদে বরণ করে নিয়েছিল। আর এই ১৯২৭ সালেই তিনি ভারতের প্রতিনিধিরূপে ইতালি সরকার কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। অ্যালেসান্দ্রা ভোল্টা—বৈদ্যুতিক আবিষ্কারে যাঁর নাম বিজ্ঞানের ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে রয়েছে, যাঁর নাম থেকে বৈদ্যুতিক শক্তি কথাটি বোঝানোর জন্য ভোল্টেজ কথাটি চালু হয়েছে, মেঘনাদ ভারতের প্রতিনিধি-রূপে ইতালি সরকারের আমন্ত্রণে কোমোতে গিয়ে তাঁর জন্ম শতবার্ষিকী উৎসবে যোগদান করেছিলেন। এই উৎসবের বিস্তারিত বিবরণ তিনি সেকালের মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় দিয়েছিলেন।

পরবর্তীসময়ে, ১৯৪৪ সালে ভারত-সরকার যে ছ’জন বৈজ্ঞানিক দ্বারা গঠিত একটি শুভেচ্ছা-মিশন ইউরোপ ও আমেরিকায় পাঠিয়েছিল, মেঘনাদ সেই বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তখন নিজের এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে তিনি একটি বিবরণ লেখবার জন্যে অনুরুদ্ধ হয়ে যে রিপোর্টটি রচনা করেছিলেন, সেটি বর্তমানে ভারত-সরকারের পুঁথিশালায় সংরক্ষিত রয়েছে। এরপরে ১৯৪৫ সালে তিনি সোভিয়েত সরকার কর্তৃকও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, এবং ১৯৪৭ সালে নিউটনের ত্রিশতবার্ষিক উৎসবে যোগদান করবার জন্য লণ্ডনের রয়্যাল সোসাইটি কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়েছিলেন।

নিজের কর্মজীবনে ব্যস্ত থাকবার সময়েই এলাহাবাদে তিনি স্কুল অব ফিজিক্স নাম দিয়ে পদার্থবিদ্যা শিক্ষাদানের ও গবেষণার জন্য একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখানে তখন শিক্ষার মান এতটাই উচ্চ ছিল এবং গবেষণার রীতি এতটাই উন্নত ধরণের ছিল যে, তৎকালীন ভারতের বিভিন্ন জায়গায়—রাজস্থান, পাঞ্জাব, মহীশূর ইত্যাদি থেকে দলে দলে ছাত্ররা এখানে এসে ভর্তি হতেন। পরবর্তীকালে এখানকার অনেক ছাত্র এখন ভারতের বিভিন্ন জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ পদ অধিকার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। মেঘনাদ তাঁর এই প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে নিজেই জানিয়েছিলেন— “এখান থেকে যাঁরা বেরিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ক-জনের নাম হচ্ছে ডক্টর ডি. এস. কোঠারি, ডক্টর পি. কে. কিচলু, ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার, ডক্টর জি. আর. তোশনিওয়াল, ডক্টর ডবলিউ. এম. বৈদ্য, ডক্টর বি. এন. শ্রীবাস্তব; এঁরা সকলেই আজ বিশেষ সম্মানিত পদে অধিষ্ঠিত আছেন।”
এলাহাবাদে দীর্ঘকাল অতিবাহিত করবার জন্য তিনি স্যার তেজবাহাদুর সপ্রু, আচার্য নরেন্দ্র দেও, বিচারপতি সুলেমান, ইকবাল নারায়ণ, ডক্টর তারাচাঁদ প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসবার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং এঁদের প্রত্যেকের সঙ্গেই তাঁর বিশেষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

বাল্যকাল থেকেই স্বদেশের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ প্রকাশিত হয়েছিল। ভারতে বিজ্ঞানের প্রয়োগের দ্বারা কিভাবে সামাজিক উন্নতি সাধিত হতে পারে—এবিষয়ে তিনি অনেক চিন্তাভাবনা করেছিলেন। আর তাই ১৯৩৪ সালে তিনি যখন ভারতীয় বিজ্ঞান-কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন, তখন নিজের অভিভাষণে এবিষয়ে সর্বপ্রথম নিজের অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর এই অভিভাষণের সুফলরূপেই পরবর্তীসময়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স গঠিত হয়েছিল। তিনি এই ইনস্টিটিউটের কার্যতালিকা এবং গঠনতন্ত্র প্রণেতাদের মধ্যে একজন ছিলেন এবং ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত এর সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৩৫ সালে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে তিনিই এই সায়েন্স ইনস্টিটিউটের একটি সভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, এবং তাঁর নিজের ভাষায়— “সেদিনই তাঁর সঙ্গে আমি প্রথম মিলিত হই। সে সময়ে আমি তাঁকে ভারতে শিল্প-প্রসারের ও জাতীয় পরিকাল্পনার বিষয় বলি।”

এবছরই তিনি বিজ্ঞান-কলেজের বন্ধুদের সহযোগিতায় ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচার’ নামের একটি বৈজ্ঞানিক মাসিক পত্রিকা বের করেছিলেন। আধুনিক সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানকে কিভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব, জনসাধারণের কাছে একথা সহজ ও সরল ভাষায় বলাই তাঁর এই পত্রিকা প্রকাশের মূল উদ্দেশ্যে ছিল। এসময়ে ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী এই পত্রিকার জন্য তাঁকে এককালীন একহাজার টাকা দান করেছিলেন। পরবর্তীসময়ে পত্রিকাটির প্রসঙ্গে মেঘনাদ জানিয়েছিলেন—
“এতে আমি ও আমার বৈজ্ঞানিক বন্ধুরা ভারতের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সমাধানের উপায়ের প্রস্তাব রূপে অনেক প্রবন্ধ লিখেছি। তার মধ্যে অনেক বিষয় ছিল, যেমন দামোদর-উপত্যকার সংস্কার, উড়িষ্যার উন্নয়ন, খাদ্য ও দুর্ভিক্ষ, ভারতের জাতীয় গবেষণা সমিতি, নদী-উপত্যকা উন্নয়ন ইত্যাদি। এইসব প্রবন্ধের দিকে অনেকেরই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এবং তার ফলও ভালোই হয়। বর্তমানে ভারতে অনেক উন্নয়ন-পরিকল্পনায় হাত দেওয়া হয়েছে।”

১৯৩৯ সালে তিনি এলাহাবাদ থেকে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন এবং কলকাতার বিজ্ঞান-কলেজে পদার্থবিদ্যার পালিত অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এখানে এসে তিনি নিজের স্বাভাবিক উদ্যম ও উৎসাহে কাজ আরম্ভ করেছিলেন। বর্তমানে একথা কারো অজানা নেই যে, ভারতে আণবিক গবেষণার উদ্যোগের মূলে ডঃ মেঘনাদ সাহাই ছিলেন। তখন তাঁরই উৎসাহে কলকাতায় ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

এছাড়া তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্যরূপেও নির্বাচিত হয়েছিলেন। যদিও বরাবরই বিজ্ঞান সাধনাই তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল, কিন্তু তিনি কখনও মানুষের কাছ থেকে নিজেকে আড়ালে সরিয়ে রাখেননি। ১৯৪৯ সালে ডঃ রাধাকৃষ্ণানের নেতৃত্বে যে বিশ্ববিদ্যালয়-কমিশন নিযুক্ত হয়েছিল, মেঘনাদ সেই কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন। এরফলে তখন তাঁর জীবনে একটি অপূর্ব সুযোগ দেখা দিয়েছিল, তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা চাক্ষুষ দেখে আসবার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯২৭ সাল থেকে তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অব সায়ান্সের আজীবন সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৫ সাল থেকে তিনি এই অ্যাসোসিয়েশন পুনর্গঠনের জন্য মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করেছিলেন এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কাছ থেকে এর প্রসারের জন্য অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করেছিলেন।

আগেই বলা হয়েছে যে, বিজ্ঞানের সাধনা নিয়ে আত্মমগ্ন থাকলেও ডঃ সাহা কিন্তু কখনও মানুষের কথা ভুলে থাকেননি। এর প্রমাণ তাঁর ছাত্রজীবনেও পাওয়া যায়। ১৯১৪ সালে যখন দামোদরের প্রবল বন্যা হয়েছিল, মেঘনাদ তখন এম. এস. সি–র ছাত্র ছিলেন। সেসময়ে তিনি আর্তত্রাণের জন্যে কৃষ্ণকুমার মিত্রের দ্বারা গঠিত স্বেচ্ছাসেবক-বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। এরপরে ১৯২৩ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় যখন বেঙ্গল রিলিফ কমিটি গঠন করেছিলেন, মেঘনাদ তখন তাঁর অন্যতম সহযোগী ছিল। এমনকি ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের প্রাথমিক সাহায্যদানের জন্য তিনি ইস্টবেঙ্গল রিলিফ কমিটি নাম দিয়ে একটি সঙ্ঘও গঠন করেছিলেন। কিন্তু এর মাত্র ছ’বছর পরে হঠাৎই বিনামেঘে বজ্রপাতের মতোই তাঁর জীবনে মৃত্যুর যবনিকা নেমে এসেছিল। ইতিমধ্যে তিনি ভারতের লোকসভার এবং পরিকল্পনা-কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৫৬ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি বা ১৩৬২ বঙ্গাব্দের ৩রা ফাল্গুন তারিখে দিল্লীতে তিনি আকস্মিকভাবেই পরলোকগমন করেছিলেন। তাঁর এই মৃত্যুকে মর্মান্তিক মৃত্যু বলা যেতে পারে। সেদিন সকালে দিল্লীর রাষ্ট্রপতি-ভবনে পরিকল্পনা-কমিশনের একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। আর সেই বৈঠকে যোগদান করবার জন্যই তিনি সকাল দশটা নাগাদ ট্যাক্সি-যোগে রাষ্ট্রপতি-ভবনে যাচ্ছিলেন। একইসাথে সেদিন আবার দিল্লীতে ইরানের শাহের আসবার কথা ছিল বলে তাঁর সম্বর্ধনার জন্য রাষ্ট্রপতি-ভবনের কাছে খুব ভিড় হয়েছিল। এজন্য মেঘনাদ একটাসময়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে পদব্রজেই রাষ্ট্রপতি ভবনের দিকে রওনা হয়েছিলেন; কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই তিনি হঠাৎই অজ্ঞান হয়ে রাস্তার উপরে পড়ে গিয়েছিলেন। তখন কাছেই যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা তাঁকে ধরাধরি করে পাশের লনে নিয়ে গিয়েছিলেন, এবং এঁদের মধ্যে একজন তাঁকে চিনতে পেরে ওয়েলিংটন হাসপাতালে নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে তাঁকে চিকিৎসকেরা মৃত বলে ঘোষণা করেছিলেন। যদিও এর বছর কয়েক আগে থেকেই তিনি রক্তচাপ সমস্যায় ভুগছিলেন, কিন্তু নিজের মৃত্যুর আগে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থই ছিলেন। সেদিন দ্বিপ্রহরে তাঁর মৃতদেহ বিমানযোগে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল এবং কেওড়াতলা শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল।

অধ্যাপক মেঘনাদ সাহার জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তিনি অতি দীন ও নগণ্য অবস্থা থেকে নিজের কর্মের ও মনীষার দ্বারা উচ্চাবস্থায় পৌঁছেছিলেন। যদিও তিনি গবেষণাগারের নিভৃতে বসে সাধনা করেছিলেন, কিন্তু তবুও মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের দুঃখ ও দুর্দশা সম্বন্ধে এতটুকু উদাসীন ছিলেন না। বৈজ্ঞানিকেরা বলেন যে, জ্বলন্ত সূর্য থেকে সামান্য একটি নগণ্য খণ্ড একদিন বিক্ষিপ্ত হয়ে পাক খেতে শুরু করেছিল এবং সেটাই ক্রমশঃ শীতল হয়ে অবশেষে এই পৃথিবী গড়ে উঠেছে

অনুরূপভাবে মেঘনাদও একটি অগ্নি-গোলকের মতোই তাঁর অসামান্য প্রতিভার তীব্র তেজ নিয়ে ছাত্রজীবন থেকে কর্মজীবনে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন; আর তারপরে নানাভাবে পাক খেতে খেতে অভিজ্ঞতার বাতাসে শীতল হয়ে মনীষীরূপে দেখা দিয়েছিলেন। আর তাই আজও তিনি শুধু বৈজ্ঞানিক মহলেই নন, সর্বত্র বন্দনীয়। অতীতে আইনস্টাইন, লর্ড রাদারফোর্ড, অধ্যাপক রাসেল ইত্যাদি বিদেশী বৈজ্ঞানিকেরা মেঘনাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রীত ও উল্লসিত হয়ে তাঁর সম্বন্ধে অনেক উচ্ছ্বসিত প্রশস্তি করেছিলেন। মেঘনাদ তখন বয়সে অতি তরুণ এবং পরাধীন ভারতের একজন নাগরিক ছিলেন। সেকালের সেই ভারতে বাস করেও তিনি যে বিদেশীর দৃষ্টি যে আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন, এটা শুধু তাঁর নয়, সমগ্র ভারতের এবং ভারতবাসীর সৌভাগ্য। ১৯১৭ থেকে তিনি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখতে আরম্ভ করেছিলেন এবং ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি পঞ্চাশটির বেশি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। এসব ছাড়াও তিনি অন্যান্য যেসব প্রবন্ধ লিখেছিলেন, সেগুলির সংখ্যাও কম কিছু নয়। তাছাড়া তাঁর অন্যান্য সতীর্থ ও সহকর্মীদের সহযোগে লিখিত নিবন্ধ তো রয়েছেই। আজও তাঁর রচনার বেশিরভাগই বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন পত্র ও পত্রিকায় ছড়িয়ে রয়েছে। বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর রচিত গ্রন্থাবলীগুলি হল—The Principle of Relativity, Treatise on Heat, Treatise on Modern Physics, Junior Text Book of Heat with Meteorology.#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!