বাংলা নববর্ষ ও হালখাতা: ঐতিহাসিক উৎসের সন্ধানে

ইতিহাস বলে যে, বর্তমান সময়ে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে উৎসব পালন করবার যে রেওয়াজটা প্রচলিত রয়েছে, সেটা কিন্তু খুব একটা পুরোনো নয়। তাছাড়া সুবিশাল ভারত ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে বছর হিসেব করবার পদ্ধতিগুলিও কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ধরণের। তাই স্বভাবতঃই বাংলায় পয়লা বৈশাখ তারিখে নববর্ষ পালনকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ প্রায় থাকেই না। তবে নতুন বছরকে অভ্যর্থনা করবার একটা প্রথা পৃথিবীর বহু সংস্কৃতিতেই সেই প্রাচীনকাল থেকেই যে প্রচলিত রয়েছে, সে কথাটাও এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে স্মরণযোগ্য।

ঐতিহাসিকদের মতে সভ্যতার ঊষাকাল থেকেই প্রাচীন যাযাবর জাতিগোষ্ঠীগুলি চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধি অনুযায়ী সময়ের হিসেবে করত। তাই প্রাচীন কৃষিকেন্দ্রিত সমাজগুলিতেও তখন চান্দ্র বৎসর গণনার পদ্ধতি প্রায়শঃই অনুসৃত করা হত। কিন্তু— সৌর-আবর্তনকে কেন্দ্র করেও বছরের হিসেবও বেশ প্রাচীনকাল থেকেই শুরু হয়েছিল। বর্তমানে সৌর-চান্দ্র মিশ্রিত হিসেব অনুযায়ী বিভিন্ন পঞ্জিকার বিধানই বিভিন্ন জাতির মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু ঠিক একই তারিখে বরাবরই যে সর্বত্র নববর্ষ পালন করা হচ্ছে — এমন কিন্তু নয়। উদাহরণস্বরূপ বলে চলে যে, অতীতের কোন একসময়ে ইউরোপে বসন্তকালে বা মার্চ মাসে নতুন বছর শুরু হত। অন্যদিকে প্রাচীন বাংলায় হেমন্তকালে যে নতুন বছর আরম্ভ হত, অগ্রহায়ণ — নামটিই সেটার ঐতিহাসিক প্রমাণ। এথেকে বুঝতে পারা যায় যে, তখন ফল-ফুলের মরসুম ও শস্যের মরসুমকে বছরের প্রথম বলে গণ্য করবার রেওয়াজটাই মুখ্য ছিল। প্রাচীন চীনে তো অনেক সময়েই নববর্ষ নির্দিষ্ট কোন তারিখে অনুষ্ঠিত হত না, সেখানে তখন চাঁদ ও সূর্যের সূক্ষ্ম গতির জটিলতার কারণে কোনো বছরে বারো তো কোনো বছরে আবার তেরো মাসে বছর গণনা করা হত। ইহুদী পঞ্জিকাতেও কোন কালেই নববর্ষ সুনির্দিষ্ট ছিল না।

প্রাচীনকালে বাংলা নববর্ষও যে শুধুমাত্র হেমন্তেই হত — এমনটা কিন্তু নয়। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমায় সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হত যখন — অতীতের কোন একসময়ে তখনই এদেশে নতুন বছর শুরু বলে ধরা হত। সেই কারণেই অতীতের কোন কোন পণ্ডিত দোল ইত্যাদি বসন্তোৎসবকে সেটারই স্মৃতিবাহী বলে গণ্য করেছিলেন। আজও তামিল নববর্ষ পোঙ্গলও কিন্তু মাঘের শুরুতেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

ইউরোপের নববর্ষের ইতিহাস খুঁজলেও বসন্তোৎসবের উচ্ছ্বাস এবং কিছুটা লাগাম-খোলা ভাবই দেখতে পাওয়া। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সীজার ৪৬ খৃষ্টপূর্বাব্দে সেযুগের প্রচলিত রোমান পঞ্জিকার সংস্কার করে জানুয়ারি মাসে বর্ষারম্ভ ঘোষণা করলেও পুরোনো ‘স্যাটার্নালিয়া’ জাতীয় লাগাম-ছাড়া যৌবনোৎসবের রেওয়াজটা কিন্তু বদলাতে পারেন নি। সেটারই ঐতিহাসিক সূত্র বহন করে এখনো নিউ ইয়ার্স ইভের উৎসবে মিসলটো (নকল গাছ)–এর তলায় তরুণ-তরুণীর চুম্বন বিনিময়ের বাধ্যবাধকতা থাকবার প্রথাটি টিকে রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেই বলে থাকেন যে, আদিম মানুষের প্রাগৈতিহাসিক আরণ্যক জীবনের নির্বাধ যৌনাচরণের পরিশীলিত সুসভ্য বিবর্তন হিসেবেই এই নকল গাছের তলায় প্রেম বিনিময় করবার রেওয়াজটি এখনও বহমান রয়েছে। কিন্তু অতীত থেকেই ভারতীয় সমাজে সামগ্রিকভাবেই ইউরোপের থেকে রক্ষণশীলতা বেশি বলে, কালের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নববর্ষের উৎসব-আচার থেকে তেমন ধরণের রেওয়াজ-রীতিগুলোকে অনেককাল আগেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। খুব সম্ভবতঃ এই ধরণের ছাড়পত্র দেওয়ার বিরুদ্ধে রক্ষণশীল সামাজিক মানসিকতা থেকেই ভারতের উত্তরাপথের অনেক জায়গাতেই হোলিকে পৃথক করে দিয়ে আলাদাভাবে নববর্ষ হিসেব করবার রেওয়াজটি এসেছে। ভারতের অনেক অঞ্চলেই চৈত্র পূর্ণিমার পরের দিন বর্ষারম্ভ হয়ে থাকে। এছাড়া নেপাল ও অন্যান্য অঞ্চলে তো কার্তিক পূর্ণিমার পরের দিনও নতুন বছর শুরু হয়। কিন্তু এই উৎসবের চরিত্র প্রাচ্য ভূখণ্ডের সর্বত্রই— শুধু ভারতে নয়— একধরণের যৌবনোৎবের থেকে অন্নোৎসবরূপেই বেশি পরিমাণে ব্যাপ্তি লাভ করেছে বলে দেখতে পাওয়া যায়।

জাপান হোক, কিংবা চীন হোক, কিংবা সিংহল হোক— সর্বত্রই নতুন শস্য ও নতুন ফলকে কেন্দ্র করে এই উৎসব চলে। এই একই জিনিস — মেক্সিকো, পেরু প্রভৃতি অঞ্চলে, এবং উত্তর আমেরিকার রেড ইণ্ডিয়ানদের অজস্র গোষ্ঠীর, যেমন — ইরোকোয়া, স্নোহোমিশ, স্যালিস, চিপ্পেওয়া প্রভৃতি মধ্যেও — এই উপলক্ষে অন্নোৎসবটাই মুখ্যতর বলে গণ্য হয়। সুইডেন, ডেনমার্ক ইত্যাদি দেশেও ব্যাপারটা অনেকটা একই। ভারতে পোঙ্গলের মূল উৎসবটাও কিন্তু নতুন অন্নভিত্তিক। অর্থাৎ— যেটা কোন কৃষিকেন্দ্রিক সভ্যতার মূল আর্থনীতিক ভিত্তি, সেই শস্য যখন নতুন থাকে, তখনকার চন্দ্র-সূর্যের অবস্থানকে তিথিগতভাবে হিসেব করেই একদা পৃথিবীতে নববর্ষ পালন করবার প্রথা প্রচলিত হয়েছিল। আজও শস্য ঘরে তোলা উপলক্ষ্যে আদিবাদীদের মধ্যে যে ধরণের উচ্ছ্বাস উৎসব দেখতে পাওয়া যায়, নববর্ষের উৎসব কিন্তু সেটারই সমধর্মী উৎসব। এটি আসলে প্রাচীন উর্বরতাকেন্দ্রিক সংস্কৃতিরই লব্ধফল। আদিম থেকে প্রাচীন, সেখান থেকে মধ্যযুগ— এমনকি একাল পর্যন্ত মানুষের মনে যে জাদুবিশ্বাস সক্রিয় ছিল এবং এখনও রয়েছে, এই উৎসবের সাথে জড়িত বিভিন্ন অনুষ্ঠান কিন্তু সেটাকেই প্রতিফলিত করে। চীনে অতীতের কোন একসময়ে পুরোনো বছরের প্রতীক হিসেবে কাগজের ড্রাগনকে আগুনে পুড়িয়ে পুরোনো বছরের জীর্ণ ক্লান্ত রাত্রিকে ভস্মসাৎ করাই হোক, কিংবা হিন্দুদের বিঘ্ন-বিনাশন (অতীতে বিঘ্নরাজ) গণপতির পূজা করাই হোক, কিংবা পশ্চিম আফ্রিকার কোনো কোনো উপজাতির মধ্যে নতুন ফসল ও নতুন বছরের মঙ্গল কামনায় কৃষিক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মিলনোৎসবই হোক — সবকিছুর পিছনেই সেই জাদুর প্রত্যয় কাজ করছে। জাপানী নববর্ষ উৎসবের একটি প্রথায় এই দু’য়ের মেলবন্ধন ঘটেছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে নতুন শস্যের সম্ভাব ঘরে তোলবার পরে দুটি পিঠে বানানো হয়, সেগুলির মধ্যে একটি পুরুষ ও অন্যটি নারী। সেগুলির প্রতীকী মিলনের মধ্যেই সেখানকার নববর্ষ উৎসবের পূর্ণ তাৎপর্যটি নিহিত রয়েছে।

হিন্দু বাঙালীর বাংলা নববর্ষ পালনের দুটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যথা — হালখাতা এবং গণেশমূর্তির প্রতিষ্ঠা ও পূজা। এই দুটিই বর্তমানে হিন্দু ব্যবসায়ী সমাজের প্রায় অবশ্য-পালনীয় প্রথা। প্রসঙ্গতঃ একথাও স্মরণযোগ্য যে, কোনো-কোনো ব্যবসায়ী আবার বৈশাখ মাসেই অক্ষয় তৃতীয়ার দিন নিজের গদীতে গণেশ প্রতিষ্ঠা করে থাকেন। গবেষকদের মতে এই গণেশ-প্রতিষ্ঠার মধ্যে অবশ্য বেশ কিছু সুপ্রবীণ লোকায়ত সংস্কার রয়েছে। এখানে আগে হালখাতার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করে তারপরে গণেশ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করা যাক।

বর্তমান সময়ে গবেষকদের মধ্যে এই বিষয়ে কোন মতভেদ নেই যে, বাংলা বছর বা বঙ্গাব্দের প্রচলন গৌড়রাজ শশাঙ্কের সময় থেকেই বা তাঁর হাতেই ঘটলেও হালখাতা কিন্তু মূলতঃ মোঘল আমলের রাজ্যশাসন পদ্ধতির সঙ্গে সম্পর্কিত। সম্রাট আকবরের আমল থেকে মুসলিম চান্দ্রবর্ষ তথা হিজরির দিন সন প্রভৃতি অনুযায়ী বাদশাহী রাজস্ব এবং তহশীল ইত্যাদি বিষয়ে হিসেব-নিকেশ করা হত। তখন ফসলই যেহেতু বাদশাহী রাজস্বের প্রধান মাধ্যম ছিল, তাই এই সন-তারিখের নতুন হিসেবের প্রচলিত নাম হয়ে দাঁড়িয়েছিল — ‘ফসলী’। এই হিসাবানুযায়ী নতুন বছরে রাজস্ব আদায় করবার নির্দিষ্ট তারিখরূপে বছরের প্রথম দিনটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে সেকালের সংস্কৃতনবীশরা সেটার নাম দিয়েছিলেন — ‘পুণ্যাহ’, অর্থাৎ— ‘পুণ্য দিন’। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের চলাফেরা করবার নিয়মে হিসেব করা হয় বলে, সেটার বার্ষিক দিনসংখ্যা সূর্যের আহ্নিক ও বার্ষিক গতির ওপরে নির্ভরশীল সর্বজনীনভাবে গৃহীত ৩৬৫ দিনের বছরের থেকে ১১ দিন কম হয়ে থাকে। এর ফলে বাদশাহী রাজস্ব আদায়ের হিসেবপত্র প্রতিবছর বঙ্গাব্দের (যা তখন ব্যাপকতরভাবে প্রচলিত ছিল) সঙ্গে গরমিলে পড়তে থাকবার জন্য অবশেষে বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ তারিখটিকেই সরকারি খাজনা ইত্যাদি আদায় করবার নির্দিষ্ট দিনরূপে স্থির করা হয়েছিল। পরবর্তী কয়েক শতবছরে ব্যবসায়ী মহলে সেই রেওয়াজটিই হালখাতায় পরিণতি লাভ করেছে। এই প্রসঙ্গে আরেকটা উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য হল যে, অতীতে দক্ষিণ ২৪ পরগণার নানা জায়গায় কিন্তু চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে হালখাতা অনুষ্ঠিত হত বলে জানা যায়, এর পিছনে থাকা কারণটি আজও গবেষকদের কাছে অজ্ঞাত। মহারাষ্ট্রের মত অবশ্য ভাদ্র মাসে গণেশ চতুর্থী পালনের সঙ্গে তুলনীয়ভাবে বাংলায় ব্যাপকভাবে গণেশপূজা অনুষ্ঠিত হয় না।

গবেষকদের মতে গণেশ পূজা এবং গণেশের মূর্তি বাণিজ্যকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করবার মধ্যে প্রাক-মুসলিমকালের কিছু সংস্কার ও বিবর্তনের আকর্ষণীয় একটি ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে। বর্তমান সময়ের সিদ্ধিদাতা এই গণেশ ওরফে গণপতি আদিতে কিন্তু বিঘ্নরাজ হিসেবেই গণ্য হতেন। গবেষকদের মতে গণেশই ধ্রুবপদী ভারতীয় দেবদেবীদের মধ্যে (বিষ্ণুর নৃসিংহাবতার রূপটি ছাড়া) একমাত্র পশু-মানব সমন্বিত মূর্তি। এককভাবে পার্বতী কর্তৃক গণেশকে জন্মদানের যে পৌরাণিক বিবরণটি কালক্রমে প্রচলিত হয়েছে, সেটার আদি-কাঠামো ওরফে আর্কিটাইপ বিশ্লেষণ করলেই বুঝতে পারা যায় যে, গণেশ প্রথমে কোনো পার্বত্য জাতি (পার্বতীপুত্র কথাটি স্মরণযোগ্য)— যাঁদের কুলপ্রতীক হাতী ছিল,— তাঁদের উপাস্য দেবতা ছিলেন। মূলগত দিক থেকে গণেশ যে প্রাগার্য দ্রাবিড়ভাষী জাতি কৌমের দেবতা, বর্তমান সময়ের অনেক পণ্ডিতই সেকথা স্বীকার করে নিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে সামাজিক দ্বন্দ্বের বিবর্তনে যখন সমন্বয়ের সৃষ্টি হয়েছিল, তখন পশু এবং মানুষের মূর্তিরও প্রতীকী সমন্বয় ঘটেছিল। ইঁদুর বাহন সম্ভবতঃ সেই ভিন্নতর যে দ্বন্দ্বশীল গোষ্ঠীর নরদেহী দেবতা, তাঁর বাহন ছিল,— ওরফে তাঁদের কৌলিক টোটেম (পশু-প্রতীক) ছিল পার্বতীর ‘ইম্যাকুলেট কনসেপশ্যন’–জাত পুত্র গণেশকে শিবপুত্ররূপে গ্রহণ করা; তাঁকে আর্যীকরণ বা এরিয়ানইজেশ্যনেরই দ্যোতক বলে ধরা যায়, যদিও শিবও মূলে প্রাগার্যভাষীদেরই দেবতা ছিলেন, এবং হরাপ্পা-সংস্কৃতির ঐতিহাসিক শীলমোহরই সেটার পরিচয়বাহী।

গণেশ নামের তাৎপর্যটির অন্বেষণও এখানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ‘গণ’ শব্দের মৌলিক অর্থ হল — ট্রাইব বা আদিবাসী কৌম। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীন ভারতের ‘গণ’ রাষ্ট্রগুলিতে ব্রাহ্মণ্য-ঐতিহ্যানুসারী বর্ণাশ্রম-ভিত্তিক শ্রেণী সমাজের পরিবর্তে একধরণের সীমাবদ্ধ গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল; যেগুলিকে ধ্বংস করবার ‘প্রয়োজনীয়’ স্বার্থ সম্পর্কে কৌটিল্য তাঁর ‘অর্থশাস্ত্র’ নামক গ্রন্থটিতে বহু কথা লিখেছিলেন। সেযুগের ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির বহির্ভূত ওই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলির সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠিত কোনো দেবতাই তখন গণেশ বা গণপতিরূপে গণ্য হতেন। খুব সম্ভবতঃ পঞ্চাশ প্রকরণের গণপতি-মূর্তি কল্পনা ঐ বিভিন্ন ‘গণ’ রাজ্যের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের উৎসজাত। সেই রাষ্ট্রগুলির গণতান্ত্রিক চরিত্রই সেযুগের শ্রেণীশোষক ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতির আওতাভুক্ত অন্য রাষ্ট্রগুলির সামাজিক শাসন-শোষণের পক্ষে বিঘ্নস্বরূপ ছিল। এই কারণেই আদিতে গণেশ ‘বিঘ্নরাজ’ বলেই গণ্য হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সেই গণরাষ্ট্রগুলি অবশেষে যখন বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল, তখন সংস্কৃতি-তত্ত্বের স্বাভাবিক নিয়মেই তাঁদের আরাধ্য দেবতা, অভিজেতা ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতির বলয়ভুক্ত রাষ্ট্রগুলির দেবমণ্ডলে রূপান্তরিত চরিত্রে গৃহীত হয়েছিলেন। এরপরে গণেশের আগেকার ‘বিঘ্নকারী’ চরিত্রকে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে ভুলে যাওয়া হয়েছিল, এবং তিনি সিদ্ধিদাতায় পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর শিবপুত্ররূপে স্বীকৃতি এবং হস্তীমুখকে ইন্দ্রের বাহনের ছিন্নমুণ্ড-রূপে কল্পনা ইত্যাদি বিষয় তাঁকে ব্রাহ্মণ্য দেবতাদের জাতে তুলেছিল। ‘সিদ্ধম্’ শব্দের প্রাচীন অর্থ হল — ‘অক্ষর’; এরপরে একটা সময়ে লিপি প্রচলন করবার ব্যাপারে তাঁকে স্মরণ করা শুরু হয়েছিল, এবং বিজিত গণরাষ্ট্রগুলির মানুষের সঙ্গে কার্যকরী একটা সমন্বয়-ব্যবস্থা হিসেবেই খুব সম্ভবতঃ সব পুজোর আগেই গণেশ পূজার বিধান দেওয়া হয়েছিল। শুধু বাংলা নয়, ভারতের যে কোন অঞ্চলেই নব বর্ষারম্ভে সর্বকর্মের প্রাক্কালে গণেশ পূজা করবার উৎসও সেখানেই নিহিত রয়েছে।

অতীতে গণেশ যে মূলতঃ অব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতির বলয়ভুক্ত দেবতা ছিলেন, দক্ষিণ চব্বিশ-পরগণার নানা অঞ্চলে প্রচলিত একটি লোকপুরাণ-বৃত্তের কাহিনী থেকে সেই তথ্যের খোঁজ পাওয়া যায়। গবেষকদের মতে, শনির দৃষ্টিতে গণেশের মানব মুণ্ড উড়ে যাওয়ার পরে ঐরাবতের মুণ্ড এনে গণেশের দেহে বসানোর যে ধ্রুবপদী পুরাণের গল্প প্রচলিত রয়েছে, ঐ লোকপুরাণ কথায় সেটার পরিপূরক পববর্তী অংশটুকু গড়ে উঠেছে। ঐসব অঞ্চলের স্থানীয় সংস্কার অনুযায়ী গণেশের সেই আদি মুণ্ডটিই এখন সেখানে বারাঠাকুর-রূপে গৃহীত এবং উপাসিত হয়ে থাকে। এই যে, বাংলার লৌকিক দেবতা বারাঠাকুরের সঙ্গে গণেশের অভিন্নতা কল্পনা, সেটা পরিশীলিত ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতির প্রভাবজাতও হতে পারে। তবে, এর বিপরীতটা হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়; অর্থাৎ— আদিতে গণেশ যে একজন লৌকিক দেবতাই ছিলেন— সেদিক থেকেও গণেশ নামটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

পুরাণবৃত্তের অর্বাচীন স্তরে গণেশের স্ত্রী হিসেবে — সিদ্ধি ও বুদ্ধি—কে নির্দেশ করা হলেও, প্রাচীনতর গণেশভাবনায় লক্ষ্মীকেই তাঁর নর্মসহচরী হিসেবে দেখতে পাওয়া যায়; প্রাচীন কিছু উপমিথুন মূর্তিতে লক্ষ্মীর সঙ্গে গণেশকে যেমন দেখা যায় (গবেষকদের মতে যেটার বিবর্তন জাপান ও চীনদেশের গণেশ ও তাঁর সঙ্গীর যুগলমূর্তি কুঅন-সি-ত্যেন বা কঙ্গি-তেনে ঘটেছিল); তেমনি ঠিক অনুরূপ মিলনোৎকণ্ঠিত ভঙ্গীরতভাবে গণেশের ও লক্ষ্মীর যুগল ধ্যানমূর্তিও অতীতে কল্পিত হয়েছিল বলে দেখা যায়। পরবর্তীকালের ধর্মতাত্ত্বিকরা এই লক্ষ্মীকে শিব-পার্বতীর কন্যা নয় বলে প্রাগ্রসর সমাজের সংস্কারানুযায়ী ব্যাখ্যা করলেও, আদিমতর সমাজের কোনো কোনো গোষ্ঠীতে অনুসৃত ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহের ‘ট্যাবু’ না থাকবার সূত্রটিও এই লক্ষ্মী-গণেশ কল্পনার মধ্যে থাকতে পারে। দুর্গাষষ্ঠীব্রতের একটি প্রচলিত গল্পে যে দেখা যায় যে, নারায়ণই দুর্গার স্তন্যপান করবার লোভে দেবীর নির্মিত পুতুলের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন, যেটি জীবন্ত হয়ে গণেশ নামে পরিচিত হয়েছিল; — অতীতে এই গল্পটি গড়ে ওঠবার পিছনে গণেশ লক্ষ্মী-সংক্রান্ত এই সমস্যার ঐতিহাসিক সূত্র থাকা সম্ভব। নববর্ষের উৎসবের ঐতিহাসিক সূত্র ধরে গণেশপূজার তাৎপর্য প্রসঙ্গে এত অশাস্ত্রীয় কথা বলবার কারণটুকুও এবারে জানিয়ে দেওয়া যাক।

নববর্ষের উৎসবের মধ্যে যে অর্বাচীনকালের লোকবিধির সঙ্গে সঙ্গে স্মরণাতীতকালের লৌকিক সংস্কার রূপান্তরিত বা পরিশীলিতভাবে চলে আসছে, গণেশপূজার আনুপূর্বিক ধারাক্রমটি বিশ্লেষণ করলেই সেকথা বুঝতে পারা যায়। এই উৎসবে বর্ষবোধনের বিশ্বজনীন লোকবিধি তো মানা হয়েছেই, একইসাথে অর্থনৈতিক বিবর্তনের পথ ধরে এতে মধ্যযুগকালীন ব্যবসা-বাণিজ্য-রাজস্ব ইত্যাদি নির্ভর সমাজের প্রয়োজনে সৃষ্ট হালখাতার ব্যাপারটাও ঢুকে পড়েছে। আর গণেশপূজার মধ্যে সুপ্রাচীন কৌমসমাজের বিবিধ বিধি এবং সংস্কার এসে সমাবৃত হয়েছে। এই সবকিছুর সমন্বয়েই বাঙালীর নববর্ষ যথার্থ একটি প্রধান লোক-উৎসবরূপে গড়ে উঠেছে। মহারাষ্ট্রে গণেশচতুর্থীতে যে গণপতি উৎসব পালিত হয়, সেটার প্রেক্ষিত আলাদা; গণেশ সেখানে হিন্দু ক্ষাত্র শক্তির প্রতীক; বাংলার গণেশের সঙ্গে অন্ততঃ চরিত্রগত অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে সেটার যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, একথাও এখানে অবশ্যই স্মরণযোগ্য।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!