এই পৃথিবীতে মানুষের সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষকে বাঁচবার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। সৃষ্টির বিতর্কে না ঢুকে সাধারণভাবে বলা চলে যে, এই পৃথিবীতে মানব সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষকে তাঁর নিজের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য কাজ করতে হয়েছে। কারণ— পৃথিবীতে মানুষের জীবনধারণ করবার জন্য এই তিনটি উপাদান অপরিহার্য। ইতিহাস বলে যে, মানুষের সামাজিক বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে কখনো পুরুষ, তো কখনো আবার নারী— সংসার নির্বাহের দায়িত্ব নিয়েছিল। সংসার নির্বাহ ও জীবনধারণ করবার পথ হিসেবে মানব সমাজে প্রথম থেকেই কৃষিকার্য ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রচলিত ছিল। মানুষের জীবনধারণের জন্য আয়ের কয়েকটি নির্দিষ্ট পন্থা সমাজ কর্তৃক আজও সাধারণভাবে স্বীকৃত। যেমন— কৃষিকাজ, ব্যবসা, শিল্প, শ্রম বিক্রি ইত্যাদি। কিন্তু সামাজিক বিবর্তনের একটি পর্যায়ে পৌঁছে নির্দিষ্টভাবে নারী দেহ বিক্রির মাধ্যমে আয়ের একটি ব্যবস্থাও অতীত থেকেই চালু হয়ে গিয়েছিল, যেটার পোশাকি নাম হল— পতিতাবৃত্তি। এই বৃত্তিটি সাধারণভাবে ঘৃণিত হলেও স্বীকৃত একটি পেশা হিসেবে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত রয়েছে। অন্যদিকে প্রকৃতি মানুষকে যে কয়েকটি সাধারণ প্রবৃত্তি দিয়েছে, যেমন— ক্ষুধা, ঘুম, লোভ, দয়া, জৈবিক তাড়না ইত্যাদি; সেগুলোর মধ্যে সবথেকে জোরালো প্রবৃত্তি হচ্ছে— ক্ষুধা ও জৈবিক তাড়না। জৈবিক তাড়নার আবার প্রচণ্ড শক্তি রয়েছে। পরিবেশের রকমফের সেটি বৃদ্ধি বা হ্রাস পায়। স্বাভাবিকভাবে সমাজ স্বীকৃত পথে কোন মানুষ যখন নিজের যৌনক্ষুধা নিবারণ করতে পারে না, তখনই সে অবৈধ পথে সেটাকে মেটাবার চেষ্টা করে। মোটকথা হল যে, কোন পুরুষ যখন নিজের যৌনক্ষুধা মেটাবার জন্য বৈধ স্ত্রী ব্যতিরেকে অবৈধভাবে অন্যকোন নারীর সঙ্গ কামনা করে, অন্যদিকে কোন নারী যখন নিজের অন্ন-বস্ত্রের সংগ্রহের প্রয়োজনে নিজের দেহদান করতে প্রস্তুত হয়— তখনই তাঁদের মধ্যে আর্থিক বিনিময়ের মাধ্যমে পারস্পরিক একটা অবৈধ যৌনসম্পর্ক স্থাপিত হয়। সাধারণভাবে এটাই হল পতিতাবৃত্তির পেশাগত রূপ, এবং সামাজিকভাবে ও নৈতিকতার দৃষ্টিতে এই বৃত্তিটি দোষণীয় হোক বা না হোক— এটি কিন্তু বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। কিন্তু এই হিসেবের বাইরে গিয়েও কোন পুরুষ ও কোন নারীর মধ্যে অবৈধ যৌনসম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে। তবে পেশাদার পতিতাবৃত্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল যে— পুরুষ যেখানে আর্থিক মূল্যের বিনিময়ে নারীদেহ ভোগ করতে চায়, সেখানে নারীর যৌন চাহিদাকে নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা হয় না। বৃটিশ আমলের ভারতে পেশাদারি পতিতাবৃত্তির চিত্রটির দিকে নজর দেওয়ার আগে, সুদূর অতীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই বৃত্তিটি কেমন ছিল— সেদিকে একটু নজর দেওয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুন: প্রাচীন ভারতে গণিকার স্তর
ইতিহাস বলে যে, এই পৃথিবীতে সৃষ্টির আদিকাল থেকে পতিতাবৃত্তির উৎপত্তি ঘটেছিল; বিশেষতঃ অর্থের বিনিময়ে এই পৃথিবীতে যৌনতা বিক্রির ইতিহাস তো সুপ্রাচীন। ওয়েবস্টার অভিধান মতে— মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রাচীন সুমেরিয়ানদের মধ্যেই সর্বপ্রথম পতিতার সাক্ষাৎ পাওয়া গিয়েছিল। পৃথিবীতে ইতিহাসের জনক হিসেবে খ্যাত হেরোডেটাসের (খৃষ্টপূর্ব ৪৮৪–খৃষ্টপূর্ব ৪৩০/২০) লেখায় পেশাদারি পতিতাবৃত্তির একটি ঐতিহাসিক নমুনা দেখতে পাওয়া যায়, যেটি প্রথম ব্যাবিলনে শুরু হয়েছিল। তাঁর প্রদত্ত তথ্যানুসারে— তখন সেখানকার প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্ততঃ একবার করে সেদেশের যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হত এবং তাঁর সেবাশুশ্রূষার নমুনা হিসেবে সেখানে একজন বিদেশীর সাথে তাঁকে নামমাত্র মূল্যে যৌনসঙ্গম করতেই হত। অতীতের সাইপ্রাস এবং করিন্থেও এই একইধরনের পেশাদারি পতিতাবৃত্তি চালু ছিল বলে হেরোডেটাস জানিয়েছিলেন। এরপরে এটি সার্দিনিয়া এবং কিছু ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ইস্টার দেবতার সম্মানে প্রসারিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ফিনিশীয়দের মাধ্যমে এটি ক্রমশঃ ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর শহরগুলোতেও; যথা— সিসিলি, ক্রটন, রোসানো ভাগলিও, সিক্কা ভেনেরিয়া —ইত্যাদি শহরে প্রসারিত হয়েছিল। বেশকিছু গবেষক জানিয়েছেন যে, প্রাচীন ইসরায়েলেও এটি একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে— প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সমাজে পতিতারা স্বাধীন ছিলেন এবং তাঁরা বিশেষ ধরণের পোশাক পরিধান করা ও সেখানকার সরকারকে কর দেওয়ার ব্যাপারে আদিষ্ট ছিলেন। গ্রিক ঐতিহাসিক হেটায়েরার মতে প্রাচীন জাপানেও এই প্রথা চালু ছিল। ইতিহাসবিদ পি. কে. হিট্টি তাঁর ‘হিস্ট্রি অফ আরব’ গ্রন্থে জানিয়েছিলেন যে— আইয়্যামে জাহেলিয়াযুগে আরবে পতিতাবৃত্তি সহ আরো অনেক খারাপ কাজ চালু ছিল। তাঁর মতে— মহানবীর (সাঃ) আবির্ভাবের একশো বছর আগে আরবে আইয়্যামে জাহিলিয়া শুরু হয়েছিল; তখন ইমরুল কায়স, তারাকা আমর, লাবীদ, যুহায়ের নামক সেখানকার কবিরা বিভিন্ন অশ্লীল কবিতা রচনা করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে মাওলানা আকরাম খাঁ তাঁর মোস্তফা চরিত (প্রথম সংস্করণ) লিখেছিলেন যে— সেযুগের আরবদের মধ্যে পুংমৈথুন, স্ত্রীমৈথুন এবং পশু মৈথুন প্রচলিত ছিল এবং সেসবকে তাঁরা স্বাভাবিক বলেই বিবেচনা করতেন। থমাস এ. ম্যাকগিন (Thomas A. McGinn) তাঁর ‘The Economy of Prostitution in the Roman World’ গ্রন্থে জানিয়েছিলেন যে— প্রাচীন গ্রিস, এথেন্স ও রোমে বহু বছর আগেই পেশাদারি পতিতাবৃত্তি চালু হয়েছিল। এমনকি সেইসময়ে সেখানকার অনেক নারীকে পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য করা হয়েছিল। তাঁর প্রদত্ত তথ্যানুসারে ইউস্তিয়ানের স্ত্রী রোমক সম্রাজ্ঞী থেওডেরো তাঁর প্রথম জীবনে একজন পেশাদার পতিতা ছিলেন। এছাড়া তিনি আরো জানিয়েছিলেন যে— পৃথিবীতে পেশাদারি বেশ্যাবৃত্তির জন্য লাইসেন্স দেওয়া ও কর ধার্য করা রোমান আমল থেকেই প্রথম শুরু হয়েছিল। ‘Herodotus Book I’ গ্রন্থের 199 নং অনুচ্ছেদ থেকে জানা যায় যে— এথেন্সের আইন প্রণেতা ও কবি সোলোন (খৃষ্টপূর্ব ৬৩৮–খৃষ্টপূর্ব ৫৫৮) যিনি প্রাচীন গ্রিসের সাতজন জ্ঞানী মানুষের মধ্যে একজন হিসাবে গণ্য হতেন, তিনি খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে এথেন্সে প্রথম পেশাদারি বেশ্যালয়টি স্থাপন করেছিলেন। চীনেও সুদূর অতীত থেকেই পেশাদারি পতিতাবৃত্তি প্রচলিত ছিল বলে দেখা যায়। এই প্রসঙ্গে চৈনিক গবেষক ‘Fang Fu Ruan’ তাঁর ‘Sex in China’ শিরোনামের প্রবন্ধে লিখেছিলেন—
“Ying-chi is the first independent prostitute in Chinese history.”
অর্থাৎ— ‘Yang chi’ নামের একজন মহিলা চীনের ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন পেশাদার পতিতা ছিলেন। উচ্চশ্রেণীর ব্যাক্তিবর্গরা তাঁর দেহের ক্রেতা ছিলেন। এছাড়া প্রাচীন চিনে ‘Tang’ (তাং) নামক একটি রাজবংশ তাঁদের রাজ্যের একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে পেশাদারি পতিতাবৃত্তি করেছিল। পরবর্তী সময়ে চীনের সাঙ রাজবংশ সেদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পতিতাদের সংগ্রহ করে ‘হাঙ চৌ’ নামক একটি শহরে বসবাসের ব্যবস্থা করবার ফলে সেখানে বড় মাপের পতিতালয় তৈরি হয়েছিল। (Sex in China, Fang Fu Ruan, Springer Science & Business Media, 31st Oct. 1991) প্রাচীন ভারতে পেশাদারি পতিতাবৃত্তির চিত্রটি মহর্ষি বাৎস্যায়ন রচিত ‘কামসূত্র’ এবং কৌটিল্য রচিত ‘অর্থশাস্ত্র’ নামক গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়। তাছাড়া প্রাচীন ভারতে আগত গ্রিক ঐতিহাসিক ও পর্যটকরাও এবিষয়ে তাঁদের লেখায় অনেক ঐতিহাসিক তথ্য দিয়েছেন বলে দেখা যায়। এবারে বৃটিশ আমলের ভারতে পেশাদারি পতিতাবৃত্তির চিত্রের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। সাম্প্রতিক অতীতে দেবাশীষ বসু তাঁর ‘কলকাতার যৌনপল্লী’ নামক একটি প্রবন্ধে জানিয়েছিলেন যে— ১৮৫৩ সালের কলকাতা শহরে ৪,০৪৯টি পতিতাগৃহ ছিল যেখানে ১২,৪১৯ জন যৌনকর্মী বাস করতেন। এরপরে মাত্র তেরো বছরের ব্যবধানে ১৮৬৭ সালের কলকাতা শহরে যৌনকর্মীদের সংখ্যা একলাফে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৩০,০০০ জনে পৌঁছে গিয়েছিল। ১৯১১ সালের সরকারি আদমশুমারি অনুযায়ী সেই সংখ্যা পুনরায় কমে ১৪,২৭১ জন হয়েছিল; এবং ১৯২১ সালের সরকারি আদমশুমারি অনুযায়ী কলকাতায় বাস করা যৌনকর্মীদের সংখ্যা রো কমে ১০,৮১৪ জন হয়েছিল। তবে এই পরিসংখ্যান নিয়ে অতীত ও বর্তমান সময়ের গবেষকদের মনে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল ও রয়েছে। গবেষক বিনয় ঘোষ তাঁর ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের ৩০২-০৩ নং পৃষ্ঠায় জানিয়েছিলেন যে, ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর কলকাতা শহরে পেশাদার পতিতাদের খুবই রমরমা ছিল। তাঁর প্রদত্ত তথ্যানুসারে তখনকার কলকাতার সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ির পাশে যেমন পতিতাদের দেখা পাওয়া যেত, তেমনি— পাঠশালা, চিকিৎসালয়, এমনকি মন্দিরের পাশেও বেশ্যাদের সন্ধান পাওয়া যেত। এই প্রসঙ্গে বিশ্বনাথ জোয়ারদার তাঁর ‘পুরোনো কলকাতার অন্য সংস্কৃতি’ গ্রন্থের ৩৪-৩৮ নং পৃষ্ঠায় জানিয়েছিলেন যে, তখন বিশেষ করে— রামবাগান, সোনাগাছি, মেছোবাজার, সিদ্ধেশ্বরীতলা, হাড়কাটা, চাঁপাতলা, ইমামবক্স —কলকাতার এই জায়গাগুলো পেশাদার পতিতাদের আখড়া ছিল। এমনকি কিছু পতিতা তো তখনকার কলকাতা শহরের প্রকাশ্য রাজপথে নৃত্য পর্যন্ত করে বেড়াতেন! এবিষয়ে সেযুগের সাধারণ মানুষ পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে অনেক অভিযোগ ও আবেদন করা সত্ত্বেও সেসবের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কারণ— তখনকার কলকাতার ধনীদের তৈরি বেশ্যালয়গুলোতে কোন ধরণের হস্তক্ষেপ করবার সাহস— পুলিশ ও প্রশাসন— কারোরই ছিল না। মোটামুটিভাবে যাঁরা আঠারো শতক থেকে শুরু করে বিংশ শতকের প্রথমদিকের কলকাতা তথা বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে অবগত রয়েছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই জানেন যে, ওই সময়কার বাংলার বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে নৈতিকতা বলে গুণটি সম্পূর্ণভাবে লোপ পেয়েছিল। এছাড়া তখনকার হিন্দুসমাজে পতিতাদের এই রমরমার পিছনে কিঞ্চিৎ ধর্মীয় কারণ ছিল বলেও মনে হয়। সেযুগের অনেক হিন্দুই মনে করতেন যে— পতিতারা সমাজকে নির্মল রাখেন আর সেই কারণেই দুর্গা পুজার সময় পতিতার গৃহের ধুলোমাটি অপরিহার্য। এই মতটি কিভাবে হিন্দুদের ধর্মই সংস্কারের মধ্যে প্রবেশ করেছিল— সেকথা এখন বলা খুব মুশকিল। তবে প্রবীর কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখিত ‘কালিকা পুরাণোক্ত দুর্গাপূজা পদ্ধতি’ নামক গ্রন্থের ৭২, ৮৬, ১০৮ ও ১২৭ নং পৃষ্ঠা থেকে জানা যায় যে— দুর্গাপুজোর সময়ে দশটি বিশেষ ধরনের মাটির প্রয়োজন হয়, এবং সেগুলির মধ্যে পতিতার গৃহের ধুলোমাটি অন্যতম। হয়ত তন্ত্রচর্চার হাত ধরেই এই বিষয়টি অতীতের কোন একসময়ে হিন্দুদের ধর্মীয় আচরণের মধ্যে স্থান পেয়েছিল।
আরও পড়ুন: প্রাচীন ভারতে গণিকা ও গণিকাবৃত্তি
বাস্তবে, অতীত থেকেই নারীদের সবসময়ে ভোগের পণ্য বলেই মনে করা হয়েছিল, এবং ইংরেজ আমলও সেসবের কোন ব্যতিক্রম ছিল না। তৎকালীন সমাজের নেতৃস্থানীয় খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের সিংহভাগ মানুষই এই নৈতিক স্খলন থেকে মুক্ত ছিলেন না। আঠারো-ঊনিশ শতকের কলকাতার বাবুসমাজে বেশ্যাবাজি নিতান্ত সাধারণ ঘটনা বলেই পরিচিত ছিল। শোনা যায় যে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি সুকুমারী দত্ত নামক একজন পতিতার প্রেমে মজেছিলেন। বাস্তবে সত্যিই তেমনকিছু ঘটেছিল কিনা— সেকথা এখন আর বলা সম্ভব নয়। তবে অতীতের অনেক লেখকই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরীর আত্মহত্যার জন্য এই কারণটিকেও দায়ী করেছিলেন বলে দেখা যায়। সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে জানিয়েছিলেন যে, জীবনের একটাসময়ে তিনি নিয়মিতভাবে বেশ্যা পাড়ায় গমন করতেন। ডঃ আবুল আহসান চৌধুরী তাঁর ‘অবিদ্যার অন্তঃপুরে’ গ্রন্থের ‘নিষিদ্ধ পল্লীর অন্তরঙ্গ কথকতা’ অধ্যায়ে জানিয়েছিলেন যে— মরমি কবি হাসন রাজা নিয়মিত পতিতালয়ে গমন করতেন। তবে শুধু সেকালের কলকাতার বাবুরাই নন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ সৈন্যরাও মাত্রাতিরিক্ত পতিতালয়ে গমন করতেন। এর ফলে ১৮৬০ সালে বাংলায় অবস্থান করা কোম্পানির ইংরেজ সৈন্যদের মধ্যে ষাট শতাংশের বেশি সৈন্য বিভিন্ন যৌনরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই কারণেই ১৮৬৪ সালে কোম্পানি সরকার— ‘Cantonment Act’ —নামক একটি আইন পাশ করিয়েছিল। এরপরে কোম্পানির সেনাছাউনিগুলোতে ইংরেজ সৈন্যদের জন্য আলাদা করে পতিতালয় তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে যেসব পেশাদার পতিতারা নিযুক্ত হয়েছিলেন তাঁদের কোম্পানির খাতায় রীতিমত রেজিস্ট্রিভুক্ত করে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া পতিতা ও ইংরেজ সৈন্য— উভয়কে বিভিন্ন যৌনরোগ থেকে মুক্ত রাখবার জন্য সমগ্র বাংলায় থাকা কোম্পানির প্রধান সেনা ছাউনিগুলোতে ‘লক হসপিটাল’ নামের একটি বিশেষ হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন: পুরোনো কলকাতায় বারাঙ্গনাবৃত্তি
ইতিহাস বলে যে, যুগের পর যুগ, শতাব্দির পর শতাব্দি, সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ ধরে পতিতাবৃত্তি মানব সভ্যতার একটা অঙ্গ। এককথায় বলা যেতে পারে যে, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দিক থেকে নারী ও পুরুষের মধ্যে সুদূর অতীত থেকেই বিরাজমান বৈষম্যের একটি চরম শোচনীয় পরিণতির নাম হচ্ছে পেশাদারি পতিতাবৃত্তি। বাংলাতেও এই বৃত্তির ধারাবাহিকতা বহুকাল ধরেই প্রচলিত রয়েছে। আজও শহর কলকাতায় পেশাদার পতিতাদের যে আখড়াগুলো বর্তমান রয়েছে, সেগুলো কোনোটাই একদিনে গড়ে ওঠেনি। একথা সত্যি যে, ভারতে প্রাচীনকাল থেকেই পেশাদারি পতিতাবৃত্তি চালু থাকলেও, এই বৃত্তির রমরমা কিন্তু বৃটিশ আমল থেকেই শুরু হয়েছিল। ইতিহাস অন্ততঃ সেই সাক্ষ্যই দেয়। একইসাথে এই বৃত্তিকে নিয়ে যে কথাটি আশঙ্কার সেটা হল যে, পেশাদার পতিতাদের আখড়ার সংখ্যা কমবার বদলে কিন্তু বেড়েই চলেছে এবং একইসাথে সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে থাকা পতিতাদের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। কিন্তু এর জন্য দায়ী কি বা কারা— সে উত্তর ইতিহাসে পাওয়া যায় না।
ছবিঋণ: গৌতম মুখোপাধ্যায়