বোদল্যার: দুইশো বছর পরে দাঁড়িয়ে ৫

।।শেষ পর্ব।।

বোদল্যারের প্যারিস শহর ধনিদের পদভারে কাঁপা আর অবিরাম প্রাণস্পন্দিত ব্যস্ততার নগর নয়, তাঁর শহর সমস্যাপীড়িত, নোংরা গরিবের শহর। চমৎকার দোকানপাট আর রাস্তাঘাট-এ্যাভিন্যু এসব বাস্তবে থাকলেও স্প্লিন-এর বিষাদগ্রস্ত অবয়বে সেসব ঢাকা পড়ে যায়। বোদল্যারের শহর তাঁর নিবিড়-একাগ্র পর্যবেক্ষণের নিরিখে প্রতিফলিত। ‘ভিড়’ কিংবা ‘পুরনো জোচ্চোর’ কবিতাগুলি পাঠ করলে বরং প্রচলিত প্যারিস-আভিজাত্য টোল খেতে বাধ্য। তবে, ভিড়, সমস্যা কিংবা রুদ্ধতার অবলোকনকারী কবির সত্তা নিজের নির্জনতার নির্মাতা। অসাধারণ তাঁর সেই অবলোকন-

জনাকীর্ণতা, জনশূন্যতা: কর্মময় ও সৃষ্টিশীল কবির জন্যে দু’টি সমান ও পরস্পর প্রতিস্থাপনীয় মাত্রা। যে তার নির্জনতাকে পূর্ণ করে তুলতে জানে না, ভিড় আর হৈচৈ-এর মধ্যে কী করে একা হয়ে যেতে হয় সেটাও সে জানে না। [‘ভিড়’]

দারিদ্র ও শ্রেণিচেতনা বোদল্যারের গদ্যকাব্য-গ্রন্থটিতে বিশেষভাবে চিহ্নিত। ‘গরিবের খেলনা’ ‘গরিবের চোখ’, ‘অচল মুদ্রা’, ‘চলো গরিবদের পিটুনি দেই’ এইসব কবিতায় জীবনদৃষ্টির গভীরতা আর বিদ্রূপ কার্ল মার্ক্সেরও পূর্বে প্রকৃত অর্থেই সামাজিক শ্রেণিচেতনার উজ্জ্বল উচ্চারণের স্বীকৃতি অর্জনে সক্ষম। প্রবল সামাজিক বৈষম্যের অসহনীয় গ্লানির মুক্তিকামী কবি স্পষ্টত অধিকারশূন্য-প্রবঞ্চিত গরিব মানুষদের পক্ষাবলম্বন করেন। তাঁর সৌন্দর্যচেতনা গরিব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা না করে শহরের সৌন্দর্য বাড়ানো কি শহরের জীবনকে চাকচিক্যময় করবার তৎপরতার সমালোচক। ‘গরিবের খেলনা’ কবিতাটিতে জীবনের পারস্পরিক বৈপরীত্যের বাস্তবতা কবির অসাধারণ কল্পনার প্রকাশ এবং কবিতাটি মার্ক্স-পূর্ববর্তী কালে লেখা এমন একটি কবিতা যেটি মার্ক্সীয় বিচারে শ্রেণিসচেতনতার কবিতা। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর প্যারিসের চমৎকার প্রেক্ষাপটে কবিতাটির উদ্ভব। এক সকালবেলার হাঁটাপথে কবির দৃষ্টিপাতে উঠে আসে শহরের ধনি লোকেদের সন্তানদের আশ্চর্য সুন্দর খেলনাগুলোর ছবি। সেসব খেলনা ছোটখাট বিষয় হলেও সেগুলো সংবাদ দেয় সমাজাভ্যন্তরের। ধনির সন্তানদের খেলনাগুলো এতটাই ঐশ্বর্যময় যে সগুলোর বাহারি বর্তমানের নিচে চাপা পড়ে যায় নির্ধনের দৈনন্দিনতার কষ্টের কাহিনি। তবে, কবির চোখে আটকায় বাস্তবের ভেতরে নিহিত বাস্তব- খেলনা থাকে গরিবেরও। লোহার খাঁচায় একটি জীবন্ত ইঁদুর গরিবের সন্তানের জীবন্ত খেলনা, যেহেতু পিতার ক্ষমতা নেই সন্তানকে দামি জড় খেলনা কিনে দেওয়ার। মাঝখানে একটি লোহার শিকের দেওয়ালের এপারে আর ওপারে দুই পৃথিবী। এক পৃথিবীতে জীবন্ত খেলনা নিয়ে গরিবের ছেলে প্যারিসের রাস্তায় আনন্দ উদযাপনরত এবং অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা ধনির দুলাল অবাক হয়ে দেখতে থাকে সেই তৎপরতা কিন্তু ছেলেটির দৃষ্টি খেলনার দিকে নয়, খেলনার মালিকের দিকে। নোংরা পোশাক, ধূলিময় অবয়ব আর তুচ্ছ অবস্থানে থাকা গরিবের ছেলে এবং চির-উজ্জ্বলতার বাসিন্দা ধনির দুলাল, দু’য়ের মধ্যে যখন দৃষ্টিবিনিময় ঘটে তখন বর্তমানের সমস্ত বৈসাদৃশ্য, বৈপরীত্য আর বৈষম্য ছাড়িয়ে তারা এক অদ্ভুত সাম্যে স্থাপিত হয়-

আর বাচ্চাদু’টি একে অন্যের দিকে সহোদর হাস্যে উদ্ভাসিত হলে উভয়ের দাঁতগুলো চকচক করে ওঠে সমান শুভ্রতায়। [‘গরিবের খেলনা’]

গল্পের ঢংয়ে বলা কবিতাটির শেষে নাটকীয় দৃশ্যায়নে শ্রেণিবিভেদের দেয়ালের দুই বিভিন্ন জগতে থাকা বাসিন্দার মধ্যে সাম্য অন্বেষণের কবিকল্পিত বাস্তবতা বিদ্যমান বিভাজনকে অস্বীকার করে না বরং মানুষে মানুষে প্রভেদের মৌল উপাদান যে অর্থনীতি সেটাই বুঝিয়ে দেয়। এরকমই আরেকটি কবিতা ‘গরিবের চোখ’- শিরোনাম থেকেও দেখা যাচ্ছে একটি যেন অন্যটির সম্পূরক। সৌন্দর্যবর্ধনের গর্জনশীল প্যারিস শহরের ক্যাফেতে বসা কবির দৃষ্টি চলমানতা থেকে চয়ন করে নেয় কবিতার উপজীব্য। এখানেও রয়েছে বিভাজনরেখা- ক্যাফের ধনিপুঞ্জ আর নগরের সদর রাস্তার মাঝখানে কাঁচের দেয়াল। প্রেমিকার সঙ্গে সময়-কাটানো কবির চোখে পড়ে তিনজন মানুষের তিনজোড়া বা ছ’টি চোখ আর সেই চোখের দৃষ্টি থেকে উৎসারিত আর্ত-ক্লিন্ন আলোক। অনেকটা মোপাসাঁর গল্পের মতন বর্ণিত কবিতাটিতে বোদল্যারকে আমরা পাই আশ্চর্য কথকরূপে। এরকম বেশকিছু কবিতার কথা বলা যাবে যেগুলোকে ছোট আকারের গল্পও বলা যেতে পারে যদিও এগুলো কবিতাই। বিখ্যাত ছোটগল্পকার গি দ্য মোপাসাঁ’র চাইতেও বয়সে ২৯ বছরের বড় বোদল্যারের অনেকগুলো গল্প-কবিতার কথা বলা যাবে যেগুলো শিল্পসাফল্যে মোপাসাঁ’র ছোটগল্পের সমতুল্য। উত্তম পুরুষে লেখা ‘গরিবের চোখ’ শুরু হয় প্রেমিকার প্রতি কবির একটা নাটকীয় সংলাপে-

ওহ, তুমি জানতে চাও কেন আজ তোমাকে অপছন্দ করছি আমি! নিঃসন্দেহে এটা আমার ব্যাখ্যা করার চাইতেও তোমার বুঝতে পারাটা অনেক সহজ হবে, কেননা, তুমি হলে, আমার ধারণা, কারও চিরদিনের অভিজ্ঞতায় আসা রমণিয় দুর্গমতার সবচাইতে সুন্দর দৃষ্টান্ত।

প্রেমিকার প্রতি কবির বর্ণন প্রলম্বিত হতে থাকে। কবি তাঁর প্রেমিকাকে বলছেন, তাঁরা সারাটা দিন একসঙ্গে কাটিয়েছিলেন এবং তাঁদের উভয়ের পারস্পরিক প্রতিজ্ঞা ছিল, তাঁরা সবকিছু পরস্পর ভাগ করে নেবেন। তাঁদের দু’টো সত্তা সম্মিলিত হয়ে একটাতে পরিণত হবে। তারপর সন্ধ্যায় খানিকটা ক্লান্তি নিয়ে ঝলমলে ক্যাফেতে একত্রিত হয়েছেন যেখানে নতুন সড়ক আর এ্যাভিন্যুর ধারে সুদৃশ্য ক্যাফেটা নির্মিত হয়েছে। আর চারদিকে নতুন শহরের গড়ে ওঠার নিদর্শন নানারকম জঞ্জালের স্তূপ ছড়ানো। অসমাপ্ত হলেও নির্মাণের চমকে চমকিত চতুর্দিক। শুভ্র কাঁচ, জানলার চকচকে সোনালি শিক, ননির পুতুল ধনির দুলালেরা, তাদের সঙ্গে থাকা বন্ধনীআঁটা কুকুরেরা, কব্জিতে টিয়েপাখি নিয়ে হাঁটা সুন্দরী দেবীরা আর ফলমূল, কেক আর মোরগমুরগি কাঁধে চিরযৌবনা নারী ও দেবিরা, আর সব উপাদেয় খাবার, কেক-চকোলেট, সমস্ত ইতিহাস এবং সমস্ত পৌরাণিকতা এক ঔদরিক তৎপরতার মধ্যে নিবদ্ধ হয়েছিল। বছর-চল্লিশেক একজন সমর্থ লোক দাঁড়িয়েছিল ঠিক তাঁদের সামনেই। তার কাঁচাপাকা দাড়িঅলা মুখে ক্লান্তির ছাপ। তার এক হাতে ধরা একটা বাচ্চা এবং অন্য হাতে ধরা হাঁটতে অক্ষম দুর্বল কিসিমের আরেকটা বাচ্চা। আয়ার ভূমিকাধারী লোকটা তার বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়েছে সন্ধ্যার হাওয়া খেতে। সবার পরনে জীর্ণ বস্ত্র। তিনটে মুখ, ছটা চোখ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নতুন ক্যাফেটার দিকে সমান প্রশংসাসূচক দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছিল, তবে প্রত্যেকের বয়সানুযায়ী উদ্ভাস ঘটছিল সেই দৃষ্টির। তখন:

বাপটার চোখগুলো বললো: “কী সুন্দর এটা! কী সুন্দর এটা! তোমার মনে হবে যে এই গরিব পৃথিবীর সমস্ত সোনা এই দেয়ালগুলোর ওপর।” – ছোট বাচ্চাটার চোখ: “এটা কী সুন্দর! এটা কী সুন্দর! কিন্তু এটা কেবল একটা বাড়ি, যারা আমাদের মত নয় শুধুমাত্র তারাই সেখানে ঢুকতে পারে।” – সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটার চোখ বলছিল, বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টি নিয়ে একটা বাজে আর খাঁটি আনন্দের বিষয় ছাড়া তারা আর কিছুই প্রকাশ করছিল না। গীতিকাররা বলে থাকেন যে আনন্দ আত্মাকে মহৎ করে এবং হৃদয়কে করে নরম। এই সন্ধ্যায় গানটা ছিল ঠিক-ঠিক, যেমনটা আমার পছন্দের। এই চোখগুলির পরিবারটি আমাকে কেবল নাড়াই দেয় নি, আমি খানিকটা লজ্জাও অনুভব করলাম আমাদের এইসব কাঁচের জগ আর পানপাত্রের জন্যে, যেগুলো আমাদের তৃষ্ণার চাইতেও অনেক বড়। প্রিয় ভালোবাসা, আমি দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলাম তোমার দৃষ্টির দিকে, আমার ভাবনাকে তোমার দৃষ্টির মধ্যে পাঠ করবার জন্যে। আমার দৃষ্টি লাফিয়ে পড়লো তোমার দারুণ সুন্দর আর দারুণ কিম্ভূত নম্র  দুই চোখে, খামখেয়ালিভরা ও চাঁদের অনুপ্রেরণায় উদ্ভাসিত তোমার সবুজ চোখে এবং তখন তুমি আমাকে বললে: “ঐ যে ওখানে, গাড়ির দরজার মত মেলা চোখগুলোর ঐ লোকগুলোকে আমি সহ্য করতে পারছি না! তুমি কী প্রধান পরিচারককে বলতে পারবে না, ওদের যাতে দূর করে দেয়।?”

একে অন্যকে বুঝতে পারাটা যে কী কষ্টকর, হে আমার প্রিয় অপ্সরী, এমনকি পরস্পর পরস্পরের প্রেমে মগ্ন এমন লোকেদের মধ্যেও ভাবনাটা যোগাযোগে অক্ষম!”

বোদল্যারের কবিতায় প্রতিষ্ঠিত ধর্মের চাইতেও সৎ-অসতের মধ্যকার দ্বান্দ্বিকতা মুখ্য। খ্রিস্টধর্মে তাঁর আস্থা ছিল পূর্বাপর কিন্তু শ্রেণির প্রশ্নে তাঁর মোহমুক্ততা তাঁর সামাজিক নীতিবোধের উচ্চাবস্থানের নির্দেশক। সামাজিক শোষণ, শ্রেণিবিভাজন প্রভৃতি বাস্তবতা তাঁর দৃষ্টিতে গভীর-গভীরতর তত্ত্বের বিষয় নয়, সাধারণ জ্ঞান মাত্র। সততা, নৈতিকতা, মহত্ব এসব বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যে উচ্চতর আভিজাত্যের কোনো সম্পর্ক নেই সে-বিষয়ে বদ্ধমূল ধারণা ছিল বোদল্যারের। সম্পত্তি, নিয়ন্ত্রণ, প্রভাব-প্রতিপত্তি এসব যে কোনো নিয়মনীতি কিংবা নৈতিকতার ধার ধারে না সেটা অনেক কাল আগে বোদল্যার ইঙ্গিত করেছেন তাঁর কবিতায়। ‘কেক’ (‘ল্য গাত্যু’) নামের তাঁর অসাধারণ কবিতাটিকেও অনায়াসে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা আখ্যা দেওয়া চলে। চারপাশে উদার আর প্রশস্ত খোলামেলা প্রকৃতির সন্নিধানে গিয়েছিলেন কবি। অবারিত সেই নৈসর্গিক উদযাপনের মধ্যে হঠাৎ একটি ছেলেকে দেখে তিনি তাঁর কাছে থাকা একটা রুটির টুকরো তাকে খেতে দেন। কিন্তু মুহূর্তেই তারই মত দেখতে তার আরেকটি ভাইও এসে হাজির এবং তারপর শুরু হয়ে যায় সেই রুটির টুকরো (যেটিকে ছেলেগুলি বলে ‘কেক’) নিয়ে কাড়াকাড়ি, ধ্বস্তাধ্বস্তি, লড়াই, খানিকটা রক্তারক্তিও। শেষে লড়াই যখন শেষ হয় তখন কে জিতেছে বলা মুশকিল। কেননা, রুটির সেই টুকরো গুঁড়ো হয়ে প্রায় অস্তিত্বশূন্যতায় বিলীয়মান। কবিতার শেষে যে-ধাক্কা বোদল্যার দেন তার কম্পন তাঁর সমকাল ছাড়িয়ে আজও অনুভূত হতে থাকে বিশ্বচরাচর জুড়ে-

আমার মনে হলো এইসব দৃশ্যাবলী অন্ধকারে ঢেকে দিল নিসর্গকে। যে প্রশান্ত আনন্দ এই ছোট-ছোট মানুষগুলিকে দেখবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার সত্তাকে উজ্জীবিত করে রেখেছিল তা সম্পূর্ণরূপে উধাও হয়ে গেল। বেদনা বোধ করলাম খানিকটা সময ধরে, বার-বার নিজেকে বলতে লাগলাম, “তাহলে এমন নিদারুণ দেশও আছে যেখানে রুটিকে বলা হয় কেক, এমনই ব্যঞ্জনাময় ব্যতিক্রম যা স্পষ্টত ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।” [“Il y donc un pays ou le pain s’apaelle du gateau, friandise si rare qu’elle suffit pour engendrer une guerre parfaitement fratricide!”] 

চিত্রশিল্পী এডওয়ার্ড মানে’র শিল্প-সমালোচনাকালে বোদল্যার কবির মৌলিকতা সম্পর্কে যে-মন্তব্য করেন সেটি কেবল রং-তুলির আঁচড়ের বাস্তবতার কথাই নয়, লেখালেখির ক্ষেত্রেও সেকথা প্রযোজ্য। এমনকি তা যদি হয় মূক শব্দাবলির মত রং-তুলির প্রত্যক্ষতাবিহীন তা-ও। বোদল্যারের ল্য স্প্লিন দ্য পারি কাব্য প্রসঙ্গে মন্তব্যটি যথার্থ। বস্তুত ‘স্প্লিন’ বা নির্বেদ/বিতৃষ্ণা কিংবা বিষাদ যাই বলা হোক না কেন সেটি কবির সঙ্গী প্রথমাবধি। লে ফ্ল্যুর দ্যু মাল-এর উপপর্বে ‘স্প্লিন এ ইদেয়াল’ (‘বিতৃষ্ণা ও আদর্শ’) পরবর্তীকালে, তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হলেও বলা যায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর-পরই এটির প্রস্তুতিমগ্নতায় ছিলেন তিনি। এ-গ্রন্থের কবিতাগুলি লে ফ্ল্যুর দ্যু মাল-এর পর থেকে রচিত হতে শুরু করে এবং প্রথম কাব্যের সাত বছর পরেই কাব্যটি প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল, বেরোয় ১৮৬৯ সালে। ‘স্পিন’ বা ‘বিতৃষ্ণা’-ই হলো কবি বোদল্যারের সবচাইতে মৌলিক বিশেষত্ব। সেই সঙ্গে শহর, ভালো করে বললে প্যারিস। প্রেম, নারী, মদ, মৃত্যু সবকিছু নিয়েই তাঁর রচিত কবিতা স্বতন্ত্র ও মৌলিক। কিন্তু তাঁর সত্তার দু’টি মৌলিক পরিচিতি-বিন্দু বিতৃষ্ণা এবং প্যারিস। প্রথম কাব্যে (লে ফ্ল্যুর দ্যু মাল) ‘স্প্লিন’ শিরোনামে কবিতা রয়েছে চারটি। একটি কবিতায় কবি বলছেন তিনি বেঁচে রয়েছেন হাজার বছর (‘জাভে মিইয়েয়াঁ’), কিন্তু তিনি বাসিন্দা এক ঘৃণ্য কবরের (‘আঁ সিমেতিয়েঘ্ আভোঘে’), যদিও চাঁদের ছায়াতলে। সৌন্দর্যের যত নেতিবাচকতা থাকা সম্ভব সেসবের সবটাই কবির উৎকলণ চলে তাঁর সত্তার বর্তমানতাকে বোঝাবার জন্যে। তিনি বিবর্ণ গোলাপ, পুরোনো স্ফিংস (‘আঁ ভিউ স্ফাঁ’), তাঁর সামনে উদয়াস্ত যে-দিবসের সেটি রাতের চাইতেও বেদনাময়। ‘স্প্লিন’ পর্যায়ের চতুর্থ কবিতার শুরু বিতৃষ্ণার প্রলম্বিত ছায়ার চিত্রকল্পে (‘লোং অনুই’)। পরবর্তীকালের কাফকা’র প্রতীকের মত মানুষগুলিকে কবি বোদল্যারের মনে হতে থাকে ‘মাকড়শা’র মত যারা কারাগারের শিকের আড়ালে বন্দি। অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে, সংকীর্ণ, বেদনাবিধূর পরিপার্শ্বিক, বর্তমান এবং ভবিতব্যের বোদল্যার-চিত্রিত পৃথিবীটা তাঁরই বাসভূমি প্যারিস। বোঝাই যাচ্ছে, বিতৃষ্ণা তাঁর সঙ্গী মোটামুটিভাবে তাঁর জ্ঞানোন্মেষের কয়েক বছরের মধ্যেই- প্রথমত পিতৃহীনতা, মাতৃবিচ্ছিন্নতা এবং দ্বিতীয়ত তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাপনের যন্ত্রণা এবং তৃতীয়ত তাঁর শহরের অধোগতির ধারাক্রমিকতা। আবার, ‘প্যারিস-বিতৃষ্ণা’ কাব্যের আগেই প্যারিসকে নিয়ে বেশকিছু কবিতা তাঁর লেখা হয়ে যায় প্রথম কাব্যেই ‘তাব্ল্যু পাঘিসিঅঁ’ শিরোনামে। বস্তুত তাঁর সে কাব্যিক প্যারিস প্রসন্নতার পরিবর্তে ছড়ায় অপ্রসন্নতা, জীবনদায়িনী প্রণোদনার পরিবর্তে বিতৃষ্ণা এমনকি বিবমিষাও। অন্তিমে ‘ল্য স্পিøন দ্য পারি’-তে তাঁর প্যারিস সংকীর্ণ এক দুঃস্বপ্নের বাস্তব এবং সেই বাস্তবতার জন্যে তাঁর বিতৃষ্ণা অনিঃশেষ।

বোদল্যারের ব্যক্তিগত জীবনাভিজ্ঞতার পাশাপাশি ঐতিহাসিক সামাজিক বাস্তবতার কারণও তাঁর ‘প্যারিস-বিতৃষ্ণা’র জন্যে দায়ী। তাঁর কাব্য-সমালোচনার সমান্তরালে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের প্রামাণ্য উৎসের অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ কবির মানসজগতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার হদিস নির্ণয়ে রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আমরা দেখবো একেবারে নিকটের বাস্তব কীভাবে কবির মনোভুবনে অনুপ্রবেশ করেছিল এবং তাঁর মনের গভীরে নিহিত থাকা অন্যান্য প্রবণতার সঙ্গে তা মিলেমিশে সৃষ্টি করেছিল নতুন মাত্রিকতার। সম্রাট তৃতীয় নাপোলিওঁ’র (১৮০৮-১৮৭৩) ভাইপো জর্জ-ইউজিন হাউসমান প্যারিস শহরের সাঁ-এলাকার প্রশাসক (১৮৫৩-১৮৭০) নিযুক্ত হলে সম্রাটের নির্দেশে সংস্কারসাধন, নির্মাণ ও পুনর্নিমাণের বিশাল এক কর্মযজ্ঞ শুরু হয় রাজধানি শহর প্যারিসে। এই অধ্যায়টি ফ্রান্সের ইতিহাসে এবং বিশ্বের স্থাপত্যবিদ্যার ইতিহাসে ‘হাউসমানের প্যারিস-নবায়ন’ নামে পরিচিত। প্রাচীন বিশেষ করে মধ্যযুগের যেসব স্থাপত্য-ভবন ছিল প্যারিস শহরে এবং যেখানটায় ছিল মূলত সরকারি কর্মচারি-কর্মকর্তাদের অফিস ও বাসস্থান, স্থানটা ছিল প্রচণ্ড ভিড় আর কোলাহলে ঠাসা একটি অস্বাস্থ্যকর জায়গা। পুরনো সব ভেঙে গুঁড়িয়ে নতুন-নতুন এ্যাভিন্যু, মাটির নিচ দিয়ে বহমান সুড়ঙ্গ, নালা-নর্দমা, ঝর্ণা এসব নির্মাণের এক তোঘলকি কাণ্ড শুরু হয়ে যায়। হাউসমানের এসব কর্মকাণ্ড এবং সংস্কারসাধনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিষোদ্গার, সমালোচনা হতে থাকে ব্যাপক। ১৮৭০ সালে সম্রাট তাঁকে বরখাস্ত করেন কিন্তু তাঁর শহরসংস্কারের গৃহীত পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শেষ হং ১৯২৭ সালে। আজকের যুগের প্যারিসের রাস্তাঘাট, ঝর্ণা, বুলোভার, এ্যাভিন্যু, নালা-নর্দমা এসব বস্তুত হাউসমানের পরিকল্পনারই পরিণাম। ১৮৫৩ সালে কবি বোদল্যারের বয়স ৩২ বছর যখন প্যারিস শহরে তাঁর চারদিকে দিনরাত ভাঙাভাঙি আর সংস্কার-মেরামতের মহাযজ্ঞ চলমান।

বোদল্যারের নিজের জীবনটা কেমন ছিল তা আমরা তাঁর জীবনী থেকে অনেকটাই জানি। তা যে এক দুঃস্বপ্নতাড়িত শৈশবেই শুরু তা বলাবাহুল্য। কিন্তু তাঁর শহর, তাঁর আমৃত্যু-আজীবনের শহর প্যারিস কেমন ছিল, যে-শহরে কবির জন্ম ও বেড়ে ওঠা এবং যে-শহর কালক্রমে কবিকে করে তুলেছিল বিতৃষ্ণা-আক্রান্ত। তাঁর পুরনো শহর তাঁর চোখের সামনে দিয়ে বদলে যেতে থাকে। একই সঙ্গে সুন্দর সম্পর্কিত তাঁর ধারণাও পরিবর্তমান স্তরপরম্পরায় হতে থাকে বিবর্তিত। বোদল্যারের জন্মের সময়কার প্যারিস শহর তাঁর বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অপ্রসন্নতার আবাসস্থলে পরিণত হয়। প্যারিসকে বলা হতো অতিরিক্ত ভিড়, অন্ধকার, বিপজ্জনক আর অসুস্থতার আখড়া। ১৮৪৫ সালে বোদল্যারের বয়স যখন ২৪ বছর, ফরাসি সমাজ-সংস্কারক ভিক্টর কনসিডারেন্ট লিখছেন: প্যারিস হলো নোংরা আবর্জনার একটা বিশাল ক্ষেত্র যেখানে যন্ত্রণা, মারি, রোগব্যাধি সারাক্ষণ তৎপর। সূর্যের আলো আর বাতাস সেখানে ঢুকতে পারে না। প্যারিস এক ভয়ংকর জায়গা যেখানে চারাগাছেরা শুকিয়ে যায়, পঁচে যায়। যেখানে বছরে সাতটার মধ্যে চারটা বাচ্চা মরে যায়। শহরের যে পরিকল্পনা, কেন্দ্র থেকে আরম্ভ করে এর চারপাশটা অর্থাৎ ল্যুভ্ মিউজিয়ম আর ‘ওতেল্ দ্য ভিয়ে’ (সিটি হল) সেটা সেই মধ্যযুগ থেকেই একইরকম রয়ে গেছে। আর এই জায়গাটাতে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্যারিসে সবচাইতে বেশি। সঁজেলিজে এলাকায় জনসংখ্যার হিসেবটা ছিল এমন, এক বর্গকিলোমিটারে ৫,৩৮০ জনের বাস। ১৮৪০ সালে একজন ডাক্তার বলেছিলেন, প্যারিসের কেন্দ্রীয় জায়গাটাতে চারতলার একটা ৩ বর্গমিটার (৫৪ বর্গফুট) কামরায় বাচ্চা-বুড়ো মিলিয়ে ২৩ জন লোক বাস করছে। এরকম পরস্থিতিতে রোগব্যাধি দ্রুত ছড়ায়। ১৮৩২ এবং ১৮৪৮-এর কলেরায় প্যারিস শহর উজাড় হয়ে গিয়েছিল। ঘনবসতির দু’টো জায়গায় ৫% লোক মরে গিয়েছিল। আরেকটা মারাত্মক সমস্যা ছিল রাস্তাঘাট-যানবাহনের সমস্যা। সবচাইতে চওড়া রাস্তা ছিল প্রস্থে মাত্র ৫ মিটার (১৬ ফুট), ২ মিটার (৩-৭ ফুট) রাস্তা ছিল অনেকগুলো। সব ধরনের গাড়িঘোড়ায় রাস্তাগুলো অনড় হয়ে থাকতো সারাক্ষণ। বিভিন্ন সময়ের উপপ্লবে এই জায়গাগুলোতে ঝামেলা হতো সবচাইতে বেশি। ১৮৫২-১৮৭০, এই সময়টা প্যারিস ছিল ইউরোপ মহাদেশের সবচাইতে বড় শহর এবং ব্যবসা-বাণিজ্য, ফ্যাশন, সাহিত্য-শিল্প সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। ১৮৫৫ সালে প্যারিসে নির্মিত হয় ‘র্যু দ্য রিভোলি বুলোভার’ যেটি লন্ডনের বিখ্যাত হাইড পার্কের আদলে গড়া বলে কথিত। প্যারিস-সংস্কারের সময় সর্বমোট ১২ হাজার ভবন ধ্বংস করা অনেকেই হাউসমানকে দায়ী করেন প্যারিসকে ধনি-দরিদ্রে বিভক্ত করবার জন্যে। শহরের পূর্বদিকে সবগুলো কারখানা যেখান থেকে নির্গত ধোঁয়া শহরের আকাশ ঘোলাটে আর অন্ধকার করে রাখতো। শহরের পশ্চিম দিকটা ছিল খোলামেলা-মুক্ত এবং সেখানকার আলো-হাওয়া ছিল স্বস্তিকর। হাউসমানের পরিকল্পনামাফিক ধনি লোকেদের কেন্দ্র হয়ে উঠতে থাকে পশ্চিম প্যারিস। ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগো প্যারিস ধ্বংস করবার জন্যে দায়ী করেছিলেন ইউজিন হাউসমানকে। লে ফ্ল্যুর দ্যু মাল-কাব্যের ১৮৬১ সালের সংস্করণে সংযুক্ত বোদল্যারের ‘তাব্ল্যু পাঘিসিঅঁ’-তে প্যারিসের চিত্র দেখতে পাওয়া যায় যথেষ্ট। বাস্তবের অদ্ভুত সব চরিত্রে ভরে উঠতে থাকে রোমান্টিক ও নিওক্ল্যাসিক কবির জগত। ভিক্ষুক, অন্ধ, শ্রমিক, জুয়াড়ি, পতিতা, বয়স্ক নাগরিক, সাম্রাজ্যবাদের শিকার উন্মূল মানুষ সবাই চরিত্র হয়ে ওঠে তাঁর কবিতায়। শৈশবের হারিয়ে যাওয়া প্যারিস তাঁর বহু কবিতায় ফিরে আসে স্মৃতিবিধূরতা নিয়ে। ভিক্টর হুগোকে উৎসর্গকৃত শহরের রাজপথে প্রাণপণ কষ্টে কাঁটতে থাকা ‘রাজহাঁস’টি আসলে কবি বোদল্যার স্বয়ং। তাঁর প্যারিস-বিতৃষ্ণার সূচনা আসলে ১৮২৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। সময়টা তাঁর জন্যে ছিল কষ্ট এবং আনন্দ দুই-ই।

পিতা ফ্রাঁসোয়া বোদল্যারের মৃত্যুর পর ১৮ মাস বোদল্যার তাঁর মায়ের সঙ্গে ছিলেন একটানা প্যারিসের উপকণ্ঠে। কষ্টকর সে-জীবনযাত্রায় একমাত্র আনন্দ ছিল মায়ের সঙ্গ। আর কখনই মাকে একান্তে পান নি বোদল্যার। পেয়েছিলেন যখন ১৮৫৯ সালের দিকে কিছুদিনের জন্যে তখন বোদল্যারের শারীরিক-মানসিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। ১৮২৮ সালের নভেম্বরে মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর বোদল্যারের একাকিত্বের শুরু। মানসিকভাবেও তিনি যথেষ্ট সমস্যায় নিপতিত হ’ন। ১৮৩২ সালে তাঁকে লেখাপড়ার জন্যে পাঠানো হয় লিওঁতে। কিন্তু বোদল্যার ক্রমশ মানসিক নৈসঙ্গ্য, অস্থিরতা এবং (তাঁর ভাষায়) বিতৃষ্ণায় আক্রান্ত হতে থাকেন। ১৮৩৯ সালে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হ’ন তিনি। এই সময়টা থেকেই, মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তাঁর বোহেমিয় জীবনযাপনের সূচনা। শহরের লাতিন কোয়ার্টার এলাকায় যেখানটাতে আড্ডা বসতো শিল্পী-সাহিত্যিকদের, তিনি ঘুরে বেড়াতেন। অর্থকষ্ট সত্ত্বেও বেহিসেবী জীবন ছিল তাঁর যে-জীবন ১৮৪২ সালে হয়ে পড়ে লাগামহীন। নিজের সম্পত্তির স্বল্পকালীন অধিকার পেয়ে উদ্দামতায় ভেসে যান বোদল্যার। বিখ্যাত পতিতা সারাহ লা লুসেটের (‘ট্যারাচোখ সারাহ’ ছিল তাঁর ছদ্মনাম) সংস্পর্শের ফল বোদল্যারের শারীরিক উপদংশ রোগ। তবে, কিছুদিন প্যারিসের অভিজাত এলাকায় বিশেষ করে হোটেল পিমোদান-এ (বর্তমানে হোটেল লোজান) তিনি লাভ করেন মাদক সেবনের অভিজ্ঞতা। তাঁর জীবনের উদ্দামতার পরিচয় মেলে তাঁরই ঘোষণা থেকে। একসময়ে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন তাঁর কবিতার বইয়ের নাম হবে ‘লে লেজবিয়েঁ’। এছাড়া তাঁরই রচিত নভেলা লা ফাঁফাঘ্লো-তে দেখা যাবে নায়ক স্যামুয়েল ক্র্যামারকে যাঁর সংস্পর্শ ক্যাবারে নায়িকা ও নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে। ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের সময় বোদল্যারকেও সক্রিয় হতে দেখা যায়। কথিত আছে, একটা বন্দুক যোগাড় করে ২৭ বছরের যুবক বোদল্যার ‘ওপিককে গুলি করবো’ (তাঁর বিপিতা) বলতে বলতে ছুটে যান। ১৮৪৮ সালের জুন মাসে প্যারিসের শ্রমিক আন্দোলনে বোদল্যার শ্রমিকদের পক্ষে তৎপর হয়েছিলেন। বলা যায় ১৮৪৭ সালে এডগার এ্যালেন পো’র সাহিত্যের সংস্পর্শ বোদল্যারকে আরও বড় অস্থিরতার বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছিল। অনুবাদ এবং লেখালেখির ধারাবাহিকতায় খানিকটা স্থিরতার দেখা পান কবি। তবে তাঁর নারীসঙ্গের শেষ হয় না। ১৮৫২-৫৪ পর্বে তিনি সঙ্গ লাভ করেন এ্যাপোলনি সাবাতিয়েঘের যাঁকে তিনি তাঁর ‘ম্যাডোনা’ ও ‘মিউজ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ১৮৫৪ সালে তাঁর জীবনে আসে অভিনেত্রী মারি দোব্রাঁ। প্রথম কাব্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঝামেলা-জটিলতা প্যারিস-বাসী কবির বিতৃষ্ণাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল বহু গুণে। বস্তুত প্রথম দফায় অভিযুক্ত হয়েছিল তাঁর কাব্যের ১৩টি কবিতা। ২০ আগস্ট গোটা দিন ধরে চলে তাঁর মামলার ‘ট্রায়াল হিয়ারিং’ এবং শেষে বহু ওকালতির জেরে ১৩টি থেকে নিষিদ্ধ কবিতার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬টি। মোটকথা ব্যক্তি বোদল্যারের কবি কিংবা পরিপূর্ণ সাহিত্যিকে পরিণত হওয়া পর্যন্ত এবং ১৮৬৬ সালে একটি চার্চের মধ্যে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এক ধারাবাহিক অন্তর্গত অস্বস্তি আর বিচ্ছিন্নতাবোধের শিকার হয়েছিলেন বোদল্যার। ১৮৫৯ সালে তাঁর চরম অসুস্থতার দিনে তাঁকে তাঁর মা ক্যারোলাইন নিয়ে গিয়েছিলেন প্যারিসের সাঁ-নদী সন্নিহিত অপূর্ব জায়গায় তাঁর বাসভবন ‘অঁফ্ল্যুঘ্’-এ। এখানেই বোদল্যার রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘ল্য ভোয়াইয়াঝ’। কবিতাটিতে আসলে তাঁর জীবনের ভ্রমণেরই বর্ণনা দিয়েছেন কবি। যে-বিতৃষ্ণা ও বিচ্ছিন্নতার বোধ তাঁর কাব্যজীবনের প্রথম থেকে সঙ্গী সেই বিতৃষ্ণার কথা আরও স্পষ্টভাবে বর্ণিত এ-কবিতায় এবং সেই বিতৃষ্ণা কেবল একা কবির নয়, সেই বিতৃষ্ণা সমগ্র দেশে পরিব্যাপ্ত- ‘স্য পেয়ি নুজনুই’। লক্ষণীয় সর্বনামটিতে কবি তাঁর আত্মতার পরিবর্তে বহুবাচনিকতার প্রয়োগ (‘নু’ মানে ‘আমরা’ এবং ‘আমাদের’) ঘটিয়েছেন।

চিরবিতৃষ্ণা বা বিচ্ছিন্নতার বোধ যা-ই একে বলা হোক না কেন এই বোধ এক ধরনের দার্শনিকতার জন্ম দিয়েছে বোদল্যারের কবিতায়। এই বোধ তাঁর পূর্বে আর কারও কবিতায় লক্ষ্য করা যায় না এবং এই বোধ পরবর্তীকালের সাহিত্যে তথা গল্প-কবিতা-নাটক-উপন্যাস প্রভৃতিতে যথেষ্ট পরিমাণে লক্ষ্য করা গেলেও আজ পর্যন্ত এর সূচক বোদল্যারকে সেভাবে চিহ্নিত করতে দেখা যায় নি কোনো সমালোচককে। কিন্তু প্রমাণসাপেক্ষে বলা যায় যে, কবি শার্ল বোদল্যারই আধুনিক সাহিত্যে সেই দার্শনিক জীবনবোধের স্রষ্টা। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় কলিন উইলসনের সাহিত্যতাত্ত্বিক গ্রন্থ দ্য আউটসাইডার। এ-গ্রন্থের সূচনা-বাক্যেই বলা হয়- “প্রথম দৃষ্টিতে, আউটসাইডার হলো একটা সামাজিক সমস্যা।” যে-লোকটি আউটসাইডার উইলসনের দৃষ্টিতে সে হলো ‘হোল-ইন-কর্নার’ বা ‘কুঠুরি-আবদ্ধ মানুষ’। ইংরেজি ‘আউটসাইডার’ শব্দটিকে বাংলায় বলা যায় বহিরাগত বা আগন্তুক। তবে আউটসাইডার শব্দটিতে একটা স্বেচ্ছাবিযুক্তি, স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্নতা কিংবা দূরত্বের ইঙ্গিত রয়েছে যেটা বাংলা ‘আগন্তুক’ শব্দে খানিকটা অনুধাবনযোগ্য। উইলসন তাঁর তাত্ত্বিক গ্রন্থে আধুনিক ‘আউটসাইডার’ তত্ত্বের সূচনাবিন্দু হিসেবে দেখেছেন ফরাসি ঔপন্যাসিক অঁরি বাঘ্বুসে’র (১৮৭৩-১৯৩৫) উপন্যাস লেজঁফেঘ্ (নরক)-কে। কবি-কথাশিল্পী বাঘ্বুসে ছিলেন ফরাসি কম্যুনিস্ট পার্টির আজীবন সদস্য এবং বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯০৮ সালে প্রকাশিত উপন্যাসটির অজ্ঞাতনামা নায়কের একমাত্র পরিচয় ‘আগন্তুক মানব’, কোথাও তার কোনো নাম নেই। সে গ্রাম থেকে শহরে আসে। চাকুরি নেয় একটা ব্যাংকে এবং একটা ‘পারিবারিক হোটেলে’র একটা কামরা ভাড়া নিয়ে থাকে। নিঃসঙ্গ একাকি জীবন কাটে তার সেই কামরায়। তার জীবনের তেমন কোনো লক্ষ্য নেই। তার কিছু নেই, চাহিদাও কিছু নেই। ধর্ম নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। তার কাছে মনে হয় যে মৃত্যুবোধই আসলে সব ভাব বা ধারণার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একটা বিষয় তার ভাবনায় জাগরুক- অতি অবশ্যই অর্থ উপার্জন করতে হবে। অজ্ঞাতনামা নায়কটির একমাত্র কাজ তার ঘরের দেয়ালের একটা ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে পাশের ঘরে কী ঘটে তা পর্যবেক্ষণ করা। উপন্যাসের শেষে নায়কের ভাষ্য- “আমি যে কিনা মানবজাতির গহিন অন্তরপ্রদেশে অনুপ্রবেশ করে ফিরে এলাম, দেখতে পেলাম এইসব নাট্যকমেডি ক্যারিকেচারের মধ্যে মানবিক বলে কিছু নেই। এটা এমনই অগভীর যে তা আসলে ফাঁকিবাজি মাত্র।”

আধুনিক সাহিত্যে ‘আউটসাইডার’ ধারণার জন্যে ঔপন্যাসিক অঁরি বাঘ্বুসেকে সমস্ত কৃতিত্বের অংশীদার করেছেন তাত্ত্বিক কলিন উইলসন। গ্রন্থটিতে তিনি আলব্যের কাম্যু’র (১৯১৩-১৯৬০) লেৎঘঁঝে উপন্যাসের (১৯৪২) আলোচনা করে উপন্যাসটিকে আউটসাউডার-ঘরানার একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে অভিহিত করেছেন। বস্তুত ফরাসি শব্দ ‘লেৎঘঁঝে’-র অর্থ হলো আগন্তুক। কলিন উইলসন তাঁর গ্রন্থে সূত্র হিসেবে আরও ব্যবহার করেছেন সার্ত্র, এইচ জি ওয়েল্স্, হেমিংওয়ে, হারমান হেস, রিল্কে, দস্তয়ভস্কি, টমাস মানসহ আরও অনেকের সাহিত্য-মন্তব্য-মূল্যায়ন। কিন্তু কলিন উইলসন শার্ল বোদল্যারের কবিতার কথা বা তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত দর্শনের কথা কোথাও উল্লেখ করেন না। আমাদের আপত্তি সেখানেই। কেননা, আধুনিক সাহিত্যে ‘আউটসাইডার’ বা ‘এৎঘঁঝে’-ধারণার প্রবক্তা অঁরি বাঘ্বুসে নয়, বরং ফরাসি কবি শার্ল বোদল্যার। বাঘ্বুসে’র উপন্যাসের পঞ্চাশ বছর পূর্বে প্রকাশিত হয় বোদল্যারের কাব্য ল্য স্পিøন দ্য পারি। কাব্যটির প্রথম কবিতার শিরোনামই ‘লেৎঘঁঝে’ যাকে ইংরেজিতে বলা হয় আউটসাইডার এবং আমরা বলছি আগন্তুক। কাম্যু তাঁর দ্য আউটসাইডার (লেৎঘঁঝে) উপন্যাসের নামকরণের জন্যে ঋণী বোদল্যারের নিকটে। মূল ফরাসি ভাষায় লেখা কবিতাটি উইলসন পাঠ করেছিলেন কিনা জানি না কিন্তু কাম্যুর উপন্যাসের প্রসঙ্গে কবিতাটির প্রসঙ্গ স্বভাবতই উত্থাপিত হওয়াটা যৌক্তিকভাবে সঙ্গত। কবিতাটি মূল ফরাসি থেকে বাংলা অনুবাদে পাঠ করা যাক-
– দুর্জ্ঞেয় পুরুষ, আমাকে বলো, কাকে তুমি সব থেকে বেশি ভালোবাসো? তোমার বাবাকে, তোমার মা’কে, তোমার বোনকে অথবা তোমার ভাইকে?
– বাবা, মা, বোন অথবা ভাই, আমার কেউ নেই।
– তোমার বন্ধু?
– তুমি এমন একটা শব্দ ব্যবহার করছো যেটির অর্থ ঠিক আজকের দিনটি পর্যন্ত আমার অজানা।
– তোমার দেশ?
– আমি জানি না কোন্ অক্ষরেখায় সেটির অবস্থান।
– সুন্দর?
– খুশিমনে তাকে ভালোবাসবো, দেবি এবং অমরতাকে।
– ঈশ্বর?
– আমি সেটা অপছন্দ করি যেমনটা তুমি অপছন্দ করো ঈশ্বরকে।
– তাহলে! কী ভালোবাসো তুমি, অসাধারণ আগন্তুক?
– আমি ভালোবাসি মেঘ… ভেসে যাওয়া মেঘদল… ঐ সুদূরের… ঐ সুদূরের… আশ্চর্য সুন্দর মেঘদল!

‘লেৎঘঁঝে’ কবিতাটিতে সহজ সরল ভাষায় প্রার্থিব জগতের সঙ্গে সংযোগে এক ধরনের অনীহা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঈশ্বর এবং বন্ধুত্বে অনাস্থা প্রকাশে কবির জবাব প্রত্যক্ষ। মোটকথা একটা আবছায়া ও রহস্যময়তার প্রতীকতা কবিতায় ছড়ানো। অঁরি বাঘ্বুসে’র যে-উপন্যাসটি কলিন উইলসনের তাত্ত্বিকতার ভিত্তি সেখানে ‘আউটসাইডারের’ যা-যা বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে তার সবই বোদল্যারের কবিতায় উপস্থিত। এমনকি লেজঁফেঘ্ উপন্যাসের নায়কের যে-অতীন্দ্রিয় দৃষ্টির তৎপরতা যাকে ফরাসি ভাষায় বলে ‘ক্ল্যাঘ্ভোয়াইয়াঁ’ সেই শব্দটি বোদল্যারের কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে অনেকবার। বিবিক্ততা, বিযুক্তি, বিচ্ছিন্নতা, বিষাদ, নির্বেদ যা-ই বলা হোক না কেন বোদল্যারের সঙ্গী তাঁর কাব্যাভিযাত্রার সূচনালগ্ন থেকে এবং সেটি তাঁর সর্বশেষ কাব্যাভিজ্ঞান পর্যন্ত বহাল ছিল। উইলসন অঁরি, কাম্যু, সার্ত্র এবং আর অনেকের সাহিত্য থেকে যে-মৃত্যুচেতনার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন সেই মৃত্যু সব থেকে বেশি রয়েছে বোদল্যারেরই কাব্যে। এক লে ফ্লুর দ্যু মাল¬-কাব্যেই রয়েছে পৃথকভাবে, স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিতভাবে মৃত্যুর বিবিধ বিন্যাস। একটি শ্রেণি (‘লা মঘ্’) পুরোপুরি বরাদ্দ ‘মৃত্যু’রই জন্যে। প্রেমিক-প্রেমিকা, গরিব মানুষ, শিল্পী এঁদের মৃত্যু ছাড়াও মৃত্যুচেতনার কবিতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘লা ফাঁ দ্য লা জুঘ্নে’ (‘ভ্রমণের শেষ’), ‘ল্য ঘেব্ দাঁ কুঘিউ’ (‘এক কৌতূহলীর স্বপ্ন’) এবং ‘ল্য ভোয়াইয়াঝ্’ (‘অভিযাত্রা’) কবিতাত্রয়। বলা যায় তাঁর সমগ্র কাব্যে মৃত্যুর স্বাক্ষর এমন পরিব্যাপ্ত যে বোদল্যারকে কেবল মৃত্যুচেতনার কবি অভীধাও দেওয়া যেতে পারে। তাঁর বিচ্ছিন্নতা কিংবা নির্বেদ অকারণ নয়। নিজের জীবন, বেড়ে ওঠা, পারিপার্শ্বিকতা, অসুস্থতা, অনিশ্চয়তা এগুলোকে তাঁর কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায় বটে, কিন্তু মানবজীবনের চিরন্তন বিশেষত্বই প্রতিফলিত হয়েছে অন্তিমে। কাজেই আধুনিক সাহিত্যের ‘আউটসাইডার’ ধারণার আদি পুরুষ বোদল্যার এবং সে-ধারণার সূচনালগ্ন ১৯০৮ নয় বরং আনুষ্ঠানিকভাবে ধরলে ১৮৬৪ সাল (যে-বছর বোদল্যার তাঁর ল্য স্প্লিন দ্য পারি কাব্যগ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি এর প্রকাশক আঘ্সেঁ উসেই-এর নিকটে জমা দিয়েছেন।), যদিও গ্রন্থের বেশকিছু কবিতা আরও অনেককাল আগেকার রচনা।

বোদল্যারের কাব্য ও দর্শন থেকে ‘লেৎঘঁঝে’ বা ‘আউটসাইডার’ ধারণার যে-বহুমাত্রিকতা লক্ষ করা যায় তাতে ব্যক্তিসত্তার অন্তর্নিহিত স্বাধীনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপমুক্ততার দিকটি অনস্বীকার্য। নিজের কাব্যের সমর্থনে সম্রাজ্ঞীর কাছে লেখা চিঠিতে বোদল্যার ব্যক্ত অনুভূতিকে তাঁর সত্তার অন্তর্নিহিত স্বাধীনতার আর্তিরূপে চিহ্নিত করা চলে। ১৮৪৫ সালে যখন বোদল্যার আধুনিক চিত্রসমালোচনা লিখতে থাকেন ‘সালোঁ’ নামক বিখ্যাত পত্রিকায় তখন তাঁর সেই সমালোচনা প্রশংসিত হয়েছিল বোদল্যারের যৌক্তিক বিশ্লেষণধর্মিতা এবং সুন্দর সম্পর্কিত তাঁর প্রচলবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে। ইউজিন দেলাক্রোয়াকে তিনি অভিহিত করেন ‘চিত্রকলার কবি’ হিসেবে যখন দেলাক্রোয়া’র পরিপূর্ণ মূল্যায়নের অনেকটাই বাকি ছিল। তাছাড়া ‘নগ্ন পতিতা’র শিল্পী এডওয়ার্ড মানে যখন তাঁর সেই বিখ্যাত চিত্রটির জন্যে নিন্দিত-সমালোচিত হচ্ছিলেন, তাঁর নিকটের লোকেরা তাঁকে ছেড়ে চলে যায় কিন্তু বোদল্যার ছেড়ে যান না মানে’কে। শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে বোদল্যারের অবস্থান ছিল স্পষ্ট, তবে তাতে ছিল না কোনো ধরনের রাজনীতির সংলগ্নতা। জীবনের শেষদিকে যখন পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হ’ন বোদল্যার তখন সেই অসুস্থ-কষ্টকর দিনগুলিতে তাঁকে সঙ্গ দিতে আসেন এডওয়ার্ড মানে এবং তাঁর স্ত্রী। তাঁরা তাঁকে পিয়ানো বাজিয়ে শোনান।

শার্ল বোদল্যার যদি ফরাসি না হয়ে ইংরেজি ভাষার কবি হতেন তাহলে গোটা বিশ্বে তিনি হয়তো পরণিত হতেন একটা সাহিত্যিক ‘কাল্টে’ কিন্তু অনুবাদের সূত্রেই তিনি ইতোমধ্যে জয় করে নিয়েছেন সারা পৃথিবী। এত বিচিত্র অনুভূতির কবিতা এবং সেসবের এত বিচিত্র প্রকাশ, জীবনের চলমানতার অসাধারণ সব ছবি, ইতিহাস-পুরাণের এমন অনির্বচনীয় ব্যবহার সবই বোদল্যারের কবিসত্তার পূর্ণমাত্রা ও নিখুঁতত্বের স্বাক্ষরবহ। সুন্দর সম্পর্কিত দীর্ঘদিনের প্রচলিত ধারণাকে তিনি পাল্টে দিয়েছেন আমূল। একদা ‘ল্য গিনোঁ’ (‘দুর্ভাগ্য’) কবিতায় লিখেছিলেন তিনি- “লাঘ্ এ লোং এ র‌্য তঁ এ কুঘ্” যার অর্থ “শিল্প বিশাল আর আয়ূ অতি ক্ষীণ।” যথার্থই লিখেছিলেন তিনি। দুইশো বছর পরেও বোদল্যারের সে-বাণী এখনও অম্লান, হয়তো ম্লান হবে না কখনও।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!