ভাদুশিল্পী রতন কাহার পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত

এত গান লিখেও সংসার চলছে না! একসময় আক্ষেপ করেছিলেন বীরভূমের লোকশিল্পী রতন কাহার। এবার সেই প্রকৃতযশা লোকসঙ্গীত শিল্পী রতন কাহার পেলেন ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কার। “বড়লোকের বিটি লো” গানের স্রষ্টার এই সম্মানে খুব স্বাভাবিকভাবে খুশি রবি ঠাকুরের লালমাটির জেলার বীরভূমবাসি।

ভাদু গান গেয়ে যৌবনকালে গায়কজীবন শুরু করেছিলেন রাজ্যের বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতন থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে জেলার সদর শহর সিউড়ি পৌরসভার চার নম্বর ওয়ার্ডের নগরীপাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা, রতন কাহার। পরে শুরু করেন গান বাঁধতে। জেলায় জেলায় ঘুরে গান শুনিয়েছেন। প্রসার ভারতীতেও গান গেয়েছেন। কিন্তু নিয়মিত সুযোগ পাননি সেখানেও। ‘বড়লোকের বিটি লো, লম্বা লম্বা চুল’– এই গানটি অনেকেরই পরিচিত। গানটির রচয়িতা রতন কাহার। ১৯৭২ সালে তিনি এই গানটি লিখেছিলেন এবং এই গানটি প্রথম গেয়েছিলেন সংগীতশিল্পী স্বপ্না চক্রবর্তী।

লাল মাটির বুকে এখনও পথ হেঁটে বেড়ান পাগল সুরসাধক। রতন কাহারও বৃদ্ধ হয়েছেন। মুখে চোখে বয়সের ছাপ। অশক্ত শরীর তাও গান নিয়ে আজও বাঁচেন। নিজের গান এত বিখ্যাত হলে কি হবে, অবস্থা তাঁর বদলায়নি আজও। গান আর অভাব তাঁর চিরসঙ্গী। জীবনে রয়েছে অনেক অসুবিধা, অনেক প্রতিকূলতা। একের পর এক লোকসঙ্গীতের ধারাকে সমৃদ্ধ করে গেছেন তিনি। সেই সঙ্গে জুড়ে একজন সাধক, যার সারা শরীর জুড়ে কেবল মাটিরই গন্ধ। ‘মাটির একতারা’। সম্মান যে পাননি, তা নয়। ছোট্ট বড় মিলিয়ে অনেক পুরস্কার। সিউড়ি শহরের এক চিলতে কুঁড়েঘরেই মানপত্র থেকে শুরু করে নানান পুরস্কার দেওয়াল জুড়ে। পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র, তথ্য সংস্কৃতি বিভাগ সহ বিভিন্ন পুরস্কার রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।লোকসঙ্গীতের মানুষ ও তার বাইরের গুটিকয়েকজন ছাড়া বৃহত্তর অংশের ধরাছোঁয়ার বাইরে তিনি।

দিন কয়েক আগেই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ভাদু গানের শিল্পী রতন কাহার কে জানানো হয় আপনাকে দেশের অন্যতম পুরস্কার পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত করা হচ্ছে। রতনবাবু এই খবর শুনে উচ্ছ্বসিত। আনন্দে দিশাহারা তিনি। ৯১ বছর বয়সে এসে এই সম্মান যেন তাকে আবার নতুন করে বেঁচে থাকার রসদ জুগিয়েছে।

বীরভূমের রাঙ্গামাটি জেলার সদর শহর সিউড়ি পৌরসভার চার নম্বর ওয়ার্ডের নগরীপাড়ার নিজ ভিটেতে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে শিল্পী ও রতন কাহার উজাড় করে দেন তার জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে পদ্মশ্রী পুরস্কার পাওয়ার আনন্দের ইতিকথা। তিনি জানান, আমার জীবনের প্রদীপ নেভানোর সময়ে খুশির খবর। ভারত সরকার আমাকে পদ্মশ্রী সম্মান দিচ্ছে। পরিবারের সকলেই ভীষণ আনন্দিত। “বড়লোকের বিটি লো, লম্বা লম্বা চুল” এই গানটি আমি লিখেছিলাম ১৯৭২ সালে। সেই সময়ই সংগীত শিল্পী স্বপ্না চক্রবর্তী রেডিওতে গান করতেন। ১৯৭৬ সালে প্রথম তিনি এই গানটি রেকর্ড করেন। তবে সেই সময় গানের স্রষ্টা রতন কাহারের নাম সামনে আনতে নিষেধ করেছিলেন স্বপ্না দেবী। সেটা ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত জানা নেই। তবে সকলেই জানতেন এটি রতন কাহারের লেখা গান। কারণ উনি ভাদুগান গাইতেন। সেই সময়ই এই গান ধরা হতো গ্রামে গঞ্জে। তবে খারাপ লেগেছিল, উনি কখনো নত শিকার করেননি, এত বড় অপরাধের।

৯১ বছর বয়সী রতন কাহার আবেগপ্রবণ হয়ে আরো বলেন, বোম্বের বিখ্যাত গায়ক বাদশা আমার এই গানটি অ্যালবাম আকারে প্রকাশ করেছিলেন। ‘বিনাফুল’ বলে তাদের দলের নাম শুনেছি। রতন কাহারের গান গেয়েছেন বোম্বের বিখ্যাত শিল্পী বাদশা। তাও আবার নিজের নামে চালিয়েছিলেন। প্রকৃত গানের মালিকের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেননি তিনি। খুব স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠতে শুরু করে। এই সংগীতের রচিয়তা রতন কাহার। চুরি করাটা অপরাধ। চাপে পড়ে অবশ্য শিল্পী বাদশা নত শিকার করে যোগাযোগ করে রতন কাহারের সাথে। ভিডিও কলের মধ্য দিয়ে কথা হয় রতন বাবুর সাথে। বাদশা বীরভূমের সিউড়িতে রতন কাহারের বাড়িতে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করে। ঘটনা চক্রে বেশ কয়েক বছর আগের এই ঘটনার সময় গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে করোনাভাইরাসে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই কারণেই আসতে পারেননি তিনি। তবে রতন কাহারের আবেদন নিবেদন ছাড়াই পাঁচ লক্ষ টাকা রতন বাবুকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাদশা। এখন ভারত সরকার পদ্মশ্রী সম্মান দিতে চলেছে। ভীষণ ভালো লাগছে জানান রতন কাহার।

“বড়লোকের বেটি লো, লম্বা লম্বা চুল” গানের একটা লাইন ভুল গেয়েছিলেন স্বপ্ন চক্রবর্তী। তা নিয়ে ভীষণ মন ভারাক্রান্ত হয়েছিল ভাদু লোকশিল্পী রতন কাহারের। রতন বাবু বলেন, “দেখেছিলাম স্বপনে, ওরে স্বপনে.. ভালোবাসা দারিন ছিল মাথার সীতেনে” এই লাইনটি ভুল গাওয়া হয়েছিল যা আজও সংশোধন হয়নি। একই রকম ভাবে ভুল করে “লাল ধুলোর সরানে ওরে সরানে ভালোবাসা দারিন ছিল মাথার সিঁথানে।” এইভাবেই ভুল গায় শিল্পীরা।

ইতিমধ্যেই বীরভূমের বিভিন্ন প্রান্তে থেকে বিধায়ক থেকে শুরু করে মন্ত্রী, সমাজের বহু স্তরের মানুষ রতন কাহাকে সংবর্ধনা দিতে শুরু করেছেন। রতন কাহার জীবনের অন্তিম লগ্নে এসে এই সম্মান পাবে ভাবতেও পারেনি। যা আজ তাকে আরো পথ চলতে সাহায্য করছে।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!