মহাজীবনের অনন্তগামী সৃজনপ্রবাহই ভালো কবির ভালো কবিতা

‘ভালো কবি’ এবং ‘ভালো কবিতা’ কথা দুটির প্রচলন বহুকাল থেকেই চলে আসছে। কিন্তু আমরা কি জানি কাদের ভালো কবি বলে এবং কোন কবিতাকে ভালো কবিতা বলে? অসির চেয়ে মসি শ্রেষ্ঠ তখনই সম্ভব, যখন মানুষের মনের দরজা খুলতে পারে শব্দের টংকার। আমাদের মনের প্রতিফলন শব্দে ফুটে ওঠে। আমাদের হৃদয়কে শব্দের আয়নায় দেখা যায়। আর এই হৃদয় এমন এক আলোর সমারোহে উপলব্ধির সাম্রাজ্য বিস্তার করে যা অনন্ত আত্মার প্রজ্ঞায় উচ্চকিত চিরন্তন বোধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। মনুষ্যজীবনের সেই অবিনশ্বর আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেই গড়ে ওঠে চিরন্তন সাহিত্য। মির্জা গালিব বলেছিলেন: সারাজীবন আয়নার কাচই মুছে গেলাম, কিন্তু নিজের চেহারাখানা একবারও মোছা হলো না। সুতরাং হৃদয়ের প্রতিফলন শব্দের আয়নায় প্রতিফলিত করতে হলে, আগে হৃদয়খানাই সূক্ষ্ম ও মাধুর্যমণ্ডিত করা দরকার। তাঁরাই প্রকৃত স্রষ্টা যাঁরাই এই কাজটি ভালো পারেন, অন্যেরা শুধু ধোঁয়াশাই সৃষ্টি করেন, দীপ্তির আলোকবার্তা দিতে পারেন না। সময়ের এবং ব্যক্তির নিরিখে শিল্পকৌশল বারবার পাল্টায়, কিন্তু প্রজ্ঞাপারমিতায় চিরন্তন মানবসত্যের বোধ একই থাকে। আর একে নিয়েই লেখা হয় সাহিত্য তথা কবিতা। ভাষা, শব্দ প্রয়োগ, সংকেত বা ব্যঞ্জনা দান, ছন্দ বা ছন্দোহীনতা, পরিমিত আবেগ এবং মেধার প্রয়োগও সময় সাপেক্ষ শিল্পকৌশলের অঙ্গ। এগুলোর পরিবর্তিত বাঁক্ প্রতিটি স্রষ্টাকেই সজাগ ভাবে গ্রহণ করতে হয়। তখন এটাই হয় নতুন। কখনো তা নতুন পদ্ধতি। কখনো তা বিস্ময়, কখনো তা বিষয়হীন, কখনো তা সহজ সরলতায় ভরা, কখনো তা শূন্যতায় বিস্তৃত, স্বপ্নহীন অথবা স্বপ্নাতুর। এর বহুমুখী অন্বয় অথবা অনন্বয় ধাঁধায় ফেলতে পারে; তখন স্রষ্টার মনন ও তাঁর পিঠভূমির অন্বেষণ দরকার হয়। সেখানেও থাকে ব্যক্তিজীবনের ভাঙন এবং সময়ের অসহিষ্ণুতা অথবা উল্লাস অথবা কদর্যতা। কখনো সেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রভাব পড়তে পারে। সব মিলিয়েই তৈরি হয় সৃষ্টির ক্ষেত্র। তাই যুগ বা ইতিহাসের নিরিখে সেই সৃষ্টিকে বিচার করতে হয়। এই সচেতনতা প্রতিটি পাঠকেরও দরকার হয়। না হলে স্রষ্টার সৃষ্টি সম্পর্কে অজ্ঞানতা দূর করা সম্ভব হয় না।

বহু গ্রন্থের জনক গ্রেগরি ডেল বিয়ার (জন্ম: ২০ আগস্ট, ১৯৫১) একজন আমেরিকান লেখক এবং চিত্রক যিনি সায়েন্স ফিকশনের জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি গ্যালাকটিক সংঘাত, কৃত্রিম মহাবিশ্ব, চেতনা এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলন এবং ত্বকের বিবর্তনের থিমগুলি নিয়ে বহু কাজ করেছেন। তাঁরই একটি উল্লেখযোগ্য বক্তব্য হল:

“Once, poets were magicians. Poets were strong, stronger than warriors or kings — stronger than old hapless gods. And they will be strong once again.” (Greg Bear)

অর্থাৎ একসময় কবিরা যাদুকর ছিলেন। কবিরা যোদ্ধা বা রাজাদের চেয়ে শক্তিশালী।শক্তিশালী ছিলেন  পুরনো অসহায় দেবতাদের চেয়েও। এবং তাঁরা আবারও শক্তিশালী হবেন।

একথা বলার কারণ হলো, রাজারা যুদ্ধ করে, সাম্রাজ্য বিস্তার করে, দুর্গ বানায়, রাজ প্রাসাদ নির্মাণ করে, কিন্তু কালের কপোলতলে তা একদিন ম্রিয়মাণ ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়। ইঁটকাঠ বস্তুময় পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ হৃদয়-মেধার সম্পদের সঙ্গে কখনো তুলনীয় হতে পারে না। কবিতা শব্দের ইমারত। অনুভূতি আর বোধের মিশ্রণে নির্মিত হয় এই ইমারত। যা থাকে আমাদের হৃদয়ে, মননে, উপলব্ধিতে এবং সৌন্দর্যের আকর্ষণে। মানবপ্রবৃত্তির সমূহ জাগরণে তাকে সর্বদা অনুধাবন করা যায়। শিবের মধ্যে যে কামের জাগরণ ঘটে, তপ্ত উল্লাসের অভিক্ষেপ তাঁকে প্রলুব্ধ করে তা আমাদের মধ্যেও জেগে ওঠে। ভারতচন্দ্র যখন সেই বর্ণনা দেন:

“আকর্ণ পুরিয়া সন্ধান করিয়া
সম্মোহন বাণ লয়ে।
ভূমে হাঁটু পাড়ি দিল বাণ ছাড়ি
অনলে পতঙ্গ হয়ে।।
কিবা করে ধ্যান কিবা করে জ্ঞান
যে করে কামের শর।
সিহরিল অঙ্গ ধ্যান হৈল ভঙ্গ
নয়ন মিলিলা হর।।
কামশরে ত্রস্ত নারী লাগি ব্যস্ত
নেহালেন চারি পাশে।
সমুখে মদন হাতে শরাসন
মুচকি মুচকি হাসে।।”

এই কামবাণে সমগ্র মানবজাতি ত্রস্ত হয়ে ওঠে। শুরু হয় অঙ্গের শিহরন। জগৎজুড়ে অনন্ত মদন সেই বাণ ছুঁড়ছে। আমরা কামকে শিল্পকলায় রূপান্তর করছি। না বলায়, অথবা শূন্যতায়, অথবা রহস্যময়তায়, অথবা বিস্ময়ে রূপান্তর ঘটাচ্ছি। কখনো এই কামেরই নাম দিচ্ছি প্রেম। কখনো প্রেমকেই কাম হিসেবে উল্লেখ করছি। আদিম প্রবৃত্তির এই ঘোর থেকেই মানব সভ্যতার এই সৃজনপ্রবাহ অনন্তগামী হয়ে বয়ে চলেছে। একে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এর মাহাত্ম্যকে উচ্চকিত করার জন্য প্রেমের আগে ‘কৃষ্ণ’ শব্দটি যোগ করছি। আর তখনই ‘কৃষ্ণেন্দ্রিয়’ হিসেবে তার গরিমাকে মিথলজিক্যাল প্রাচুর্যে সমন্বিত করছি। কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন  ‘কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতিইচ্ছা ধরে প্রেম নাম’। অর্থাৎ প্রেম অনন্ত পবিত্র আত্মায় তা সমন্বিত এবং চিরন্তন। জীবনানন্দ দাশ হয়তো এই কামকেই প্রেমের মহিমা দান করে লিখেছিলেন:

“জীবন হয়েছে এক প্রার্থনার গানের মতন
তুমি আছ ব’লে প্রেম,—গানের ছন্দের মতো মন
আলো আর অন্ধকারে দুলে ওঠে তুমি আছ ব’লে!
হৃদয় গন্ধের মতো— হৃদয় ধূপের মতো জ্বেলে
ধোঁয়ার চামর তুলে তোমারে যে করিছে ব্যজন!
ওগো প্রেম,—বাতাসের মতো যেই দিকে যাও চ’লে
আমারে উড়ায়ে লও আগুনের মতন তখন!
আমি শেষ হব শুধু, ওগো প্রেম, তুমি শেষ হ’লে!
তুমি যদি বেঁচে থাকো,— জেগে র’বো আমি এই পৃথিবীর ’পর,—
যদিও বুকের ’পরে র’বে মৃত্যু,— মৃত্যুর কবর!”

প্রেম যেমন জীবনের আয়ু, প্রেম তেমনি শিল্পেরও আয়ু, প্রেম তেমনি কবিতারও আয়ু। এই আয়ুকে যেমন কবিরা life হিসেবে দেখেছেন, তেমনি live হিসেবেও দেখেছেন। প্রেম তখন শুধু নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, প্রকৃতির মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। প্রেমের এই পরিব্যাপ্তি অনন্ত সৃষ্টির ব্যাখ্যার মধ্যেই এর তাৎপর্য উপলব্ধি করেছে। সেই প্রেমের আলোয় আলোকিত সাম্প্রতিক আরও এক কবি মুম্বাইয়ের বাসিন্দা  সানোবর খান যাঁর প্রথম গ্রন্থ ২০১২ সালে ‘A touch, a tear, a tempest’ প্রকাশিত হয়েছে। ইতিমধ্যেই তা পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছে। একটা সাক্ষাৎকারে তিনি পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন: “The endless love I get from my fans! There was a time when I only wrote for myself, but now I want to write for the people who made my books a success.”

অর্থাৎ আমি আমার ভক্তদের কাছ থেকে পাই অফুরন্ত ভালবাসা! একটা সময় ছিল যখন আমি কেবল নিজের জন্য লিখেছিলাম তবে এখন আমি সেই লোকদের জন্য লিখতে চাই যারা আমার বইগুলিকে সফল করেছে।

এই সাফল্যের পেছনের কারণও আমরা জানতে পারি: “It is important as a need for personal expression, and also as a way of honouring what brings joy and sorrow. Without it, so much beauty of the world would go unnoticed.”

অর্থাৎ এটি ব্যক্তিগত মত প্রকাশের প্রয়োজন হিসাবে এবং আনন্দ ও দুঃখ বয়ে নিয়ে আসা এমন বিষয়টিকে সম্মানের  মাধ্যম  হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ করা।তা না থাকলে পৃথিবীর এত সৌন্দর্য অবহেলায় যেত। কিন্তু এই সৌন্দর্যের মধ্যেই সানোবর খান প্রেমকেই বেশি উপলব্ধি করেছেন। তাঁর কবিতায় দেখি সেই পবিত্র আত্মাকেই:

“i want to be
in love with you
the same way
i am in
love with the moon
with the light
shining
out of its soul.”
(Sanober Khan)

কবিতাংশটি বাংলায় এভাবে অনুবাদ করা যায়:
আমি তোমার সাথে ভালোবাসায় থাকতে চাই
যেভাবে আমি চাঁদের সঙ্গে ভালোবাসায় থাকি।
যেভাবে তার আত্মা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়।’

যে আলোর কথা কবি এখানে উল্লেখ করেছেন তা যখন আত্মা থেকে প্রতিফলিত, তখন সেই আত্মাই অনন্তকে ধারণ করে। তখন সেই আলো ঈশ্বর-উপলব্ধির পবিত্রতায় সমন্বিত এক বিস্মিত অনুরাগ। কবিতার আর একটি অংশে কবি তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন:

“in a world
full of temporary things
you are a perpetual feeling.”
(Sanober Khan)

অর্থাৎ অস্থায়ী জিনিসগুলিতে ভরা বিশ্বে  তুমি একটি চিরস্থায়ী অনুভূতি। এখানে ‘তুমি’ সর্বনামটির ব্যাপ্তি দান করলেন কবি। কেননা এটি ব্যক্তিবাচক হলেও ব্যক্তির ঊর্ধ্বে সর্বময় প্রেমেরই ধারক এবং সম্পর্কের সর্বময় নির্ণায়ক সেতুবন্ধক একটি শব্দ। যা কবিতাটিকে ব্যাপ্তিময় চিরন্তনতা দান করেছে।

ইংরেজ ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও লিবারেটো রচয়িতা এডওয়ার্ড মরগ্যান ফরস্টার  (জন্ম: ১ জানুয়ারি, ১৮৭৯, মেলবোর্ন, লন্ডন, যুক্তরাজ্য —মৃত্যু: ৭ জুন, ১৯৭০, কনভেন্ট্রি, যুক্তরাজ্য) ছিলেন একজন বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের ব্রিটিশ সমাজ ও শ্রেণিবৈষম্য, ভণ্ডামি এবং লিঙ্গ ও সমকামিতার প্রতি শ্লেষাত্মক ও সুসংবদ্ধ এবং সুপ্রসিদ্ধ উপন্যাস লেখক। একটি রচনায় তিনি তাঁর চিরন্তনতার অভিজ্ঞতা এভাবে ব্যক্ত করেছেন:

“It isn’t possible to love and part. You will wish that it was. You can transmute love, ignore it, muddle it, but you can never pull it out of you. I know by experience that the poets are right: love is eternal”.(E.M. Forster, A Room with a View)

অর্থাৎ ভালোবাসা এবং ভাগ কখনোই সম্ভব নয়। তুমি অবশ্যই ইচ্ছা করো যে এটি ছিল।তুমি অবশ্যই এটিকে সঞ্চার করতে পারো, এটিকে উপেক্ষা করতে পারো, কাটাছেঁড়া করতে পারো, তবে তুমি কখনোই এটিকে তোমার কাছ থেকে টেনে ফেলতে পারবে না। । আমি অভিজ্ঞতার দ্বারা জানি যে কবিরা সঠিক: প্রেম চিরন্তন।

Love  যে  eternal এবং কবিরা যে right অথবা truth একথা বলাই বাহুল্য। রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ একটি প্রেমের কবিতার এক অংশে লিখেছেন:

“আমি তো প্রার্থনাগুলো শস্যের বীজের মতো দিয়েছি ছড়িয়ে
জল তাকে পুষ্টি দেবে, মাটি তাকে ভূমি দেবে, তুমি তার গভীর ফসল—
বাতাসে তুলোর মতো তুমি তবে উড়ে এলে কেন!
কেন আজ পোড়া তুষের গন্ধে শুধু জন্মের কথা মনে পড়ে!
শৈশব কৈশোর এসে মিশে থাকে ফাল্গুনের তুমুল হাওয়ায়
একটি রাত্রি কেন হয়ে ওঠে এতো দীর্ঘ দীর্ঘ রাত?”

প্রেম সেই প্রার্থনাই শিখিয়েছে যে প্রার্থনা সত্যের। প্রেম সেই বীজই ছড়িয়ে দিয়েছে যে বীজ অনুভূতির শস্য হয়ে রোপিত হয়েছে। যে চারাগুলি উৎপন্ন হবে তা এই মাটি বাতাস জলেই পুষ্টি পাবে। অর্থাৎ হৃদয় থেকে হৃদয়ে সঞ্চারিত হবে। তবেই তো তা ‘গভীর ফসল’। তবেই তো বসন্ত। তবেই তো একটি রাত—দীর্ঘ দীর্ঘ রাতের সমাহার। আর এক কবির কলমে পাই:

“I want you. I want you to be mine. I want to be yours. Because even though none of this makes sense, it just feels right.” (Kathryn Vance-Perez, Love and Truth)

অর্থাৎ  আমি তোমাকে চাই। আমি তোমাকে আমার করে পেতে চাই। আমি তোমার হতে চাই।কারণ যদিও এগুলির কোনোটিই বোঝায় না,  তবু এটি  ঠিক ঠিক অনুভব করে। ক্যাথরিন ভ্যানস-পেরেজ এর উপলব্ধিটি সত্য-সম্পর্কের সেতুটিকেই মনে করিয়ে দেয়।ক্যাথরিন বর্তমানে স্থানীয় স্বামী এবং দুটি বাচ্চা নিয়ে ভার্জিনিয়ায় বসবাসকারী টেক্সান। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস “ভালবাসা এবং সত্য”। তিনি  ‘থেরাপি’  নামে আরও একটি নতুন বইয়ের প্রকাশ করছেন। তাঁর বই এবং সংগীত আবেগপ্রবণ, পাগল, মুক্ত-উল্লাসে পূর্ণ লেখা।তিনি ভালোবাসেন একটি কাল্পনিক বিশ্বে বসবাসের স্বপ্ন দেখতে। তাঁর আর একটি কথা স্মরণযোগ্য:

“Perfection is not attainable, but if we chase perfection, we can catch excellence.” (—Kathryn Vance-Perez in Love and Truth) অর্থাৎ পরিপূর্ণতা অর্জনযোগ্য নয়, তবে আমরা যদি পরিপূর্ণতাকে তাড়া করি তবে আমরা শ্রেষ্ঠত্ব ধরতে পারি।

কবি-লেখক  স্রষ্টাদের তো শ্রেষ্ঠত্বকেই ধরতে হয় আর এই পরিপূর্ণতাকে তাড়া করার তাগিদ অন্তর থেকে আসে। অন্তরের সত্য উপলব্ধি থেকে আসে। এই তাড়া করার ক্ষমতা না থাকলে ভালো কবি হওয়া যায় না, ভালো কবিতাও লেখা যায় না।

এই সময়ের কবি গোলাম রসুল (জন্ম:১৯৫৯) এই কাজটি সহজেই করতে পারেন বলেই তিনি অতিক্রম করে চলেছেন এই জীবনপরিধির সীমানাকে। মহাজীবনের মহাপরিক্রমণে তিনি মুক্তির দূত হয়ে উঠেছেন। কবিতার চিত্রধর্মিতায় সমূহ শব্দব্যঞ্জনা ছাপিয়ে গেছে তাঁর মর্মের আলোড়ন। এক অপার্থিব নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছে তাঁর উপলব্ধির ঐশ্বর্যে। যে জগৎ তিনি উপস্থাপনা করেছেন তা চিরাচরিত কোনো বৈজ্ঞানিক ফিকশন নয়, ফ্যান্টাসিও নয়, অন্ধ আবেগের বিহ্বল সমর্পণও নয়—আদিপ্রজ্ঞার নিবিষ্ট মনোভূমি, যেখানে প্রত্নঅভীপ্সার খেলা আছে, ব্রহ্মপ্রাণের মহিমা আছে। বিস্ময়কর এক মুক্তির সোপান আছে। একটি কবিতায় তিনি এভাবেই তা বলেছেন:

“মাঠ কষ্ট আর  আকাশ
লক্ষ্য নেই শুধু পালক
আমি ঘন্টার পর ঘন্টা অতিক্রম করছি সেই সব পরিযায়ী রাস্তা
পাখিদের উড়ে যাওয়ার সোনার রেখা

চাঁদ উঠছে বনভূমির মধ্যে প্রাচীন শহর
বজ্র বিদ্যুতের দড়িতে বাঁধা কাঠের বোঝা

মানুষের জীবন মানুষের থেকে সবসময় দূরত্ব রেখে চলে

আমার আগে আগে আমার বুকের বাজনা ভেসে যায় যেদিকে পাহাড় রয়েছে
আমি নির্জনতার হাড় ভাঙা পরিশ্রম দেখি

একগুঁয়ে আকাশ
কোথাও আত্মসমর্পণ নেই”

স্ব-স্বমহিমায় প্রকৃতি তার অভিরূপ প্রজ্ঞাময় প্রকাশে নিজেকে জানান দিচ্ছে। প্রকৃতির মাঝে ‘কষ্ট’ এবং ‘পালক’কে স্থিতি করে ‘আমি’ সর্বনামের গতিময় সঞ্চারকে কার্যত স্বয়ংক্রিয় ও সক্রিয় করে তুলেছেন। পরিযায়ী রাস্তায় পাখিদের উড়ানের সঙ্গে ‘সোনার রেখা’ বিশেষণটি যুক্ত করে যাত্রাপথের গরিমাকে আরও উচ্চকিত পর্যায় দান করেছেন। তারপর চাঁদ এবং বনভূমির প্রাচীন শহর উল্লেখ করে আদিপ্রজ্ঞার সামঞ্জস্যে কার্যত সমতা এনেছেন। বজ্রবিদ্যুৎ এর দড়িতে কাঠের বোঝা বাঁধাও মহাজীবনের ছন্দেই তা সংঘটিত হয়েছে। কেননা মানুষের জীবন মানুষের থেকে দূরত্বে থাকে। এই জীবনকে আমরা ধরতে পারি না। আমরা ক্ষুন্নিবৃত্তির শ্রমের ভেতর অশ্রু পতনে নিবিষ্ট। সেখানে মহাজীবনের মহাস্রোতকে ধারণ করতে পারি না। কবির বুকের বাজনা সেই মহাজীবনের পথেই তাঁকে অগ্রসরতা এনে দিয়েছে।  তাই নির্জনতার এই হাড়ভাঙা পরিশ্রম তিনিই তো উপলব্ধি করার ক্ষমতা অর্জন করেছেন। জনসাধারণের কাছে এই আকাশ, এই দৃশ্য, এই মহাযজ্ঞ কখনোই আত্মপ্রকাশ করে না। কবি তাই ‘একগুঁয়ে’ শব্দটি ব্যবহার করে এর ভেতর মানবিক প্রকল্পের প্রত্যয় জাগিয়ে দিয়েছেন। তাঁর বহু কবিতায় এই মহাজীবনের উল্লাস নিস্তব্ধতায় আকীর্ণ হয়ে আছে।  আসুন আমরা এর সঙ্গে আরও কয়েকজন কবির কবিতা যোগ করে দিই।#

 

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!