মালঞ্চা এবং…

।। মালঞ্চার পথে ।।

ভোরবেলা। সূর্য সবে উঠছিল। ‌বৈশালী দূর থেকে দেখতে পেল, বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে বালুরঘাটের দিকে মুখ করে একটি পাবলিক বাস দাঁড়িয়ে। বৈশালী হনহন করে হাঁটতে লাগল। কাঁধে সাইড-ব্যাগ। প্রতিদিনের মতো মাধবী বৌদি প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিল। রাস্তার মধ্যে বৈশালীর সাথে দেখা। মাধবী বৌদি দাঁড়িয়ে পড়ল। বৈশালীও দাঁড়িয়ে গেল। মাধবী বৌদি জিজ্ঞেস করল, “কি রে বৈশালী,খুবই সুন্দর ভাবে সেজেগুঁজে একা-একা এত সকালে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিস বুঝি? প্রেমিকের সাথে দেখা করার সময় দেওয়া আছে বুঝি?”
বৈশালী বিরক্তি সহকারে উত্তর দিল, “কি যা তা বলো না বৌদি। ওসব কিছুই না। আমি বালুরঘাটের মালঞ্চা দত্তক- গ্রামে ঘুরতে যাচ্ছি। আমি দত্তক-গ্রাম‌ দেখিনি। তাই দত্তক-গ্রামে বেড়াতে যাচ্ছি।”
বৈশালী তার কথাতে অসন্তুষ্ট হয়েছে বুঝতে‌ পেরে মাধবী বৌদি আর কথা বাড়াল না। বলল,”ঠিক আছে যা।”
মাধবী বৌদি প্রাতঃভ্রমণে চলতে লাগল। বৈশালী বাস ধরার জন্য আবার জোরে-জোরে হাঁটতে লাগল। বৈশালী কাছে গিয়ে দেখল,বাসটির নাম ‘শুভেচ্ছা’। বাসের সামনে গিয়ে দেখল,বাসের সামনের কাঁচে ‘বালুরঘাট’ লেখা বোর্ড লাগানো। চালকের আসনে চালক বসেছিল। বৈশালী দেরি না করে দ্রুত বাসে উঠে জানলার ধারে একটি ফাঁকা আসনে বসে পড়ল।

রাত থাকতে বৈশালী ঘুম থেকে উঠে মাথায় শ্যাম্পু দিয়ে বেশ করে স্নান করে নিয়েছিল। হেয়ার-ড্রায়ার দিয়ে চুল ভাল মতো শুকিয়ে নিয়েছিল। লম্বা কোমর অবধি চুল। সামনের দিকে বাদামি-রং করা। চুলগুলো ক্লিপ লাগিয়ে ভালভাবে লাগিয়ে নিয়েছিল। হাত আর পায়ের আঙুলে মনোযোগ দিয়ে নেল-পালিশ পরেছিল। ড্রেসিং-টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে লাল লিপস্টিক,চোখে কাজল দিয়েছিল। সাদা রঙের চুড়িদারের সাথে হলুদ রঙের ওড়না পরেছিল। একটি ফ্লোল্ডিং ছাতা বের করে আবার ছাতাটি রেখে দিয়েছিল। বৈশালী রোদে তার শরীর ভেজাতে চায়। বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে রোদে গগলস পরা উচিত জেনেও বৈশালী সঙ্গে গগলস নেয়নি। কারণ, বৈশালী মনে করে, গগলস পরে কোনও কিছুর প্রকৃত রূপ জানা যায় না। গগলস চোখে আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না। বৈশালী কপালে একটি বড় আকারের খয়েরি রঙের টিপের ওপর একটি ছোট আকারের নীলটিপ পরেছিল। খুব… খুব সুন্দর লাগছিল বৈশালীকে।

ড্রাইভার বাসে স্টার্ট দিল। বাস চলতে শুরু করল। পিচের পাকা রাস্তার ওপর দিয়ে বাসটি চলতে লাগল। বৈশালী বালুরঘাটের বাস ভাড়া কাটল। মালঞ্চায় যেতে হলে বুনিয়াদপুর থেকে প্রথমে বালুরঘাট পৌঁছতে হবে। তারপর বাস কিংবা অটো অথবা টোটো ধরে মালঞ্চা। সকালের দিকে রাস্তা প্রায় ফাঁকা। পাকা রাস্তা দিয়ে দ্রুতগতিতে ‘শুভেচ্ছা’ বাসটি বৈশালীকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলছিল। জানলা খোলা ছিল। উন্মুক্ত জানলা দিয়ে ঢোকা ঠান্ডা হাওয়া বৈশালীর শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছিল। বৈশালী আসনের পেছনের দিকে আরাম করে হেলান দিল। বৈশালী ভাবতে লাগল,পাকা রাস্তা হোক আর মাটির রাস্তা হোক, সব ধরণের রাস্তার প্রধান কাজ হল পথচারিকে তার গন্তব্যের জায়গায় পৌঁছে দেওয়া। মসৃণ রাস্তা হোক, এবড়োখেবড়ো রাস্তা হোক কিংবা কাদা-ভরা-রাস্তা হোক, সকল রাস্তার দায়িত্ব ও কর্তব্য হল পথিককে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া।

বৈশালীর মনে পড়ল, প্রথম রাস্তার উৎপত্তি হয়েছিল জীবজন্তুর পায়ের ছাপ অনুসরণ করে। তবে এই কথা সর্বস্বীকৃত নয়। কেননা,অনেক ক্ষেত্রে জীব-জন্তু সুনির্দিষ্ট পথ ব্যবহার করে না। কিন্তু কিছু রাস্তার উৎপত্তি ঘটেছিল প্রাণীদের পথ-চলা থেকে।
তার উদাহরণ হল ‘আইনিল্ড ওয়ে’। ওই রাস্তায় মানুষ এবং প্রাণী উভয়ে চলাচল করত। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দশ হাজার বছর আগে মাটির কাচা-রাস্তার উদ্ভব হয়েছিল। মিশরে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ পাকা রাস্তা নির্মিত হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যের ‘উর’ শহরে পাথর সহযোগে নির্মিত পাকা রাজপথের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। প্রাচীন ভারতবর্ষে ইটের তৈরি রাস্তা ছিল। প্রথম দারিয়াস ‘রয়েল রোড’ নামে পারস্যে ব্যয়বহুল রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন। রোমান সাম্রাজ্যে সোজা, মজবুত পাথর দিয়ে রোমান রোড তৈরি হয়েছিল। আরব সাম্রাজ্যে ইরাকের বাগদাদে খলিফারা আলকাতরা ব্যবহার করে পাকা রাস্তা বানিয়েছিল। আমেরিকা ডেনমার্ক, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, তাইওয়ান, চীন, নেদারল্যান্ডস, ইন্দোনেশিয়াতে এমন কিছু পাকা রাস্তা রয়েছে,যে-রাস্তা ধরে একটি নির্দিষ্ট গতিতে গাড়ি চালিয়ে গেলে সুরেলা ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। রাস্তাগুলো এমন ভাবে তৈরি করা যে রাস্তার সঙ্গে গাড়ির চাকার ঘর্ষণে সুরেলা আওয়াজের সৃষ্টি হয়। এদের সংগীত-মুখর-রাস্তা বা গান-গাওয়া-রাস্তা বলে। এই সমস্ত গান-গাওয়া রাস্তা গান করলেও, সঙ্গীত পরিবেশন করলেও কাজে কোনওরূপ গাফিলতি না করে তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে মানুষকে তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়।

বাস বালুরঘাট বাসস্ট্যান্ডের ভেতর প্রবেশ করে থেমে গেল। বালুরঘাট এসে গেছে। বৈশালী বাস থেকে নেমে পড়ল। কিছুটা দূরে টোটো দাঁড়িয়ে ছিল।
বৈশালী টোটোওয়ালাকে বলল, “দাদা,মালঞ্চা দত্তক-গ্রামে যাবে?”
টোটোওয়ালা বলল,”হ্যাঁ,যাব।”
বৈশালী টোটোতে উঠে বসল। টোটো চলতে লাগল মালঞ্চার উদ্দেশ্যে। বালুরঘাট বাসস্ট্যান্ড থেকে হিলি যাওয়ার রাস্তা ধরে মালঞ্চা গ্রাম প্রায় তিন কিলোমিটার হবে। পাকা রাস্তা ধরে এগোতে লাগল টোটো। ফাঁকা রাস্তা। অল্প সময়ের মধ্যে মালঞ্চায় পৌঁছে গেল টোটোটি। বৈশালীর চোখে পড়ল, একটি সাইনবোর্ডে বড়-বড় হরফে লেখা ‘মালঞ্চা-দত্তক-গ্রাম’। ভাড়া মিটিয়ে টোটো থেকে নেমে মালঞ্চার মাটিতে বৈশালী যখন প্রথম পা রাখল, বৈশালী তার হাত-ঘড়িতে দেখল, তখন সকাল সাড়ে আটটা বাজে। বৈশালী মনে-মনে বলল,রাস্তা তার দায়িত্ব, তার কর্তব্য খুবই ভালভাবে পালন করেছে। কোনওরকম বাধা-বিঘ্ন ছাড়া,তাকে কোনওরূপ কষ্ট না দিয়ে রাস্তা তাকে তার গন্তব্যে সুন্দর ভাবে পৌঁছে দিয়েছে।

মালঞ্চা-দত্তক-গ্রাম। বালুরঘাট কলেজ থেকে পাঁচ বছরের জন্য মালঞ্চা গ্রামকে দত্তক নেওয়া হয়েছে। তিন বছর হয়ে গেছে গ্রামটির দত্তক নেওয়া। বৈশালী নিশ্বাস টেনে বুক ভরে মালঞ্চা গ্রামটির বাতাস গ্রহণ করল। সাইড-ব্যাগ থেকে ছোট্ট আয়না বের করে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে নিল। বৈশালী চারদিকে দেখতে লাগল। গ্রামে পাকা-রাস্তা, কাঁচা রাস্তা দু,ধরণের রাস্তা রয়েছে। বৈশালীর চোখে পড়ল,গ্রামের মাঝখানে একটি কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ। প্রচুর লাল-লাল-কৃষ্ণচূড়া ফুলে ভরতি কৃষ্ণচূড়া গাছটি। মনে হচ্ছিল,লাল ফুলে ভরতি কৃষ্ণচূড়া গাছটি নারীর কপালের লাল-সিঁদুর। চারপাশে সবুজ গাছপালা। সবুজে সবুজময় গ্রাম। গ্রামটির বেশ কিছু অংশ জুড়ে মাটির রং লাল। বৈশালীর মনে হল,গায়ে সবুজ শাড়ি পড়ে, পায়ে আলতা লাগিয়ে, কপালে লাল-সিঁদুর দিয়ে মালঞ্চা-গ্রামটি বিবাহিত গ্রাম্য-বধূ সেঁজে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রথম দেখাতেই মালঞ্চা গ্রামের রূপে বৈশালী মুগ্ধ হয়ে গেল।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!