যে রকম ছিল আমার শৈশব

১.

আমার জন্ম আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের বরিশাল শহরে। তখন আমাদের পরিবার হাটখোলা রোডে ভাড়া বাসায় থাকতো। সে রাস্তায় সপ্তাহে দুবার বসতো হাট। সে হাটের নামানুসারে এলাকাটির নাম হাটখোলা রোড। সেখান থেকে কিছুটা পথ হেঁটে গেলে প্রবাহিত কীর্তনখোলা নদী। আমার যতো প্রথমা বিস্ময় যতো নতুন আবিষ্কার সব ছিলো ঐ হাটকে ঘিরে। আমাদের সময়ে তখনকার হাটের চরিত্র এখনকার মতো শুধু তরিতরকারীর বাজার ছিলো না। নানা রকম গাছের চারা, বাঁশ-বেত-নারকেলের তৈরি হস্তশিল্প, মাটির তৈরি তৈজসপত্র বিক্রির উদ্দেশ্যে হাটুরেরা নিয়ে আসতো দূর-দূরান্ত থেকে। ঘরের বাইরে বেরিয়ে প্রথম দেখা এ জিনিসগুলো আমার জন্যে বিস্ময়ের ছিলো। তখন ভাবতাম আমার পরিচিত জীবনের বাইরে আর কি কি আছে সেসব আমাকে দেখতে হবে। এভাবে একটু একটু করে ঘরের গণ্ডি ছেড়ে বের হলাম। নানা রকম মানুষ আসতো সে হাটে, তাদের মাঝে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করতাম। নানা রকম মুখ, নানা পোশাক পরনে, তাদের সঙ্গে আবার নানা রকম ছেলেমেয়ে বা নানা রকম লোক।

গাছের চারা ও হস্তশিল্পের পরে আমার চোখে পড়লো এসব যারা হাটে আনে সেসব মানুষদের প্রতি। তাদের খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতাম। তারা কেমন, তাদের টুকরো কথাগুলো, হাসি, উৎকণ্ঠা, পসরা না বিক্রি হওয়ার মনখারাপ, কিংবা জিনিসপত্র সব বিক্রি করে হাট শেষে রান্নার ও জ্বালানী দুই রকম তেল কিনে দড়িবাঁধা দুটি লম্বা বোতলে তেল ভরে তাদের আস্তে আস্তে বাড়ি ফেরা দেখতাম। ভাবতাম তাদের জন্যে তাদের বাড়িতে কারা কারা অপেক্ষা করে তাদের দেখতে হবে আমার, দেখতে হবে এই পৃথিবীতে আরও কারা থাকে। এসব বিষয় যখন আমাকে ভাবাতে লাগলো তখন দেখলাম হাটটির যেখানে শেষ হয়েছে তারপরে একটা বড় রাস্তা দুদিকে চলে গেছে। এ রাস্তা দুটি কোথায় যেন গেছে, দূর থেকে দেখলাম সেসব রাস্তায় আরো অনেক অচেনা মানুষ হাটাচলা করছে। তারা কারা? তারপর শুধু রাস্তার পর রাস্তা পেরোনোর নেশা আমায় পেয়ে বসলো। আস্তে আস্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে শুরু করলাম আমি। মায়ের শাসনের কারণে একটু ভয় কাজ করতো; কিন্তু মানুষকে দেখতে পাওয়ার জানতে পারার আকুতি কোথাও কোনো দূর থেকে আমায় হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো ডেকে চললো কেবলি।

সে সময় একদল ভয়ংকর প্রাণীর সঙ্গে আমার দেখা হলো। তারা ছিলো পাঁচ-ছয় ফুট লম্বা গুইসাপের একটি দল। আমার বাবা তখন ছিলেন আজাদ অয়েল মিলের হিসাব কর্মকতা, আর মা সরকারী হাসপাতালের নার্স। আমরা হাটখোলায় তখন আজাদ অয়েল মিলের পাশে যে বিল্ডিংয়ের এপার্টমেন্টে ভাড়া থাকতাম, তার চারপাশে ছিলো নানা রকম মিল, যেমন: তেলের মিল, ময়দার মিল। তখনকার সময়ে হাটখোলা রোড এলাকাটি ছিলো বরিশালের মূল বাণিজ্য কেন্দ্র। এই মিলগুলোর কোথাও সে গুইসাপের দল বাসা বেঁধেছিলো। ওরা প্রায়ই সকালে দলবেঁধে আমাদের বিল্ডিংসংলগ্ন ছাদ ও একের পর এক মিলগুলোর গাঁঘেঁষা টিনের চালের ওপর হেঁটে হেঁটে দূরে কোথাও যেতো, আবার বিকেলবেলা ফিরে আসতো। আমি তখন ওদের কিছুটা দূর থেকে হাত-পা ছুঁড়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করতাম। এভাবে আমার কোনো ভয়ঙ্কর প্রাণীর সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে।

নানারকম পুজোর সময় দূর-দূরান্ত থেকে ট্রলারে করে নদীপথে প্রতিমা নিয়ে আসতো লোকেরা। আমাদের রাস্তা ধরে সেসব প্রতিমা ভ্যানগাড়িতে, কিংবা ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হতো। এক সন্ধ্যায় ঢাকঢোল পিটিয়ে ভ্যানে করে মাটি ও খড় দিয়ে তৈরি প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যারা প্রতিমা কিনেছে তারা নৃত্য করে জয়ধ্বনি দিয়ে ভ্যানগাড়ির সঙ্গে যাচ্ছে। এর আগে আমি কোনো প্রতিমা দেখিনি। শোরগোল শুনে এপার্টমেন্টের তিনতলার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু নিচে ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছি না সন্ধ্যার আবছায়ায়। বড় বোন বীথির কাছে জানতে চাইলাম: ‘কার প্রতিমা?’ সে উত্তর করলো: ‘মা কালীর প্রতিমা’। তারপর অনেক কষ্টে রেলিং বেয়ে উঠে নিচের দিকে তাকিয়ে কালী প্রতিমার রুদ্রমূর্তি দেখলাম, আমার জীবনে প্রথমবারের মতো হ্যালুসিনেশন ঘটলো। মুখ তুলে সন্ধ্যার আকাশে দেখলাম অসংখ্য খর্বাকৃতির কালী উড়ে যাচ্ছে, তা আমার শিশুমনে যে ছাপ রাখলো তা থেকে এক পরাবাস্তব (surrealistic) জগতের প্রথম নির্মাণ হলো।

২.

আমরা পিঠেপিঠি দুই ভাইবোনের স্কুলে ভর্তি হবার বয়স হতেই, মা-বাবা বাড়ি বদল করলেন। আমরা চলে এলাম আমাদের দুজনের স্কুলের কাছাকাছি। আমরা প্রথমে ঈশ্বর বসু রোডের একটি এপার্টমেন্ট ভাড়া নিলাম। উচ্চবৃত্তের পাড়ায় আমরা অপেক্ষাকৃত গরীব মানুষ। কারুকাজ করা কাঠের দরজা ছিলো প্রতিটির বাড়ির। প্রতিটি বাড়িতে দামী কাপের্ট, বিদেশী আসবাবপত্র, বিভিন্ন সরঞ্জাম—যা আমাদের বাসায় ছিলো না। মায়ের পুজো করা-প্রার্থনা দেখে তখন ঈশ্বর সম্পর্কে একটু একটু জানতে পারছি। তখন ভেবেছিলাম এই ঈশ্বর বসু রোডেই ঈশ্বর থাকেন। কিন্তু তিনি কোন্ বাড়িতে থাকেন? তা জানতে চেয়ে পড়শির কাছে বারবার হাসির খোরাক হয়েছি। আমার মাঝে-মধ্যে হ্যালুসিনেশন হতো বোধহয়, কখনও সন্ধ্যায় পরাবাস্তবিক অতিকায় ডানা ঝাপটে কোনো কোনো বাড়ির ছাদে ঈশ্বরকে নেমে আসতে দেখতাম। পাড়ার কোল ঘেঁষে যে খালটি ছিলো তাতে নানা রকম রঙিন মাছ থাকতো, আমরা পাড়ার ছেলেরা সেসব মাছ ধরে ভাগাভাগি করে বাসায় নিয়ে এসে স্বচ্ছ কাঁচের জারে রেখে দিতাম। ও পাড়ায় আমরা ছিলাম একমাত্র ভিন্ন ধর্মালম্বী পরিবার, অন্য সকলে মুসলিম ছিলো। বেড়ে উঠতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে গোঁড়া মানুষদের ব্যবহারে। এরকমও হয়েছে অনেকবার, ঘর থেকে রাস্তায় বেরোতেই কোথাও থেকে মাথায় ঢিল পড়তো আর আমার ও দিদির প্রায়ই মাথা ফাটতো। মাথার ঘা শুকোতে না শুকোতে আবার ঢিলের আঘাতে মাথা ফাটতো।

এসব কারণে চরম বর্ণবাদী সে পাড়ায় আমরা টিকতে না পেরে দুমাস যেতে না যেতে বাসা পরিবর্তন করে পাশেই ব্রাউন কম্পাউন্ড রোডের একটি বাড়িতে এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে চলে আসি। সে সময়ে এ ব্রাউন কম্পাউন্ড রোড ছিলো বরিশালের সবচে অভিজাত এলাকা। আমার বড় বোন তখন সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে, আর আমি সবে খ্রিস্টান মিশনারীদের পরিচালিত উদয়ন স্কুলে প্রথম গ্রেডে ভর্তি হয়েছি। স্কুল ছিলো আমার জন্য আরেকটি বিস্ময়ের জাগানিয়া স্থান। স্কুলে গিয়ে দেখি আমার বয়সী কত ছেলেমেয়ে একসঙ্গে এক জায়গায়। ‘তুই আমার বন্ধু হবি? ‘তুই আমার বন্ধু হবি? করতে করতে বন্ধু-ও হলো কেউ কেউ। ক্লাশ ওয়ানে শ্রেণী শিক্ষক ছিলেন রাণু ম্যাডাম, ছাত্র-অভিভাবক নির্বিশেষে সকলে তাকে ‘রাণু দি’ বলে ডাকতো। আমার হাতের লেখা ছিলো আঁকাবাঁকা; অনেকটা কাদায় হেঁটে চলা পাখির পায়ের ছাপের মতো। আমি কালো (লোকেরা বলতো: ‘গায়ের রঙ ময়লা’)। আমার হাতের লেখা প্রাকটিসের খাতায় বারবার কাটাকাটি রাবার দিয়ে ঘঁষাঘঁষি করি বলে খাতার অবস্থাও শোচনীয় হতো। তখনকার দিনে শিক্ষকরা জোড়া বেত পেটা করে শাস্তি দিতেন আমাদের। অথচ আমরা কত না ছোট প্রাণ ছিলাম, আমাদের তারা কী নির্দয়ভাবেই না শারীরিক নিপীড়ন করতেন। ওটাই ছিল নাকি আমাদের শেখানোর প্রক্রিয়া! উদয়ন স্কুল বরিশাল শহরের সবচে নামকরা ও প্রথম শ্রেণীর স্কুল ছিল তখনকার দিনে। রাণু ম্যাডাম কয়েকদিন বেত দিয়ে মারতেই ভয়ে আমার হাতের লেখা প্রাকটিসের খাতায় বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখা চলনসই ও উদ্ধারযোগ্য হয়ে গেল। যা দু’একটি শব্দ তিনি ক্লাসে কিংবা হোমওয়ার্ক হিসেবে বাসায় লিখতে দিতেন তা থেকে বানান ভুলও উধাও হয়ে গেল। বানান ভুল না করার যে ভয় রাণু ম্যাডাম ওই অল্প বয়সে আমার মাঝে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তা পরে গিয়ে বানান সচেতনতায় রূপ নেয়। বড় হয়ে প্রচুর বইপত্র পড়ার কারণে আমার বাংলা বানানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়। অবশ্য উদয়ন স্কুলে মাত্র প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে আমি পড়েছিলাম, অন্য স্কুলে চলে যাওয়ায় তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তিনি ছিলেন আমার কাছে বিভীষিকার মতো। উদয়ন স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে গণিতে আমি একশত নম্বরের মাঝে একশত পেয়েছিলাম। মা আমার ওটুকু সাফল্যে খুশি হয়ে রসগোল্লা কিনে এনে আমাদের পরিবারের সকলকে খাইয়েছিলেন।

বরিশাল জিলা সরকারী স্কুলে তখন সবে প্রভাতি শাখা খুললে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ক্লাশ থ্রিতে এসে ভর্তি হলাম। উদয়ন স্কুলে আমরা ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়তাম, আর জিলা স্কুল বালক বিদ্যালয়। উদয়ন স্কুলের কড়া অনুশাসনের দমবদ্ধ পরিবেশ থেকে একটু হলেও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কেননা আমাদের এই স্কুল ছিলো অনেক বড়, একাধিক বিল্ডিং, পি.টি. করার আলাদা জায়গা, একাধিক বড় বড় খেলার মাঠ, সাইকেল রাখার গ্যারাজ, বড় লাইব্রেরী, ফুলের বাগান, ফলের বাগান, বাস্কেটবল খেলার কোর্ট, পুকুর, শরীরচর্চা করার জন্য লোহার তৈরি কিছু রিং বা কাঠামো সহ আরো অনেক কিছু। ছিলো স্কুলের পুরানো ভবনের ধ্বংসাবশেষ। এই পুরানো ভবনের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে ছাত্রদের মাঝে কৌতুহলের সীমা ছিলো না। ভবনের নিচ থেকে ওপাশে যাওয়ার কয়েকটি ট্যানেল ছিলো। ট্যানেলের এপাশ থেকে ‍উঁকি দিলে মাকড়সার জাল পেরিয়ে ওপাশে আলো দেখা যেতো। আমরা মাঝে-মধ্যে ট্যানেলে উঁকি দিয়ে অজানা ভয়ে আবার সরে যেতাম। একদিন লাঞ্চ পিরিয়ডে সাহস করে আরেকজনকে সঙ্গী করে সে ট্যানেলে ঢুকে পড়লাম। পরে বেরিয়ে ক্লাসে ফিরে গিয়ে বললাম সে ট্যানেলের এপাশ থেকে ঢুকে ওপাশে যাওয়ার কালিঝুলি মাখা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা। আমাদের দুঃসাহসী সে অভিযানের কথা শুনে আমাদের ক্লাশের বন্ধুদের চোখ বড় বড় হয়ে যেতো দেখে আনন্দ পেতাম।

বরিশাল জিলা স্কুলের শিক্ষকেরা ছিলেন উদয়ন স্কুলের থেকে অনেক উদার ও স্নেহশীল। যদিও তারাও কম-বেশি শারীরিক নিগ্রহ করতেন, আবার কখনও কখনও আদর করে পড়া আদায় করে নেয়াতেও তারা সিদ্ধহস্ত ছিলেন। কামরুল স্যারেকে ক্লাশ থ্রি থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত মানে সব ক্লাশের ছাত্ররা ভয় করতো। কারণ কামরুল স্যার কঠোর নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য করতেন সকলকে। খোলা মাঠে পি.টি. করা, স্কুলের ড্রেস কোড (শাদা শার্ট-শাদা প্যান্ট) অনুসরণ করা, কোনও পূর্বনির্ধারিত র‌্যালিতে যাওয়া এসবে কোথাও একটু ছাত্রদের ভুল হলেই তার ডাক পড়তো। অন্যদিকে স্কুল পলাতক ছাত্ররা পরদিন ক্লাশে এলেই সেদিন কামরুল স্যারের ক্লাশ নাও থাকতো তবুও তিনি ডেকে পাঠাতেন সেসব ছাত্রদের শিক্ষক মিলনায়তনে। মিলনায়তনের দরজার সামনেই দাঁড় করিয়ে বেত দিয়ে সশব্দে হাতে, পায়ে পেটাতেন। দুপুরবেলা সে শব্দ শুনে সমগ্র স্কুল নিঃস্তব্ধ হয়ে উঠতো। কেউ টু শব্দ করতো না। হয়তো কোনো ছাত্র কাউকে মেরেছে তিনি সে ছাত্রকে তার সঙ্গে নিয়ে প্রত্যেক ক্লাশে গিয়ে কান ধরে উঠ-বস করাতেন। তাকে আমি কখনো চটাতাম না। সে কারণে বোধহয় আমি দু-একবারের বেশি তার হাতে মার খাইনি। তার হাতে যা মার খেয়েছি তাও হয়তো অন্যদের দোষে, তিনি কেউ দোষ করলে কখনো কখনো যাকে কাছে পেতেন তাকেই গোঁয়ারের মতো পেটাতেন!

৩.

আমরা ব্রাউন কম্পাউন্ড রোডে তিনটি এপার্টমেন্টে প্রায় এক যুগ ছিলাম। ব্রাউন কম্পাউন্ড এলাকাটি বরিশাল জিলা স্কুল লাগোয়া। স্কুলে প্রবেশের ৩টি গেট ছিল। আমি স্কুলে যেতাম পরেশ সাগরের মাঠ হয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সরকারী বাসভবনের সামনের পকেট গেট থেকে ঢুকতাম। এভাবে খুঁজে পেলাম সিমেন্টের তৈরি আকাশচুম্বী বিশালকৃতির জলের ট্যাংকি, জলের ট্যাংকির পেছনে বড় একটা জঙ্গল বাগান, পরেশ সাগর নামে বড় একটা রহস্যময় দীঘি, প্রোল্ট্রি ফার্মের পরিত্যক্ত একতলা বাড়ি, মূল সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ‘অচ্ছুত’ বলে পরিচিত মেথরপাড়া, নিরাপত্তা বেষ্টনিতে ঘেরা পুলিশ লাইনের লাল রঙের দালানগুলো, ভকেশনাল স্কুলের অদ্ভুতুড়ে মেশিনপত্র। তখন ওই অতটুকুন জঙ্গল বাগানকে দুর্ভেদ্য মনে হতো। বরিশাল শহরের দীঘি খননের নানা রকম রহস্যময় শ্রুতিগল্প তখন আমরা জানতে পারছি অন্যদের কাছ থেকে। তাছাড়া তখনো স্মৃতিতে রয়ে গেছে মা’র কাছ থেকে শোনা বাংলা রূপকথার গল্পভাণ্ডার। তাই পরেশ সাগরের উপর সবসময় উড়তো রহস্যময় কুয়াশার মেঘ। শহরের একমাত্র ভকেশনাল স্কুলটির প্রতি তখনকার মানুষের বেশ নেতিবাচক ‍ধারণা ছিলো, তারা মনে করতো বিভিন্ন স্কুলের সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরা পড়া ছাত্ররা মূলত এ স্কুলে মোটরগাড়ির ইঞ্জিন মেরামত, ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি মেরামত, ওয়েল্ডিং করা প্রভৃতি শিখতো। আমরা তখন দেয়ালের ওপর উঁকি দিয়ে সে স্কুলের শ্রেণীকক্ষে কি চলছে তা দেখার চেষ্টা করতাম।

ওই দীর্ঘ মাঠের ওপর ছিল সারবাঁধা লোহার খুঁটি, শর্টকার্টে বৈদুতিক সংযোগ চলে গেছে অন্য এলাকায়। মোটা তারগুলো চলে গেছে কোথাও দীঘির পাড়ের অনেক ওপর দিয়ে, আবার কোথাও দীঘির শেষ মাথায় জলের ওপর দিয়ে পুলিশ লাইনের লাল দালানগুলোর দিকে। আমরা পরেশ সাগরে দুজনে দুপাশ থেকে লম্বা গামছা ধরে মাছ ধরতে নামতাম। আর প্রতি খেপেই মাছধরা সাপ উঠতে থাকতো, ওগুলো খুব চাতুর্য আর দক্ষতার সঙ্গে দুআঙুলের এক ঝটকা টানে আবার সেগুলোকে জলে ফেলতাম। বর্ষার সময়ে সাপের বংশবৃদ্ধির কারণে সাপ বেশি উঠে আসতো আমাদের গামছার জালে। বছরের সে সময়ে বিরক্ত হয়ে আমরা পরেশ সাগর দীঘিতে মাছ ধরা বন্ধ করতাম।

তখনো আমি সাঁতার জানি না। শুধু মাছ ধরার জন্যে হাঁটু সমান জলে নামতাম। একদিন বাবা আমাকে আর বড় বোনকে নিয়ে এলেন সাঁতার শেখানোর জন্য। মা আমাদের চারটে নারকেল দুটি করে জোড়া বেঁধে  দিয়েছিলেন। নারকেলের বাঁধন ছিঁড়ে যাবার ভয়ে আমি নারকেলের তৈরি সে লাইফ জ্যাকেট পরিনি। আমি পরেশ সাগর দীঘির সিঁড়ি ধরে হাত-পা নেড়ে সাঁতার শিখেছিলাম। এক সিঁড়ি এক সিঁড়ি করে গভীর জলে প্রতিদিন একটু একটু নামতে শুরু করলাম। একদিন অনেক সাহস করে খুব কাছের মাছ ধরার একটি বাঁশের মাচার উদ্দেশ্যে সাঁতরে গেলাম। সেখানে পৌঁছে গভীর সমুদ্রাঞ্চলে দ্বীপ জয়ের আনন্দ হয়েছিল। এভাবেই সাঁতারের শুরু। সে দীঘি ঘিরে থাকা বিভিন্ন এলাকার সাহসী যুবকেরা নিজেদের মাঝে বাজি ধরতো অত বড় দীঘি সাঁতরে যাবার। আমরা ছোটরা তখন তাদের দিকে তাকিয়ে হিংসা করতাম। এরপর আমরাও অমন নায়কোচিত কাজ করার চেষ্টা করতাম। প্রথম প্রথম আমরা দীঘির অর্ধেক পর্যন্ত যেতেই হাঁফিয়ে গিয়ে পাড়ে উঠে যেতাম। তারপর একদিন আমরাও পুরো দীঘি সাঁতরে যেতে সমর্থ হলাম। সেসব তুমুল জলমুখর দিনে বাড়ি ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেতো। বাড়ি ফেরার পথে পড়তো কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি। সে গাছেদের শাখায় থাকা ভুতের ভয়ে সদলবলে ঐ রাস্তাটুকু দৌড়ে আমরা বাড়ি ফিরতাম। মাঝে মাঝে গান গেয়ে গেয়ে হেঁটে দীঘিতে স্নান করতে আসতো এক অন্ধগায়ক। তার উল্টানো চোখ দেখে প্রথম প্রথম ভয় পেলেও পরে সে আমাদের ছোটদের বন্ধু হয়ে যায়। আমরা তাকে মাঠের শেষ পর্যন্ত গিয়ে তার পাড়ায় ঢোকার রাস্তায় এগিয়ে দিয়ে আসতাম।

স্কুলে যাবার দিনগুলোতে খুব সকালে উঠে আমি পড়শিদের বাগানে ফুল কুড়োতে যেতাম। মার কাছে শোনা পরীদের গল্পের কথা মনে পড়তো ফুল কুড়াতে গিয়ে, আর গায়ে শিহরণ জাগতো। এক  খুব সকালে, তখনও ঠিকমতো আলো ফোটেনি, শিউলি ফুল কুড়াতে গিয়ে আমার হ্যালুসিনেশন হয়। পরে এ নিয়ে একটি ছোটদের গল্পও লিখেছি। যতোটা না আমি মায়ের দেব-দেবীদের পুজার জন্য ফুলের যোগান দিতে ফুল কুড়োতে যেতাম, তারচে নানারকম ফুলের অচীন ঘ্রাণ আর ভোরবেলার শান্ত স্নিগ্ধ অন্যরকম প্রকৃতিজগতকে দেখার লোভ আমার ভেতরে খুব বেশি কাজ করতো। ফুল কুড়ানোর পরে বাড়ি ফিরে স্কুলের হোম ওয়ার্ক তৈরি করতাম, তারপর স্নান করে খেয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুলের পরে বাড়ি ফিরে কখনও কখনও স্কুলসংলগ্ন জামরুল গাছে উঠতাম। তখন ওই জামরুল গাছটিকে আমার ভাই মনে হতো। তখনো জানতাম না যে মানুষ গাছ জন্ম দেয় না। জামরুল ভাইয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটিয়ে তারপর মাছ ধরতে পুকুরের দিকে যেতাম

পরেশ সাগরে মাছ ধরার পর্ব শেষ হতেই তারপর আমার শুরু হয়েছিলো বড়শি নিয়ে সারাদিন পুকুরের কাছে বসে থাকা। আটা গুলিয়ে ছোট ছোট দলা করে বড়শির মাথায় লাগিয়ে পুকুরে ছেড়ে দিতাম। মাছ ধরা পড়তো কিছুক্ষণ পরেই। এক সময় তেলাপিয়ার পোনায় চাষের পুকুর ভরে গেলে তখন আর আটা লাগতো না, খালি বড়শি পুকুরে ছুঁড়ে সজোরে টান দিলেই বড়শি বিঁধে মাছ উঠতো। মাছেদের রক্তাক্ত শরীর দেখে আমার কোমল শিশুমন কেমন যেন করা শুরু করতো

তখন এক টাকায় চারটে ছোট বড়শি পাওয়া যেতো। এক দুপুরবেলা আমি বড়শি কিনতে দোকানে  গিয়েছি। প্রথমে পঁচিশ পয়সার একটি কয়েন দিয়ে একটি বড়শি কিনলাম। তখনি দূর থেকে দেখলাম আমার এক খেলার সাথী নিবিড়কে আসতে। নিবিড়দের পরিবার সে এলাকায় খুব গরীব পরিবার ছিলো, সে কারণে ব্রাউন কম্পাউন্ড রোডের নিজেদের অভিজাত ভাবা বাসিন্দারা খুব বেশি ওদের সঙ্গে মিশতো না। নিবিড়ের সঙ্গে আমার খুব সখ্য হয়েছিলো। নিবিড় আমার থেকে দু-এক বছরের ছোট ছিলো। বড়শি দেখলেই নিবিড় চাইবে, তাই সদ্য কেনা বড়শিটি তাড়াহুড়ো করে জিহ্বায় রাখলাম। এ কসরত ওর বেশ রপ্ত ছিল, মাঝেমাঝে করে দেখাতো। নিবিড় আমাকে বড়শি কিনে দিতে বললো। আমি কোনো কথা না বলে আরো দুটি বড়শি কিনে একটি ওকে দিয়ে অন্যটি আমার হাতে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম।

বড়শি বানানোর জন্য নাইলনের সুতো আর একটি চিকন গাছের ডাল লাগবে। বাসায় বড়শির জন্য নাইলনের সুতো কিনে রেখেছিলাম। রাস্তার পাশে এক পড়শির বাগান থেকে একটি ডাল কুড়াতে গিয়ে কিভাবে জানি ঢোক গিলে ফেললাম। আমার মুখের ভেতর থাকা বড়শিটা জিহ্বার নিচে গেঁথে গেলো। একা একা চেষ্টা করেও আঙুল দিয়ে টেনে বের করতে পারলাম না। আমি অনেক সাবধানে বাড়ি ফিরলাম। বড় বোন তখন ওর স্কুল থেকে ফিরেছে। ওকে ইশারা করে দেখিয়ে বললাম বড়শিটা বের করে দিতে। সে ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে পেন্সিল ব্যাটারিচালিত টর্চ আর একটি শোন্ নিয়ে এলো। তখন আমাদের মা ও বাবা দুজনেই নিজ নিজ অফিসে। সাবধানে কয়েকবার টানাটানি করে বড়শিটা আমার মুখ থেকে বের করার চেষ্টা করলো। কিন্তু বড়শিটার আল জিহ্বায় গেঁথে আছে। কষ্ট হলে আমি ওকে থামিয়ে একটু বিশ্রাম নিই, বড় বোন আবার আস্তে আস্তে ছুটানোর চেষ্টা করে। আবার খেয়ালও রাখতে হয় বড়শিটা গলায় ভেতরে চলে না যায়। ব্যথা আর রক্তে আমার মুখ ভরে উঠেছিল। সে এরকম অনেক চেষ্টার পর বড়শিটা বের করে আনলো।

এসব মাছেদের অভিশাপ ভেবে দিদি আমাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিলো যে আমি আর কখনো মাছ ধরবো না। তারপর থেকে আমি আর মাছ ধরিনি।

৪.

গোলাম কবিরের বাসায় যখন ভাড়া থাকি তখন আমাদের টেলিভিশন ছিলো না। আমি ও আমার বোন দুজনে বাড়িওয়ালার বাসায় রাতের বেলা টিভি দেখতে যেতাম। নব্বই দশকের প্রথম দিকে তখন একমাত্র টিভি চ্যানেল বলতে ছিল সরকার পরিচালিত বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। আমরা বিটিভিতে চলমান ধারাবাহিক বাংলা নাটক (সিরিয়্যাল) দেখতে যেতাম। সে সময়ের টিভি সিরিয়ালগুলো খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো, সপ্তাহে একবার একটি সিরিয়ালের অংশবিশেষ দেখানো হতো। পরদিন সারা পাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে, চায়ের দোকানে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলতো। সারাদিনে-রাতে ঐ আধঘন্টা সময় মাত্র আমরা টেলিভিশন দেখতে পেতাম। কিন্তু টেলিভিশন দেখতে গিয়ে আমাদের অপমানের অন্ত ছিলো না।

বড়লোকের বাসায় টেলিভিশন দেখতে গিয়ে আমরা যারা ভাড়াটেদের শিশুরা যেতাম সকলেরই স্থান হতো সোফায় নয় কার্পেটের ওপরে। আর পরদিন বিকেলে খেলাধুলার সময় সে বাড়িওয়ালার ছেলেমেয়েদের ব্যাডমিন্টন কিংবা ক্রিকেট খেলায় জিতিয়ে দিতে হতো। নয়তো তারা আমাদের কথা শোনাতো যে: ‘আমাদের বাসায় গিয়ে টিভি দেখিস, অথচ আমাদেরই খেলায় হারাস! আজ রাতে দেখো নেবো।’ ওরা যেদিন কোনো খেলায় হারতো সে রাতে আমাদের টিভি দেখতে ঢুকতে দিতো না। এসবে আমরা খুব বিরক্ত হলাম। আমি আর বোন আমাদের মা-বাবাকে বিষয়টি খুলে বলতেই তারা খুব কষ্ট পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ও বোনকে নিয়ে র‌্যাংসের শোরুমে নিয়ে গিয়ে রঙিন টিভি কিনে আনলেন। সেসময় রঙিন টিভি খুব কম লোকের ছিল বরিশাল শহরে। বাবা সপ্তাহে দু’একবার খবরের কাগজ অফিস থেকে বাসায় নিয়ে আসতেন। আমার খুব আগ্রহ দেখে তিনি একজন হকারকে স্থানীয় ও জাতীয় দুটি সংবাদপত্র নিয়মিত আমাদের বাসায় দিতে বলে দিলেন। এভাবে আমার সামনে এক অজানা জগত খুলে গেলো। বাইরের পৃথিবীর খবর অনর্গল আসতে শুরু করলো এবার। ‍শুধুমাত্র বরিশালের খবর নয়, রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খবরাখবর, এমনকি বিদেশের খবরও পেতে শুরু করলাম আমি।

মা-বাবা টিভি কেনার পরে ভাড়া বাড়ি পরিবর্তন করলেন। একই পাড়ায় আশরাফ আলীর বাসায় উঠলাম আমরা। এ বাড়ির একেবারে পেছনেই পরেশ সাগরের মাঠ। আগে মাঠের এদিকটির পুরো দখল আমরা পাইনি। এবার অনেক নতুন বন্ধু জুটলো আমার। এবার আমি পেলাম অনেক রকম খেলার খোঁজ। মাঠে প্রথমে দাঁড়িয়াবান্ধার কোর্ট কাটা হলো। যারা কোর্ট কাটায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশগ্রহণ করবে তারাই প্রতিদিন কিংবা একদিন অন্তর পালাক্রমে খেলার সুযোগ পাবে। আমিও যোগ দিলাম বন্ধুদের সঙ্গে। ফুটবল খেলায় কয়েকবার পায়ে ব্যথা পেয়ে শেষে হলাম গোলকিপার! তবে ভালো গোলকিপার ছিলাম। ক্রিকেটে ব্যাটিং ফিল্ডিং ভালো করতাম। কিন্তু বল করতে পারতাম না; কনুই ভাঙতো বা জার্ক হতো। মাঝে মাঝে মার্বেল, ডাংগুলিও খেলতাম। সবকিছু ছুঁয়ে দেখার একটা অভ্যাস আমার ছোটবেলা থেকে আছে। এসব কোনো খেলার প্রতি আগ্রহ বেশিদিন ধরে রাখতে পারলাম না। কেননা তারপরই ডাকটিকিট জমানোর প্রতি আমার আগ্রহ জন্মে। স্কুলে সহপাঠীদের সঙ্গে ও পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে ডাকটিকিট বিনিময় করতাম। স্কুলে ডাকটিকিটের বিনিময় করতে গিয়ে এক বন্ধুর কাছে পাঠ্যবইয়ের বাইরের বইয়ের প্রথম সন্ধান পাই।

সেসব অনেক কথা, অনেক গল্প; তুমুল রহস্য-রোমাঞ্চের গল্প, আমরা বন্ধুরা মিলে একটি গোয়েন্দা দল তৈরি করেছিলাম তার গল্প, তারপর কিভাবে লেখালেখি শুরু হলো তার গল্প, হঠাৎ হঠাৎ পাবলিক বাসে উঠে অন্য কোনো শহরে হুটহাট নেমে পড়ার গল্প। সেসব বেশি উপরের ক্লাশের কথা নয়, ষষ্ঠ শ্রেণীর কথা। আরেকদিন বলবো।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!