লোকসংস্কৃতির গবেষকদের মতে, সর্পদেবী মনসাকে বিভিন্ন অর্বাচীন পুরাণে পাওয়া গেলেও বাস্তবে তাঁকে একজন লৌকিক দেবী হিসেবেই গণ্য করা উচিত। এর কারণ হল যে, সর্প-অধিষ্ঠাত্রী দেবীর উপাসনা পৃথিবীর আদিমতম ধর্মসংস্কারগুলির মধ্যে অন্যতম। সুতরাং দশহরা থেকে শুরু করে ভাদ্র মাসের নাগপঞ্চমী তিথি পর্যন্ত ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সর্প-উপাসনার যে ব্যাপক রেওয়াজ দেখতে পাওয়া যায়, সেটাকে দেবীভাবগত বা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ বা মহাভারতের সূত্র ধরে কোন ধ্রুবপদী মহিমা দান করাটা মোটেও সঙ্গত নয়। গবেষকদের মতে— সুদূর অতীতে ভরা-বর্ষার মরশুমে মূলতঃ নদীমাতৃক বাংলায় একজন সর্প-দেবতার উপাসনার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সাপের ভীতি দূর করবার আদিম সংস্কারই বর্তমানে মনসা পূজায় পরিণতি পেলেও বাস্তবে এই দেবীকে বিচিত্র কিছু সমন্বয়ের প্রতীকরূপে গণ্য করা যেতে পারে। একটু খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলেই দেখা যায় যে, এই দেবী কিন্তু একই সঙ্গে পশু-পূজা, বৃক্ষ-পুজা, নদী-উপাসনা এবং মাতৃকা-আরাধনার ঐতিহাসিক ধারাকে অবলম্বন করে নিজের বর্তমান রূপটি পরিগ্রহণ করেছেন। তাছাড়াও সমাজবিজ্ঞানের আলোয় খুব খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করলে এই দেবীর পূজার মধ্যে সুদূর অতীতের শিশ্ন-প্রতীক পূজারও একটা আভাস অবশ্যই পাওয়া যায়। এত ধরণের পূজা-অর্চনার ধারা একটি মাত্র দেবীপূজার মধ্যে সমাহৃত হয়েছে বলেই এই দেবী লোকসংস্কৃতির গবেষকদের কাছে বাস্তবে খুবই আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে উঠেছেন। অনেক বিশেষজ্ঞই এ ব্যাপারে একমত যে, বংলায় প্রচলিত থাকা মনসা পূজার বর্তমান রূপটি খুব সম্ভবতঃ দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছে। মনসা পূজার অনিবার্য উপকরণ যে মনসাসিজ গাছ— ভারতের দ্রাবিড়-বলয়ে সেটির প্রতিনাম হল চেম্মুড়ু; প্রসঙ্গতঃ স্মরণযোগ্য যে বাংলায় মনসা ঠাকুরানীর আরেকটি নাম হল— চ্যাংমুড়ী। দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘মনে মনচাম্মা’ নামের যে সর্পাধিষ্ঠাত্রী দেবীর উপাসনা করা হয়, প্রায়শঃই তাঁর কোনো মূর্তি থাকে না, বরং সেখানে ওই চেম্মুড়ুর ডাল মাটিতে পুঁতে ভক্তরা সেটাকেই এই দেবীর প্রতীক হিসেবে ধার্য করেন। অতীত থেকেই মনসার যে কাহিনী মঙ্গলকাব্যের মাধ্যমে বঙ্গদেশে প্রচারিত হয়েছে, তাতে দেবসভায় বেহুলার যে নৃত্যবর্ণনা পাওয়া যায়, বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সেটার কোনো তুলনাযোগ্য দ্বিতীয় নজির কিন্তু মেলে না। অনেকের মতে মঙ্গলকাব্যের এই অংশটি বাংলার সংস্কৃতিতে অবশ্যই প্রক্ষিপ্ত; কারণ— দেবতার সামনে নারীর নৃত্যশৈলী দেখানোর কোনো লোকজীবনসম্মত ঐতিহ্য বঙ্গদেশে কোনদিনই গড়ে ওঠেনি, এটি পুরোপুরিভাবে দক্ষিণ ভারতের মন্দিরগুলিতে প্রচলিত থাকা দেবদাসী নৃত্যের ছাঁচে ঢালা একটি দৃশ্য। অতীতে নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালীর ইতিহাস’ গ্রন্থে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের উৎস বিশ্লেষণ করে একথা জানিয়েছিলেন যে, বাংলার উচ্চবিত্ত সমাজের লালসা-তৃপ্তির পরিপোষণের জন্য দেবদাসীপ্রথাটি দক্ষিণ ভারত থেকে খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর পরে বঙ্গদেশে আমদানী করা হয়েছিল; এবং এই প্রথাটি কখনোই বাংলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রচলিত ছিল ন। সুতরাং, চেম্মুড়→ চ্যাংমুড়ী, মনচাম্মা→ মনসা মা এবং বেহুলার নাচ = দেবদাসী-নৃত্য— এই তিনটি অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য অবশ্যই বাংলার মনসা দেবীর বর্তমান ভাবগত অবয়বটি যে দক্ষিণ ভারতের ঐতিহ্যাশ্রিত কাঠামোর ওপরে গঠিত, —সে কথাকেই ইতিহাসগতভাবে প্রমাণিত করে দেয়।
তবে মনসা পূজায় মনসা গাছকে পূজোপকরণ হিসেবে গণ্য করবার মধ্যেই যে শুধু বৃক্ষোপাসনার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য রয়েছে— এ তথ্য সঠিক নয়। বস্তুতঃ শিব-কর্তৃক বিল্ববৃক্ষ আশ্লিষ্ট হওয়ার পরিণতিতে মনসার জন্ম হওয়ার পৌরাণিক কাহিনীও কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় বৃক্ষোপাসনার সঙ্গেই সম্পৃক্ত। প্রসঙ্গতঃ স্মরণীয় যে, এই দেবীর আরেক নাম হল কেতকা, অর্থাৎ— কেয়া এবং অন্য আরেকটি নাম হল— পদ্মা। এছাড়া এই একই দেবীর জাঙ্গুলী বা জাঙ্গলী নামও বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায়। এথেকে স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত যায় যে, সুদূর অতীতে এই দেবীকে— তাঁর কোনো একটি আদিম পর্যায়ে বৃক্ষ বা ফুল ইত্যাদির কোন একটা প্রতীকেই পুজো করা হত; যেমন— এখনও দক্ষিণ ভারতে ‘মনে মনচাম্মা’–র পুজো করা হয়। তবে মনসাসিজ গাছ, পদ্ম ফুল এবং কেয়া ফুলের অন্যতর ব্যঞ্জনাও রয়েছে, সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। আপাততঃ একথা জানিয়ে রাখা যাক যে, গবেষকদের মতে— জাঙ্গলী বা জাঙ্গুলী দেবী শুধুমাত্র প্রাচীন ভারতের বৃক্ষ-উপাসনার ঐতিহ্যকে বহন করেন না; তাঁদের মতে জঙ্গলের শুধু ‘ফ্লোরা’ নয় ‘ফণা’–ও এই দেবীর সঙ্গে নিশ্চিতভাবে সম্পর্কিত এবং স্বাভাবিকভাবেই এই ফণার মধ্যে সাপও রয়েছে। প্রসঙ্গতঃ একথাও এখানে উল্লেখ্য যে, এখনও পর্যন্ত ঐতিহাসিকেরা শুধু সর্পবাহনা মনসা দেবীর প্রাচীন মূর্তি নয়, হংসবাহনা ও হস্তীবাহনা মনসা দেবীর প্রাচীন মূর্তিও আবিষ্কার করেছেন; এছাড়া আজও কোন কোন জায়গায় চ্যাং মাছকে যে মনসা পূজার অন্যতম উপচাররূপে ব্যবহার করতে দেখা যায়, সেটা খুব সম্ভবতঃ এই দেবীর চ্যাংমুড়ী নামটির সঙ্গে ভাবানুষঙ্গ বজায় রেখেই করা হয়। তাছাড়া এই বিশেষ ধরণের মাছটির মধ্যে ফণাওয়ালা সাপের একটা আদলও রয়েছে। তবে মনসার বাহন হিসেবে হাঁস এবং হাতীর প্রশ্নও থেকেই যায়।
মনসাকে যে শিবের মানসকন্যা বলা হয়ে থাকে, গবেষকদের মতে সেটা নিতান্তই অর্বাচীনকালের শিষ্ট সংস্কৃতির ফলশ্রুতি। মনসার জন্ম নিয়ে যে দুটি পৌরাণিক গল্প প্রচলিত রয়েছে, সেগুলির মধ্যে একটিতে দেখা যায় যে— শিবেব চরিত্রবল পরীক্ষা করবার জন্য দুর্গা একজন কোচ-যুবতীর বা বাংলার রাঢ় অঞ্চলে প্রচলিত থাকা এই একই কাহিনীর অন্য সংস্করণে ডোম-কন্যার মূর্তি ধরে তাঁকে অরণ্যের মধ্যে প্রলুব্ধ করে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটারই ফলশ্রুতিতে কোচ জাতির দৌহিত্রীরূপে মনসার জন্ম হয়েছিল। অর্থাৎ— এই পৌরাণিক কাহিনীর অন্তর্কাঠামোর সূত্র ধরে মনসাকে যেমন শিবের দুহিতারূপে পাওয়া যায়, তেমনি তাঁকে কোচ-কন্যা হিসেবেও পাওয়া যায়। বাংলায় প্রচলিত থাকা অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনীতে যেখানে অন্য যে কোনো দেবীকেই মূলতঃ ব্রাহ্মণ প্রমুখ তথাকথিত উচ্চবর্ণের ঘরে জন্মগ্রহণ করতে দেখা যায়, সেখানে অবণ্য-প্রত্যন্তনিবাসী কোচদের বা অন্ত্যজরূপে অবহেলিত ডোমদের ঘরের কন্যা হিসেবে মনসাকে স্বীকার করে নেওয়াটা নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সামাজিক সূচক বলেই গবেষকরা মনে করে থাকেন। তাঁদের মতে, আসলে এই দেবী যে ধ্রুবপদী অর্থে কোন পৌরাণিক দেবী নন, বস্তুতঃ লোকায়ত উৎসেই যে এই দেবীর উৎসারণ ঘটেছে— তাঁর জন্ম নিয়ে বাংলায় প্রচলিত থাকা লৌকিক কাহিনীটি মূলতঃ সেকথাই প্রমাণ করে।
এই একই পৌরাণিক কাহিনীর যে ভিন্নতর তাৎপর্য দেখতে পাওয়া যায়, সেটার সূত্র ধরে মনসার গজবাহনা এবং হংসবাহনা রূপ দুটিকেও বিশ্লেষণ করা সম্ভব। শিব এবং দুর্গার কন্যা হিসেবে মনসাও লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই সমীকৃতা হয়েছেন বলে দেখা যায়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, মনসাকে কিন্তু মহাজ্ঞানের অধিকারিণী হিসেবে দেখা হয়; এবং গবেষকদের মতে— খুব সম্ভবতঃ এই জ্ঞান হল— জীবন ও মৃত্যুর রহস্য, লখীন্দরের পুনর্জীবন লাভ যেটার ব্যঞ্জনাবাহী। তাই এই বিশেষ বিদ্যার একজন অধিদেবীরূপেও তিনি বিদ্যাদেবী সরস্বতীর সঙ্গে সমীভূতা হয়েছেন বলে দেখা যায়। এছাড়াও এমন লোকপ্রত্যয়ও রয়েছে যে— মনসা নাকি ঝল্লমল্ল, অর্থাৎ— গান-বাজনার উপচার ছাড়া পুজো গ্রহণ করেন না; মনসামঙ্গল অনুসারে যাঁরা এসব করেন, তাঁদের ঝালু-মালু বলে অভিহিত করা হয়। এই ঝলমল্ল যেহেতু আবার সরস্বতীর অধীন বিষয়, সেহেতু এদিক থেকেও মনসা এবং সরস্বতীর সাযুজ্য কিন্তু মোটেও অপ্রত্যাশিত বলে মনে হয় না। সুতরাং, এই সূত্র ধরেই সুদূর অতীতে সরস্বতীর বাহন হংস, মনসার বাহন রূপেও উপস্থিত হয়েছিল। মনসা ও সরস্বতীর পারস্পরিক যোগসূত্রের ব্যাপারে নদী-উপাসনার কথাটিও চলে আসে, সেবিষয়ে যথাস্থানে আলোচনা করা হবে। এছাড়া বৌদ্ধদের সর্পদেবী বিষহারিণী জাঙ্গুলীতারা এবং সরস্বতী মূর্তির প্রকরণগত সাদৃশ্য অত্যন্ত বিস্ময়জনক বলেও এই সূত্রেও মনসা এবং সরস্বতীর সমীভবন সম্ভাব্য বলেই মনে হয়।
শিবকন্যারূপে লক্ষ্মীর সঙ্গেও মনসার ভাবৈক্য রয়েছে বলে দেখা যায়। প্রচলিত লোকায়ত সংস্কারানুযারী সাপ আবার সম্পদরক্ষক হিসেবেও কাজ করে থাকে; প্রসঙ্গতঃ স্মরণীয় যে— সর্পমণির কল্পনা এবং গুপ্তধনের প্রহরী হিসেবে সাপের উপস্থিতি প্রাচীন লোককথার বিশেষ পরিচিত উপকরণ। অতএব গবেষকদের মতানুসারে, বিত্তাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী এবং সর্পাধিদেবী মনসা স্বাভাবিকভাবেই একে অপরের সঙ্গে মিলে যেতেই পারেন। লক্ষ্মীর কমলা নামটি এবং মনসার পদ্মা নামটিও এই ভাবনা সমীকরণের অনুষঙ্গস্বরূপ, প্রসঙ্গতঃ একথাও স্মরণীয় যে, লক্ষ্মী কিন্তু বহু সময়েই প্রাচীন সাহিত্যে পদ্মিনী বা পদ্মাবতীরূপেই উল্লেখিত হয়েছিলেন। লক্ষ্মীর অন্যতম বাহনরূপে গজনাগ বা মহানাগ— বহু প্রাচীনকাল থেকেই স্বীকৃত। যদিও হাতীর এই নাগ নামটি কোন ঐতিহাসিক সূত্র ধরে হয়েছে, সেটা অবশ্যই প্রশ্নসাপেক্ষ, তবুও মনসার বাহন সর্পনাগ এবং লক্ষ্মী একটি বাহন হস্তীনাগ— এই দুই নাগের মধ্যে নামবাচক সাদৃশ্য আসলে মনসার একটি বাহনরূপে হাতীকেও সাব্যস্ত করে বলেই গবেষকরা অভিমতপ্রকাশ করে থাকেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনীতেও এই একই ধরণের জিনিস দেখা যায়। যেমন— দেবসেনার সঙ্গে বৈবাহিক সূত্র ধরে কার্তিক ‘দেবসেনাপতি’ নাম পরিচিত হলেও, পরবর্তীসময়ে এই শব্দটির দ্বারা একথাই প্রতিপন্ন করা হয়েছিল যে, তিনি আদতে দেবকুলের সৈন্যবাহিনীর অধিপতি। যাই হোক— সাপ, রাজহাঁস এবং হাতী— মনসার এই বেশি বা কম প্রচলিত তিনটি বাহনই সুদূর অতীতে প্রচলিত থাকা পশুপুজার সুপ্রাচীন সূত্র ধরেই পরবর্তী সময়ে তাঁর বাহন মূর্তিতে যে উপস্থিত হয়েছিল, সেবিষয়ে গবেষকদের কোন সন্দেহ নেই। একইসাথে সরস্বতীর সঙ্গে মনসার সমীভবন ঘটবার প্রসঙ্গক্রমেই মনসার সূত্রে প্রাচীন ভারতে প্রচলিত থাকা নদী-উপাসনার বিষয়টিকেও এখানে বিচার করা যেতে পারে। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, গঙ্গা উত্তরাপথের পবিত্র নদীরূপে সর্বজনীন স্বীকৃতি পাওয়ার আগে সরস্বতী নদীই সেই সম্মানের ভাগী ছিল। পরে যখন গঙ্গাকে পবিত্রতার আধার ও বিষহারিণী বলে গণ্য করা হয়েছিল, তখন সরস্বতীর উত্তরাধিকারও তাতে বর্তেছিল এবং বাংলায় গঙ্গার ব্যাপকতোয়া শাখাটি পদ্মা নামেও খ্যাতিলাভ করেছিল। বিশেষতঃ নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গে মনসাতন্ত্রের ব্যাপক প্রসারের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে এই নামকরণের বিশেষ তাৎপর্যটি অনুধাবন করা কঠিন নয়। বর্তমান বাংলায় প্রচলিত থাকা মনসা-কাল্টের মধ্যে প্রাচীনতর নদী-উপাসনার ধারাটি এভাবেই সুপ্রচ্ছন্নরূপে বহমান রয়েছে বলে দেখা যায়। এছাড়া একজন মাতৃকাদেবীরূপেও মনসা যে পরিগণ্যা, সেকথা আলাদাভাবে বুঝিয়ে বলবার কোন প্রয়োজন নেই। ঘট-প্রতীকে তাঁর পূজার বিধিও বর্তমানে সর্বজনবিদিত। স্বভাবতঃই এক্ষেত্রে তাঁকে প্রাচীন ভারতীয় উর্বরতা-কেন্দ্রিক ধর্মধারার সঙ্গেই সংশ্লিষ্টারূপেও গ্রহণ করতে হয়। তবে মনসার ক্ষেত্রে ‘ফার্টিলিটি কাল্ট’ কিন্তু শস্য নয়, বরং শুধুমাত্র প্রজননের সঙ্গেই বিজড়িত বলেই দেখা যায়। সাপের অধিদেবী হিসেবে তাঁর পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক বলেও মনে হয়। অন্যান্য মাতৃকাদেবীরা, যেমন— চণ্ডী, ঘটে পূজিতা হন বটে, কিন্তু তাঁদের সাথে মনসার ঘটের পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। অন্য মাতৃদেবীরা যেখানে শুধু ঘটরূপেই অর্চিতা হন, মনসা সেখানে কিন্তু ঘটের গায়ে অঙ্কিতা গর্ভবতী নারীর মূর্তিতে বিরাজ করেন।
গবেষকদের মতে— এই সংযোজন সম্ভবতঃ পৌরাণিক মনসা তথা জবৎকারু ঋষির স্ত্রী, যিনি আবার ঋষি কশ্যপের কন্যা, বাসুকীর ভগিনী এবং আস্তিকের জননী ছিলেন— তাঁর সঙ্গে লৌকিক মনসার একীকরণ হওয়ার ফলশ্রুতিতেই সৃষ্টি হয়েছে। পৌরাণিক কাহিনী থেকে জানা যায় যে, মনসার স্বামী জরৎকারু তাঁকে পরিত্যাগ করতে উদ্যত হলে, দেবতারা স্ত্রীর গর্ভসঞ্চার না করে তাঁকে ত্যাগ করা পাপ বললে তিনি অতঃপর নিজের স্ত্রীকে গর্ভবর্তী করে তারপরে পরিত্যাগ করেছিলেন। খুব সম্ভবতঃ এই কারণেই ঘটে মনসার গর্ভবতী মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গতঃ একথাও উল্লেখ্য যে, অন্যান্য প্রাচীন মাতৃদেবীরা যেখানে অনেক বেশি ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট’ প্রতীক বা ঘটরূপ, মনসাব প্রতীক-ধর্ম কিন্তু সেখানে অনেক বেশি বাস্তব বা ‘রিয়াল’।
মনসা পূজায় প্রচ্ছন্ন-যৌন প্রতীক উপাসনার ধারাও সংযুক্ত রয়েছে বলে দেখা যায়। লক্ষ্য করে দেখা যায় যে, বিশ্বজনীনভাবেই সাপের সঙ্গে প্রজননের একটা সংস্কার অতীত থেকেই সংবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। সাপের স্বপ্ন দেখলে সন্তান-সম্ভাবনা ঘটে, দুটি সাপের ‘শঙ্খ লাগা’ দেখলে শুভ কিছু ঘটে, সাপ পুরুষত্বসূচক প্রত্যঙ্গের প্রতীক, নির্বিষ সর্প এবং পুরুষত্বহীন পুরুষ পরস্পরের উপমা, খোলস ছেড়ে সাপের বেরিয়ে আসা যৌনসক্রিয়তার রূপক— যার মাধ্যমে নতুন দেহ তথা প্রাণের আবির্ভাব ঘটে— ইত্যাদি সংস্কার আসলে সুদূর অতীত থেকেই বিশ্বজনীন। সাপই যে মানুষকে যৌনজ্ঞান দিয়েছে, এই কাহিনী কিন্তু শুধুমাত্র আদম ও ইভের গল্পে নয়, আরো নানাভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, জাতি ও সংস্কৃতিতে প্রচলিত থাকা লোককাহিনীতেও পাওয়া যায়। সুতরাং, সর্প তথা সর্পদেবীর পূজার মধ্যে আসলে শিশ্ন-প্রতীক উপাসনার ধারাটিই যে অবলীন হয়ে রয়েছে, সেবিষয়ে কিন্তু গবেষকদের কোন সন্দেহ নেই। এই প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে, সন্তানসম্ভবা নারী-রূপে ঘট মূর্তিতেই শুধু মনসার পুজো হয় না, শোলার তৈরি একটি বিশেষ আকৃতির বস্তুর ওপরে মনসা মূর্তি এঁকে বা খোদাই করে যে পুজো করা হয়, সেটার লৌকিক নাম হল— ‘করণ্ডী’, শুদ্ধ বাংলায় এর অর্থ হল— যোনি। অন্যদিকে মনোবিজ্ঞানে পুষ্পকেও কিন্তু ঐ একই প্রত্যঙ্গের প্রতীকরূপে ধরা হয়ে থাকে। সুতরাং মনসার— ‘পদ্মা’ এবং ‘কেয়া’ —এই নাম দুটির তাৎপর্য বোঝা বিশেষ কঠিন কিছু নয়। পদ্মের ওপরে শিবের রাগমোচন হওয়ার ফলে মনসার জন্ম হওয়া, কিংবা কোচনী/ডোমনীর ছদ্মবেশে কেয়াবনে দুর্গার ঘুরে বেড়ানোর গল্পগুলি আসলে এই ধরণের আদিমকালাগত প্রতীক-সংস্কারের উপরে পরিশীলনের চকচকে পালিশ চড়ানো ছাড়া অন্য কিছুই নয়। প্রাচীন তন্ত্রশাস্ত্রে স্ত্রী-প্রত্যঙ্গকে সর্বদাই ‘পুষ্প’ বলে অভিধা দেওয়া হয়েছে বলে দেখা যায়; এছাড়া তন্ত্রশাস্ত্রে অষ্টদল পদ্ম, শতদল পদ্ম এবং সহস্রদল পদ্মের আসল ব্যঞ্জনা যে কি— সেকথা তন্ত্রশাস্ত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞ মানুষমাত্রেই জ্ঞাত রয়েছেন। এছাড়াও উল্লেখ্য যে, কামরূপী উপভাষায় এবং অসমীয়া ভাষায় কেতকা বা কেতি শব্দের অর্থগত ব্যঞ্জনাও কিন্তু একই। বেলগাছকে উপলক্ষ্য করে শিবের কামনা উদ্দীপিত হওয়ার তাৎপর্য বৃক্ষোপাসনার সঙ্গে যেমন সংযুক্ত রয়েছে, ঠিক তেমনই শিশ্ন প্রতীকের একটা ব্যাপারও সেটার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। বিশেষতঃ বেলগাছ আর কলাগাছ তো অত্যন্ত সহজবোধ্য কারণেই হিন্দু-সংস্কারে নারীবৃক্ষরূপে কল্পিত হয়। ঠিক তেমনি আবার মনসাসিজের গাছও শিশ্ন প্রতিভূ— বিশেষতঃ, ফণা তোলা বিষধর সাপের সঙ্গে সেটার চেহারার সাদৃশ্যটা সচেতনভাবেই খেয়াল করা যায়।
এখন প্রশ্ন হল যে, মনসাকে টোটেম বা কুলপ্রতীকী বলে কি আদৌ গণ্য করা যায়? গবেষকদের মতে, মনসার প্রসঙ্গে হাঁস এবং হাতির ব্যাপার দুটি অন্যভাবে এলেও, যেখানে মূলতঃ সাপরূপেই এই দেবীর অভিপ্রকাশ ঘটেছে, সেখানে টোটেম জাতীয় একটা ভাবনার আভাস বশ্যই রয়েছে। মনসার জন্ম নিয়ে অন্য যে পৌরাণিক কাহিনীটি প্রচলিত রয়েছে, সেটা থেকে জানা যায় যে— ছদ্মবেশিনী পার্বতীকে দেখে পদ্মবনে শিবের রাগমোচন ঘটলে চ্যাং মাছ সেটিকে গলাধঃকরণ করে সেটার তেজ সহ্য করতে না করতে পেরে উগরে দিয়েছিল, এবং এরপরে সেই বীর্যপুঞ্জ পাতালপুরীতে পৌঁছে মনসারূপে নিজের মানবীয় কলেবর ধারণ করেছিল। এই কাহিনী অনুসারে চ্যাং মাছের টোটেমের ব্যাপারটাও এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট থাকা সম্ভব বলে মনে হয়। টোটেমতত্ত্বের বিশেষজ্ঞরা শুধু পশু নয়, ফল-ফুল ইত্যদিকেও প্রাচীন কুল বা জাতির প্রতীকচিহ্নের ভাবনার সঙ্গে যুক্ত করেছেন বলে দেখা যায়। সুতরাং এই পরিপ্রেক্ষিতে পদ্ম, কেয়া ইত্যাদি ফুল এবং বেল ফলও বিচার্য। গবেষকদের মতে— সাপই খুব সম্ভবতঃ পৌরাণিক কাহিনীর নাগজাতির টোটেম ছিল। হরপ্পার শীলমোহর থেকে একথার ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় যে, আর্যভাষী জাতি ভারতের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করবার আগেই যেসব প্রত্ন-অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়রা এখানে বাস করতেন, তাঁদের মধ্যে সাপের পূজা বিধিমতেই প্রচলিত ছিল। এই টোটেমের বিষয়টি আরও একভাবে বাংলায় প্রচলিত থাকা মনসা ব্রতের গল্পের ভিতরেও দেখতে পাওয়া যায়। সেই কাহিনী অনুসারে— সাপেরা এক বেণে-বউয়ের মাসতুতো ভাইরূপে ও স্বয়ং মনসাদেবী তাঁর মাসীরূপে গণ্য হয়েছিলেন, এবং তাঁর আশীর্বাদে সেই বেণে-বউয়ের শ্বশুরকুলের বিত্ত উপচে পড়েছিল। এই ব্রতকাহিনীতে লক্ষ্য করবার বিষয় হল— প্রথমতঃ, মনসা এখানে ধনদা দেবী, অর্থাৎ— এখানে তিনি লক্ষ্মীর গুণঋদ্ধা; এবং দ্বিতীয়তঃ, তিনি মানবকন্যার সঙ্গে আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধা। কাহিনী অনুসারে নাগেরা যেহেতু মাতৃকুল সম্পর্কে তাঁর ভাই, সুতবাং টোটেম ভাবনাটি এখানে সুস্পষ্টভাবেই দেখতে পাওয়া যায়। এই ব্রতকথাটির মধ্যে সমাজবিজ্ঞানগত অন্য কোনো তাৎপর্য না থাকলেও মনসাকে নিয়ে প্রচলিত থাকা মঙ্গল কাহিনীটির অন্তর্লীন সমাজতত্ত্বের গুরুত্ব কিন্তু অবশ্যই রয়েছে।
প্রথমতঃ, সেই কাহিনীতে মানুষ দেবতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল;
দ্বিতীয়তঃ, মানুষ দেবকুলের এক্তিয়ার থেকে মহাজ্ঞান আয়ত্তগত করে নিয়েছিল;
তৃতীয়তঃ, বেহুলার মাধ্যমে সর্বপ্রথম নারীর বিদ্রোহিনী চিত্রটি অঙ্কিত হয়েছিল;
চতুর্থতঃ, তাঁর অসহায় নৃত্যের মাধ্যমে তৎকালীন শ্রেণী বিভেদী সমাজের ভযঙ্কর শোষক রূপটি অনাবৃত হয়ে উঠেছিল।
গবেষকদের মতে— কাহিনীটির এই সব ক’টি দিক বিচার করলে এটির সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব যে কতটা, সেকথা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারা যায়।
পৃথিবীর সর্বদেশে, সর্বকালে, সমস্ত সংস্কৃতিতে দেখা যায় যে— আদিমকাল থেকেই প্রকৃতির অন্তর্লীন অলক্ষ্য দৈবীশক্তির কল্পনা করে মানুষ সেসবের কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণই করে গিয়েছে এবং সেসবকে যেভাবেই হোক পরিতুষ্ট করবার চেষ্টা করেছে। বুদ্ধিতে বা কৌশলে দেবভোগ্য কিছু, যেমন— আগুন, দেবতাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া বা লুকিয়ে নিয়ে আসবার মধ্যে আসলে প্রকৃতির ওপরে মানুষের অধিকার বিস্তৃতিব ক্রমান্বিত পরিচয়ই অবশ্যই ফুটে ওঠে। কিন্তু দৈবশক্তিকে অমোঘ এবং অলঙ্ঘ্য বা অনিবার্য বলে না মনে করে, সেটার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যে ছবি— মনসা-কাহিনীর চন্দ্রধর সওদাগর চরিত্রের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়, সেটা নিঃসন্দেহে এই কাহিনীর আদিমকালের উৎসের বিভিন্ন প্রকরণের মধ্যে আপাতদর্শনে অপ্রত্যাশিত বলেই মনে হয়। অনেকের মতে, তৎকালীন সমাজ এবং পরিবারের অনুশাসনের বিরুদ্ধে মৃত্যু-জয়ের সংকল্প নিয়ে বেহুলার কলার মান্দাসে ভেসে বেড়িয়ে পড়াও তাঁর একধরণের বিদ্রোহী মনেরই পরিচয় দেয়। দেবসভার সজ্জনদের লোলুপ দৃষ্টির সামনে অসহায়ভাবে বেহুলার নৃত্যগীত পরিবেশন করাটাও সমাজবিজ্ঞানীদের চোখে একটি বিশেষ তাৎপর্যরূপেই ধরা দেয়। তৎকালীন শ্রেণীনির্ভর সমাজে একজন কুলবধূকে সভানর্তকীরূপে বারাঙ্গনার সমতুল্য পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা দেখা গিয়েছিল, আদিম বা কৌম বা লোকায়ত সমাজে সেসব কিন্তু ছিল না। তাই মঙ্গলকাব্যের মনসা-কাহিনীর মধ্যে একদিকে যেমন শ্রেণীসোপানের ওপরের দিকে থাকা মানুষদের কাছ থেকে— মনসা প্রমুখ দেবতারা, যাঁদের প্রতীক ছিল মহাজ্ঞা তথা মৃত্যুজয়ের রহস্য, —সেই তাঁদের কাছ থেকে পুনর্জীবন অর্জনের রহস্য ছিনিয়ে আনবার দ্বান্দ্বিক চিত্র যেমন পাওয়া যায়, অন্যদিকে তেমনি ওপরতলার দেবতাদের শোষণের শিকার হয়ে নীচের তলার মানবীকে তাঁর স্বামীর জীবনের মূল্যস্বরূপ নিজের সন্মান বিক্রি করতে হচ্ছে— এই ছবিও সমভাবে বিন্যস্ত হয়েছে বলে দেখা যায়। মনসাকে উপলক্ষ্য করে মঙ্গলকাব্যে ইতিহাস-সচেতনতার এই যে সুষ্ঠু অভিপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়, এর মত সামগ্রিক একটি তাৎপর্য ক্ষমতা অন্য কোনো ধরণের দেবতার পুজোপার্বনের সাথে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িয়ে নেই বলেও দেখা যায়।
মনসার ব্রতকথা এবং মনসার মঙ্গলকাব্য— এই দুটির মধ্যে অবশ্যই ভাবগত দিক থেকে প্রথমটি প্রাচীনতর চরিত্রের। গবেষকদের মতে— খুব সম্ভবতঃ, মনসার ব্রতকাহিনীটিই আসলে বঙ্গ সংস্কৃতির ভূমিজাত; অন্যদিকে মঙ্গলকাব্যটি দ্রাবিড়-বলয় থেকে কোনভাবে এসে বহু শতাব্দীর বিবর্তনে এখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছে। এভাবেই মনসাপূজার মধ্যে সেই প্রাচীনতর ঐতিহ্যের আদিমতা ও প্রাচীনতর সংস্কার এখনো টিকে রয়েছে। অন্যদিকে তরুণতর মঙ্গলকাব্যটি সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ হওয়ার ফলে সেটিই বেশি জনপ্রিয় হয়েছে।
বাংলার গ্রামেগঞ্জে প্রায় সর্বত্রই শিব এবং চণ্ডীর কোনো না কোনো রূপকে অবলম্বন করে যেমন কোন থান বা মন্দির রয়েছে, তেমনি গ্রাম বাংলায় মনসার থানও অত্যন্ত সুলভ। এমনকি খোদ কলকাতা শহরেই মনসাতলা নামের পাড়াও অপ্রাপ্য নয়। বিশেষ বিশেষ দিনে মনসার পুজো তো সেসব জায়গায় হয়ই, এছাড়া বাংলার ঘরে-ঘরেও হয়। তাই মনসাকেও বর্তমান সময়ের হিন্দু বাঙালির অন্যতম প্রধান দেবী বলেও গণ্য করতেই হবে। সর্প মূর্তিতে, মনসাসিজ মূর্তিতে, হংসবাহিনী মূর্তিতে, কৈতরী (গর্ভিণী) ঘটে, অষ্টনাগ চালিতে, বিয়াল্লিশনাগ চালিতে, শোলার করণ্ডীতে— ইত্যাদি কোনো না কোনোভাবে তাঁর পুজো সর্বত্রই দুধ-কলা-সন্দেশ-ফুল-চাল দিয়ে যেমন করা হয়ে থাকে, ঠিক তেমনি আবার হাঁস, মুরগী এমনকি শুয়োর পর্যন্ত বলি দিয়েও সেই রক্ত করন্ডীতে ছিটিয়েও করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে যেসব জায়গায় মূর্তিহীন অবস্থায় শুধু একটি ঢিবিকেও মনসার প্রতীক বলে ধরে নিয়ে উপাসনা করা হয়, সেটাকে আদিম ঐতিহ্যেরই ভগ্নাবশেষ রূপে ধরে নেওয়া যেতে পারে। অনেক জায়গায় আবার কোন বাড়িতে যদি মনসার থানার আল্পনার ওপরে কোন বাস্তুসাপ এসে ঘুরে ফিরে যায়, তাহলে সেই থানের ভক্ত-ভক্তারা মনসার বাহনের সেই উপস্থিতিকে নিজেদের পিতৃপুরুষের আবির্ভাব বলেই গণ্য করে থাকেন। গবেষকদের মতে— এক্ষেত্রে পশুকে নিজেদের পূর্বপুরুষরূপে গণ্য করবার টোটেম-ভাবনার সঙ্গে পিতৃপুরুষের আত্মাকে পূজার প্রাগৈতিহাসিক প্রবণতাও সংমিশ্রিত হয়েছে বলে দেখা যায়।
পরিশেষে মনসা-পরবের প্রসঙ্গে অন্য যে কথাটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সেটা হল যে— মনসার গাজন উপলক্ষ্যে আজও মল্লভূম অঞ্চলে যে ঝাঁপান অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে কয়েক গণ্ডা জীবন্ত সাপ নিয়ে খেলা দেখানো হয়ে থাকে। আগেই বলা হয়েছে যে, গবেষকদের মতে— মনসা পূজাকে এক অর্থে মানুষের মৃত্যুজয় করবার সাধনা বলে গণ্য করা যেতে পারে। তাই মনসার ঝাঁপানে জীবন্ত একগাদা সাপের ছোবল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে সেগুলিকে নিয়ে খেলা করবার মধ্যে মানুষের সেই ভয়মুক্তির সাধনাই সিদ্ধিলাভ করেছে বলে দেখা যায়। মললভূমির ঝাঁপান খেলুড়েদের কাছে সাপ নিয়ে এই খেলা তাঁদের পুরুষকার প্রতিষ্ঠার প্রতীক ও দেবতার কোপকে প্রতিহত করবার একটা দ্যোতক। এই অর্থে তাঁরাই কিন্তু বেহুলার আসল প্র-সন্ততি এবং চাঁদের আসল উত্তবপুরুষ। মনসার শ্রাবণী সংক্রান্তির পুজোয় এই ঝাঁপানের খেলা ছাড়া অন্য কোন পরবের উৎসে কিন্তু মানুষের মধ্যে মর্ত্যসীমাচূর্ণী অমর মহিমার সন্ধান পাওয়া যায় না।#