‘আমার পতাকা উড়ছে
পাখিদের স্বাধীনতা ছুঁয়ে।’
এই পতাকা যাঁর উড়ছে আজ তাঁর মহাপ্রয়াণের দিন। একাধারে কবি সাহিত্যিক, প্রচ্ছদশিল্পী, চিত্র পরিচালক, গবেষক প্রভৃতি বিস্ময়কর গুণের অধিকারী সেই ব্যক্তি পূর্ণেন্দুশেখর পত্রী (২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১ – ১৯ মার্চ ১৯৯৭)। পূর্ণেন্দু পত্রী নামে সর্বাধিক পরিচিত; ছদ্মনাম সমুদ্রগুপ্ত। বাংলা সাহিত্যের শতাধিক ধ্রুপদী গ্রন্থের প্রচ্ছদ অঙ্কন করেছিলেন তিনি। তাঁর অঙ্কিত প্রচ্ছদচিত্রগুলি গুণমানে ও স্বকীয়তায় বিশেষ স্বাতন্ত্র্যের দাবি রাখি।
১৯৫১ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একমুঠো রোদ’ প্রকাশিত হয়। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস ‘দাঁড়ের ময়না মানিক’। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল: ‘শব্দের বিছানা’ (১৯৭৫), ‘তুমি এলেসূর্যোদয় হয়’ (১৯৭৬) ‘আমাদের তুমুল হৈ-হল্লা’ (১৯৮০) ও ‘গভীর রাতের ট্রাঙ্ককল’ (১৯৮১), ‘আমিই কচ আমিই দেবযানী’ ইত্যাদি। সাহিত্য গবেষক শিশির কুমার দাশ তাঁর কাব্য সম্পর্কে বলেছিলেন: “ছন্দের কৌশল, প্রতিমা গঠনের স্পষ্টতা এবং কথনভঙ্গির ঘরোয়া চাল তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য।” পূর্ণেন্দু পত্রীর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ‘ভোমরাগুড়ি’, ‘মালতীমঙ্গল’ ইত্যাদি। ‘রূপসী বাংলার দুই কবি’ তাঁর একটি বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ।এই গ্রন্থে জীবনানন্দ দাশ ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে অদ্ভুতভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন। বাংলার জীবন্ত প্রকৃতি একদিকে কবিতা ও কথা সাহিত্যে যেভাবে রূপ পেয়েছে তা দেখিয়েছেন। পূর্ণেন্দু পত্রী কলকাতা সম্বন্ধে প্রায় এক ডজন গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ‘শহর কলকাতার আদি পর্ব’, ‘বঙ্গভঙ্গ’, ‘কি করে কলকাতা হল’, ‘ছড়ায় মোড়া কলকাতা’, ‘কলকাতার রাজকাহিনী’, ‘এক যে ছিল কলকাতা’ ইত্যাদি। ইতিহাস ও তথ্যের সংযোগে বইগুলিতে এক গবেষকেরই দেখা পাওয়া যায়। জীবনের শেষপর্বে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এক বিশাল গবেষণার কাজ শুরু করেছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে ১৯৯৬ সালে তাঁর প্রথম খণ্ড ‘বঙ্কিম যুগ ‘ প্রকাশিত হয়। শিশুসাহিত্যেও তিনি ছিলেন এক জনপ্রিয় লেখক। ছোটোদের জন্য লিখেছেন: ‘আলটুং ফালটুং’, ‘ম্যাকের বাবা খ্যাঁক’, ‘ইল্লীবিল্লী’, ‘দুষ্টুর রামায়ণ’, ‘জুনিয়র ব্যোমকেশ’, ‘জাম্বো দি জিনিয়াস’, প্রভৃতি হাসির বই। ‘আমার ছেলেবেলা’ নামে তাঁর একটি স্মৃতিকথাও রয়েছে। সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের জন্য পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া বিদ্যাসাগর পুরস্কার।
তাঁর কবিতাংশগুলি প্রবাদ বাক্যের মতো চিরন্তন হয়ে আছে। এক একটি মেধাবী অভিজ্ঞতার স্পর্শ অনুভূতির রৌদ্রে তীক্ষ্ণ ঔজ্জ্বল্য পেয়েছে:
১.
‘স্বপ্নেই শুধু দ্বিতীয়বার ফিরে পাওয়া যায় শৈশব।
সব ধুলোবালিমকুচি, সব উড়ে-যাওয়া আঁচল
রঙিন পরকলা আলোচনায় সব মুখচ্ছবি
বৃষ্টি বাদলের ভিজে গন্ধের ভিতরে লুকিয়ে কাউন্সার সুখ।
স্বপ্নেই কেবলবার অগাধ জলের ভিতর থেকে
মুখ তাক ছেলেবেলার লাল শালুক।’
২.
‘সবচেয়ে দুর্ধর্ষতম কোনো বীরত্বও ঘাড়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতির থাপ্পড় পড়ে
সবচেয়ে রক্তপায়ী তলোয়ারও মেঘের মতো
এই সত্যকথা কোনো, কোনো বৃষ্টি, নীল নক্ষত্রের আলো জোরে জোরে জোরে জোরে
জোরেশোরে?’
৩.
‘মানুষ থাকবে না।
কেউ কেউ ধুলো হবে, কেউ কাঁকর ও বালিমকুচির
জোড়াতালি খুলবে।
কেউ ঘাস, অযত্নের অপ্রীতির অমনোযোগের
বংশানুক্রমিক দূর্বাদল।
আঁধারেদীপ কেউ নিরিবিলি একাকী উজ্জ্বল।
সন্ধ্যায় কুমগন্ধ,
কেউ বা সন্ধ্যার শঙ্খনাদ।
চরিত্র বর্ণমালা
কেউ প্রবল সংবাদ।’
৪.
‘কাকে পাপ বলে আমি জানি
কাকে পুণ্যজল জানি
মুকুটের কাঁটা কয়খানি।
অভিজ্ঞতায় বৃদ্ধ, আবেগে বালক,
গোত্রহীন ভেসে দেখতে দেখতে দেখতে নাড়ীর ভিতরে
উলঙ্গ পালক!’
আজ এই প্রয়াণ দিবসে তাঁকে প্রণাম জানাই।#