নজরুলকে কি উগ্রবাদী জিহাদি বয়ানের কবি বানানোর চেষ্টা চলছে?
নাকি উগ্রবাদী ও সংস্কৃতিবিরোধী মতাদর্শকে নজরুলের সমমর্যাদায় দাঁড় করানো হচ্ছে?
কাজী নজরুল ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম, দল বা মতাদর্শের কবি নন; তিনি মানবমুক্তির কবি। সাম্য, অসাম্প্রদায়িকতা, বিদ্রোহ ও মানবিক মর্যাদার প্রশ্নে তিনি আপসহীন। ধর্মের নামে ভণ্ডামি, কুসংস্কার ও গোড়ামির বিরুদ্ধে তার কলম ছিল বিদ্রোহের অস্ত্র। হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন ঘুচিয়ে “গালাগালিকে গলাগলিতে” পরিণত করাই ছিল তার আজীবন সাধনা।
ঢাকায় সেই নজরুলের কবরের পাশেই ইনকিলাব মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা শরীফ ওসমান হাদীকে সমাহিত করা হয়েছে, যার বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চেতনা, সংগীত-নৃত্য ও শিল্পকলার বিরোধিতার প্রতীক হিসেবে সমালোচিত; যার নাম এবার জড়িয়ে গেছে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত এক উগ্র ধর্মীয় বয়ানের সঙ্গে। এই বিষয়টিকে যদি নিছক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়, তবে তা ইতিহাস ও চেতনার প্রতি দায়িত্ব এড়ানোর শামিল।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি গুরুতর সাংঘর্ষিক দিক। ওসমান হাদী প্রকাশ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরোধিতা করেছেন এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের প্রতি অশ্রাব্য, অশালীন ও বিদ্বেষপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তার উগ্রবাদী আদর্শে অন্যদের উৎসাহিত করেছেন। অথচ কাজী নজরুল ইসলাম জন্মসূত্রে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়ায় জন্মগ্রহণকারী কবি, যার জীবনের বৃহৎ অংশ কেটেছে ভারতের মাটিতে এবং যাকে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সপরিবারে বাংলাদেশে এনে জাতীয় কবির স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এই ঐতিহাসিক বাস্তবতার আলোকে জানতে চাই, ভারতবিরোধী বিদ্বেষ ও অশালীনতার রাজনীতি যার প্রকাশ্য পরিচয়, তাকে কোন নৈতিক ও ঐতিহাসিক যুক্তিতে অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদের কবি কাজী নজরুল ইসলামের পাশে সমাহিত করা হলো?

বিষয়টি আরও গুরুতর হয়ে ওঠে যখন সংবাদপত্রে পরিবারের বরাত দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে, ওসমান হাদীর নিজের ইচ্ছা ছিল ঝালকাঠির নলছিটিতে পৈতৃক বাড়িতে তার বাবার কবরের পাশেই সমাহিত হওয়ার। সেই ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে, এমনকি বলা যায় অবজ্ঞা করে, তাকে কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে যায়: কারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং কী উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত ইচ্ছা, পারিবারিক সম্মান ও ঐতিহাসিক সামঞ্জস্য— সবকিছুকে উপেক্ষা করা হয়েছে? এটি কি কেবল একটি কবরের স্থান নির্ধারণ, নাকি প্রতীকি রাজনীতির অংশ?
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্নটি আর এড়িয়ে যাওয়ার আর সুযোগ নেই; রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি কাজী নজরুল ইসলামকে উগ্রবাদী জিহাদি বয়ানের কবি হিসেবে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে চাইছে? নাকি উগ্রবাদী, সংস্কৃতিবিরোধী ও শিল্পবিমুখ মতাদর্শকে নজরুলের সমমর্যাদায় দাঁড় করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে একটি বিপজ্জনক ঐতিহাসিক সমতা তৈরি করা হচ্ছে?
নজরুল যে সংস্কৃতিকে আজীবন লালন করেছেন, সেই সংগীত, নৃত্য, নাট্য ও মুক্তবুদ্ধির চর্চাই ছিল তার বিদ্রোহের ভাষা। যে মতাদর্শ এসবকে অপরাধ হিসেবে দেখে বা দমনের চেষ্টা করে, তার প্রতিনিধিত্বকারী কাউকে নজরুলের কবরের পাশে স্থান দেওয়া হলে ইতিহাস বিভ্রান্ত হয়, প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয়। এটি কেবল ব্যক্তি-পূজার প্রশ্ন নয়; এটি জাতীয় চেতনার প্রশ্ন।
কাজী নজরুল ইসলাম কোনো রাজনৈতিক ঢাল নন, কোনো মতাদর্শিক সনদও নন। তাকে ব্যবহার করে উগ্রতা ধুয়ে মুছে ফেলার চেষ্টা হলে তা হবে কবির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা এবং জাতির সঙ্গে প্রতারণা। নজরুলের নামের পাশে এমন কোনো প্রতীক বসানো যাবে না, যা তার আদর্শকে খণ্ডিত করে, বিকৃত করে।
কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে এই অপরাজনীতি বন্ধ হোক। মানবতা, সাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতার কবি নজরুলকে মুক্ত রাখুন ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে।#




