হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী কোজাগরি শব্দটি এসেছে ‘কো জাগর্তি’ থেকে। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘কে জেগে আছো’। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, এই পূর্ণিমার রাতে স্বয়ং দেবী লক্ষ্মী মর্ত্যলোকে নেমে আসেন। তিনি গোটা চরাচর ঘুরে ঘুরে দেখেন, তাঁকে আরাধনার রাতে সারারাত কেউ জেগে আছে কি না। অনেকে এও বলে থাকেন, ওই দিন রাতে যে ব্যক্তি জেগে থাকেন এবং পাশা খেলেন তাঁকে লক্ষ্মীদেবী নাকি ধনসম্পদ উজাড় করে দেন। আর সেটা পাওয়ার জন্যই গৃহস্থদের ভক্তিপূর্ণ চিত্তে লক্ষ্মীপুজো করার পরে প্রথমে শিশু, বালক এবং বৃদ্ধদের পেট পুরে খাওয়াতে হয়। তাই আজও ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মীকে পাওয়ার জন্য গৃহস্থেরা সারারাত ঘিয়ের প্রদীপ জালিয়ে রাখেন। যাতে সেই আলো দেখে পথ চিনে গৃহস্থের বাড়িতে মা লক্ষ্মী আসতে পারেন। এই পুজোর দিন লক্ষ্মীকে আহ্বান করার জন্য বাংলার প্রতিটি ঘরে মুখরিত হয়ে ওঠে শঙ্খধ্বনি।
বাংলায় শারদীয়া দুর্গোৎসবের পরে আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমা তিথিতে ধন, যশ, খ্যাতি, সুস্বাস্থ্য, সৌভাগ্য আর সমৃদ্ধির প্রতীক লক্ষ্মীদেবীর পুজো মূলত হয় প্রতিমা, সরা, নবপত্রিকা কিংবা থোড়ের তৈরি নৌকোয়। লক্ষ্মীর সরাও হয় নানা রকমের। যেমন— ঢাকাই সরা, ফরিদপুরি সরা, সুরেশ্বরী সরা এবং শান্তিপুরী সরা। নদিয়া জেলার তাহেরপুর, নবদ্বীপ এবং উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন অঞ্চলে লক্ষ্মীর সরা আঁকা হয়। তবে অঞ্চল ভেদে লক্ষ্মীর সরায় তিন, পাঁচ, সাতটি মূর্তি আঁকা হয়। এতে থাকে লক্ষ্মী, জয়া, বিজয়া-সহ রাধাকৃষ্ণ, সপরিবার দুর্গা ইত্যাদি।
ফরিদপুরের সরায় দেবদেবীরা সাধারণত একটি চৌখুপির মধ্যে থাকেন। আবার সুরেশ্বরী সরায় ওপরের দিকে মহিষাসুরমর্দিনী আঁকা হয় আর নীচের দিকে থাকেন পেঁচা-সহ লক্ষ্মী। এই কোজাগরি লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গে যেমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে আলপনা, তেমনই জড়িয়ে আছে কৃষি সমাজও। অনেকেই সারাবছর ধরে প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীদেবীর আরাধনা করে থাকেন। এ ছাড়া শস্য সম্পদের দেবী বলে ভাদ্র সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি, চৈত্র সংক্রান্তি এবং আশ্বিন পূর্ণিমা ও দীপাবলিতেও লক্ষ্মীর পুজো করা হয়। খারিফ শস্য ও রবি শস্য যে সময় হয়, ঠিক সেই সময় বাঙালি মেতে ওঠে লক্ষ্মীর পুজোয়। তবে পুজোর উপাচার পরিবর্তন হয় মাস ভেদে। লক্ষ্মীপুজো করার জন্য লাগে—
১. ধানের শিস। ধানের শিস ছাড়া কোনও ভাবেই লক্ষ্মীপুজো সম্ভব নয়।
২. ধান ছাড়াও টাকা, স্বর্ণমুদ্রা, পান, কড়ি, হলুদ, পাঁচ কড়াই, ঘট, এক সরা, আতপ চাল, দই, মধু, গব্যঘৃত, চিনি, চন্দ্রমালা এবং পূর্ণপাত্র ও হরিতকির প্রয়োজন হয়।
৩. প্রয়োজন হয় কলার পেটো। কলার পেটো দিয়ে তৈরি নৌকোকে সপ্ততরী বলা হয়। এই তরীকে বাণিজ্যের নৌকো হিসাবে গণ্য করা হয়।
৪. লক্ষ্মীপুজোর ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণরা দেবীকে খিচুড়ি ভোগ দেন আর অ-ব্রাহ্মণরা লুচি এবং সুজিভোগ দেন।
৫. লক্ষ্মীপুজোর আরও একটি বিশেষ উপাদান নাড়ু। নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, গুড়ের নাড়ু, পরবর্তী কালে খইয়ের নাড়ু, মুড়কির নাড়ু, চিড়ের নাড়ু অর্পণ করা হয় দেবীর উদ্দেশে। রসালো ফল লাগে পাঁচ রকমের।
৬. লাগে ধূপধানি, পঞ্চপ্রদীপ, প্রদীপ, কর্পূর, ধূপকাঠি, ধুনুচি, বেলপাতা, দুর্বা, ১টি ঘটাচ্ছাদন গামছা, ১টি কুণ্ডহাঁড়ি, ১টি তেকাঠি, ১টি দর্পণ, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চগব্য, পঞ্চরত্ন, ১টি স্ব-শিস ডাব, ৪টি তির, ফুল, দুর্বা ইত্যাদি লাগে।
৭. এ ছাড়াও দরকার হয় লক্ষ্মীকে তুষ্ট করতে লক্ষ্মীর শাড়ি, নারায়ণের ধুতি, পেচক পুজোর ধুতি, লোহা, শঙ্খ, সিঁদুর-চুবড়ি, বালি, কাঠ, খোড়কে, ঘি এক পোয়া, হোমের জন্য ২৮টি বেলপাতা।
শুধু জিনিসপত্র হলেই হবে না। লক্ষ্মী হলেন আদিশক্তির সেই রূপ, যিনি বিশ্বকে বস্তুগত সুখ প্রদান করেন। শাস্ত্র মতে, সমৃদ্ধি, অর্থ, দ্রব্য রত্ন এবং ধাতুর অধিপতি এই দেবীকে বলা হয় লক্ষ্মী। শাস্ত্রজ্ঞরা বলেন, লক্ষ্মীলাভের কিছু উপায় আছে, যা করলে তিনি প্রসন্ন হন এবং তাঁর কৃপা বর্ষণ করেন। আর সেগুলো হল— পুজোর সময় উত্তর দিকে মুখ করে হলুদ আসনে বসতে হয়। ন’টি তেলের বাতি জ্বালাতে হয়। তার পর একটি থানায় স্বস্তিক তৈরি করে পুজো করতে হয়। এর ফলে আর্থিক দিক থেকে অলৌকিক ফল পাওয়া যায়।
এ ছাড়াও অর্থ সংকট থেকে মুক্তি পেতে, দেবীর পুজো করুন এবং প্রতিদিন পুজোর সময় দেবীর মূর্তির ওপরে লবঙ্গ অর্পণ করুন। লক্ষ্মীপুজোর দিন অবশ্যই লক্ষ্মী পাঁচালি পড়ুন এবং ১০৮বার গায়ত্রী মন্ত্র জপ করুন। লক্ষ্মীপুজোর দিন বাড়িতে দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ স্থাপন করলে খুবই শুভ ফল লাভ করা যায়। সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধির দেবী শ্রীলক্ষ্মী। শ্রীবিষ্ণুর স্ত্রী। তাঁকে অচঞ্চল রাখতে কোজাগরি পূর্ণিমা তিথিতে পটের সামনে পাঁচটি কড়ি রেখে পুজো করে, সেই কড়ি সযত্নে আলমারিতে তুলে রাখলেও দারুণ ফল পাওয়া যায়। কেউ কেউ ঘটে, কেউ কেউ পটে, আবার কেউ কেউ মূর্তি এনেও পুজো করেন। তবে পুজো যে ভাবেই করুন না কেন, লক্ষ্মীপুজোর দিন এই নিয়মগুলো মেনে চলেন। যেমন:
১. আমিষ পদ এড়িয়ে চলেন।
২. মঙ্গলঘট পরিষ্কার জল দিয়ে পূর্ণ করেন।
৩. ঘটের উপর নারকেল রাখেন।
৪. ঘট লাল কাপড়ে মুড়ে, লাল সুতো দিয়ে বেঁধে রাখেন।
৫.সমৃদ্ধির প্রতীক স্বস্তিক চিহ্ন ঘটে আঁকেন।
৬. ঘটের জলের মধ্যে চাল ও মুদ্রা রাখেন।
৭. মা লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গে একই সঙ্গে নারায়ণও পুজো করেন।
এর পাশাপাশি এই দিন লক্ষ্মী হিসাবে কল্পনা করে ছোট কোনও মেয়েকে তাঁর পছন্দের পাঁচ রকম জিনিস উপহার দেন কেউ কেউ। সম্ভব হলে বড়দেরকেও উপহার দেন। কারণ অনেকে বিশ্বাস করেন লক্ষ্মীপুজোয় দান-ধ্যান করলে পুণ্যার্জন হয় এবং এই দিন গঙ্গাস্নানেও পুণ্যলাভ হয়। বাড়ির সদর দরজায় মায়ের পদচিহ্ন আঁকাটাকেও শুভ মনে করা হয়।
এর পাশাপাশি যখন রাতের আকাশে উঁকি দেবে পূর্ণিমার চাঁদ, ঘরে ঘরে তখন বাজাবে শাঁখ এবং সাধ্যমতো করবেন সমৃদ্ধির দেবীর পুজো। ‘কঃ জাগর’ শুনতে রাত জাগবেন কেউ কেউ। ভক্তদের বিশ্বাস, পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় যখন উদ্ভাসিত চরাচর, তখনই মা লক্ষ্মী পা রাখবেন মর্ত্যের মাটিতে। বিত্তশালী হবে ধরা!
এই পুজোয় কিন্তু পুরুষের চেয়ে মহিলাদেরই অগ্রাধিকার বেশি। সন্ধ্যায় পুজো করে সারারাত জেগে থাকাই কোজাগরি-রীতি। তবে কোজাগরি লক্ষ্মীদেবীকে তুষ্ট করতে হলে ভক্তদের অবশ্যই উচ্চারণ করেন কিছু মন্ত্র, আর সেগুলো হল—
লক্ষ্মীপুজো প্রণাম মন্ত্র—
ওঁ বিশ্বরূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে।
সর্বতঃ পাহি মাং দেবী মহালক্ষ্মী…
লক্ষ্মীপুজো স্তব—
ওঁ ত্রৈলোক্য পূজিতে দেবী কমলে বিষ্ণুবল্লভে।
যথা ত্বং সুস্থিরা কৃষ্ণে তথা ভব ময়ি স্থিরা।।
ঈশ্বরী কমলা লক্ষ্মীশ্চলা ভূতি হরিপ্রিয়া।
পদ্মা-পদ্মালয়া সম্পদপ্রদা শ্রীঃ পদ্মাধারিণী। দ্বাদশৈতানি নামানি লক্ষ্মীং সম্পূজ্য যঃ পঠে।
স্থিরা লক্ষ্মীভবেস্তস্য পুত্রদারদিভিঃ সহ।।
অন্য দিকে, এই কোজাগরি লক্ষ্মীপুজোর রাতেই আগেকার দিনে গ্রামবাংলায় গৃহস্থ বাড়িতে চুরি করা নাকি চোরেদের কাছে ছিল বিশেষ সম্মানের। এ দিন পূর্ণিমায় আলোয় যেহেতু ভেসে যায় চারদিক, সেই জ্যোৎসনার আলোয় জেগে থাকা গৃহস্থের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চুরি করতে পারলে সেই চোরের সম্মান নাকি বেড়ে যেত অনেকটাই। তাই গ্রামবাংলার পুরোনো উপকথা অনুসারে কোজাগরি লক্ষ্মীপুজো শুধু গৃহস্থ নয়, চোরেদের কাছেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন।♦