১৯৭১ বনাম ২০২৪: ইতিহাস নিয়ে রাজনীতি এবং আসিফ নজরুলের দায়!
সম্প্রতি একটি আলোচনা ও তথ্য প্রদর্শনীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এক বক্তব্যে বলেছেন- “শেখ হাসিনা ও তার দোসররা যে অপরাধ বাংলাদেশে করেছে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও মনে হয় এত জঘন্য অপরাধ করে নাই।”
একজন আইনের অধ্যাপক এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির মুখে এমন বক্তব্য শুধু অমার্জনীয়ই নয়, বরং এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র ও ঐতিহাসিক সত্যের প্রতি সরাসরি অবমাননার শামিল। এই মন্তব্য যদি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না-ও হয়, তবুও তিনি যে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, রাজনৈতিক পক্ষপাত এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যে এক বিপজ্জনক সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন, তা অস্বীকারের উপায় নেই।
তথ্য ও প্রমাণ কোথায়?
আইনের শিক্ষক হয়ে আসিফ নজরুল বলছেন, “মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে”, “আহতকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে”, অথচ এসব কথার পক্ষে কোনো মামলা, কোনো স্বজনের অভিযোগ, কোনো ভিডিও ফুটেজ, এমনকি একটিও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন তিনি উপস্থাপন করতে পারেননি।
যদি ঘটনাগুলো সত্যি হয়, তাহলে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক ও আইন উপদেষ্টা হিসেবে কেন তিনি নিজেই আদালতে যাননি? কেন বারবার কেবল মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে নাটকীয় ভাষায় বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক ডায়লগ দিচ্ছেন?
‘শহীদ’ দাবির পর ফিরে আসা কর্মীরা?
২০২৪ সালের কথিত ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’–এর সময় যাদেরকে ‘শহীদ’ বলা হয়েছিল, পরে দেখা গেছে তাদের অনেকে জীবিত আছেন। কেউ কেউ আবার টিভিতে এসে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। এক ভিডিও বার্তায় এমনও শোনা গেছে, বিএনপির কর্মী ডার্বি নাসির নাকি ‘শহীদদের’ সঙ্গে কথাও বলেছেন। এসব দেখে হাসি চেপে রাখা কঠিন, অথচ এই নাটক তখন জনগণের সামনে গুজব হিসেবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
প্রশ্ন জাগে:
১. এই ‘শহীদ তালিকা’ কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছিল?
২. জনগণকে বিভ্রান্ত করে আন্দোলনের নামে সহিংসতা উসকে দেওয়া হয়নি তো?
৩. যারা এই গুজব ছড়িয়েছেন, তারা কি কোনো জবাবদিহির আওতায় আসবে?
অস্ত্র লুট ও সহিংসতা: দায় কার?
৫ আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন থানায় হামলা, অস্ত্র লুট ও সহিংসতার খবর সামনে আসে। পুলিশ সদর দপ্তরের ৪ সেপ্টেম্বরের রিপোর্ট অনুযায়ী:
রাইফেল লুট হয়েছে ১,১৪৭টি, পিস্তল ১,৫৫৬টি, গুলি উদ্ধার হয়েছে ২,৮৬,০৮২ রাউন্ড, এখনও বেহাত আছে ৩,২০,৬৬০ রাউন্ড গুলি ও ২,০৬৬টি আগ্নেয়াস্ত্র
প্রশ্ন হলো:
এত বিপুল অস্ত্র কারা লুট করলো?
সেই অস্ত্র এখন কাদের হাতে?
গত ১০ মাস ধরে চলা এই সশস্ত্র সন্ত্রাসই কি “গণআন্দোলন” নাকি অজানা ষড়যন্ত্র?
২৬ লাখ ভারতীয়: আসিফ নজরুলের গুজবের হ্যান্ডেল?
এর আগেও আসিফ নজরুল দাবি করেছিলেন, “২৬ লাখ ভারতীয় বাংলাদেশে চাকরি করছে।” কিন্তু কোথাও এর সত্যতা নেই। না কোনো সরকারী রিপোর্টে, না কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যে।
এটা ছিল আরও একটি পরিকল্পিত গুজব। উদ্দেশ্য, জাতীয়তাবাদের মুখোশ পরে জনমনে ঘৃণা উস্কে দেওয়া।
১৯৭১ বনাম ২০২৪: তুলনার নৈতিক অধিকার কোথায়?
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাষ্ট্রীয় মদদে গণহত্যা চালিয়েছে। ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ, দুই লক্ষাধিক নারী ধর্ষণের শিকার, হাজারো গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া- এই ভয়াবহতা ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম অধ্যায়গুলোর একটি।
মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের বর্বর ঘটনার সাথে ২০২৪ সালের ঘটনাবলীর তুলনা টেনে আসিফ নজরুল আসলে কিসের স্বাক্ষর রাখলেন? ইতিহাসকে বিকৃত করে রাজনৈতিক বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা- এটাই কি তার আইনি নৈতিকতা?
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে কিভাবে একজন ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধকে লঘু করে এমন তুলনা টানতে পারেন?
নির্বাচনের আগে ‘গণহত্যা কাহিনি’: আতঙ্ক না আগাম প্রোপাগান্ডা?
আসিফ নজরুল বলেছেন, “বিচার হবে, এমনভাবে হবে যে ভবিষ্যতের সরকারও তা মুছে ফেলতে পারবে না।”
যদি বিচারব্যবস্থার প্রতি এতই আস্থা থাকে, তাহলে মিডিয়ায় দাঁড়িয়ে এই অতিনাটকীয় হুমকির ভাষা কেন?
নির্বাচনের আগেই ‘গণহত্যা’, ‘নৃশংসতা’, ‘বিচার’- এসব আড়ম্বরপূর্ণ শব্দের ব্যবহার আসলে একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার ইঙ্গিত অর্থাৎ আগামী নির্বাচনের আগে এক ধরনের বিকল্প বাস্তবতা গড়ে তোলা।
ইতিহাস নয়, তিনি যেন উপন্যাসের চরিত্র!
গণতন্ত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু সেটা মিথ্যাচার, বিকৃতি আর প্রমাণহীন নাটকের মঞ্চ হতে পারে না। জাতির বেদনাকে রাজনীতির হাতিয়ার বানানোর এই প্রবণতা প্রতিহত না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ইতিহাস নয়, বিভ্রান্তি শেখে।
আসিফ নজরুল নিশ্চয়ই ডিগ্রি শিক্ষিত লোক; কিন্তু মাঝে মাঝে তার বক্তব্যে মাঝে মাঝে মনে হয়; তার শিক্ষা কেবল সার্টিফিকেটেই সীমাবদ্ধ। ইতিহাসের বিশ্লেষণ নয়, তিনি এখন রাজনৈতিক চিত্রনাট্যের এক চরিত্র- যেখানে তিনি নিজেই কখনো নায়ক, কখনো খলনায়ক, কখনো আবেগ বিক্রির ‘শহীদবাবা’!
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ইতিহাস না পড়ে, যদি এইসব গল্প পড়ে বড় হয়, তবে দায় তারই- শুধু শিক্ষক হিসেবে নয়, একজন ইতিহাস-ধ্বংসকারী চরিত্র হিসেবেও।।#