অতীতে মহেঞ্জোদড়োতে তিনমাথাওয়ালা কোনো একজন দেবতার চিত্রসম্বলিত একাধিক মোহর পাওয়া যাওয়ার পরে হরাপ্পাবিদ্যার প্রথম আচার্য স্যার জন মার্শাল তাঁকে পৌরাণিক শিবদেবতার আদিরূপ বলে সিদ্ধান্ত করেছিলেন। হরাপ্পা-সংস্কৃতির স্বরূপ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে যতই বিরোধ থাকুক না কেন, অন্ততঃ এই একটি বিষয় নিয়ে এখনও অবধি কেউই দ্বিমত পোষণ করেননি। বাস্তবিক পক্ষে, ভারতীয় পৌরাণিক ঐতিহ্যে শিবের যে বহু বিচিত্র নাম এবং বর্ণনা পাওয়া যায়, সেগুলির অনেকগুলির সঙ্গেই মহেঞ্জোদড়োর সেই তিনমাথাওয়ালা দেবমূর্তির রেখা এবং প্রকরণগত সাদৃশ্য অনস্বীকার্য। মহেঞ্জোদড়োর সীলমোহরের ছবিতে সেই ‘আদিশিব’ দেবতা যোগসাধনায় — যেটাকে কুর্মাসন বলা হয়, অবিকল তেমন ভঙ্গিমায় উপবিষ্ট রয়েছেন বলে দেখা যায়; তাঁর দু’হাতে অনেকগুলি বালা বা কঙ্কণজাতীয় অলঙ্কার, গলায় কয়েকটি হার (কোনো কোনো অতিউৎসাহী বিশেষজ্ঞের মতে সেগুলো সাপ), এবং তিনমাথার উপরে মহিষের জোড়া শিং বসানো মুকুট দেখতে পাওয়া যায়। সেই দেবতার পরিধানে কিছু নেই, এবং তাঁর পুরুষাঙ্গটি ঊর্ধ্বমুখ। সীলমোহরে তাঁকে বেষ্টন করে — একটি করে গণ্ডার, মহিষ, বাঘ, হাতী, এবং মানুষ — রয়েছে বলে দেখা যায়; আর তাঁর আসনের তলায় রয়েছে দুটি ভেড়া। অন্যান্য কিছু সংখ্যক মোহরেও সেই একই দেবমূর্তি খোদিত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল; অবশ্য সেগুলিতে পশুমূর্তিগুলি গরহাজির রয়েছে এবং সেইসব মোহরগুলির ওপরে উৎকীর্ণ হরফগুলিও কিছুটা পরিমাণে পৃথক। পরবর্তীকালে মহাভারতে শিবকে যে সমস্ত নাম ও অভিধায় ভূষিত করা হয়েছিল, সেগুলির মধ্যে কয়েকটি হল — ত্রিশীর্ষ, ত্রিবক্তৃ, যোগাধ্যক্ষ, ঊর্ধ্বলিঙ্গ, শার্দুলরূপ, নাগচর্মোত্তরচ্ছদ, গন্ডলিন, পশুপতি এবং দিগবাস। এগুলির মধ্যে স্যার জন মার্শাল — পশুপতি — অভিধাটির ওপরেই বেশি করে গুরুত্ব আরোপ করলেও স্পষ্টতঃই অন্যান্য অভিধাগুলিও কম কিছু উল্লেখযোগ্য নয়। আরও পরবর্তীকালের শিবাষ্টক শ্লোকে শিবকে — করিচর্মগ, কৃত্তিপট, আজিবিষাণধর এবং বৃষরাজ-নিকেতন বলা হয়েছিল। করি এবং কৃত্তি শব্দের ব্যাখ্যা এখানে নিষ্প্রয়োজন; আজিবিষাণ হল — গণ্ডারশৃঙ্গ, এবং বৃষরাজ-নিকেতন শব্দটির অর্থ হল — মহাবৃষ-দেশবাসী। সুদূর অতীতে এই মহাবৃষ — সৌবীর সিন্ধু এবং আরট্ট ভূমির মধ্যবর্তী দেশ, অর্থাৎ — বর্তমান সময়ের পাঞ্জাব এবং সিন্ধুপ্রদেশের মধ্যবর্তী অঞ্চল ছিল। স্পষ্টতঃই অতীতে সিন্ধুসভ্যতা যে ভূখণ্ডে বিকশিত হয়েছিল, শিবাষ্টক শ্লোকে শিবকে সেখানকার দেবতা বলেই গণ্য করা হয়েছিল।
কিন্তু আদিতে এই দেবতা ঠিক কোন নামে অভিহিত হতেন? প্রাগার্য যে জনগোষ্ঠীটি প্রাচীন সিন্ধু-সংস্কৃতির ধারক ছিল, তাঁদের লিপিমালা এখনও পর্যন্ত অপঠিত থাকবার ফলে, এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট এবং প্রত্যক্ষ কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এখানে হাজির করা সম্ভব নয়। অতএব, এই বিষয়ে কোন পরোক্ষ ঐতিহাসিক সূত্রের সন্ধান না করলে আরেক পাও এগোনো সম্ভব নয়। অতএব — প্রাচীন সিন্ধু-সংস্কৃতি যাঁদের হাতে ধ্বংস হয়েছিল বলে এখনও পর্যন্ত অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই অভিমত প্রকাশ করেছেন, সেই আর্যভাষী জনগোষ্ঠীর সাহিত্য তথা সংহিতার মধ্যে সেই সূত্রের সন্ধান করবার জন্য অন্তঃপ্রবিষ্ট হতে হবে; অর্থাৎ — ঋগ্বেদের শ্লোকের অরণ্যে প্রবেশ করতে হবে। একইসাথে অথর্ববেদের মধ্যেও প্রাসঙ্গিক অনুসন্ধান প্রয়োজনীয়, যদিও অথর্ববেদের কতটা আর্য-প্রভাবিত আর কতটা প্রভাবিত নয়, সেটা এখনও বিতর্কিত।
ঋগ্বেদে একজন ত্রিশীর্ষ দেবতার এরকম উল্লেখ পাওয়া যায় —
(১) আপ্তের পুত্র সেই ত্রিত, ইন্দ্রকর্তৃক প্রেরিত হইয়া নিজ পিতার যুদ্ধাস্ত্রসকল গ্রহণপূর্বক যুদ্ধ করিলেন। সপ্তরশ্মি ত্রিশিরাকে বধ কবিলেন। ত্বষ্টার পুত্রের গাভী সমস্ত অপহরণ করিলেন।
(২) শিষ্টপালনকর্তা ইন্দ্র অভিমানী ও সর্বব্যাপী তেজোবিশিষ্ট ত্বষ্টার পুত্রকে বিদীর্ণ করিলেন। তিনি গাভীদিগকে আহ্বান করিতে ত্বষ্টার পুত্র বিশ্বরূপের তিন মস্তক ছেদন করিলেন।
(৩) সেই প্রভু ইন্দ্র বহুলচিৎকারী দাস জাতীয়কে শাসন করিয়াছেন, মস্তকত্রয়বিশিষ্ট ষটচক্ষু শত্রুকে দমন করিয়াছেন। ত্রিত ইহার তেজে তেজস্বী হইয়া লৌহের ন্যায় তীক্ষ্ণ নখবিশিষ্ট অঙ্গুলি দ্বারা বরাহকে বধ করিয়াছেন।
উপরোক্ত শেষ শ্লোকটির পরের অংশে ইন্দ্র কর্তৃক শত্রুপুরীর ধ্বংসসাধনের, শুষ্ণ নামের ‘দাস’–এর হত্যাসাধনের, এবং শতদ্বারবিশিষ্ট শত্রুপুরী থেকে সম্পদ হরণের উল্লেখ পাওয়া যায়। বৈদিক ঋষি অন্যত্র — শুষ্ণ নামক ‘দাস’–কে শৃঙ্গবিশিষ্ট বলে অভিহিত করেছিলেন। এছাড়া ঋগ্বেদে — বৃষশিপ্র, বৃষাণিন — প্রভৃতি শৃঙ্গসজ্জিত শিরোভূষণধারী ‘দাস’ বা দস্যু জাতীয়দের উল্লেখও পাওয়া যায়। সুতরাং ত্রিমস্তক, ষটচক্ষু এবং বৃষ (বা মহিষ)–শৃঙ্গধারী ‘দাস’ — বিশ্বরূপ ত্বষ্টার বৈদিক বর্ণনার সঙ্গে মহেঞ্জোদড়ো থেকে প্রাপ্ত শিবমূর্তি অঙ্কিত সীলমোহরগুলির আবয়বিক সাদৃশ্য অবশ্যই নতুন কিছু চিন্তার উদ্রেক করে। ঋগ্বেদের মধ্যে উল্লেখিত নক্ষত্রসংস্থানের গাণিতিক বিশ্লেষণ করে আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি একথা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, এখন থেকে আনুমানিক চার থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার কোনো একসময়ে ঋগ্বেদ-রচয়িতা আর্যভাষী গোষ্ঠীর বাহিনী ইন্দ্র নামক একজন অধিনায়কের (পরবর্তীকালে যিনি দেবতারূপে গৃহীত হয়েছিলেন) নেতৃত্বে ‘দাস’ বা ‘দস্যু’ নামক জনগোষ্ঠীর নগরগুলিকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। হরাপ্পা-তত্ত্ববিদদের মঙ্গলে এই দাস বা দস্যু (বা অসুর বা অহি)–রূপে সাধারণভাবে প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতার ধারক জনগোষ্ঠীকেই গণ্য করা হয়ে থাকে। কাজেই ঐ মোহর লাঞ্ছিত সিন্ধু দেবমূর্তিই পরবর্তীকালের ঋগ্বেদ-সূক্তগুলি সঙ্কলিত হওয়ার সময়ে ইন্দ্রশত্রু — ত্রিশীর্ষ, বিশ্বরূপ, ত্বষ্টারূপে যে আখ্যাত হয়েছিল, এমনটা ভাবলে ভুল করা হয় না।
ত্বষ্টা বা ত্বষ্ট্রর পুত্র এই বিশ্বরূপের আসল পরিচয় কি? ঋগ্বেদ থেকে এসম্পর্কে কিছু জানা না গেলেও, পরবর্তী সময়ে রচিত শতপথ ব্রাহ্মণে এবং দেবীভাগবতে দেখা যায় যে, ত্বষ্ট্রর পুত্ররূপে সেখানে বৃত্রকেই নির্দেশ করা হয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, প্রচলিত হিন্দু পুরাণের ধারণানুসারে বৃত্র আবার বিশ্বরূপের অনুজরূপে কথিত। কিন্তু এটা পরবর্তী সময়ের সংযোজন। ইন্দ্র-বৃত্র সংঘাতের মিথ যে ঋগ্বেদের একটি প্রধান কাহিনীর উপজীব্য, একথা এখানে বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। সুদূর অতীতে বৃত্রনিধনের গল্পটি আর্যভাষী বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে এমনভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছিল যে, বৈদিক আর্যদের বিরোধী আবেস্তা-অনুগামী ইরাণীয় আর্যদের পুরাকাহিনীর মধ্যেও এর সুবিস্তৃত উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। সেই মিথলজির কল্পকাহিনীর অবাস্তব অংশটুকুকে বাদ দিলেও একথা স্বীকার করতেই হয় যে, ঋগ্বেদ অনুসারে বৃত্র নামধারী কোনো দাস (বা অহি)–বংশীয় অধিপতি আর্যভাষী জনগোষ্ঠীর ইন্দ্র, কিংবা আবেস্তা অনুসারে থ্রতেয়ন নামক নায়কের হাতে নিহত হয়েছিলেন, — এবং একথা ঐতিহাসিক সত্যি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, বৃত্র আবেস্তায় বেরেথ্র বলে কথিত, এবং তাঁরও তিনটি মাথা (রামাযস্ত — জেন্দ আবেস্তা)। থ্রতেয়ন অবশ্যই ঋকসূক্তে কথিত ত্রিত। বৃত্র তথা বেরেথ্র হলেন অহি ওরফে অজি। ত্রিমস্তক এবংষট্চক্ষু সম্পন্ন বেরেথ্রকে আবেস্তায় একাধিক জায়গায় ‘দ্রুজ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। ‘দ্রুজ’ — খুব সম্ভবতঃ প্রাগৈতিহাসিক ভারতীয় জাতি ‘দ্রুহ্য়’–এর সঙ্গে একই অর্থ বহন করে। সেক্ষেত্রে প্রচলিত পৌরাণিক সংস্কার অনুযায়ী বৃত্রকেও আর্যজনসম্ভূত হতে হয়, যদিও সেই একই পৌরাণিক সংস্কার অনুযায়ী দ্রুহ্য়বংশীয়রা শর্মিষ্ঠার সন্তান বলে মাতুলকুলাগত প্রাগার্য অনুররক্তেরও অংশীদার। এক্ষেত্রে পৌরাণিকরূপক বাদ দিলেও, একথা অবশ্যই মনে করা চলে যে — প্রাগৈতিহাসিক দ্রুহ্য়বংশীয়দের সঙ্গে আর্য নয়, এমন জনকৌমের রক্তের সম্পর্ক ছিল। প্রাসঙ্গিকভাবে একথাও উল্লেখযোগ্য যে, অতীতে কেউ কেউ এই দ্রুহ্য়দেরকে ‘দ্রাবিড়’ বলেও মনে করেছিলেন। সেক্ষেত্রে আদি-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মানুষেরাই যে সিন্ধু সংস্কৃতির স্রষ্টা ছিলেন, — এমন মতাবলম্বীরা তাঁদের নিজেদের বক্তব্যের স্বপক্ষে একটা ভাল ঐতিহাসিক নজির পেতে পারেন। অবশ্য সেই আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।
ইন্দ্র-বৃত্র যুদ্ধের যে মিথ ঋগ্বেদের বিভিন্ন শ্লোকে ছড়িয়ে রয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়, সেইসব শ্লোকগুলিকে সংশ্লেষণ ও বিন্যাস করলে যেটা দাঁড়ায়, সেটা হল যে — দনুর পুত্র অহি বা দাসবংশীয় বৃত্র সপ্তনদী (সিন্ধু)–র জল রুদ্ধ করে রেখেছিলেন (খুব সম্ভবতঃ বাঁধ বেঁধে)। তখন আর্যভাষী একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নায়ক ইন্দ্র অন্যান্য ‘দস্যু’–অধিপতিদের মত বৃত্রের সঙ্গেও যুদ্ধ করেছিলেন। বৃত্র তাঁর নিজের মায়াবলে মেঘ সৃষ্টি করে সূর্যকে আচ্ছাদিত করে দিয়ে পৃথিবীকে অন্ধকার করে দিলে, ইন্দ্র বজ্র নামক একটি ভীষণ অস্ত্রের সাহায্যে সেই মেঘকে বিদীর্ণ করে দিয়েছিলেন, এবং সেই অস্ত্র নিয়েই তিনি বৃত্রকে আক্রমণ করেছিলেন। তাঁর আক্রমণে আহত হয়ে বৃত্র জলের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন, এবং সেখানে তার মা দনু নিজের সন্তানকে রক্ষা করবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। বজ্রাস্ত্রের মাধ্যমে বৃত্রের নিধন ঘটিয়ে ইন্দ্র বন্দী জলধারাকে মুক্ত করে দিয়ে বৃত্রপুরীকে প্লাবিত করে দিয়েছিলেন, এবং সেখানকার ধনরত্ন ও গাভীগুলিকে লুণ্ঠন করে এবং পুরনারীদের সদলবলে ধর্ষণ করেছিলেন। তাঁর সেইসব অপকর্মে ‘দাস’–বংশীয় কিছু বিভীষণও যোগ দিয়েছিলেন। স্পষ্টতঃই শত্রুকবলিত মহেঞ্জোদড়ো নগরীর শেষলগ্নের ইতিহাস এবং এই কাহিনীর মধ্যেকার সাদৃশ্য কিন্তু উপেক্ষা করবার মত নয়। মহেঞ্জোদড়োতে হত্যা, লুণ্ঠন এবং জলপ্লাবনের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এমনভাবেই পাওয়া গিয়েছিল যে, সেই ঐতিহাসিক নগরীর পরিসমাপ্তি কি ভাবে ঘটেছিল — সেকথা এখন প্রশ্নাতীত।
সিন্ধু-সভ্যতা আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বকালীন বৈদিক গবেষণায় অবশ্য ইন্দ্র ও বৃত্রের মধ্যেকার সেই সংঘাতকে একটি নেচারমিথ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। তাতে বৃত্র ছিলেন জলনিরুদ্ধকারী মেঘের রূপক এবং ইন্দ্র ছিলেন বজ্র-বিদ্যুতের রূপক। তাঁদের উভয়ের সংঘর্ষের ফলে মেঘ বিদীর্ণ হয়ে জলের বন্দীত্ব ঘুচে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই, সুদূর অতীতের অন্তরীক্ষ-দেবোপাসক ঋগ্বেদীয় এবং আবেস্তীয় আর্যদের কাহিনীর ফলেই যে সেই নেচারমিথের সৃষ্টি হয়েছিল — এমনটা ভাবলে ভুল কিছু ভাবা হয়না। কিন্তু একালীন লোকবৃত্ত-গবেষণার নেচারমিথ বিশ্লেষণ করবার পদ্ধতির মধ্যে ইতিহাসের বস্তু-উপাদান বিচার করবার রীতি এমনভাবে অনিবার্য হয়ে উঠেছে যে, বর্তমান সময়ে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সংঘটনের একটি রূপক বলেই এটিকে গণ্য করা চলে না; বিশেষতঃ যখন এর থেকে ইতিহাসের উপকরণ খুঁজে বের করা অসম্ভব কিছু নয়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, — যে কোনো কাহিনী কোনো না কোনো বাস্তব ঘটনার সূত্র ধরেই, সেটার ওপরে কল্পনার রং চড়াতে চড়াতে মিথ থেকে লিজেন্ডে বিবর্তনের পথে অগ্রসর হয়। আলাদাভাবে ইন্দ্র-বৃত্র ওরফে থ্রতেয়ন তথা বেরেথ্রঘ্ন-বেরেথ্র-মিথ থাকা সত্ত্বেও ঠিক একই নেচারমিথ আবেস্তার মধ্যেও রয়েছে। সেই নেচারমিথে তিশতার হল জলদানকারী দেবদূত এবং অপওশা হল জলরোধকারী দৈত্য। তিশতারের হাতে অবশেষে জলের অপহারক অপওশার মৃত্যু হয় এবং নিরুদ্ধ জলরাশির মুক্তিলাভ ঘটে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে আদি-আর্যভাষীদের লোকপুরাণে এই জলরোধকাবী শক্তি এবং জলরাশির মুক্তিদানকারী শক্তির মধ্যকার সংঘাতের একটা কাহিনী প্রচলিত ছিল — যেটা ইরাণীয় আর্যভাষী এবং ভারতীয় আর্যভাষীদের মধ্যে দু’ভাবে কল্পিত হয়েছিল, যথা — তিশতার বনাম অপওশা এবং ইন্দ্র বনাম বৃত্র। আবার ইন্দ্র-বৃত্র কাহিনীটি আবেস্তায় বেরেথ্রঘ্ন বনাম বেরেথ্র সংঘর্ষের বিবরণী সমেত নতুনভাবে সংযোজন করা হয়েছিল। সেই সুদূর প্রাক-ইতিহাসের যুগে বাস্তব ক্ষেত্রে দাস/অহিনায়ক বৃত্র এবং আর্যনায়ক ইন্দ্রের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল বলে এবং কালক্রমে সেই কাহিনীর বিবরণী লিজেন্ডের স্বরূপ ধারণ করেছিল বলেই — এটা সম্ভব হতে পেরেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে মহেঞ্জোদড়োর পতনের সময় থেকে ঋগ্বেদের সূক্ত সংকলনের মধ্যে প্রায় পাঁচশো বছরের দূরত্ব রয়েছে, যে সময়কালের মধ্যে বাস্তব ঘটনার ওপরে কল্পনা, পুরাকাহিনী এবং অলৌকিক সংঘটনে সার্বিক বিশ্বাসের রং জমতে জমতে স্বচ্ছন্দেই সেটি লিজেন্ডে পরিণতি লাভ করতে পারে। আর সেটারই ফলে বিশ্বরূপ ত্বষ্টার ত্রিশীর্ষমূর্তি উপাসক সিন্ধুরাষ্ট্রনায়ক বৃত্র অহি ঋগ্বেদে এবং আরও পরবর্তীকালের শতপথ ব্রাহ্মণে — স্বয়ং ত্রিশীর্ষ এবং ষট্চক্ষুষ্মান হিসেবে বর্ণিত হয়েছিলেন। প্রতিবেশী আবেস্তানুসারক-ইরাণীয় আর্যভাষীরাও সেই কাহিনীকে তাঁদের নিজেদের সংহিতার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন।
বিশ্বরূপ ত্বষ্টা (সিন্ধুজনকৌমভাষায় তাঁর নাম কি ছিল সেটা আজও অজানা) কিভাবে বৃত্রে রূপান্তরিত হয়েছিলেন, সেটা না হয় যাই হোক একটি কারণ-শৃঙ্খলার মাধ্যমে বোঝা গেল; কিন্তু বৃত্রের শিবরূপে বিবর্তন কেমনভাবে ঘটেছিল? কিভাবে পৌরাণিকযুগে শিব নামের আবির্ভাব ঘটেছিল, এবং কিভাবেই বা তিনি আর্যদের প্রধান দেরতায় পরিণতি লাভ করেছিলেন, এবং বৃত্রহন্তা আর্যমহানায়ক ইন্দ্র তখন দেবতারাজরূপে স্বীকৃতি পেলেও, শিবের তুলনায় তাঁর মাহাত্ম্য খর্ব হয়েছিল, সেইসব প্রশ্নের জবাবও প্রাসঙ্গিকভাবে উপরোক্ত সূত্র ধরেই দিতে হবে।
বৃত্র-হত্যা এবং দাসরাজ শম্বরের নিরানব্বইটি পুরের ধ্বংসসাধন করবার পরে ইন্দ্র-বাহিনী ‘বৃত্রপত্নী’ তথা দাসনারীদের মুক্ত জলধারার মতোই বার করে নিয়ে এসেছিল, এবং অভিলাষিণী স্ত্রীর মত পৃথিবী ইন্দ্রের আলিঙ্গনে আত্মসমর্পণ করেছিল — এই বিবরণ স্বয়ং বৈদিক কবিরাই দিয়েছিলেন, এবং তাঁরাই আবার ইন্দ্রকে অন্যত্র ধর্ষণকারীরূপে অভিহিত করেছিলেন। অর্থাৎ — দাসবংশীয়া সিন্ধুজনকৌমের নারীরা বিজেতা আর্যভাষীদের উপপত্নী হয়ে তাঁদের অন্দরমহলে ঢুকতে বাধ্য হয়েছিলেন; এবং সেই সঙ্গে তাঁরা নিজেদের ধর্মবিশ্বাস, আচরণবিধি এবং দেবকল্পনাকেও সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন; নিজেদের সম্ভ্রমের অবমাননার প্রতিশোধক হিসেবে তাঁরা আর্যশিবিরের তাঁবুতে তাঁবুতে সেই সবকিছুকে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন। তাঁদের সন্ততি-প্রসন্ততিরা ধীরে ধীরে মাতুলকুলের ধর্মবিধি পালন এবং দেবতার পূজার্চনা কালক্রমে ব্যাপক এবং প্রকাশ্যভাবে করতে শুরু করেছিল। ফলে এককালের মূর্তিহীন মুরদেবাঃ নিন্দক আর্যদের কল্পনার মধ্যে মূর্তিধারী দেবতাদের আবির্ভাব ঘটেছিল। তাঁরা যে শিশ্নদেবাঃ দাসদের কোনোকালে ঘৃণা করতেন, শিবলিঙ্গ গৌরীপট্ট উপাসক পৌরাণিক আর্যধর্মীয়রা সেকথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। দেখতে দেখতে সিন্ধুজনের পশু-উপাসনা আর্যদের দেবদেবীর বাহন-কল্পনায় রূপান্তরিত হয়েছিল, এবং অথর্বীয় মন্ত্র-তন্ত্র অভিচার মায়া ইত্যাদি আর্যমানসকে গ্রাস করে নিয়েছিল। একটা বিজয়ী জনগোষ্ঠীর এতবড় আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক পরাভবের নিদর্শন কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে খুব বেশি পাওয়া যায় না।
প্রত্নবিদ পণ্ডিত এ. এইচ. দানী তাঁর একটি প্রবন্ধে সিন্ধু বালুচিস্তান অঞ্চলের ‘শিবি’ নামধারী একটি জাতির সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছিলেন। অতীতের নৃতত্ত্ববিদদের মধ্যে কেউ কেউ শেওহান এবং শিবিপুরা নামের দুটি জাতিগোষ্ঠীরও ঐ অঞ্চলে একদা অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেছিলেন। বালুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটার কিছু দূরে শিবিস্থান নামের একটি ছোট কিন্তু সুপ্রাচীন শহরের অস্তিত্ব এখনও রয়েছে। অতীতে চিতোরগড় অঞ্চলে একটি খননকার্য চালানোর সময়ে — ‘মঝঝিমকায় শিবি জনপদ’–এর উল্লেখসহ একটি রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল। এবারে প্রশ্ন হল যে — শিবিজাতি, শিবি জনপদ হত্যাদির প্রত্ন-ইতিহাসকালে উপাসিত দেবতা (ত্বষ্টাবৃত্র)–ই কি কালক্রমে শিবে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছেন? এবং আর্যভাষীদের সঙ্গে প্রাগার্য সেইসব জাতির সংমিশ্রণের ফলশ্রুতিতেই কি তিনি উত্তরকালের হিন্দু বিশ্বাসের সর্বপ্রধান তিন দেবতার একজন হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন? একথার সমর্থনে কোন পূর্ণায়ত যুক্তির প্রতিষ্ঠা করা এখন প্রায় অসম্ভব বললেই চলে; কারণ — এখানে অতীতের যেসব অঞ্চল এবং যেসব জাতিগোষ্ঠীর কথা বলা হচ্ছে, সেখানে এবং তাঁদের মধ্যে বর্তমানে সার্বিকভাবে ইসলাম ধর্মেরই ব্যাপ্তি দেখতে পাওয়া যায়। তাই এই বিষয়ে নতুন কোনো প্রত্ননিদর্শ যদি পাওয়া যায়, কিংবা তাঁদের মধ্যে প্রচলিত লোককথা ইত্যাদির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে যদি এ সম্পর্কে স্বীকার্য ও গ্রহণীয় কিছু ঐতিহাসিক তথ্য বা তথ্যের উপাদান পাওয়া যায়, — তবেই এই অনুমানের বাস্তব ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব।
এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে আরো দুটি কথা বিচার্য। মহেঞ্জোদড়ো এবং হরাপ্পা — এই শহর দুটির নামের তাৎপর্য কি? এখন না হয় সিন্ধি ভাষায় ‘মহেঞ্জোদড়ো’ শব্দের অর্থ হল ‘মৃতের পুরী’, কিন্তু পাঁচ হাজার বছর বা তারও আগে সেই নগর যখন ‘জীবিতের পুরী’ ছিল — তখনও কি এই শব্দের এই একই অর্থ ছিল? অবশ্যই সেটা সম্ভবপর নয়। তাহলে কি এমন ধরে নেওয়া অসঙ্গত হবে যে, সিন্ধু-জনকৌমগুলি মহেঞ্জোদড়োকে তখন যে নামে উল্লেখ করত, আর্যদের ভাষায় সেটি অনূদিত হয়ে এবং কালপরম্পরায় প্রাকৃত ভাষার মধ্যে দিয়ে আধুনিক সিন্ধি ভাষায় মহেঞ্জোদড়োতে পরিণত হয়েছে? মহেন্দ্র (শিব)–দৃঢ় (দুর্গপুরী) — মহেঞ্জোদড়ো, এই ভাষাগত বিবর্তন খুবই স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। এই প্রসঙ্গে একথাও উল্লেখ্য যে, ঋগ্বেদের ইন্দ্র হলেন — ‘দৃঢ়হা’। হরাপ্পা নামটিও একইভাবে বিশ্লেষণ করা আদৌ অসম্ভব নয় — ‘হর’ (শিব) শব্দের উত্তরপদ হিসেবে ‘আপ্পা’ থেকে গিয়েছে; সিন্ধু জনপদবাসীরা এই শহরকেও সম্ভবতঃ শিবের (তদানীন্তন ভাষায় তাঁরা তাঁকে যে নাম অভিহিত করেছিলেন সেইরূপে) নাম নামাঙ্কিত করেছিলেন। ‘আপ্পা’–বাচক দ্রাবিড় প্রত্যয়টি গবেষকদের কাছে অপরিচিত নয়, খুব সম্ভবতঃ আদি-দ্রাবিড় ভাষাতেও সেটা বিদ্যমান ছিল এবং এখনো পর্যন্ত সেটি টিকে রয়েছে। ইরাবতীর নিকটবর্তী হরাপ্পাকে যজ্বাবতী-তীরস্থ ‘হরিযূপীয়া’–রূপে ঋগ্বেদে অবশ্য একবার উল্লেখ করাও হয়েছিল; খুব সম্ভবতঃ ভাষাগত মিশ্রণের অস্থিরপর্বটি তখনো অনতিক্রান্ত ছিল।
যাঁদেরকে ঋগ্বেদে — ‘বিষাণিন’, ‘বৃষশিপ্র’; মহাভারতে — ‘শৃঙ্গিন’; বিষ্ণুপুরাণে — ‘শৃঙ্গল’ ইত্যাদি রূপে অভিহিত করা হয়েছে, তাঁদের-কল্পিত দেবতার মাথাতেও বৃষ বা মহিষশৃঙ্গ সমন্বিত মুকুট বা শিরোভূষণ যে থাকবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। উত্তরকালে শিবের প্রতিমূর্তির মাথায় যে বঙ্কিম চন্দ্রকলাটি দেখা দিতে আরম্ভ করেছিল, সেটা সম্ভবতঃ অতীতের ঐ শৃঙ্গমুকুটেরই রৈখিক বিবর্তন ছিল। আদি শিবের পশু প্রতীক হিসেবেই হয়ত মহেঞ্জোদড়ো, হরাপ্পা এবং চনহূদড়োর বিখ্যাত ‘সিন্ধু-ষণ্ড’ অঙ্কিত মূর্তিসহ মোহরগুলি প্রচলিত ছিল। শিবের বাহন হিসেবে উত্তর-কালের হিন্দুধর্মের আসরে তারাই আসর জাঁকিয়ে বসেছে। বৈদিক শ্লোকের সাক্ষ্যানুযায়ী ত্বষ্টা তথা বৃত্র তথা শিবের শত্রু ইন্দ্র সেইসব বৃষ ও মহিষকুলকে ভোজন করে নিঃশেষ করে দিতে চাইলেও পরিণামে তিনি নিজেই বৃষপতি মহেন্দ্রের (শিবের) দ্বারা গ্রস্ত হয়ে গিয়েছেন। পরাভূত প্রাগার্য দেবতা অপহৃতা সিন্ধু-জনপদবালাদের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখে কালক্রমে যেখানে প্রধানতম হিন্দু দেবতা শিব মহেশ্বর (মহিষ-ঈশ্বর?) –রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, বৈদিক রুদ্রদেবতা সেখানে তাঁর মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। আর বিজয়ী ইন্দ্র পৌরাণিক সাহিত্যে দেবরাজরূপে প্রতিভাত হলেও, উত্তরকালে নগণ্য একজন লৌকিক দেবতা ‘ইঁদ’–এ পরিণতি পেয়েছেন। ইন্দ্রের দ্বারা নিহত হয়েও বৃত্র তাই জয়ী হয়েছেন, এবং শিবরূপে তাঁর অনড় প্রতিষ্ঠা ঘটেছে।
শিব নিয়ে আলোচনার শেষে শিব দেবতার ব্যাপকভাবে প্রচলিত প্রতীক মূর্তিটির প্রসঙ্গেও কয়েকটি কথা ব্যাখ্যা করবার প্রয়োজন রয়েছে, কেন না — আদিরূপে সেটিও হরাপ্পা সংস্কৃতিরই বস্তু। ‘শিশ্নদেবাঃ’ তথা যৌনপ্রতীক উপাসকদের সম্পর্কে ঋগ্বৈদিক আর্যভাষীরা যে কটু-কাটব্য করেছিলেন, সেটার পরিপ্রেক্ষিতে হরাপ্পা প্রভৃতি নগরে সুপ্রচুরভাবে পাওয়া বর্তুলাকার প্রস্তরখণ্ডের মধ্যে প্রবিষ্ট করানো নীতিদীর্ঘ মসৃণ আরেকটি পাথর সংবলিত প্রতীক মূর্তিকে, সেই সংস্কৃতিতে শিশ্নদেবতার সার্বজনিকভাবে গৃহীত রূপ বলে গণ্য করা চলে। পিতৃদেবতা এবং মাতৃকাদেবী — দু’য়েরই ব্যাপক প্রচলন যখন শতাব্দীর পরে শতাব্দী ধরে ঐ সভ্যতায় বজায় ছিল, তখন স্বাভাবিকভাবেই পিতৃদেবতার প্রতীক পুরুষচিহ্ন দ্যোতক নীতিদীর্ঘ প্রস্তরখণ্ড এবং মাতৃদেবতার প্রতীকচিহ্ন বর্তুলাকার আংটির মত আরেকটি প্রস্তরখণ্ডের সংলগ্নরূপটির মাধ্যমে ঐ দুই ধর্মধারারার সমন্বয় যে ঘটেছিল — সেখানে সেটি বোঝা কঠিন কিছু নয়, বা সেই ভাবাটুকু দূরান্বয়ী নয়। আদি-শিব এবং আদি-দুর্গা — দু’য়েরই হদিশ যখন হরাপ্পা সংস্কৃতিতে পাওয়া গিয়েছে, তখন শিবলিঙ্গ ও গৌরীপট্টের সমন্বিত আদি রূপটিও যে সেখানে পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। অর্বাচীনকালে ‘লিঙ্গপুরাণ’ মারফৎ, কামনার্ত শিব কর্তৃক বসুন্ধরাকে বিদীর্ণ করতে উদ্যত হওয়ার প্রাক্কালে সুদর্শন চক্রের সাহায্যে বিষ্ণুকর্তৃক তাঁর শিশ্নচ্ছেদন করা এবং ঐ প্রত্যঙ্গের খণ্ডাংশকে গৌরী কর্তৃক যথাস্থানে সন্নদ্ধ করবার যে গল্পটি প্রচলিত হয়েছিল, সেটা প্রাচীনতর পূজাবিধিরই পরবর্তীকালীন ব্যাখ্যা মাত্র।
শুধুমাত্র বৈষ্ণবধর্ম প্রভাবিত কিছু কিছু অঞ্চলের কথা বাদ দিলে, বাঙালীর সমাজ এবং সংস্কৃতিতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ দেবতা হলেন — শিব। এই শিবের যে রূপ ব্রাহ্মণ্য সংস্কার নির্ভর পুরাণে দেখা যায়, বাঙালীর শিব সেটার থেকে নিঃসন্দেহে আলাদা। তাঁকে উপলক্ষ্য করে যে শিবরাত্রির অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় — সেটাও বলাই বাহুল্য যে, পৌরাণিক হিন্দুধর্মের ভাবাদর্শসঞ্জাত নয়।
শিব প্রকৃতপক্ষে হিন্দুধর্মের উদ্ভবের আগের সময়ের দেবতা। আগেই বলা হয়ে যে — ঋগ্বেদিক আর্যভাষীরা যে সিন্ধুসভ্যতাকে ধ্বংস করেছিলেন, শিব আদিতে সেখানকার উপাস্য প্রধান পুরুষ দেবতা ছিলেন। এই আদি শিব পরবর্তীকালে বৈদিক রুদ্র দেবতার সঙ্গে অভিন্নরূপে কল্পিত হয়েছিলেন, এবং আরও পরে যখন প্রাগার্য আদি-ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ঋগ্বৈদিক আর্য সংস্কৃতির বিমিশ্রণ ঘটে হিন্দুধর্মের পত্তন হয়েছিল, তখন শিবই সেই ধর্মের প্রধান তিন পুরুষ দেবতার মধ্যে অন্যতম, — সঠিকভাবে বললে প্রধানতম দেবতাতেই পরিণত হয়েছিলেন; আর প্রাগার্য মাতৃকা দেবী মহাদেবী বা শক্তিতে পরিণতি পেয়েছিলেন। হরপ্পা সংস্কৃতি থেকেই শিব ও শক্তির সম্মিলিত রূপের প্রতীক হিসেবে গৌরীপট্ট-শিবলিঙ্গের যৌথ আরাধনার প্রবর্তন ঘটেছিল। হিন্দু ধর্মের প্রতিষ্ঠা ঘটবার পরে শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে তাঁর ওপরে জল, দুধ ইত্যাদি ঢালা তাই আদিম যৌন প্রতীক পূজারই প্রবহমান ধারা। এই যৌন প্রতীক-উপাসকদের উদ্দেশ্যে ঋগ্বেদে প্রচুর গালমন্দ করা হলেও এখনও পর্যন্ত যে এই রীতির অস্তিত্ব বজায় রয়েছে, এথেকে বুঝতে পারা যায় যে, এর মধ্যে মৌলিকভাবে সমাজমনের একটা স্বীকৃতি আছে। কুমারী কন্যাদের শিবরাত্রি উপলক্ষে শিবলিঙ্গ প্রতীকের মাথায় জল-দুধ ঢালবার প্রথাটার তাৎপর্যও এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। পরবর্তীকালে অবশ্য শিবরাত্রির জাগরণ, উপবাস এবং পূজাপদ্ধতিকে শাস্ত্রীয় ব্রতের আবরণ পরানো হয়েছিল। তাতে ব্যবহৃত সংযত মন্ত্রগুলি যে নেহাৎই স্মার্ত সংস্কৃতির প্রলেপ বুলোনোর জন্য, এই ব্রতের মূল কাহিনীটি বিশ্লেষণ করলেই সেকথা বুঝতে পারা যায়। সেই মূল কাহিনীটি এরকম — পবিত্র বেলগাছের ওপরে উঠে ক্লান্ত ব্যাধের রাত কাটানোর অবকাশে কখন গাছের পাতা আর শিশিরের জল নিচের মাটিতে প্রোথিত শিবরূপী প্রস্তরখণ্ডের উপরে পড়লে আশুতোষ মহাদেবের আশীর্বাদে নিজের অজ্ঞাতেই সেই ব্যাধ মহাপুণ্যবান বলে গণ্য হয়েছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পরে শিবদূতেরা যমদূতদের পরাজিত করে তাঁকে যথাকালে কৈলাসে নিয়ে গিয়ে হাজির করেছিলেন।
স্পষ্টতঃই আদিমকালের প্রাগৈতিহাসিক শিকার নির্ভর জীবনের পুরুষানুক্রমে প্রচলিত স্মৃতিকাহিনীই উপরোক্ত ব্রতকথার প্রথম অংশে প্রতিভাসিত হয়ে উঠেছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। সেই কারণেই বৃক্ষবিশেষ পবিত্ররূপে গণ্য হয়েছে, গাছের পাতা এবং শিশিরের জলের স্পর্শে প্রস্তরখণ্ডরূপী দেবতা পরিতুষ্ট হয়েছেন এবং ইহলোকে মৃত শিকারের অধিকার নিয়ে দুই প্রাগৈতিহাসিক মানবগোষ্ঠীর দ্বন্দের আদলে পরলোকের অতিলৌকিক আধিদৈবিক সত্তারাও সেখানে মরা মানুষের দাবী নিয়ে যুদ্ধ করছেন। ঐ আদিম মিথোলজি তথা লোকপুরাণের কাহিনীই উপরোক্ত ব্রতকথায় রূপান্তরিত হয়েছে মাত্র। বৃক্ষপূজা, প্রস্তরপূজা, অচেতন বস্তুর মধ্যে চেতনাময় সত্তাকে কল্পনা করা, পশুপূজা — ইত্যাদি সব প্রাগৈতিহাসিক সংস্কার মানুষের মধ্যে এখনও সক্রিয় রয়েছে। সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব এবং লোকসংস্কৃতির ছাত্র মাত্রেই জানেন যে, উপরোক্ত ব্রতকাহিনীর মধ্যে এর সব কিছুই অবিচ্ছেদ্যভাবে সংস্থিত হয়েছে। এরই সঙ্গে যৌনপ্রতীকের আরাধনা — যেটার হদিশ সারা পৃথিবীর প্রাচীন পর্বতগুহাগাত্রেই পাওয়া যায়, পরবর্তীকালে যেটা শুধুমাত্র আরো সংকেতায়িত হয়েছে — তাতেও দেখতে পাওয়া যায়। শিব অতএব এখানে — পশুপতি, ভূতনাথ, জন্মশক্তিপ্রদাতা এবং আরো নানারকমের বিশ্বাসে কল্পিত হয়েছেন।
বস্তুতপক্ষে, বাঙালীর শিব তাঁর আর্যত্বের খোলস ছেড়ে নিজের স্বকীয় মূর্তিতেই স্বপ্রতিষ্ঠ বলেই বাঙালীর সাংস্কৃতিক জীবনে এত কাছের মানুষ। বাঙালীর বিচারে প্রায় যে কোনো গ্রামীণ তথা লৌকিক পুরুষ দেবতাই আঞ্চলিকভাবে শিবের রকমফের। শিব তাই বাঙালীর বিচারে একজন চাষী হয়ে ধান বোনেন (নিঃসন্দেহে উত্তরকালের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির অনুভাবনায়), ভাঙ-ধুতরো খেয়ে নেশাখোর বৃদ্ধ হয়ে শ্মশানে-মশানে ঘুরে বেড়ান, প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে সংসার করেন এবং অল্পে রুষ্ট ও আরো অল্পে তুষ্ট হন। স্বভাবতঃই এরকম একজন সাধার’ দেবতা — যিনি স্বভাবে এবং পরিচয়ে নিতান্তই কাছের মানুষ — তাঁকেই যে সাধারণ বাঙালী হিন্দুঘরের সাধারণ নারীরা নিজেদের স্বামী হিসেবে চাইবেন, এটাই তো স্বাভাবিক ব্যাপার। ‘শিবের মত স্বামী’ — কথাটির তাৎপর্যও তো সেটাই। অতএব শিবরাত্রি পালন করবার এত ব্যাপক প্রাবল্য যে হিন্দু বাঙালীর ঘরে ঘরে দেখতে পাওয়া যায়, সেটার অবলীন সামাজিক মানসিকতাটির স্বরূপ যে কি, — সেকথা বুঝতে একটুও অসুবিধে হয় না। সুদূর অতীতে শীতের শেষে বসন্তের সময়ে নতুন করে শিকারের সন্ধানে বের হওয়ার সময়ে যে পশুদেবতাকে পরিতুষ্ট করবার আদিম প্রথা শিবরাত্রির ব্রতকথায় বিবৃত হয়েছে বলে দেখা যায়, পরিবর্তিত সমাজ আর অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে ফাল্গুনী কৃষ্ণা চতুর্দশীতে সেই তাঁকেই বাঙালী হিন্দুঘরের নারীদের আকাঙ্ক্ষিত স্বামীর আদর্শে রূপান্তরিত হতে দেখা যায়। আধুনিক নাগরিক জীবনেও সেই আকাঙ্ক্ষার অন্তর্কাঠামোটি যে এখনও অটুট রয়েছে — সেটাই আকর্ষণীয় ব্যাপার। বর্তমানে পুরুষেরা কিংবা বিবাহিতা বা বিধবা নারীরাও শিবরাত্রি পালন করে থাকেন। কিন্তু সেটা পরবর্তীকালের ব্রাহ্মণ্য সমাজের সংস্কারে — কিছুটা ইহবিমুখ বেদান্ত ধর্মের প্রভাবে — অর্থাৎ অক্ষয় পরলোকের প্রত্যাশায়। কিন্তু আজও কুমারী বঙ্গ ললনারাই শিবরাত্রির পালার মূল গায়িকা।
আগেই বলা হয়েছে যে, শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে শিবলিঙ্গের মাথায় জল বা দুধ ঢালবার রীতিটি আসলে আদিম যুগের শিশ্নপ্রতীক পূজারই অনবচ্ছিন্ন রূপ। এইভাবে বিচার করলে অবশ্য এই পার্বণেরও একটি নিজস্বতা রয়েছে। প্রচ্ছন্নভাবে যৌনপ্রতীক উপাসনার রেওয়াজ অন্যান্য কোনো কোনো পার্বণে বজায় থাকলেও, প্রত্যক্ষভাবে এমন ধরণের ব্যাপক শিশ্নপূজা যে অন্য কোথাও দেখা যায় না, —মনসা বা ইঁদের প্রসঙ্গকে মাথায় রেখেও একথা নির্দ্বিধায় বলা চলে। মূলতঃ রক্ষণশীল বঙ্গসমাজে পিতৃদেবতা শিব যে এরকম খোলাখুলিভাবে যৌনপ্রতীকে জল ও দুধের (মনোবিজ্ঞানের পড়ুয়ারা এই দুটির তাৎপর্য জানেন) ধারাস্নানে পূজা পেয়ে থাকেন, —এটা হিন্দুসংস্কৃতির বিশেষ একটি চরিত্রকে যে সূচিত করে — সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই লিঙ্গপূজা অবশ্যই উর্বরতা-নির্ভর একটি কাল্টের পরিচয় দেয়। গবেষকদের মতে — লাঙ্গল এবং লিঙ্গ — উভয়েই ভাষাগতভাবে সম-উৎসজাত। আগেই বলা হয়েছে যে, সধবা ও কুমারী নারীরাই শিবপূজার প্রধান পূজারিণী। উর্বরতা ধর্মধারায় সেটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। অতীতে বাঙালীর সংস্কৃতিতে যে শিবকে কৃষকরূপে দেখা গিয়েছিল, এটি সেই ধর্মধারার দ্বিতীয়তর প্রকাশ। এটাই এই সংস্কৃতির মাটির ফসল। ‘লিঙ্গপুরাণ’ ইত্যাদি মারফৎ ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির যে অভিক্ষেপই সেই লিঙ্গ-যোনি সমন্বিত প্রতীক পূজার মধ্যে আরোপ করা হোক না কেন, সেটাকে প্রক্ষিপ্ত বলেই বুঝতে হবে।#