ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের এক ডজন মজার ঘটনা

১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জন্মেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর বেশভূষা ছিল খুবই সাধারণ। পরনে ধুতি, গায়ে মোটা চাদর আর পায়ে এক জোড়া চটি।
একদিন তিনি গেছেন রেলস্টেশনে। এমন সময় ট্রেন থেকে নামলেন এক ডাক্তারবাবু। হাতে ছোট্ট ব্যাগ। সহজেই বয়ে নেওয়া যায়। তবু তিনি হাঁক পাড়তে লাগলেন ‘কুলি’ ‘কুলি’ বলে।
ঈশ্বরচন্দ্র এগিয়ে গেলেন। কুলি ভেবে ডাক্তারবাবু তাঁর হাতে ব্যাগটি দিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রও ব্যাগ নিয়ে গিয়ে বাবুকে পালকিতে তুলে দিলেন। ডাক্তারবাবু পয়সা দিতে গেলে তিনি বললেন, ‘পয়সা দিতে হবে না। আমি ঠিক কুলি নই। এত ছোট ব্যাগ নিয়ে বিপদে পড়েছিলেন বলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলাম। আমার নাম ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা।’

দুই
ঈশ্বরচন্দ্র এক রবিবার নিজের বাড়ির সামনের বাগানে কাজ করছিলেন। এমন সময় মেদিনীপুর থেকে চারজন লোক এলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তাঁরা ভাবলেন, ইনি নিশ্চয়ই বাগানের মালি। বললেন, ‘বিদ্যাসাগর মশায় কি বাড়ি আছেন?’
— ‘তিনি একটু ব্যস্ত। আপনারা বসুন।’
একটু পরে অতিথিরা বললেন, ‘ওহে, একটু তামাক খাওয়াতে পারো?’
— ‘আজ্ঞে, পারি।’ বিদ্যাসাগর তামাক সাজিয়ে দিলেন অতিথিদের।
তামাক টানতে টানতে তাঁরা একসময় বললেন, ‘বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। দ্যাখো না বাবু বিদ্যাসাগর মশায় কোথায়?’
তখন তিনি বললেন, ‘আমিই ঈশ্বরচন্দ্র। বলুন।’

তিন
ঈশ্বরচন্দ্র ছোটবেলায় ভীষণ জেদি আর একগুঁয়ে ছিলেন। বাবা হয়তো বললেন, ‘ঈশ্বর, যাও, স্নান করে এসো।’ সেদিন আর ঈশ্বরচন্দ্র স্নান করবেনই না। আর বাবা যেদিন বলবেন, ‘আজ বেশ ঠান্ডা, আজ আর স্নান করার দরকার নেই’, সেদিন বালক ঈশ্বরচন্দ্র অবশ্যই স্নান করবেন। পারলে একবার নয়, দু’-দু’বার। তাই তাঁকে একটু বেশিক্ষণ পোড়ো বলতে হলে তিনি বলতেন, ‘ঈশ্বর আজ পড়বে কম, খেলবে বেশি।’ ব্যস। ওই দিন ঈশ্বরচন্দ্র বেশি বেশি করে পড়তেন।

চার
কলকাতায় ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর বাবা আর তাঁর ভাই-সহ অনেকে মিলে একটা বাড়িতে থাকতেন। ভোরবেলা উঠে তিনি সবার জন্য রান্না করতেন। তাঁকেই বাজার করতে হতো। তারপর তিনি দশটার মধ্যে কলেজে হাজির হতেন।
একদিন রেঁধে সবার সামনে তিনি খাবার পরিবেশন করছেন। নিচতলার আধো অন্ধকার ঘর। স্যাঁতসেঁতে মেঝে। পোকা কিলবিল করে। ঈশ্বরচন্দ্র দেখলেন, তরকারির হাঁড়িতে একটা তেলাপোকা। কিন্তু এতগুলো মানুষের খাবার তো নষ্ট করা যাবে না। তাই তিনি তেলাপোকাটা নিজের মুখে চালান করে দিলেন।

পাঁচ
ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স তখন ১৪ কি ১৬। তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠান। আগে ঈশ্বরচন্দ্র কনের মুখও দেখেননি। কিন্তু ঘরের মধ্যে বেশ কয়েক জন মেয়ে, এর মধ্য থেকে নিজের বউকে খুঁজে নিতে হবে। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর বয়সের একজনের হাত ধরে বললেন, ‘এই আমার কনে।’ হইচই পড়ে গেল। মেয়েটি কেঁদেকেটে বলল, ‘আমায় ছেড়ে দাও।’
বড়রা তখন কনেকে এনে হাজির করলেন তাঁর সামনে। ‘এই নাও তোমার কনে।’

ছয়
হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন কার সাহেব। একদিন বিদ্যাসাগর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কার সাহেব জুতো-সহ টেবিলের ওপরে পা তুলে বসে ছিলেন। বিদ্যাসাগর কাজ সেরে ফিরে এলেন। একদিন কার সাহেব এলেন বিদ্যাসাগরের ঘরে। বিদ্যাসাগর তাড়াতাড়ি তাঁর চটি জুতোসমেত পা তুলে দিলেন টেবিলের ওপরে।
কার সাহেব শিক্ষা বিভাগের উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলেন। অভিযোগের জবাবে বিদ্যাসাগরের সাফাই ছিল— ‘এটা আমি শিখেছি স্বয়ং কার সাহেবের কাছ থেকেই।’

সাত
সংস্কৃত কলেজের উন্নতি করার জন্য একটা পরিকল্পনা লিখে জমা দিলেন বিদ্যাসাগর। কলেজের সম্পাদক রসময় দত্ত সেটা কাটাছেঁড়া করলেন। প্রতিবাদে বিদ্যাসাগর চাকরি ছেড়ে দিলেন। লোকে বলাবলি করতে লাগল, ‘ঈশ্বরচন্দ্র যে চাকরি ছেড়ে দিল, ও খাবে কী?’ শুনে বিদ্যাসাগর বললেন, ‘বলে দাও ঈশ্বরচন্দ্র আলু-পটল বেচবে।’

আট
১৮৪৯ সালে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যোগ দেন। ১৮৫০ সালে ফিরে আসেন সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক হয়ে। ৩১ বছর বয়সে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ, বেতন ১৫০ টাকা। তখনকার ১৫০ টাকা মাইনে মানে প্রচুর টাকা। তখনও তিনি তাঁর জন্মভূমি মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে যেতেন ৬০ মাইল রাস্তা হেঁটে। আর টাকাপয়সা দান করতেন অকাতরে।

নয়
বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্রের এক খেলার সাথী ছিল। এক পড়শি কন্যা। ছোটবেলাতেই একদিন কলকাতা থেকে ফিরে এসে ঈশ্বর দেখা পেলেন তাঁর খেলার সাথীর। ‘এই তুই কি খেয়েছিস?’ ঈশ্বর জিজ্ঞাসা করলেন।
সে বলেছিল, ‘আমি আজ খাব না। আজ একাদশী। আজ আমার উপোস‌।’
— ‘উপোস কেন?’
সে বলেছিল, ‘ও মা তুমি জানো না, বিধবাদের একাদশীতে খেতে নেই।’
মনে মনে ঈশ্বরচন্দ্র সেদিন বলেছিলেন, ‘যদি বেঁচে থাকি, ১৩–১৪ বছরের বিধবার এই দুঃখ দূর করব।’
তিনি বিলেতের পার্লামেন্টে চিঠি লিখলেন বিধবা বিয়ের অনুমতি দিয়ে আইন পাস করতে। সে আইন পাস হল। আইন পাস হওয়ার পরেও কত বাদ–প্রতিবাদ হল। তাঁকে মারার জন্য লোক ঘুরত আর তাঁকে পাহারা দেওয়ার জন্য লোক রাখা হল। তিনি পকেটের পয়সা খরচা করে বিধবাবিবাহের আয়োজন করতে লাগলেন।

দশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি হল বাংলা ভাষা। তাঁর মতে, ‘বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন।’
বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের বিরোধ ছিল। অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্র একাই ছড়ি ঘুরিয়েছেন। বিদ্যাসাগর জবাব দিতেন না।
বিষবৃক্ষ উপন্যাসে সূর্যমুখী চরিত্রটি একটি চিঠিতে লিখছে, ‘ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবাবিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে?’

এগারো
বর্ধমানে এক বাড়ির ভোজে অতিথিদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রও ছিলেন। রান্না খেয়ে বঙ্কিম উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুরু করলে তাঁর ভাই সঞ্জীবচন্দ্র বললেন, ‘কে রেঁধেছে জানো তো? ঈশ্বরচন্দ্র!’
ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, ‘না হে না, বঙ্কিমের সূর্যমুখী আমার মতো মূর্খ দেখেনি।’ হাসির রোল উঠল।
বিদ্যাসাগরের গদ্যের বহুবার সমালোচনা করেছেন বঙ্কিম, তাঁকে অনুবাদক হিসেবেও তাচ্ছিল্য করেছেন। তবে শেষ জীবনে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোহর।’

বারো
একদিন এক লোক বিদ্যাসাগরকে বলল, ‘অমুকে আপনার পেছনে খুব লেগেছে। সারাক্ষণ আপনার নিন্দামন্দ করছে।’
বিদ্যাসাগর বললেন, ‘অমুকের তো আমার বিরুদ্ধে লাগার কথা নয়। আমি তো তাঁর কোনও উপকার করেছি বলে মনে করতে পারছি না।’#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!