এবং উলুখাগড়ার দহন

হাওন দে হারামজাদী!
হূছেন আলীর চীৎকারে চমকে ওঠে নাছিরা। হাতের কাজ ফেলে সে পেছন ফিরে তাকায়। তাকিয়ে দেখে হুছেন আলীর চোখ মুখ আগুন হয়ে আছে। সে ভাবে, অইলটা কী গো, লোকটা এমুন করতাছে ক্যারে? আর এই অসময়ে হে বাসাতেইবা আইছে ক্যারে? উৎকন্ঠিত নাছিরা নিজেকেই প্রশ্ন করে। রগচটা হুছেন আলীকে ঘাটাতে সাহস হয় না তার। কিন্ত সে যে খাবার চাইল এখন এই খাবার কোথা থেকে দেবে! নাছিরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় বসে থাকে। সমস্যার কথা কিছু কখনোই তাকে বলে না হুছেন আলী। তবু সে জানে যে এখন রুজি-রোজগারে মন্দা চলছে। এদিকে একমাস হলো তার নিজের কাজটাও গেছে। সেদিন সকালে কাজের বাড়ির ভাবী মুখ কালো করে বলেছিল, “কাল থেকে আর এসো না নাছিরা। তোমার ভাইয়ের ব্যবসা বন্ধ। আমাদেরও সংসার চালানো মুশকিল হয়ে গেছে। তোমার ভাই বলেছে- এখন থেকে নিজের কাজ নিজেই করতে হবে।” এক সানকি ভাতসহ আগের মাসের বেতন ধরিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বিদায় দিয়েছিল সেই ভাবি। এদিকে রোজ রোজ দ্রব্যমূল্য যেভাবে লাফিয়ে বাড়ছে নাছিরার মনে হয় আর খেয়ে বাঁচা সম্ভব নয়। তার ঘরে এখন সবকিছুর অভাব। চাল-ডাল,তেল, আলু,আনাজপাতি কিচ্ছু থাকে না। একটু আলুভর্তা খাওয়াও এখন বিলাসিতা। কাল রাতে একটু শুটকীভর্তা ভাত জুটেছিল সকলের। তাও সেই ভর্তায় ঠিকমত পেঁয়াজ রসুন লাগেনি। কাল দুপুরে দু’কেজি চাল, লবণ, সামান্য পেঁয়াজ রসুন আর দশটাকার চ্যাপা শুটকী এনেছিল হুছেন আলী। কিভাবে এনেছিল সেই জানে। তা দুই বেলায় সেই চালও শেষ।
সকালে রাতের একমুঠ ভাত পড়েছিল হাঁড়িতে। লবণপানিতে মাখিয়ে সেটুকুই খাইয়েছে ছোট দুইটাকে। বড় তিনটা খিদের চোটে চেঁচামেচি শুরু করলে নাছিরার কান্না আসে। চোখের পানি মুছে মিটসেফ এর ডিবি কন্টেইনার খুঁজে পেতে রঙচটা প্লাস্টিকের কন্টেইনারে পড়ে থাকা একমুঠ আটা দিয়ে সে একটা চটা রুটি বানায়। সেটাকে তিনটুকরো করে তিনজনকে খেতে দেয়। ছোট হলেও নাছিরার বাচ্চাগুলো বুঝদার। বলে, তুমি কিতা হাইবায় আম্মা? তোমার লাইগ্যা যে নাই! নিজেদের ভাগের টুকরো ছিঁড়ে তারা মাকে দিয়ে বলে, তুমিও এট্টু হাও! ছেলেমেয়েদের মমতা ও দায়িত্ববোধে নাছিরা পেটের খিদে ভুলে যায়। কেবল তাদের ভালবাসার মর্যাদা দিতে একটুকরো রুটি মুখে দেয় সে। চোখের পানি মুছে মগ ভরে পানি খেয়ে বাসী ঘরধোর ঝাড়া মুছামুছি করে সে ঝুটা বাসনগুলো ধুতে বসে ভাবছিল যদি হুছেনা আলী বাজার সদাই কিছু আনে তবে তাড়াতাড়ি রান্না বসিয়ে দেবে।
সকালবেলা হুছেন আলী বাড়িতে খায় না। খুব ভোরে সকলকে ঘুমে রেখে সে কাজে বেরিয়ে যায়। শহরের শিববাড়ির মোড়ে তখন তার মত মুটে মজুরেরা এসে জড়ো হয় কাজের জন্য। রাতের বেলা ঢাকা চট্টগ্রাম থেকে মালভর্তি ট্রাক এসে থামে সেখানে। ভোর থেকে সেই মাল খালাসের কাজ শুরু হয়। কেউ ট্রাক থেকে মাল নামিয়ে রাস্তার মাঝখানে স্তুপ করে রাখে। সেই মাল ভ্যান বা রিকশায় করে কেউ পৌছে দেয় দোকানের গুদামে। যেসব দোকান শিববাড়ির কাছে, সেসব দোকানে মাথায় বয়ে মাল পৌছে দেয় অনেকে। হুছেন আলী তাদের একজন। তার ভ্যান বা রিকশা গাড়ি নেই। দুটো হাত আর মাথাটাই সম্বল। অনেকদিন আগে একবার নাছিরা বলেছিল,আশা ব্যাংকের লোন নিয়া একটা ভ্যান বা রিকশা কিনুন যায় না? বেইন্যালার কামের পর রিকশা চালাইলে যে কামাই অইব, ইতান জমাইলেত বিপদ আপদে কামে লাগব!
হুছেন আলী নাছিরার কথা দুহাত দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার মত ভঙ্গি করে বলেছিল, আর রিকশা ভ্যান ! কিস্তির টেকা দিতে দিতে হেষে দেহা যাইব লাভের গুড় পিঁপড়ায় হাইয়ালছে। আমার অত রোজগারের কাম নাই লো! বেইন্যালা যা কামাই অয় এইতা দিয়াই যখন সংসার চলে হারাদিন রিকশা চালাইবার বেগার ক্যারে? হোন, আজাইরা কথা কইছ না। ইতান আমার পোষাইত না।
হুছেন আলীর নিজের কাজকর্ম আর কামাইরোজগার নিয়ে হা-হুতাশ ছিল না। সে তার পেশার কাজে বরং রোমাঞ্চ অনুভব করত। সবাই যখন ঘুমে তখন শিববাড়ির মোড় জেগে ওঠে তাদের তুমুল হাঁকডাক আর ছুটাছুটিতে। হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি আর কাজের ছুটাছুটিতেই শরীর চাঙা হয়ে ওঠে। সেইসময় একটানা তিনচার ঘন্টা কাজ করলেও যেন গায়ে লাগেনা। আর এই তিনচার ঘন্টার কাজেই শ’ পাঁচেক টাকা রোজগার হয়ে গেলে আর কাজ করতে মন চাইতনা তার। ভোরবেলা কয়েক খেপ কাজের পর তারা ক’জন মিলে মোড়ের পূব পাশের রাজধানী হোটেলে বসে পরোটা ভাজির নাস্তা খেত। তারপর এককাপ রঙ চা খেয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে সেটা ফুঁকতে ফুঁকতে আবার কাজ। বেলা এগারোটা পর্যন্ত কাজ করে বন্ধুদের সাথে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিতে দিতে আরেক দফা চা নাস্তা খেয়ে, চাল-ডাল মাছ সব্জি কিনে বাসায় দিয়ে, বাসার পাশের চায়ের দোকানে বসে বিড়ি খেতে খেতে রাজা উজির মারা লোকদের গালগল্প শুনতে তার বেশ লাগত। তারপর বউএর রান্নাবান্না সারা হলে গোসল করে খেয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাক ডাকিয়ে ঘুম। সন্ধ্যার পর শিববাড়ির মোড়ের সেই বড় দোকানে গিয়ে বসে থাকলেও কিছু রোজগার হয়। বড় বড় কাস্টমারদের সদাইপাতির ভারী ব্যাগগুলো রিকশায় তুলে দিলে বিশ পঞ্চাশ টাকা করে দেয়। তাতেই চা নাস্তা আর বিড়ির খরচ দিব্যি উঠে যায়। তবে হুছেন আলী তাতে খুশি হলেও নাছিরা খুশি হতে পারে না। পাঁচ পাঁচটা ছেলেমেয়ে নিয়ে তাদের সাতজনের সংসার। অথচ সকালে একবেলা রোজগার করে লোকটার এমন ভাব যেন সে রাজা বাদশা! নিজের মর্জিমত চলে। সবকিছুতেই মর্জি খাটায়। এই এতগুলো ছেলেমেয়ের জন্মও হয়েছে তার মর্জিমতই। বুদ্ধিমান মানুষেরা এখন কেউ আর এত ছেলেমেয়ে জন্ম দেয় না। বেশি ছেলেমেয়ে জন্ম দিতে গিয়ে না তার শরীর স্বাস্থ্য ভাল থাকে, না থাকে মনের শান্তি। অভাব অনটন নিত্যদিনের সঙ্গী। কিন্তু লোকটার তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। সে নিজের ফুর্তি আর মস্তি নিয়া থাকে।
পরিবার পরিকল্পনার আপা মাসে মাসে আসে। তারা বোঝায় – ও আপা এবার একটু থামেন! ছেলেমেয়েগুলোর কী দশা করে রাখছেন বলুন তো? সংসার ছোট রাখলে ওদেরকে একটু ডিম, দুধ বা ফলমুল খেতে দিতে পারতেন! পারতেন না? শুনে নাছিরা ম্লান হাসে। বলে, হুদা আমি বুঝলে অইবগো আপা? ঐ গোঁয়ার গোবিন্দ লোকটাত কোস্তা বুঝে না।
একবার লুকিয়ে সুখী বড়ি খেয়েছিল কয়েকমাস। কি করে যেন সব জেনে যায়্ লোকটা। শুরু হয় অশান্তি। বন্ধ করতে হলো বড়ি খাওয়া। আর একবার ঐ আপারা তাকে নিয়ে হাতের চামড়ার নীচে দুইটা কাঠি ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সেটাও জেনে গেল। এদিকে রাতেত বটেই সুযোগ পেলে দিনেও রেহাই দেয়না। বলে, “হেই মাগী বিয়া কইরা আনছিলাম কি তর চিয়ারা দেহনের লাইগা?” কাল রাতেও একবারে তার আশ মেটেনি। শেষ রাতে আবারও চাইলে নাছিরা বাধা দিয়ে বলেছিল- অতলা পোলাপান জরমাইয়া অহন তারারে ঠিকমতন হাওয়াইতারো না! তাও তোমার হুঁশ নাই? কিনÍ আমিত বেহুঁশ হইতে পারুমনা। আর পোলাপানত পেটে ধরণ লাগে আমারই নাকি? অন্ধকারে হুছেন আলীর রক্তচক্ষু দেখা যায় না। তাই নাছিরা আবারও সাহস দেখিয়ে বলে, পেটের বোঝা বওন, খালাস হইলে রাইত জাগন, শীতের রাইতে আবুদ্যার হাগামুতার মাঝে লেফটাইয়া থাহনের যত কষ্ট, সবইত আমার! তোমার কী ? তোমারত খালি ফুর্তির তাল! কিন্তু আমার অহন আর ফুর্তিও লাগে না। অন্য সময় হলে নাছিরার এত সাহস বরদাশত করত না হুছেন আলী। কিন্তু তখন সে নাছোড়বান্দার মত নাছিরাকে ফুসলায়। নাছিরা সেসব আমলেও নেয়না। বলে, একটা হাছা কথা কই, হোনো! পেটে ভাত না থাকলে কোস্তা আর মজা লাগে না! এল্যাগি কই কি, অতলা ফুর্তির চিন্তা না কইরা ভাতের চিন্তা করো!
ভোরবেলার কথা মনে করে নাছিরার এখন কিছুটা অনুতাপ হয়। ধুর! অতলা কথা না কইলেই পারতাম! নিচ্চই খুব অপমান হইছিল তার। বকতে বকতে বাসা থাইকা গেছিল। তাই কি অহনো মেজাজ তিরিক্ষি হইয়া আছে? হুছেন আলীর তর্জন গর্জন শুনে মনে মনে কারন অনুসন্ধান করে নাছিরা।
নাছিরার অনুমানই ঠিক। ভোরবেলা এমন অপমানের পর হুছেন আলীর মনে হয়েছিল- ‘নাছিরার কথামত একটা রিকশাভ্যান কিনলেই অইত! মালখালাসের কাজ না পাইলেও রোজগার এমন বন্ধ অইতো না। আর তাইলে ঐ বেডির তেজ নামাইতেও দুই মিনিট লাগতনা।’ তাও হুছেন আলী আত্মপক্ষ সমর্থন করে ভাবে, রিকশা ভ্যান যে সে কিনেনি তাতে সে মন্দত কিছু ছিলনা। দিনগুলোত ভালোই কাটছিল এতদিন। পরিস্থিতি যে এমন পাল্টে যাবে তা কে জানত? তবে দিনত আর সবসময় একরকম থাকে না, একদিন নিশ্চয় আবার সুদিন আসবে। হুছেন আলী এতদিন যেসব দোকানের মাল খালাস করত সেসব দোকানের দোকান এখন বন্ধ। কেউ কেউ বলে সরকার পরিবর্তনের কারণে দেশে যে পরিবর্তন চলছে তাতেই নাকি মালিককে ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে। হুছেন আলীর মনে পড়ে আজ থেকে বাইশ তেইশ বছর আগে যখন তার বাবার সাথে এই কাজে যুক্ত হয়েছিল তখন গকুল সাহা আর গোপী রায় নামের দুই বড় ব্যবসায়ীর দোকানও হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে শুনেছিল তারা এদেশের পাট চুকিয়ে দেশান্তরি হয়ে গেছে। তবে এবার শুধু যে বাবুল পাল ও হরিলাল সাহার দোকানগুলোই বন্ধ হয়ে গেছে তাও নয় আসলাম উদ্দিন আর সোহেল মিয়ার দোকানও বন্ধ হয়ে গেছে। আর হুছেন আলী ঐ চার দোকানের মালামাল উঠানো নামানোর কাজই করত। প্রথমে শুনেছিল বাবুল পাল ও হরিলাল সাহার দোকান খোলা না হলেও আসলাম উদ্দিন আর সোহেল মিয়ার দোকান কিছুদিন পরে খুলবে। কিন্তু কোথায় কী ? প্রতিদিন সকালে কাজের আশায় শিববাড়ির মোড়ে এসে বসে থাকলেও আজ পর্যন্ত কারোর দোকান খুলেনি। তার সহকর্মী যারা অন্য দোকানের মাল টানে তারা কিছুদিন সহানুভূতি দেখিয়ে একটা দুটো কাজ তাকে দিলেও এখন আর দেয়না বরং পরামর্শ দেয় অন্য কোথাও কাজ নিতে। চালের আড়তে, কাঁচাবাজারের মোড়েও সকাল বেলা ট্রাক আসে। সেসব ট্রাক থেকেও মাল টানার অনেক কাজ আছে। গিয়েছিল সেখানে হুছেন আলী। কিন্তু সেসব কাজের জন্য আগে থেকেই লোক নিয়োজিত আছে। নতুন কারোর কাজ যোগাড় করার সুযোগ থাকবে কেন? তার ওপর সবখানেইত ব্যবসার মন্দা। ওখানকার একজন হেসে বলেছিল, পুরাণ পাগল ভাত পায় না, নতুন পাগলের আমদানি! অন্য কাজ খোঁজোগাগো ভাই! দোকান খোলার আশায় আগের মতই দিন পনেরো ধরে সেই ভোরবেলায় শিববাড়ির মোড়ে এসে বসে থাকে হুছেন আলী। আজও এসেছিল। অন্যদিন পুরনো সহকর্মীরা যে দুয়েকটা কাজ তাকে দিত সেই কাজের টাকায় সকালের নাস্তাটা খেতে পারত। আজ তাও পায়নি। তার ওপর শুনলো তার কাজের ঐ চারটি দোকানই বেদখল হয়ে গেছে। দখলদার পার্টি এখন আর ওখানে দোকান করবে না। ওগুলো ভেঙ্গে দশতলা বিল্ডিং বানাবে।
এতদিনের আশা ভেঙ্গে এভাবে ধুলিস্যাৎ হয়ে যাওয়াতে চোখে অন্ধকার দেখে হুছেন আলী। সেইসাথে তার খুব খিদেও পায়। বাকীতে নাস্তা খেতে চাওয়ায় রাজধানী হোটেলের ম্যানেজার তাকে যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করে। খিদা আর অপমানে তার মেজাজ খিচড়ে যায়। কীভাবে বাড়ি ফিরে এসেছে তার মনে পড়ে না। তার সমস্ত হতাশা রাগ ও অপমানের জ্বালা মেটাতে সে আবারও নাছিরাকেই টার্গেট করে। তবে এবার সে আঘাত করে নাছিরার শরীরে। শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে বাঁ পায়ে সে নাছিরার পেছনে একটা লাথি মারে। মেরে বলে, ‘এ্যাই হারামজাদী কইলাম না হাওন দিতে!’ ঘটনার আকস্মিকতায় নাছিরা কিছু বলতে পারে না। সে কেবল চেয়ে থাকে। হুছেন আলীর তাতে রাগ বাড়ে। সে চীৎকার করে – কিওে মাগী কথা কানে যায় না? হাওন না দিয়া ইবায় আমার পাইল ফ্যালফ্যালাইয়া চাইয়া রইছোস ক্যারে? এ্যাই হারামজাদী! আমার ভোগ লাগছে কইছি! কতবার কমু হাওন দে?
নাছিরা কী বলবে বা করবে ভেবে পায় না। সে কেবল হুচেন আলীর মুখের দিকে চেয়েই থাকে। হুছেন আলীর রাগ আরো বাড়ে। এবার সে মুখ খিঁচায়- অ! কইততন হাওন দিবি? নিজেরাত ডেগ হাইল্যা কইরা হাইয়া অহন অক্কারে ধুইয়া পাকলাইয়া পরিষ্কার কইরালছস! আমি শালা হাইলাম কি না হাইলাম ইতান চিন্তার সুমায় কই তরার !
নাছিরা আর সহ্য করতে পারে না। বলে ঘরে কত হাওন আইন্যা রাখছস, ডেগ হাইল্যা কইরা হাইয়াম! পোলাপানডিতের মুখে দিবার মত চাইল্যা হাওন ঘরো নাই। আর কয় ডেগ হাইল্যা কইরা হাইছি! নিজের কত মুরোদ আছে মাইনষে য্যান জানেনা!
কথা বলতে বলতে উঠতে যাচ্ছিল নাছিরা। কিন্তু সে দাঁড়াবার আগেই হুছেন আলী তার চুলের মুঠি ধরে হ্যাচকা টানে তুলে এনে বলে, “আমার মুরোদ নাই! কি কইতে চাস লো হারামজাদী? মুরোদ দেখবি? এ্যাই দ্যাখ!” নাছিরাকে মাটিতে ফেলে তার পিঠে কোমরে পাছায় সমানে লাথি মারতে থাকে সে। মারতে মারতে বলে, “মুরোদ দেখছস? আরও দেখবি?” ঘরের কোণায় পড়ে থাকা একটা লোহার রড হাতে তুলে নেয় হুছেন আলী। ছেলেমেয়েগুলো ঘরের ভেতরে এতক্ষণ কাঁপছিল। নাছিরার চীৎকারে তারা বারান্দার একচিলতে রান্নাঘরের মত জায়গায় এসে দাঁড়ায়। বড়টা বাপের হাত থেকে লোহার রডটা টেনে নেয়ার চেষ্টা করে আর ছোটগুলো মায়ের পিঠে ঢাল হয়ে পড়ে থাকে। এইসময় পাশের ঘরের কবীর মিয়াও দৌড়ে আসে। এসে ধমকায় হুছেন আলীকে- “এ্যাই মিয়া! পাইছডা কী? বেডিডারে অক্কারে খুন কইরা ফালাইবায়নি?” বলতে বলতে হুছেন আলীকে টেনে বাইরে নিয়ে যায় সে। হন্তদন্ত হয়ে কবীর মিয়ার বউও আসে। নাছিরাকে মাটি থেকে টেনে তোলে বলে, “কী হইছিল গো বইন? হুছেন আলীত এই সুমায় ঘরে থাহে না। অত রাগলই বা ক্যারে?” দুঃখে অপমানে নাছিরা তখনও চীৎকার করে কাঁদছিল। বড় মেয়েটা বলে, “আব্বা ঘরে আইয়া হাওন চাইল আর আম্মারে সমানে বকল। আম্মা কিছু একটা কইতেই মাইর শুরু কইরা দিল। দেহনা চাচী আব্বা এই রডের টুকরাটাও লইছিল। চাচা না আইলে আম্মারে আউজগা মাইরাই ফালাইত!” প্রতিবেশি চাচীর কাছে নালিশ শেষ কওে নাছিরার এগারো বছরের মেয়েটা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কবীর মিয়ার বউ আমিনা দুই হাতে মা মেয়েকে বুকে টেনে নেয়। তারপর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দেয়- “কান্দিস না লো বইন। হুনছ না দেশের অবস্থা অহন ভালা না! বাজারে বলে হের কাইম কাইজ নাই, রুজি রোজগার বন্ধ! মনে লয় হুছেন আলীর মন মিজাজ ঠিক না। কাউলকা হুনছিলামত এইতা লইয়া আরিজারি করতাছে! কী করবি ক? অহন এট্টু সামলাইয়া চলনত লাগবই। বইন উড!” নাছিরাকে মাটি থেকে তোলে খাটের কিনারে নিয়ে বসায় আমিনা। তাতেই নাছিরা আমিনাকে জড়িয়ে ধরে আবার ডুকরে ওঠে। আমিনা বুঝতে পারেনা কি করে সে এই রোরুদ্যমান নারীটিকে সান্তনা দেয়। হতবিহ্বল হয়ে সে কেবল নাছিরার মাথায় হাত বুলায়। নাছিরার মন কবীর মিয়া ও আমিনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় নত হয় কিন্তু দেশের এই পরিস্থিতির জন্য যারা দায়ী তাদেরকে সে চরম অভিশাপ দেয়। তবে তাদের প্রতি সে যতই অভিশাপ বর্ষণ করুক আর তাদের কারণে দেশের পরিস্থিতি যেমনই হোক হুছেন আলীকেও সে ক্ষমা করতে পারে না। সে প্রতিজ্ঞা করে হুছেন আলীকে একদিন কোনো একটা শাস্তি দেবেই দেবে! #

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!