সেদিন এক সম্পাদকের সঙ্গে সাম্প্রতিকের কবিতা বিষয়ক যে কথাবার্তা হয়েছিল, তা হুবহু এখানে তুলে ধরা হলো। কবিতা লিখতে আসা বহু তরুণ প্রজন্মের কবির ও পাঠকের কাছে তা অত্যন্ত জরুরি বিষয় বলেই মনে করি। এখানে সম্পাদকের নাম উহ্য রাখা হলো।
কবি: যে কোনও বিষয় উল্লেখ করে দিলে কি তা নিয়ে কবিতা লেখা যায়?
সম্পাদক: যায় তো! রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, কালিদাস রায় লিখেছেন, কুমুদরঞ্জন মল্লিক লিখেছেন, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন। আরও কত কবি লিখেছেন।
কবি: কবিতা তো জোর করে লেখা যায় না, হৃদয়ের তাগিদ থাকলে তবেই লেখা সম্ভব। কবিতা আপনা থেকেই অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেরিয়ে আসে। কোনও বিষয় নিয়ে জোর করে ভাবতে গেলে ঠিক কবিতা লেখা যায় না।
সম্পাদক: কিন্তু পূর্বের কবিরা তো লিখেছেন! আজকের অনেক কবিও লিখছেন। ধরুন বিষয় বলে দিলাম: নববর্ষ, শীত, বর্ষা, কোকিল, পৌষ এলো ঘরে, শান্তিনিকেতন, আকাশ, সূর্য, চাঁদ নক্ষত্র ইত্যাদি। বিষয় দেওয়া মাত্রই কবিরা গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। চমৎকার বর্ণনা, কী সুন্দর অন্ত্যমিল!
কবি: বর্ণনা-বিবৃতি আর অন্ত্যমিল যুক্ত পদ্য যে সার্থক কবিতা আজকের দিনে তা আর মানতে পারছি না। কবিতা বহুদূর এগিয়ে এসেছে তাই কবিতাকে আর আধুনিক কবিতাও বলতে পারি না। কারণ চিরদিন কবিতাকে আধুনিক বলা যায় না। সাম্প্রতিক কালের কবিতা বা পুনরাধুনিক বলা যেতে পারে। আমি বিশ্বাস কবি:‘Poetry is a deal of joy and pain and wonder, with a dash of the dictionary.’ (Khalil Gibran) অর্থাৎ কবিতা হলো আনন্দ-বেদনা ও বিস্ময়ের ডিকশনারি, যার সাথে অভিধানের একটি ড্যাশ। অর্থাৎ কবিতার অর্থ কখনও অভিধানে থাকে না।
সম্পাদক: আমি তো ফেসবুকের বেশ কয়েকটি গ্রুপের এডমিন। প্রতিদিন কবিতা প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ কবি নির্বাচন করি। শ্রেষ্ঠ কবির মানদণ্ড হলো তিনি ছন্দ ঠিক রেখে কবিতা লিখছেন কিনা। কারণ আমার কাছে কবিতাতো কবিতাই। সে কবিতা রবীন্দ্রনাথের মতোই হোক কিংবা জীবনানন্দ দাশের মতোই হোক। সুকান্ত বা সুকুমার রায়ের মতো হলেও ক্ষতি নেই। কবিতার বিষয় উল্লেখ করে দিলে কবিতা লিখতেও সুবিধা হয়। আমরা অনলাইনে সার্টিফিকেটও প্রদান করি। আপনারাই দেখছি কবিতা বিষয়টিকে জটিল করে তুলছেন।
কবি: থাক দাদা, ক্ষমা করবেন। আপনি সেইসব কবিদের নিয়ে এবং কবিতার গ্রুপ নিয়ে আনন্দে থাকুন। আমার অতটা ক্ষমতা নেই যে, যেকোনও বিষয় উল্লেখ করে দিলে সেই বিষয়ে তৎক্ষণাৎ ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লিখে দিতে পারব। কারণ আমার কাছে কবিতা এক যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা, যে যন্ত্রণা আমার আত্মার, আমার বিপন্নতার, আমার ধ্বংসের। কবিতা লেখাকে কখনোই আমি আনন্দের কাজ হিসেবে গ্রহণ করতে পারিনি। আমি এখনও বিশ্বাস করি: ‘কবিতা হল সেই জিনিস যা একটি কবিতায় আপনাকে হাসায়, কাঁদায়, নীরব করে, কখনও আপনার পায়ের নখগুলিও চিকচিক করে ওঠে, অথবা এটি আপনাকে তৈরি করে অথবা কিছুই করতে চায় না, আপনাকে জানাতে পারে যে আপনি অজানা জগতে একা, আপনার সুখ এবং দুঃখ চিরকালের জন্য ভাগ করা হয় এবং চিরকালের জন্য তা আপনার নিজেরই থাকে।’ (ডিলান থমাস)
সম্পাদক: ঠিক আছে, কিন্তু ভেবে দেখুন প্রকৃতির রূপ-সৌন্দর্য বা উৎসব-আনন্দ হৃদয়ে যে অনুভূতি জাগায় তা থেকে তো কবিতা রচিত হতে পারে। কারণ কবিতার একটি বড় দিক হচ্ছে অনুভূতি।
কবি: কথাটি অনেকাংশে সত্য। কিন্তু শুধু অনুভূতি দিয়ে কবিতা হয় না।যৎ দৃষ্টং তল্লিখিতং অর্থাৎ যা দেখছি তাই লিখছি এটা করলে কবিতার মৃত্যু অনিবার্য। ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক অস্কার ওয়াইল্ড বলেছেন: ‘All bad poetry springs from genuine feeling.’ অর্থাৎ সবচেয়ে খারাপ কবিতা আসে প্রকৃত অনুভূতি থেকেই। কেননা অনুভূতি কবিতা লেখাতে পারে না। কবিতায় মেধারও প্রয়োজন হয়। সুতরাং অনুভূতি বা বিবৃতি-বর্ণনা কবিতায় প্রয়োজন হলেও তার সীমাবদ্ধতা আছে।
সম্পাদক: তাহলে আপনি বলতে চান আজকে এত কবিতা লেখা হচ্ছে, এসব কি কবিতা নয়? কত বড় বড় অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র-ছাত্রী-গবেষক কবিতা লিখছেন, কবিতা নিয়ে গবেষণা করছেন—তাঁদের কবিতাও কবিতা নয়?
কবি: না, সকলের কবিতা কবিতা নয়। অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, শিক্ষক-শিক্ষিকা বা গবেষকরা বেশিরভাগই অ্যাক্যাডেমিক ব্যাপারটিতেই সীমাবদ্ধ থাকেন। সাহিত্যে নতুন কিছু ভাবনার অবকাশ তাঁদের কম। অর্থাৎ কবিতার ব্যাকরণের ভিতরেই তাঁরা ঘোরাফেরা করেন। ওই চিরকালীন ছন্দ এবং বর্ণনা-বিবৃতিকেই কবিতার আদর্শ হিসেবে তাঁরা মেনে চলেন। এর বাইরে তাঁরা বেরোতে পারেন না। দু-একজন দুঃসাহস দেখান, কবিতার প্ল্যাটফর্ম পাল্টে দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু বেশিরভাগই গতানুগতিক, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে কবিতা চর্চা করেন। এঁদের কবিতায় না আছে বৈচিত্র্য, না আছে নতুনত্ব। চিরকাল একঘেয়েমি কাব্য চর্চাতেই এঁরা আবদ্ধ থাকেন। সাহিত্যের স্বাস্থ্যেরও খুব উন্নতি আশা করা যায় না এঁদের দ্বারা। অনেক সময় ডিগ্রির ভারে এঁরা ভারাক্রান্ত। পদমর্যাদায় এঁরা উচ্চকিত। কিন্তু সৃষ্টির ক্ষেত্রে এঁদের দীনতা করুণা করার মতো। অধিকাংশ কবিতার গ্রুপগুলি এই রোগে আক্রান্ত। বিষয় ভিত্তিক কবিতা লেখকরা গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা লিখে চলেছেন, অথচ সেইসব কবিতাগুলি সাহিত্যের কোনও নতুন দিকদর্শনে উন্নীত হতে পারছে না। এই ভাবনা টুকুও তাঁদের নেই।
সম্পাদক: আপনার কথা শুনে হতাশ হলাম। যাঁরা সাহিত্যের শিক্ষক তাঁরা যদি সাহিত্যিক না হন, তাহলে আমরা কার উপর ভরসা করব? কবিতার মূল্যায়ন তো তাঁরাই করেন! তাঁরাই তো ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করেন। এমনকী কবিও তৈরি করেন।
কবি: আপনার ধারণা একবারে ভুল। সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলেন অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা। তাঁরা সাহিত্যের নতুন ধারণাকে নস্যাৎ করে দেন। প্রাচীনকে আঁকড়ে ধরে থাকেন। ব্যতিক্রম অধ্যাপক ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। তিনি কাল বা সময়ের কবি, বিবেক বা চৈতন্যের কবি,আবার কবিদেরও কবি। কিন্তু তাঁর পরেও আজকের বহু কবি সময় বা কালকে, চেতনা বা আধুনিকতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা হয়ে উঠেছেন মহাকালের কবি। মহাবিস্ময়ের কবি। মহাজীবনের কবি। আমরা অনেক সময়ই অজ্ঞতার কারণে এঁদের দূরে সরিয়ে রেখেছি। সময়ান্তরে এঁদের নিয়ে আলোচনা করব।
সম্পাদক: আধুনিক বলতে আপনি কী বোঝেন? আপনিও কি তাহলে আধুনিক নন? কবি মাত্রই তো আধুনিক!
কবি: হ্যাঁ, কবি মাত্রই আধুনিক অবশ্যই, কিন্তু সেই আধুনিক ব্যাপারটিও বহু পুরনো একটা ধারণা। রোমান্টিকতার অবসান ঘটিয়ে বাস্তবতাকে গ্রহণ করার জন্যই কবিরা কবিতায় বিজ্ঞান, যুক্তি, সত্যতা, মানবতা, যৌনতা, মনস্তত্ত্ব ফিরিয়ে আনেন। মানুষের অধিকার, মানুষের দুঃখ-কষ্ট, দারিদ্র, জীবনযাপন, স্বপ্নভঙ্গ, বিচ্ছিন্নতা, নাগরিক যন্ত্রণা, বঞ্চনা, শোষণ, পীড়ন নিয়ে কবিতা লেখেন। কবিতায় বাস্তবতা আনতে চাঁদের ঝলসানো রুটি থেকে চাঁদের কাস্তে হওয়া রূপটিও দেখা যায়। নর্দমা থেকে ইঁটের উনানে রাস্তার ধারে রান্না করার ছবি উঠে আসে। ডিমের ভাঙা খুলি থেকে কাঁঠালের ভূতি পর্যন্ত শব্দগুলি ব্যবহৃত হতে থাকে। উলঙ্গ মানুষের গান থেকে মাথার খুলি পর্যন্ত কবিতার চিত্রকল্পে আশ্রয় পায়। লোনা চোখের জলে ভিজে যায় বুকের বসন। পরনারীর সঙ্গেও সঙ্গম বৈধ হয়ে ওঠে। আবার মিছিলের হাতও স্লোগানমুখর বিদ্রোহীর অস্ত্রে পরিণত হয়। দেশভাগের যন্ত্রণা, উদ্বাস্তু জীবনের প্রতিচ্ছবি, বিশ্বযুদ্ধোত্তর ক্লান্তি ও বিষণ্নতা মানুষকে গ্রাস করে। কবিতার এইসব বিষয় বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে দেখা দিল। আধুনিকতার অস্ত্র ভোঁতা হয়ে গেল। কবিরা পথ খুঁজতে শুরু করলেন।
সম্পাদক: কী সেই পথ? মানুষ ছাড়া কি আর কোনও পথ থাকতে পারে?
কবি: সেই পথ মানুষের আদিম প্রবৃত্তির। অবদমিত চেতনার। যা সামাজিক নয়, যা স্বীকৃত নয়, যা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট নয়। অথবা এমনও পথ, যার কোনও বিষয় নেই,যা নাথিংনেস্। যার অবস্থান এম্পটিনেস্-এর মধ্যেই। শুধু শূন্যতার বাজনা। মুম্বাইয়ে বসবাসকারী এ যুগের তরুণ কবি সানোবের খানও তখন লিখতে পারেন:
“My dear, I have nothing to say.
my heart burns
like the evening sky.”
অর্থাৎ আমার প্রিয়, আমার কিছু বলার নেই। আমার হৃদয় সন্ধ্যার আকাশের মতো জ্বলে।
কবির কিছু বলার না থাকলেও তার উত্তাপ ঘনীভূত হয়ে ওঠে। পাঠকও তা উপলব্ধি করতে পারে। এই সময়ের আর এক কবি গোলাম রসুলও ‘শূন্যের চেয়ে শূন্য’ কবিতাতে তিনি লিখেছেন:
“শূন্যের চেয়েও আমি শূন্য হয়ে যাই
আলো পার হয়ে দেখি আমার হৃদয়
যে অনুসরণে তৈরি করে নিয়েছি ভালোবাসা আর স্নেহ
শরীরের ভেতর কেঁপে ওঠে পৃথিবী
প্রতিটি হিংসা ধারালো হতে হতে আত্মহত্যা করে।”
এই বোধকে তখন আমরা আর আমাদের সামর্থ্য দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি না। কীভাবে তা ঘটে যায়, কোন্ শক্তিতে তা সচল হয় তা আমাদের ধারণাতীত এক ক্রিয়াসংযোগ। তখন মনে পড়ে যায় অস্ট্রিয়ান নিউরোলজিস্ট, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, দার্শনিক, লেখক এবং হলোকাস্ট থেকে বেঁচে ফেরা ও লোগোথেরাপির প্রতিষ্ঠাতা ভিক্টর এমিল ফ্রাঙ্কল (১৯০৫-১৯৯৭)-এর একটি উক্তি: “An abnormal reaction to an abnormal situation is normal behavior.”
(Victor Frankl, Man’s Search for Meaning)
অর্থাৎ একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে একটি অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াই হলো স্বাভাবিক আচরণ। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি শুধু আমাদের বাস্তব পৃথিবীতে নয়, আমাদের মনোজগতেও নানা ভাঙচুর সৃষ্টি করেছে। যেখানে সদর্থক কোনও মূল্যবোধ নেই। স্বাভাবিকভাবেই কবিও অশ্রয়চ্যুত। আর সেই কারণেই একটি নিজস্ব জগৎ সৃষ্টি করেছেন যা বিনির্মাণ হিসেবেই সাম্প্রতিক কাব্যকলায় প্রকাশিত। তাই মহাজাগতিক মহাবিস্ময়ের ব্যাপারটি আজকের কবিরা লালন করেন। শুধু এই পৃথিবী নয়, তাঁরা মহাপৃথিবীর নাগরিক। গোলাম রসুল আরেকটি কবিতায় লিখেছেন:
“অন্তরঙ্গ জল বয়ে যাচ্ছে বায়ুমণ্ডল দিয়ে নীরবে” (বিমূর্ত বই)
অন্তরঙ্গ জল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেরই জল হয়ে যায়। পাঠক এখানে কোন বিষয় খুঁজে পান?
কবিরা যে বিষয়ের বাইরে তাঁর আত্মাকে পৌঁছে দিতে পেরেছেন, তার আত্মযন্ত্রণাকে ব্রহ্ম যন্ত্রণায় রূপ দিতে পেরেছেন তা বলাই বাহুল্য। শূন্যতাকে বর্ণনা করতে গিয়ে আমেরিকান বিখ্যাত লেখক জ্যাকসন পিয়ার্স (১৯৮৪) লিখেছেন:
“It is beautiful, it is endless, it is full and yet seems empty. It hurts us.”
(Jackson Pearce, Fathomless)
অর্থাৎ এটা সুন্দর, এটা অন্তহীন, এটা পূর্ণ এবং এখনও খালি মনে হয়। এটা আমাদের কষ্ট দেয়।
এই বোধের ব্যাপ্তি বাস্তব পৃথিবীর ক্ষুন্নিবৃত্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি তা অনন্তজীবনের উপলব্ধির স্বয়ংক্রিয়তায় পর্যবসিত হয়েছে। সুতরাং মুহূর্ত মহাকালেরই অন্বয় রচনা করে চলেছে। এই কবিতাই চর্চা করার মধ্যেই কবিরা তাঁদের মুক্তি খুঁজছেন।
সম্পাদক: আর কিছুই শুনতে চাই না। আপনার বক্তব্য অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। কবিতা চর্চাও যে এক রীতিমতো মেধাবী কাজের মধ্যেই পড়ে সেটা এই মুহূর্তে কিছুটা আঁচ করতে পারলাম। এখন এটাও বুঝতে পারছি, কবিতার নামে বেশি অকবিতাই লেখা হয়, যেগুলিতে কোনও উৎকর্ষ চোখে পড়ে না। গতানুগতিক পথেই এইসব কবিতা একঘেয়েমি ও জড়ত্বের জন্ম দেয়।♣