আমি যেখানে রয়েছি, তার থেকে অল্প কিছুটা দূরে ধীরে ধীরে ‘স্বর্গের রথ’ এসে দাঁড়াল। আমার পাশে স্বর্গের রথ দেখে চমকে গেলাম আমি। আসলে
এর আগে আমি কখনও স্বর্গের রথ দেখিনি। স্বর্গের রথ দেখতে কেমন, কীরূপ তার আকার-আকৃতি, লম্বা কত, চওড়া কত, উচ্চতা কত, রথের রং কেমন… এসব কিছু অজানা ছিল আমার কাছে। কী দিয়ে তৈরি, ক’টা চাকা আমি তা জানতাম না। আমার পাশেই স্বর্গের রথ দাঁড়িয়ে থাকায় আমি স্বর্গের রথকে ভালোভাবে দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলাম না। স্বর্গের রথকে দু’চোখ ভরে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি স্বর্গের রথের একদম কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে স্বর্গের রথকে দেখতে লাগলাম। নিজের চোখে স্বর্গের রথ দেখার সৌভাগ্যে আমার মনের ভেতর আনন্দ খেলতে লাগল।
আমি বালুরঘাটে আসার সময় আমার সঙ্গে ছিল আমার বয়স্ক, অসুস্থ বাবা,আমার মামাতো দাদা খোকনদা, আর তিনজন প্রতিবেশী উপেন কাকা, যোগেশ কাকা ও কোয়েল বৌদি। খোকনদা অনেকটা দূরে এক জায়গায় একা বসে মনোযোগ সহকারে হাসপাতালকে দেখছিল। কোয়েল বৌদি আমার বাবাকে ভালোভাবে হাত দিয়ে ধরে আমার পাশে চুপচাপ বসেছিল। যোগেশ কাকা উপেন কাকার থেকে বয়সে বড়। উপেন কাকা এবং যোগেশ কাকা দু’জনে আমার থেকে কিছুটা দূরে ফাঁকা জায়গায় ঘাসের ওপর বসেছিল।
আমি শুনতে পেলাম, যোগেশ কাকা উপেন কাকাকে বলল, “বুঝলি উপেন, পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে কোটি কোটি বছর আগে। পৃথিবী আরও কোটি কোটি বছর ধরে চলতে থাকবে। কোটি কোটি বছরের মধ্যে একটি মানুষের প্রাপ্য মাত্র পঁয়ষট্টি বছর। কারণ বর্তমানে মানুষের গড় আয়ু পঁয়ষট্টি বছর। কোটি কোটি বছরের মধ্যে মাত্র পঁয়ষট্টি বছর খুবই নগণ্য সময়, খুবই সামান্য সময়। এত অল্প সময়ের মধ্যে একটি মানুষের পৃথিবীর বুকে নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করাটা ভীষন কঠিন।”
উপেন কাকা বলল, “যোগেশদা, তুমি ঠিকই বলেছ। মানুষ জীব শ্রেষ্ঠ। অথচ জীবশ্রেষ্ঠ মানুষের জন্য পৃথিবীতে খুবই কম সময় ধার্য করা আছে। এটা বেমানান। এটা অন্যায়।”
আরও পড়ুন: শ্রীমতি একটি মেয়ের নাম (প্রথম পর্ব)
যোগেশ কাকা বলল, “মানুষের গড় আয়ু পঁয়ষট্টি বছর হলেও মানুষের কাজ করার সময় মাত্র কুড়ি বছর। শরীর সুস্থ রাখতে একটি মানুষের এক দিনে অর্থাৎ চব্বিশ ঘণ্টায় আট ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। সেই হিসেবে একটি মানুষ পঁয়ষট্টি বছর বাঁচলে মানুষটি প্রায় বাইশ বছর ঘুমিয়ে কাটায়। পঁয়ষট্টি বছর থেকে বাইশ বছর বাদ দিলে বাকি থাকে তেতাল্লিশ বছর। তেতাল্লিশ বছরের মধ্যে মানুষের শিশুকাল ও কৈশোরকাল থাকে সতেরো বছর। এই সময়ে মানুষ নাবালক থাকে। তাহলে তেতাল্লিশ বছর থেকে সতেরো বছর বাদ দিলে অবশিষ্ট থাকে ছাব্বিশ বছর। পাঁচ বছর বৃদ্ধকাল। ছাব্বিশ থেকে পাঁচ বাদ দিলে বাকি থাকে একুশ বছর। এই একুশ বছর হলো একটি মানুষের কাজ করার জন্য ধার্যকৃত সময়। একুশ বছরের মধ্যে একটি মানুষকে যা কাজ করার তা করতে হয়। মানুষের হাতে খুবই অল্প সময়।”
উপেন কাকা বলল, “মানুষ প্রকৃতির কাছে বড্ড অসহায়। প্রকৃতি মানুষকে যা দেয়,তা আবার কেড়ে নেয়। প্রকৃতি মানুষকে প্রাণ দেয় আবার সেই প্রাণ কেড়ে নেয়।”
উপেন কাকা আবার বলল, “পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর ঘোরে। পৃথিবী আবার সূর্যের চারদিকেও ঘোরে। পৃথিবীর সাথে-সাথে আমরাও ঘুরি। পৃথিবী মানুষকে ঘোরাতে-ঘোরাতে বড় করে তোলে,আবার ঘোরাতে-ঘোরাতেই মানুষকে মেরে ফেলে।”
যোগেশ কাকা বলল, “আমার তো মনে হয়, প্রকৃতির একটা নির্দিষ্ট নিয়ম হলে খুব ভালো হতো। কমপক্ষে একটা নির্দিষ্ট বছর অবধি প্রতিটি মানুষ সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বাঁচবে, তারপর তার ভালো কাজের নিরিখে তার পরবর্তী বাঁচার বয়স নির্ধারিত হবে। সেটা না করে দিন নেই, ক্ষণ নেই, যে কোনও সময়ে, যে কোনও বয়সে প্রকৃতি মানুষকে মেরে ফেলে।”
উপেন কাকা বলল, “মানুষের গড় আয়ু পঁয়ষট্টি ধরলে মানুষের আয়ুষ্কাল মাত্র পঁয়ষট্টি বছর। কিন্তু মানুষের আয়ুষ্কাল এত কম হওয়া একদমই সঠিক নয়। যেহেতু মানুষ জীবদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ,তাই মানুষের বেশি দিন বাঁচার অধিকার আছে। মানুষের সেই অধিকার পাওয়া উচিত।”
উপেন কাকা বলল, “ক্রিকেট খেলায় যেমন প্রতিটি বলে ব্যাটসম্যানের মৃত্যু লেখা থাকে, তেমনই প্রতিটি সেকেন্ডে মানুষের মৃত্যু লেখা থাকে। ক্রিকেট খেলায় ব্যাটসম্যান একবার ‘আউট’ হয়ে গেলে সেই ম্যাচে ব্যাটসম্যানের আর দ্বিতীয় বার খেলার সুযোগ থাকে না, পৃথিবীতে একবার কেউ মারা গেলে দ্বিতীয় বার সেই মানুষের আর জন্মগ্রহণ করার সুযোগ থাকে না। অবশ্য কিছু জাতিস্মরদের ঘটনা ব্যতিক্রমী ঘটনা।”
যোগেশ কাকা বলল, “ফুটবল খেলায় একবার ‘গোল’ হলে সেই ‘গোল’ শোধ করার সুযোগ থাকে। মানুষের জীবন ফুটবল খেলার মতো হওয়া উচিত। মৃত্যু হলেও আবার একই রূপের জন্ম হওয়ার সুযোগ পাওয়া উচিত।”
আমি উপেন কাকা এবং যোগেশ কাকার সব কথাই শুনতে পেলাম। আমি দু’কাকার উদ্দেশ্যে বললাম,”কাকা, কারও ইচ্ছে না থাকলেও স্রষ্টা তাকে ওপরে তুলে নেয়। আবার কেউ নিজের মৃত্যু চাইলেও, সরকারের কাছে মৃত্যুর জন্য আবেদন করলেও স্রষ্টা তাকে মৃত্যু দেয় না। স্রষ্টা ভীষন স্বেচ্ছাচারী।
চলবে…