আমি ‘খনগান’ শুনে বাড়ি ফিরছিলাম। খনগান হলো দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী লোকগান। এই লোকগান গোলাকার জায়গায় পরিবেশন করা হয়। বাদ্যকাররা গোল জায়গার একদম মাঝখানে বসে বাদ্যযন্ত্র বাজায়। তারপর দু’হাত বৃত্তাকার জায়গা ফাঁকা রাখা হয়। এরপর দর্শকরা বৃত্তাকারে বসে। বাদ্যকারদের পরে দু’হাত ফাঁকা বৃত্তাকার জায়গা হলো মঞ্চ। এই বৃত্তাকার মঞ্চে খনগান পরিবেশন করা হয়। ‘খন’ কথার অর্থ ক্ষণ, মুহূর্ত বা তাৎক্ষণিক। বর্তমান সময়ের কোনও ঘটনাকে কেন্দ্র করে খনগান করা হয়। আমার বাড়ি থেকে পাঁচ-সাত কিলোমিটার দূরে জোড়দিঘি নামে এক জায়গায় খনগানের আসর বসেছিল। আমি ‘খনগান’ ভালোবাসতাম। আমি হেঁটে-হেঁটে পাকা রাস্তার একধার ধরে বাড়ি ফিরছিলাম। আমি সুন্দর লাল রঙের একটি শাড়ি পরেছিলাম। নখে লাগিয়ে ছিলাম নেলপালিশ,চোখে দিয়েছিলাম কাজল। শ্যাম্পু করা চুলে ক্লিপ দিয়ে সুন্দর করে সেঁজেছিলাম আমি। আমার বয়স চল্লিশ বছর। আমি ধীর পায়ে রাস্তা হাঁটছিলাম আর গুনগুন করে খনগান গাইছিলাম… ‘বাড়ি ঘরের কামলা স্বামী/গেল্লেন কুনঠিন/ভাদরের বেলা আদরে আদরে/স্বামী জাছেরে চলিয়া/বাড়ি ঘরে মন নাই তোমার/হবেন কি দেউলিয়া।’
সামনে দিয়ে একটি বাইক আসছিল। বাইক চালাচ্ছিল এক যুবক ছেলে। ছেলেটি তার বা’দিক ধরে আসছিল। একটি মাঝ বয়সী লোক সাইকেল চালিয়ে তার বা’ দিক ধরে এগিয়ে আসছিল। সাইকেলের কাছাকাছি এসে যুবকটি সাইকেল চালককে সতর্ক করতে বাইকের হর্ণ দিয়েছিল। হর্ণ শোনার সঙ্গে-সঙ্গে সাইকেল চালক লোকটির সাইকেলের হ্যান্ডেল বাইকটির দিকে বেঁকে যায়। বাইকটি সাইকেলে গিয়ে ধাক্কা মারে। সাইকেল চালক সাইকেল নিয়ে রাস্তার একপাশে পড়ে গিয়েছিল। বাইক চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমাকে এসে বাইকটি লাগিয়ে দিয়েছিল।
আমি আমার পেছন দিকে পড়ে গিয়েছিলাম। রাস্তার ধারে কয়েকটি ইট পড়ে ছিল। আমার পিঠটা ইটগুলোর ওপরে পড়েছিল। ইটগুলোর আঘাতে আমার দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রাস্তার ধারে মূমুর্ষূ অবস্থায় পড়ে ছিলাম আমি। খবর পেয়ে খোকনদা, উপেন কাকা, যোগেশ কাকা, কোয়েল বৌদি ছুটে এসেছিল। প্রথমে তারা আমাকে রসিদপুর প্রাথমিক স্বাস্থ কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে ভর্তি না নেওয়ায় আমার বাবাকে সাথে নিয়ে খোকনদা, কোয়েল বৌদি,উপেন কাকা ও যোগেশ কাকা আমাকে ট্যাক্সি করে বালুরঘাট সদর হাসপাতালে নিয়ে চলছিল। হাসপাতালে পৌঁছানোর ঠিক আগে রাস্তার মধ্যে মারা গিয়েছিলাম আমি। হাসপাতালে নিয়ে গেলে হাসপাতাল আমাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছিল। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছিল,আমার দেহের পোস্টমর্টেম হবে। পোস্টমর্টেম ছাড়া আমার মৃতদেহকে দেওয়া সম্ভব নয়। পোস্টমর্টেম করতে বিকেল পাঁচটা বাজবে। এটা দুপুর একটার ঘটনা। তখন থেকে আমরা হাসপাতালে রয়েছি।
আমার দেহের পোস্টমর্টেম হোক, আমার শরীরের কাটাছেঁড়া হোক, এটা আমি চাইছিলাম না। আমি আমার দেহকে খুব ভালোবাসি। কতটুকু ভালোবাসি, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল। আমি আমার দেহকে খুবই যত্ন করতাম। ত্বককে সতেজ এবং উজ্জ্বল রাখতে নিয়মিত পাতিলেবুর রস খেতাম। শরীরের বলিরেখা দূর করার জন্য দেহে আমন্ড তেল ব্যবহার করতাম। দেহে রক্ত সরবরাহ ঠিকমতো রাখার জন্য এবং ত্বকের পুষ্টির জন্য আমি নিয়মিত বেদানা খেতাম। ত্বককে মসৃন ও টানটান রাখতে প্রতিদিন দই খেতাম। দেহে যাতে প্রোটিনের ঘাটতি না পড়ে, সেজন্য এবং ত্বক, চুল ও নখকে ময়শ্চারাইজ রাখতে আমি প্রতিদিন একটা করে ডিম খেতাম। নিজেকে ফ্রেস রাখতে প্রচুর শাকসবজি ও পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খেতাম। শরীরকে সবল রাখতে আমি ব্যায়াম করতাম ও প্রতিদিন সকালে আমি প্রাতঃভ্রমণ বের হতাম। আমার দেহে সামান্য আঘাত লাগলে, কেটে ছড়ে গেলে আমি ভীষণ অস্থির হয়ে উঠতাম। ডাক্তার না দেখালে স্থির থাকতে পারতাম না। আমার দেহের খুব সামান্য রক্তপাত ঘটলে, মনে খুব কষ্ট পেতাম, ভীষণ যন্ত্রণা পেতাম। আমি খুবই মনোযোগ সহকারে আমার শরীরকে সাঁজাতাম। প্রতিদিন আমার দু’চোখে সুন্দর করে কাজল পড়তাম। মুখশ্রীকে আরও সুন্দর করার জন্য, ফর্সা হওয়ার ক্রিম রাখতাম। মাঝে- মাঝে গালে পাউডার লাগিয়ে নিজেকে সুন্দর করে সাঁজাতাম। দেহকে সুস্থ রাখতে সঠিক সময়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। বাড়িতে সুগার মেসিন, রক্তচাপ বসানোর মেসিন কিনেছিলাম। নিয়মিত সুগার ও রক্তচাপ মাপতাম। শীত-গ্রীষ্ম প্রতিদিন স্নান করে দেহকে সতেজ, তরতাজা রাখতাম। রঙিন নাইটি পরতাম,গাঢ় রঙের চুড়িদার পরতাম, গাঢ় রঙের শাড়ি পরতাম। চুলে নিয়মিত শ্যাম্পু দিতাম। আমার বয়স বাড়লেও মনের বয়সকে বাড়তে দিতাম না। প্রতিদিন ঠোঁটে মানানসই লিপস্টিক পরতাম, নখে নেলপালিশ, নাকে নত, কানে দুল পরে সকাল-সন্ধে আমি আয়নার সামনের দাঁড়িয়ে আমার নিজের রূপকে দেখতাম, নিজের সৌন্দর্যকে দেখতাম। অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “শ্রীমতি,তুই নিজের দেহের এত যত্ন করিস কেন,এত পরিচর্যা করিস কেন?” আমি বলেছিলাম, “আমি আমার শরীরকে, আমার দেহকে খুবই ভালোবাসি,তাই।” তাই আমি চাই না আমার দেহের পোস্টমর্টেম হোক, আমার দেহের কাটাছেঁড়া হোক।
আমি জানি, সব জায়গায় সন্তানদের ক্ষেত্রে অন্যদের থেকে বাবামায়ের কথার গুরুত্ব অনেক বেশি। বাবামায়েরা যে কথা বলে, সেই কথা লোকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে। তাই প্রথমে আমি বাবাকে গিয়ে বললাম, “বাবা, ডাক্তারবাবুর কাছে তোমার কথার গুরুত্ব অনেক বেশি। বাবা, তুমি যদি একবার ডাক্তারবাবুকে অনুরোধ করো, আমার পোস্টমর্টেম না করানোর জন্য, তাহলে হয়তো ডাক্তারবাবু তোমার কথার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আমাকে পোস্টমর্টেম নাও করতে পারে।” বাবা আমার কথার কোনও গুরুত্ব দিল না। তার জায়গা থেকে উঠল না। কোনও রূপ নড়াচড়া করল না। যে-জায়গায় বাবা চুপচাপ, মনমরা হয়ে বসেছিল, সেই জায়গায় বাবা একইরকম নিশ্চুপ,মনমরা হয়ে বসে রইল। আমি ভীষণ হতাশ হয়ে পড়লাম। আমি নিরাশ হয়ে গাছের নিচে আবার আগের জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। দেহের পোস্টমর্টেমের জন্য আমার বুকের মধ্যে খুব ব্যথা হচ্ছিল,কষ্ট হচ্ছিল। যন্ত্রণা অনুভব করছিলাম আমি।
চলবে…