গল্প: শ্রীমতি একটি মেয়ের নাম ৫

।।পাঁচ।।

অগ্রগতি সংঘে নবমীর পরের দিন রাতের বেলা আমি স্বপ্নে আবির ও তার বন্ধু তুহিনকে দেখেছিলাম। তারা দু’জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে কোথাও যাচ্ছিল। আমি সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে-হেঁটে আসছিলাম। আমার চুল সাদা, হাত-পা সাদা, আমার সমস্ত শরীর সাদা। আমার কাছাকাছি আসতেই ওরা দু’জন আমাকে দেখে চমকে উঠেছিল।
আবির তুহিনকে বলেছিল, ‘তুহিন, দেখ, এটা তো সেই অগ্রগতি সংঘের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শ্বেতপাথরের স্ট্যাচু। সেই মুখ, সেই চোখ, সেই চুল, সেই নাক, সেই শরীর। কিন্তু স্ট্যাচুটি চলাফেরা করছে কীভাবে? হাঁটা-চলা করছে কীভাবে?’
তুহিন বলেছিল, ‘ঠিক তো। এটা তো অগ্রগতি সংঘের দুর্গাপুজোর শ্বেতপাথরের স্ট্যাচু। স্ট্যাচু তো জড় বস্তু। স্ট্যাচু তো নড়াচড়া করতে পারে না। তাহলে স্ট্যাচুটি হেঁটে-হেঁটে আসছে কীভাবে! এটা তো অসম্ভব!’ আমি স্বপ্নের ভেতর লোকের সাথে কথা বলছিলাম, হাসছিলাম। আমার কথা বলা দেখে, আমার হাসি দেখে ওরা দু’জন ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল। আমি আড়চোখে খেয়াল করেছিলাম, আবির ও তুহিন একটা গাছের পেছনে লুকিয়ে গিয়েছিল এবং গাছের আড়াল থেকে তারা দু’জন আশ্চর্য চোখে লুকিয়ে-লুকিয়ে আমাকে দেখছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম,ওরা দু’জন চুপিসারে আমার পিছু নিয়েছিল। আমি স্বপ্নের ভেতর দোলনায় বসে দোল খাচ্ছিলাম, আমি ঝরনার জলে গা ভিজিয়ে স্নান করছিলাম। ওরা অবাক চোখে আমাকে দেখছিল। আমি শুনতে পেয়েছিয়াম, আবির তুহিনকে বলেছিল, ‘তুহিন,তবে যাই বলিস, আমাদের দেখা শ্বেতপাথরের স্ট্যাচুটিকে হাসতে দেখে, খেলতে দেখে, হাঁটাচলা করতে দেখে, কথা বলতে দেখে, ঝরনার জলে স্নান করতে দেখে আমার কিন্তু খুবই ভালো লাগছে, আমার ভেতরে ভীষন আনন্দ হচ্ছে, খুবই খুশি লাগছে। আমি স্বপ্নের মধ্যে শুনতে পেয়েছিয়াম,ঝরনার জলে আমার স্নান করা দেখে আবির বলে উঠেছিল, ‘অপুর্ব! খুবই সুন্দর! অসাধারণ!’

আবির কোথায় থাকে, কী তার পরিচয়, তার বাবা–মায়ের নাম কী কিছুই আমি জানি না। শুধু তারা দু’বন্ধু মিলে যখন আমার নারী-স্ট্যাচুর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, তখন তাদের নামগুলো শুনেছিলাম। আমি যখন বেঁচে ছিলাম,তখন আমি আবিরকে অনেক খুঁজেছি, অনেক সন্ধান করেছি কিন্তু তার খোঁজ আমি পাইনি। আমার মনে হয়, আবির ও তুহিন ধুপগুড়ির বাইরে কোনও জায়গা থেকে বাইক নিয়ে প্রতিমা দেখতে এসেছিল। অনেক বন্ধুরা কিন্তু এমন বাইক নিয়ে দূর দূরান্তে প্রতিমা দেখতে যায়।

আরও পড়ুন: শ্রীমতি একটি মেয়ের নাম ৪

আমি বিয়ে করিনি। মা-হারা আমাকে আমার বিয়ের কথা বাবা আমাকে অনেকবার বলেছিল। বাবা বলত, ‘শ্রীমতি,বিয়ে কর। আমি আর কতদিন বাঁচব? আমার ভরসায় আর ক’দিন থাকবি? সারাজীবনটা তুই একা একা কীভাবে কাটাবি?’
বাবার কথাতে বিয়েতে আমি সম্মত হইনি।
অগ্রগতি সংঘে সেদিন আমি এত সুন্দর ভাবে সেঁজেছিলাম, এত নিখুঁত রূপে নিজেকে রূপ-দান করেছিলাম যে, যে-কেউ আমাকে দেখলে প্রথমে আমাকে স্ট্যাচু মনে করবে। সেদিন আমি এত দক্ষতার সঙ্গে, এত পরিপক্কতার সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম যে, যে-কেউ আমাকে হঠাৎ করে দেখলে আমাকে শ্বেতপাথরের স্ট্যাচু-ই ভাববে। উপরন্তু, সেদিন প্যান্ডেলের ভেতরে ও বাইরে আলোকসজ্জা এমন মায়াময় ছিল যে, সেই আলোকসজ্জায় আমাকে পাথরের স্ট্যাচু ভাবাটা স্বাভাবিক ছিল। আমি আমার দুটো হাত দিয়ে বেশ ভালো ভাবে আমার মুখ-চোখ ঢেকে রেখেছিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে থাকতে পারলাম না। আমি ধীরে-ধীরে দুটো আঙুল ফাঁক করলাম। দুটো আঙুলের ফাঁক দিয়ে আমি দেখলাম, আমার দেহ মর্গের কাছাকাছি পৌঁছল।

আমি আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম, আমার দেহকে মর্গের মধ্যে ঢোকাতে লাগল। আমি আর ঠিক থাকতে পারলাম না। আমি চোখ থেকে আমার হাত দুটো সরিয়ে‌ নিলাম। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, ‘ডাক্তারবাবু, আমার শরীরকে কাটাছেঁড়া করবেন না। আমার দেহকে ব্যবচ্ছেদ করবেন না। আমার শরীরকে দ্বি-খন্ডিত করবেন না। আমার দেহের মধ্যে আবিরের দেওয়া প্রাণ আছে, আমার শরীরের ভেতর আবিরের দেওয়া জীবন রয়েছে।’

কেউ আমার কথা মানল না, কেউ আমার কথাকে পাত্তা দিল না। আমার কথার কোনওরূপ গুরুত্ব না দিয়ে আমার দেহকে মর্গের ভেতর প্রবেশ করাল। আমার চোখের সামনে মর্গের দরজা বন্ধ করে দিল। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, ‘ডাক্তারবাবু, আবির আমার দেহে প্রাণ-দান করেছিল, আবির আমার শরীরে জীবন-দান করেছিল।’

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!