মাটির গান গাইতে গাইতে নোনাজলে ভেসে বেড়ায় মদন, ছমির মিঞারা। প্রকৃতি কাড়ে তাদের সুখ-স্বপ্ন-আশা-ভরসা। নোনাস্রোতে ভাঙনের সাক্ষী হয় রোজ রোজ। রাত নামলে ছমিরের চোখে ভাসে মেয়ে গোলাপির মুখ। শোনে বিবির অসহায় কান্না।কালক্রমে বাঁজা হারামনি শোনে নারী জীবনের কাঙ্খিত মা ডাক। নোনা জল শোনায় নিখোঁজ হওয়া মানুষের গল্প। আখ্যান জড়িয়ে বাঁচে বিপন্ন লোকসংস্কৃতি, অলৌকিক বিশ্বাস, গ্রাম্য নরনারীর প্রেম, অকাল শোক। ‘নোনা মাটির নোলক’ বস্তুত সমাজ, লোকসংস্কার ও রাজনৈতিক পালাবদলের প্রেক্ষিতে গ্রামীণ বিভাজনের দৃশ্যলিখন, ভাঙনের গান।
প্রথম পর্ব
মাতলা নদীর শান্তো চরে গেরাম সারি সারি
নুইকে থাকে নদীর জলে কুমুর কামোট কাঁড়ি
নদীর জলে জেবোন ভাসে নদীই হানে মরোণ
মাতাল হাওয়া বুকিতেনে তোলে সুদু কাঁপোন।
ছপাৎ ছপাৎ দাঁড়ের আবাজ তোলে ছমির মাঝি
নোনাগাঙে ভেসে ব্যেড়ায় সোকাল বিকেল সাঁঝি
আগাশ এসে নুইটে পড়ে নোনা জলের গায়
নদীর বুকি বান ডেকেচে স্বপোন ভেসে যায়।
বিবির কোতা মনে হলি নাগে ঝ্যেনো এ্কা
ভাটিয়ালি গান ভেসে যায় মনটা তেবু ফাঁকা
মনে পড়ে এ্যাকোনো যে পেতোম দেকার দিন
হাতের ওবর অক্সোকাটা নোজ্জায় আঙা সিন।
মাতায় বাঁদা সোবজে গামচা চোকিতেনে নেশা
নোনা বাতাস গায়ে নাগে মনে পেমের আশা
ত্যেকোন আমার বয়োস ষোলো ওরে জানের জান
তোর পিরিতি ভাসবে বলে পাণ করে আনচান।
এরোমকোরে পেতোম দেকা ভুলতি কি আর পারে
চোকাচোকি সুকির ঝিলিক খলসে পাতা নড়ে
ফুলি ফুলি ছুটে ব্যেড়ায় বুনো অলির দল
ঘুমির ঘোরে স্বপোন আঁকে বাজে দুপায় মল।
পাশের বাড়ির নূরোর আম্মায় ডাকে ছলেমা বুন
পান খাবারে মনির বাপটা হোবা কি এট্টু চুন?
ও শোনা বুন দুকির কোতা কি আর বলি তোর
ভাত জোটাতি হিমসিম খাচ্চি কষ্টো জেবন ভোর!
পড়ে আচে পানের ডিব্বা পড়ে আচে জাঁতা
সোংসার চলে নদীর বুকি ধোরে চিংমড়ির মেতা
ভাঙা ব্যেড়ার ঘরে আচি বানে ভাঙে ঘর
ককোন বাদে কালবৈশাখী নোনা বুকির চর।
নদীর টানে জেবোন ভাসাই করি না ভয় ডর
ভয় করলিরে মোরতি হোবা ভাঙবে সুকির ঘর
সুকি দুঃকি কাটে ব্যেলা জেবোন বাঁচে মরে
কুঁজিকাজা বেঁদে আচি সোঁদোরবোনের চরে।
নকডাউনি কাজ হেইরে যে পাণে বাঁচা দায়
কোপাল মন্দো ভালো মানুষ আগে চলে যায়!
যাবার সমোয় হলি তেকোন আকবি ধোরে কার!
ছিঁড়লি সুতো মায়া ঘরের আগাশ ডাকে তার।
আতিদিনি কোতায় থাকে যায় না বলে মোটে
হায় রে আল্লাহ! আত্তির হলি বুকি চিড়েকোটে!
কিজানি কি ভাবে কি কেউ সূয্যু ডোবার পরে
চোকির পানি ঝরে সুদু পোড়া এই সোংসারে।
কি আর করবি বুনরে আমার এ সোমাজের নীতি
ঝারা শুদু বেগার খাটে তাগার বুকি মাটি
সক্কোলেতো চায়রে এট্টু দেকতি সুকির মুক
ভাঙে কেনো সোনার সোংসার ঝুইজে নাবে দুক।
দুঃক্কে যাগার জেবন গোড়া ভাবলি সুকির কোতা
জমবে বুকি শুদু আঁদার বাড়বে নদীর ব্যেতা
জেবন তাগার সহজ সরল নোনা কাদা মাটি
নদীর ঢেউয়ে জেবন জাগে সোনার চেয়ে খাঁটি।
ছানিটার নে ঝেতো জ্বালা বাপ থাকে না ঘরে
আঁচল ছাড়া হলি তেকোন থাকবো কেরোম করে
বয়োস ও আর কতো হোবা পনেরো বা ষোলো
দেকতি ঝ্যেনো পরির নাহান শরীর ঢলোঢলো।
ছোরমা চোকি কাজল দিঘি নাকে ঝোলে নোলক
উপ ঝেনো তার ঠিগরে পড়ে জোসনা ছলাক ছলাক
মায়া ভরা মুক ঝেনো তার শিশির ভেজা আত
জোনাক ছাওয়া গাচের পাতায় আকলো কে যে হাত!
গেরাম ঘোরে বিকেল হলি নুকোচুরি খ্যেলা
পাড়ার ঝেতো ছানিপুনির নদীর পাড়ে ম্যেলা
হই ছানিটার দেকতি ভালো নোকের কাচে শোনা
মা বাপের যে দুখ্যু বোঝে সেতো খাঁটি সোনা।
নদীর নোভে মনি ঋষির সাধন আকা দায়
কোমল ঢেউয়ের আঁকে বাঁকে সত্যোবতীর নায়
বালির চড়ায় দোলে হাওয়ায় নোম্বা গাচের ছাওয়া
নোনা বাতাস চোকি মুকি মনের গোপন চাওয়া।
উপোবতী বোনের মায়ায় পাকির চেনা গান
নদীর বুকি ভাঙার ব্যেতা ঢেউয়ের বুকি টান
চোকির কোণে জমে ঝেতো অঙিন সুকির আশা
শূন্যো মাটে ধানের ব্যেতায় কাঁদে নিঃস্বো চাষা।
অন্দোকারে ঘুমোয় গেরাম নদী থাকে জেগে
ভাঙা মেগের ছায়ায় ছায়ায় আগাশ ওটে এগে
চোকির জলে ভাসে যেকোন তেকোন ভাঙে ভুল
উজান ভাটির নীরব খ্যেলা ককোন ছাপায় কুল!
ফুটলি গাচে অঙিন কুঁড়ি বাতাস খবোর দ্যেয়
অলির ডেনায় মিলোন ছোঁয়া কাচে ডেকে নেয়
জইড়ে ধরে বাঁশির সুরি উতাল পাতাল মন
হাতে বাজে কাঁচের চুড়ি স্বপ্নো সুকির কোণ।
ও সোনা বুন যাইরে এ্যাকোন মদ্দ এয়েচে ঘরে
আমারে না দেকলি আবার মনটা কেরোম করে
হাঁড়ি কুড়ি ডেয়ো ঢেকনা পড়ে আচে বাসি
নদীর চড়ায় শোকে ব্যেতায় মিইলে গেচে হাসি।
চলবে…




