কালবৈশাখী ঝড় যেমন নিজের সহজ ও প্রবল আত্মপ্রকাশে চকিত আবির্ভাবে বিশ্বসংসারকে একেবারে অভিভূত করে দেয়, ঠিক এরকমভাবেই আধুনিকযুগের বাংলা কাব্যজগতে একদা কাজী নজরুল ইসলামের চমক লাগানো আবির্ভাব ঘটেছিল। এই জগতে আবির্ভুত হয়ে তিনি প্রথমেই নতুনের কেতন উড়িয়ে দিয়েছিলেন, আর তারপরে মহাকবি রবীন্দ্রনাথের চরণে নিজের প্রণতি রেখে অনুরাগভরা দৃষ্টিতে কবিঅগ্রজ সত্যেন্দ্রের দিকে তাকিয়েছিলেন। আর এর বদলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তখন দুর্দান্ত যৌবনের কবি ও শাসনের শিকল-ছেঁড়া নজরুল ইসলামকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এ এক অতি স্মরণীয় এতিহাসিক ঘটনা। বস্তুতঃ আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসের পাতায় নজরুল-কাব্য স্বতন্ত্র একটি অধ্যায়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আজও নজরুল ইসলাম বাঙালির কাছে কবি—বিদ্রোহী—‘বিদ্রোহী’ নামক অমর কাব্যের কবি।
আধুনিক বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব প্রসঙ্গে তাঁর ভাষাতেই বলা চলে, সহসা ‘এক অসাধারণ কবি-বালকের’ দেখা মিললো, যে দুরন্ত আবেগে থর থর করে কাঁপছে, হৈচৈ–কে সঙ্গীতে ফুটিয়ে তুলছে, উচ্চকণ্ঠে যৌবনমন্ত্র উচ্চারণ করছে, কাব্যাঙ্গনে একজন সৈনিকের মতোই কদম কদম পা বাড়িয়ে যাচ্ছে, অপূর্ব ছন্দোনৈপুণ্যে প্রাণের কথাকে গাঁথছে, প্রবল কবিত্বের অনর্গল অজস্রতায় বাংলার তরুণসমাজকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর সোল্লাসে চীৎকার করে বলছে—
“তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ঐ নতুনের কেতন ওড়ে—কাল-বোশেখীর ঝড়।”
নজরুল ইসলাম হলেন আধুনিক বাংলার এক অদ্ভুত জনপ্রিয় কবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাদ দিলে, তাঁর মত এত খ্যাতি আধুনিকযুগের খুব কম বাঙালি কাব্যকারের ভাগ্যেই জুটেছে। এই লোকপ্রিয় নজরুল যেমন যে কারো মনে ঈর্ষা জাগিয়ে তুলতে পারেন, তেমনি শেষজীবনে তাঁর দুর্ভাগ্যের কথা স্মরণ করেও ব্যথিত হতে হয়। বর্তমানে তাঁর জীবনের সাথে পরিচিত প্রায় সকলেই অবগত রয়েছেন যে, নিজের শেষজীবনে তিনি জীবিত থেকেও মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন; সেসময়ে তাঁর কণ্ঠ নির্বাক ও লেখনী স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
নজরুলের সাহিত্যজীবন লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’–র যুগে তাঁর অভ্যুদয় ঘটেছিল। রবি-কবি যখন স্থবিবের শাসননাশন চিরবিদ্রোহী যৌবনের আশ্চর্য কবিতাগুলি লিখছিলেন, অবুঝ সবুজের প্রাণোন্মদনার আগ্নেয় স্পর্শে জীর্ণ জরাকে ঝরিয়ে দিচ্ছিলেন, আর মরানদীর দেশে ভরানদীর কলধ্বনি জাগাচ্ছিলেন, ঠিক সেসময়েই বাংলা সাহিত্য জগতে নজরুল-প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিল। তখন সেদিনের তরুণ নজরুল রবীন্দ্রকণ্ঠের যৌবনসংগীত উৎকর্ণ হয়ে শুনেছিলেন, এবং শুনে উদ্দীপিত হয়েছিলেন। আর এরপরে বোধহয় ‘আগুনের পরশমণি’–র ছোঁয়া প্রাণে লেগেই নজরুল ইসলাম অকস্মাৎ একদিন ‘বিদ্রোহী’–র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তখন থেকেই নজরুলের রক্তটগবগানো কবিতা লেখার পালা শুরু হয়েছিল। কিন্তু এগুলি শুধু কবিতা ছিল না, এগুলিকে বরং ভেরীরব-দুন্দুভিধ্বনি বললেই ভালো বলা হয়। এসময়ে কবি নজরুল দীপক রাগিণীতে গান ধরেছিলেন, ‘অগ্নিবীণা’ বাজিয়েছিলেন, ‘বিষের বাঁশি’–তে ফুৎকার হেনেছিলে, হাঁক দিয়ে ‘ভাঙার গান’ শোনাতে শুরু করেছিলেন, ‘সর্বহারা’দের বেদনাকে মুখের ভাষা দিয়েছিলেন, কম্বুকণ্ঠে ‘সাম্যবাদ’ প্রচার করেছিলেন, ‘প্রলয়শিখা’–য় তৎকালীন সমাজের যুগসঞ্চিত জীর্ণতাকে—অতিরন্ধ অন্ধ-সংস্কার ও নির্জীব আচারকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভস্ম করে দিতে চেয়েছিলেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সবধরণের অসাম্য-বৈষম্য, অন্যায়-অবিচার, শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে দৃপ্তভঙ্গিতে ও অধীন ছন্দে এমন প্রতিবাদ কিন্তু সেযুগের অন্য কোনো কবির লেখায় ধ্বনিত হয়নি। নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন সংগ্রামী কবি; আরো ভালো করে বললে, তিনি ছিলেন একজন শিল্পীযোদ্ধা। কবিতাকে তিনি লড়াইয়ের হাতিয়ারে পরিণত করেছিলেন। বস্তুতঃ বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম পুরুষ-কণ্ঠস্বর মধুসূদন দত্তের কণ্ঠে, আর তারপরে নজরুলকণ্ঠেই শুনতে পাওয়া গিয়েছিল।
সমকালীন ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, খৃষ্টীয় বিংশ শতকের প্রথমভাগে বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বন্ধনমোচনের আগ্রহ বাঙালি জাতিকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল, এবং তা উত্তরোত্তর বর্ধিত হচ্ছিল। নজরুল তৎকালীন বাঙালির সেই নবজীবনভাবুকতার কবি ছিলেন। এসময়ে তাঁর কবিতায় বন্ধনমুক্তির দুর্বার আকাঙ্ক্ষা আত্মপ্রকাশ করেছিল। এমনকি তাঁর কাব্যের বাণীভঙ্গিতেও এই আকাঙ্ক্ষা তখন স্পন্দমান ছিল। সমালোচকদের মতে, অবন্ধন স্বতঃস্ফূর্ততা ও আবেগের প্রচণ্ডতা হল তাঁর কবিতার সবথেকে বড়ো লক্ষণ। যদিও ভাবের দিক থেকে যুগোত্তর মানুষের কামনা-বাসনা তাঁর রচনাবলী তেমনভাবে বহন করেনা, কিন্তু তবুও একটি সমগ্র জাতির সাময়িক আশা-উদ্দীপনার এমন বিশ্বস্ত প্রতিনিধিত্ব আধুনিক সময়ের অন্য কোনো বাংলা কাব্য করতে পারেনি বলেই দেখতে পাওয়া যায়। পরাধীনতার দুর্বিষহ জ্বলা, রাজনৈতিক মুক্তির তীব্র পিপাসা, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঐক্য, অন্নহীনের দুঃখ ইত্যাদিকে নজরুল নিজের আবেগময়ী ভাষায় সফলতার সঙ্গেই বাণীবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। বিশেষতঃ একটি বিশেষ যুগের সমস্যা ও আদর্শ তাঁর রচনায় চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ স্মরণীয় যে, পরাধীন ভারতে অসহযোগ-আন্দোলন আর খিলাফৎ-আন্দোলনের দিনগুলিতেই নজরুল তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলির অধিকাংশ রচনা করেছিলেন।
সমালোচকদের মতে, নজরুলের কবিতার একদিকে যেমন জ্বালা-নেশা-উন্মাদনা দেখতে পাওয়া যায়, অন্যদিকে তেমনি আবার প্রেমানুভবের অতৃপ্ত মধুর মাদকতা, স্বপ্নসুন্দর কল্পনাবিলাস ও প্রকৃতিপ্রীতির মৃদু গুঞ্জরণও লক্ষ্য করা যায়। বস্তুতঃ নজরুল তাঁর কবিতায় রণতূর্য এবং বাঁশি—দুই-ই বাজিয়েছিলেন। একদিকে ‘চির-উন্নত মম শির’ এবং অন্যদিকে ‘হে মোর রানি, তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে’—এই দুই বিপরীত বিন্দুতে তাঁর কবিসত্তার অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। অনেকের মতে নজরুলের অন্তরের গভীরে এই দুই বিপরীত দ্বন্দ্ব ছিল—একথা বিশ্বাস করবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
এছাড়া নজরুল বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে বিস্তর গানও লিখেছিলেন। সমালোচকরা মনে করেন যে, তাঁর কবিপ্রতিভার সর্বোত্তম প্রকাশ এই গানগুলিতেই ঘটেছিল। এমনকি নজরুলের কবিতায় প্রায়শঃই যেসব শিল্পগত ত্রুটিবিচ্যুতি লক্ষ্য করা যায়, সঙ্গীতে সেসব তিনি অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তাই বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে যেমন, বাংলা গানের ক্ষেত্রেও তেমনি নজরুলপ্রতিভার অসামান্য অবদান রয়েছে। মোটকথা হল যে, আধুনিকযুগের বাংলায় কবিব্যক্তি হিসেবে নজরুল অ-সাধারণ। কোন শিক্ষিত বাঙালির পক্ষেই তাঁকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
তবে কবিতা ও গানের বাইরে কাজী নজরুল ইসলাম কিছু ছোট ছোট গল্পও লিখেছিলেন। বস্তুতঃ আধুনিক বাংলা কবিতার মত ছোটগল্পের জগতেও তিনি এক অনন্যপূর্বতার স্বাদ নিয়ে এসেছিলেন। ১৯২২ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গল্প-সঙ্কলন ‘ব্যথার দান’ সেযুগে ‘গদ্য-কাব্য’ নামে প্রশংসামুখর স্বীকৃতি পেয়েছিল। যদিও এসময়ে ‘কল্লোল’ পত্রিকা নজরুলের এই সঙ্কলনের গল্পগুলোকে চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়ের ‘উদ্ভ্রান্ত প্রেম’–এর সঙ্গে তুলনা করেছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও নজরুলের রচিত গল্পগুচ্ছকে, অন্ততঃ ‘ব্যথার দান’–এর গল্পগুলোকে কোনো পরিচিত রূপ-প্রকৃতির সীমায় গণ্ডিবদ্ধ করা সম্ভব নয় বলেই সমালোচকরা মনে করে থাকেন। তাঁদের মতে, যদিও নজরুলের লেখায় বিচিত্র চেনা রূপের আভাস পাওয়া যায়, কিন্তু তবুও কোনো বিশেষ রূপসৃষ্টির কোনো পূর্বসংস্কারই (convention) এগুলিতে গভীর ছাপ ফেলতে পারেনি বলেই দেখা যায়। এর কারণ হল, তাঁর সহজে ‘আনকনভেনশন্যাল’ ব্যক্তি-স্বভাব!
সাধারণভাবে সাহিত্য সমালোচকরা বলে থাকেন যে, সকল সার্থক সৃষ্টিই হল আসলে স্রষ্টার আত্মরূপ রচনার আনন্দলীলা। আর নজরুলের পক্ষে একথা আরও বেশি পরিমাণে সত্যি বলে দেখতে পাওয়া যায়। জীবনের বিষ-সমুদ্র মন্থনকারী দাহময় অভিজ্ঞতার যে পুঁজি তাঁর কাছে ছিল, তা সমকালীন অন্য যে কোনো বাঙালি শিল্পীর তুলনায় অপরিসীম ছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকের পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ গৃহস্থ ঘরের এক সন্তান প্রথমে রানিগঞ্জে পড়তে গিয়েছিলেন। সেখানে ধনিশ্রেষ্ঠ ও বর্ণশ্রেষ্ঠ হিন্দু পরিবারের এক দুলাল দৌহিত্রের সঙ্গে তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধুত্ব হয়েছিল। (ব্যথার দান, নজরুল ইসলাম, পঞ্চম সংস্করণ) কিন্তু বন্ধুর পক্ষ থেকে না হলেও বন্ধুর পরিবারের পক্ষ থেকে এবিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা সেযুগে অন্ততঃ সর্বাংশে প্রীতিপ্রদ হওয়ার কথা ছিল না, আর হয়ওনি। এই বন্ধুর নাম ছিল শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। তারপরে তিনি কলম ছেড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রঙ্গভূমে হাতিয়ার ধরতে গিয়েছিলেন। এই যুদ্ধক্ষেত্রেই তিনি ফারসি ভাষা শিখেছিলেন। এসময়ে একদিকে তাঁর হাতে যখন প্রাণঘাতি অস্ত্র ছিল, অন্যদিকে তাঁর হৃদয় তখন কবি হাফেজ–এর প্রেম-রোমাঞ্চে ভরা কাব্য-কবিতার অপার রহস্য-পাথারে ডুব দিয়েছিল। এরপরে একসময়ে দেশ-বিদেশের যুদ্ধভূমি পেরিয়ে ঘরের ছেলে পুনরায় নিজের ঘরে ফিরে এসেছিলেন; আর অস্ত্রে-রাঙা হাতে শিল্পের লেখনী ধারণ করেছিলেন। এসময়ে বৃটিশ সৈন্যবাহিনীর হাবিলদার লিখেছিলেন কবিতা। তাঁর এই কবিতা ছাপা হয়েছিল ‘প্রবাসী’ পত্রিকার পৃষ্ঠায়। এরপরে তিনি গোরা পল্টন ছেড়ে দেশের মানুষের জীবনভূমিতে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এর আগে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ইংরেজ প্রভুদের যথার্থ স্বরূপ দেখে এসেছিলেন বলে ইতিমধ্যে তাঁর মর্মে বিদ্রোহ-বাসনার পুঞ্জিত অগ্নিদাহ জমে উঠেছিল। কিন্তু নিজের বন্ধু বলে, পরমাত্মীয় বলে তিনি যাঁদের কাছে ফিরে এসেছিলেন, তাঁদের কাছ থেকেও সুবিচার পাননি। তাই কলকাতায় এসে প্রথমে উঠেছিলেন বন্ধু শৈলজানন্দের মেস-এ। ইতিমধ্যে সেযুগের ধনী কুলীন পরিবারের ব্রাত্য এই দুলাল তখন অনাভিজাত্যের অপরাধে পরিবার-চ্যুত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বন্ধুর জন্য এবারে তাঁকে মেসও ছাড়তে হয়েছিল; কারণ, সেকালে ‘পবিত্র হিন্দু মেস’–এ একজন মুসলমানকে অতিথি হিসেবে প্রবেশ করতে দেওয়ার অপরাধ অক্ষমণীয় ছিল। (চলমান জীবন, ২য় পর্ব, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়) যদিও বিদেশী রাজার জাতের অন্যায় তখন হাবিলদার নজরুলকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল, কিন্তু তবুও দেশের ভাইদের উৎপীড়ন তিনি হাসিমুখেই বরণ করে নিয়েছিলেন। এখানে এই কথাগুলো একারণেই বলা হল যে, রাজশক্তির পক্ষ থেকে জাতির এই অশিক্ষিত অন্ধ সংকীর্ণতার সুযোগ সেদিন পূর্ণমাত্রায় গৃহীত হয়েছিল; আর এভাবেই তখন জাতি ও সম্প্রদায় ভেদের ফাটলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ উপ্ত হয়েছিল। অন্যদিকে যুদ্ধের পল্টনে নিযুক্ত নজরুল কিন্তু পাঞ্জাবি মৌলবির কাছ থেকে ধর্ম-শিক্ষার বদলে ফারসি সাহিত্যের প্রেম-সৌন্দর্যে স্নিগ্ধ সারস্বত মন্দিরের পাঠ নিয়েছিলেন। তাই এসব দিক থেকে নজরুলের ব্যক্তিত্ব তখন অন্যদের তুলনায় অগতানুগতিক, বা বিস্ময়কর রূপে ‘আনকনভেনশন্যাল’ ছিল। অর্থাৎ, প্রচলিত জীবনভূমিতে তাঁর অন্তর-চেতনা তখন প্রত্যাশিতের বিপরীত, অথবা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়ার রচনা করেছিল। আর নজরুলের জীবনীকারদের মতে, তাঁর এই আশ্চর্য ব্যক্তি-প্রেরণার উৎস ছিল তাঁর প্রখর-দীপ্ত স্বয়ং-সুরেখ আত্মশক্তি, বা তাঁর ‘ego’। আসলে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যে দিয়েই তিনি চিরকাল তাঁর অন্তরলীন সেই অনন্য নিঃসঙ্গ ‘ego’–রই একটা রূপ-রচনা করেছিলেন। সুস্থ থাকবার সময়ে জগৎ-ব্যাপ্ত অসীম অভিজ্ঞতার পুঁজি নিয়ে তিনি পুনঃপুনঃ নিজ আত্মার গভীর গহন মন্দিরে প্রবেশ করেছিলেন। আর সেই জগতে বসে একান্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে বিশ্বজগতের দুঃখদাহ ভরা অভিজ্ঞতাকে নিংড়ে নিজ আত্মশক্তির (ego–র) নিভৃত বাসনার মাধুরী মিশিয়ে মালা গেঁথেছিলেন। সমালোচকদের মতে, বাংলা কাব্য-সাহিত্যে মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ ছাড়া এমন তীব্র ও একনিষ্ঠ ‘ego’–অভিমুখিতা অন্য কোনো শিল্পীর মধ্যে রীতিমত দুর্লক্ষ্য। এঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ধ্যানী আত্মার প্রশান্তি তাঁর আত্মশক্তির উগ্রতাকে কখনো প্রখর হতে না দিলেও নজরুলের ‘egoism’ ছিল চির অশান্ত, অসীম ও তীব্র; এবং এখানে তিনি স্বয়ং মধুসূদনের স্বগোত্রীয় হলেও মধুসূদনের থেকে অনেক বেশি ভাব-অচেতন ছিলেন। ফলে তিনি তাঁর সময়কার বাঙালির অসংখ্য দুঃখ-হতাশা-বেদনা-মন্থিত জীবনের অধিবাসী হয়েও আত্মলীন এক স্বপ্নিল দৃষ্টির কল্যাণে বস্তুজগতের এই রূঢ়ভূমিতে চির-পরবাসী হয়েই থেকে গিয়েছিলেন। নজরুল তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে কম আঘাত-বঞ্চনা পাননি; কিন্তু যদিও নিজের বাস্তবিক অভিজ্ঞতায় এসব তিনি বরাবরই সঠিকভাবে অনুভব করেছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও এবিষয়ে তাঁর আত্মার প্রতিক্রিয়া কিন্তু নিজের অন্তর-গহনে লীন নিভৃত-স্বতন্ত্র আত্মশক্তির (ego) পাদপীঠেই রচিত হয়েছিল। তাই এই অর্থে নজরুলের সৃষ্টিকে বিশেষভাবে বা একান্তভাবেই তাঁর আত্মসৃষ্টি বলা যেতে পারে; অর্থাৎ তাঁর যথার্থ সফল সব রচনাতেই এই অনন্য ego–র স্বেচ্ছামুক্তি দেখতে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, নজরুলের কবিতা প্রসঙ্গে রূপকর্মের অনিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খলাহীনতার বিতর্ক এককালে যেমন উদ্দাম হয়ে উঠেছিল, তেমনি আজও তা নিরর্থক নয়। সমালোচকদের মতে, এক্ষেত্রে আসল কথা হল যে, কবিতার ভাব-স্বভাবের মত বহিঃশরীরের রূপায়ণেও ব্যক্তি-নজরুলের কোনো সচেতন প্রভাব বিস্তারের উপায় ছিল না; কারণ, কবির অন্তরে যিনি কবি ছিলেন, কবি নজরুলের সেই দুরন্ত দুর্মদ ‘ego’ ব্যক্তি-নজরুলের লেখনীর হাত ধরে নিজেকে যথেচ্ছভাবে সৃষ্টি করেছিল। তাই বর্তমান উপলক্ষ্যে এখানে কবির সেই অন্তঃশক্তি, সেই ‘ego’–র স্বভাব সন্ধান না করে অন্য কোন উপায় নেই।
নজরুলের জীবনীকারদের মতে, এদিক থেকে নজরুলের আত্মসত্তাকে অমিত যৌবনের শক্তি-মূর্তি বলে অভিহিত করা যেতে পারে। যৌবন যেন জীবনের এক অতল স্পর্শ অপার পাথার। প্রাণশক্তির সুরাসুরে মিলে যৌবনের সমুদ্রে সবসময় অমৃত-পিপাসু আত্মার সমুদ্রমন্থন চলে। যৌবনের গভীরে যেখানে দেবতার সুমিতি ও সংযম রয়েছে, সেখানেই অমৃতের শাশ্বত প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। এই অমৃতে অমরতার অধিকার সঞ্চিত হলেও এতে কিন্তু অনন্ত প্রাণের নিরবধি জীবনানন্দের প্রতিশ্রুতি নেই। এজন্যই দেবতারা অমর হলেও তাঁরা কিন্তু অপার আনন্দিত নন। আনন্দের বাসনা বেদনার অন্ধকার পাথার তলে জন্ম নেয়; আর অসীম দুঃখের অমানিশা পেরিয়ে মুহূর্তের ঊষারুণরাগে এর অনির্বচনীয় অভিব্যক্তি অনুভব করা যায়। প্রসঙ্গতঃ স্মরণীয় যে, ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ এই উপলব্ধিরই সার্থক রূপায়ণ করেছিলেন। জীবনের মর্মলীন ব্যথার রক্তবৃন্তেই আনন্দের শ্বেত-শতদল ফোটে। একারণেই পদ্ম ক্ষণিক হলেও রক্তিম মৃণাল কিন্তু চিরদিনের। এই ব্যথা-বেদনা-দুঃখের অভিঘাত যত অ-পরিমাণ ও অ-প্রমেয় হয়, আনন্দের বাসনা তত উদগ্র অমিত, তত অতৃপ্ত এবং নিরবধি হয়ে ওঠে। তবে একে যৌবনের আসুর শক্তি বলা চলে না, বরং অপার দুঃখ-যন্ত্রণায় আর্ত, অথচ আনন্দের পিপাসায় চির-উন্মুখ এই জটিল জীবনধর্মকে মর্ত্যমানবের চিরন্তন সম্পদ বলে অভিহিত করলেই সঠিক বলা হয়। সমালোচকদের মতে, নজরুলের কবি-চেতনায় যৌবনের এই অমিত শক্তিই অনুভব করা যায়। এতে আনন্দ-ঋষি লাভের চরিতার্থতা নেই, বরং নিরানন্দ জীবনে ব্যথার জ্বালাময় পসরা আনন্দ-পিপাসুতার উদগ্র উচ্ছ্বাসে ভরে রয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। তাই এদিক থেকে তাঁর সব সফল সৃষ্টিই হল ‘ব্যথার দান’; এমনকি তাঁর সৃষ্ট অন্য গল্পগুলোও একই পর্যায়ের। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ‘অগ্নিবীণা’–র বিদ্রোহী কবি একদা আত্মপরিচয় দিতে বলেছিলেন—
“এক হাতে মোর বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণতূর্য।”
সমালোচকদের মতে, তাঁর ‘ব্যথার দান’–এর গল্পগুলো সম্বন্ধেও এই একই কথা প্রযোজ্য। কারণ, এই সঙ্কলনের অধিকাংশ গল্প যুদ্ধের পটভূমিতে রচিত হয়েছিল, আর এসবের ঘটনাস্থল ছিল ভারতবর্ষের বাইরে। শুধুমাত্র শেষ গল্প ‘রাজবন্দীর চিঠি’ ভারতবর্ষের জেল থেকে একজন ভারতীয় রাজবন্দীর লেখা ছিল। নজরুল তাঁর এই গল্প গ্রন্থটি ‘মানসী’কে উৎসর্গ করেছিলেন। কিন্তু এরসঙ্গে কবির ব্যক্তিগত জীবনের কোনো শরীরী প্রিয়ার যোগ আছে কিনা—এধরণের কৌতূহল নিতান্তই অবান্তর। কিন্তু এই সঙ্কলনের গল্পগুলো যে ব্যক্তিকবির অন্তরবাসিনী ‘মানসী’কে তাঁর ‘ego’–র প্রিয়ারূপকে বক্ষে ধরে এসেছে—একথা অবশ্য সত্যি। এতে একদিকে যেমন প্রেমের জন্য অমিত যৌবনের বিষদগ্ধ উৎকণ্ঠা দেখতে পাওয়া যায়, অন্যদিকে তেমনি যুদ্ধের মরণ-ভীধণ কর্মভূমির আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায়; আর এই দু’য়ের মধ্যে এই গল্প সঙ্কলনে হাবিলদার কবির কল্পনা উন্মথিত হয়ে ফিরেছে বলে বুঝতে পারা যায়।
সমালোচকদের মতে, এই সঙ্কলনের গল্পগুলোর শরীরে আধুনিক জীবনের যৌন জটিলতা, এবং স্বদেশী আদর্শবাদের উচ্ছ্বসিত প্রকাশ রয়েছে। শুধু তাই নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নজরুলের এই গল্পগুলো নর-নারীর প্রণয় সমস্যার দেহ-মনোগত স্বভাব-চিত্রণের অভিমুখী। কিন্তু কবির স্বতউচ্ছ্বসিত কল্পনা এই সঙ্কলনের সব গল্পের দেহেই আবেগের মদিরা ছড়িয়ে দিয়ে সেগুলিকে বস্তু-ভারহীন এক আশ্চর্য ভাব-নির্মুক্তি দিয়েছে। ফলে গল্পগুলি সেই কবিতার রূপ ধারণ করেছে, যে কবিতাকে শুধুমাত্র কবির অন্তর্লীন ‘ego’–র আত্মসৃষ্টি বলা যেতে পারে।
এই সঙ্কলনের প্রথম গল্প ‘ব্যথার দান’—দারা, বেদৌরা ও সয়ফুল-মুলুক–এর আত্মবিবরণীর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এই কাহিনীতে দেখা যায় যে, বেদৌরাকে দারা আকৈশোর ভালোবেসেছিল। আর তাঁদের এই প্রেমের উৎসভূমি দারার মায়ের মৃত্যু মুহূর্তের আশীর্বাদে পুণ্যস্নাত হয়েছিল। এরপরে নবীন যৌবনে ভরা-জীবনের স্বপ্ন দেখে যখন তাঁদের দিন কেটে যাচ্ছিল, ঠিক এমন সময়ে বেদৌরার ঐতিহ্যদম্ভী সেই মামার আবির্ভাব ঘটেছিল, যিনি একজন গরীব চাষার ছেলের হাতে বেদৌরাকে কিছুতেই ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। তাই এরপরে দারা ছুটে গিয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে, আর বেদৌরা পৌঁছেছিল নিজের মাতুলালয়ে। কিন্তু প্রবৃত্তির আকর্ষণ অমেয় বলে সয়ফুল-মুলুক–এর মোহের কাছে বেদৌরা একসময়ে আত্মসমর্পণ করেছিল। তবে প্রবৃত্তির কোন চরিতার্থতা থাকে না বলে বেদৌরা এরপরেও চির অতৃপ্ত থেকে গিয়েছিল। অন্যদিকে দারা ইতিমধ্যে সাফল্যের সমৃদ্ধি নিয়ে ফিরে এসেছিল। কিন্তু বেদৌরার মন তখন পবিত্রতার স্বরূপ জানতে পারলেও তাঁর শরীর যে অপবিত্র হয়ে গিয়েছিল! তাই অনেক কুণ্ঠা ও অনেক আত্মধিক্কারের শেষে সে দারার কাছে আত্মসমর্পণ করলেও দারা কিন্তু তখনই তাঁকে গ্রহণ করতে পারে নি। তাই বেদৌরাকে কুণ্ঠাহীন চিত্তে গ্রহণ করতে পারলে তবেই তাঁকে সে ডাকবে, এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে দারা আবার যুদ্ধে ফিরে গিয়েছিল। তবে এবারে অনুশোচনার্ত সয়ফুল-মুলুকও এখানে তাঁর সঙ্গী হয়েছিল। অবশেষে এই যুদ্ধে স্বদেশের জয় হয়েছিল, আর দারাই মহৎ মূল্যের দ্বারা—নিজের অন্ধ ও বধির জীবনের শূন্যতা দিয়ে তখন এই জাতীয় বিজয়কে ক্রয় করেছিল। পরিশেষে সয়ফুল-মুলুক দারার ক্ষমা পেয়েছিল, আর বেদৌরা পেয়েছিল দারার সঙ্গ। দারা শেষপর্যন্ত দেহের দৌলত হারিয়ে নিজের মনের পবিত্রতার মূল্য দিতে পেরেছিল।
সমালোচকদের মতে, গল্পের এই ছোট্ট থিম নজরুলের বিদ্রোহী চেতনার উন্মথিত আবেগে যে সীমাতিক্রমী কবিতার রূপ পেয়েছে, এই কাহিনীতে বেদৌরার কথার একটি অংশে সেই পরিচয় পাওয়া যায়, যা নিম্নরূপ—
“বাইরে ফাগুনের উদাস বাতাস প্রাণে কামনার তীব্র আগুন জ্বালিয়ে দিলে। ঠিক সেই সময় কোথা থেকে ধূমকেতুর মত সয়ফুল-মুলুক এসে আমায় কান-ভাঙানি দিলে—ভালবাসায় কি বিরাট স্নিগ্ধতা আর করুণ গাম্ভীর্য, ঠিক ভৈরবী রাগিণীর কড়ি মধ্যমের মত! আর এই বিশ্রী কামনাটা কত তীব্র-তীক্ষ্ণ নির্মম। এই বাসনার ভোগে যে সুখ, সে হচ্ছে পৈশাচিক সুখ। এতে শুধু দীপক রাগিণীর মত পুড়িয়েই দিয়ে যায় আমাদের! অথচ এই দীপকের আগুন একবার জ্বলে উঠবেই আমাদের জীবনের নব ফাল্গুনে! সেই সময় স্নিগ্ধ মেঘ-মল্লারের মত সান্ত্বনার একটা কিছু পাশে না থাকলে সে যে জ্বলবেই—দীপক যে তাকে জ্বালাবেই।”
অন্ধকামনার বিষবনে ভালবাসাই হল যৌবনের ফুল। তাই যৌবনের ভিত্তিমূলে কামনা-বাসনার অবস্থান অনপনেয় হলেও এদিক থেকে কামনা-বাসনা যৌবনের—ভালবাসার অপরিহার্য এক অনুষঙ্গ। ভালবাসার অঙ্গে আত্মগোপন করে এলে তার নিরাবরণ দাহ স্তিমিত হয়ে আসে। কিন্তু প্রিয় যেখানে অনুপস্থিত, প্রেয়র আকাঙ্ক্ষা-রহিত যৌবন-ভোগলিপ্সা সেখানে তখন লালসার আকার ধরে। নজরুলের এই কাহিনীতে প্রেমের এই যৌনতা-নির্ভর স্বভাবের দুঃসাহসী ইঙ্গিতই দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এ সব কিছুই কবির ভাবনায়, কবিতার ভাষায় কাব্য-সুরভিত। ফলে, গল্পের স্থূল দেহটি নজরুলের এই গল্পে সুরেখ হতে পারেনি। সমালোচকদের মতে, আসলে এই গল্পের পাত্রে তিনি তাঁরই লেখা প্রেম-সঙ্গীতের স্বাদ পরিবেশন করেছেন, তবে সেটা শুধুমাত্র পৃথক আধারে।
এছাড়া নজরুলের ‘রিক্তের বেদন’ নামক গল্প সঙ্কলনের গল্পগুলির স্বভাবও মোটামুটি অভিন্ন। এতে গল্প ও কথিকার মোট সংখ্যা হল আটটি। অন্যদিকে ‘ব্যথার দান’–এ গল্প সংখ্যা ছ’টি।
কিন্তু সাহিত্য সমালোচকদের মতে, গল্প হিসেবে এগুলির কোনোটাই খুব একটা অবিস্মরণীয় নয়,—না শৈলীতে, না বিষয়-বিন্যাসে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের দরবারে নজরুলের এই সংস্কারমুক্ত অনন্য রূপ-রচনার প্রসঙ্গ মোটেই অবান্তর নয়, বিশেষ করে অন্যান্য সব নজরুল-রচনার মতোই এগুলিতেও অদ্ভুত অভিব্যক্তি ও স্বাদুতার বৈশিষ্ট্য করা যায়। তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘কল্লোল’-যুগের ‘কল্লোল’-যুবকদের মত শৃঙ্খলা-সাহিত্য এবং যৌন উৎকণ্ঠার প্রতি লক্ষ্য রেখেই বর্তমান প্রসঙ্গে নজরুলের এসব অভিনব রচনা-প্রবন্ধের পরিচয় আজও সবিশেষ স্মরণীয়।