মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড ঊনবিংশ শতাব্দীর নিউইয়র্কের মার্কিন সমাজের একজন বিশেষ প্রতিপত্তিসম্পন্না মহিলা ছিলেন। ১৮৯৫ সালে নিউইয়র্কে স্বামীজীর সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়েছিল এবং এরপরে ক্রমে স্বামীজী ও তাঁর মধ্যে নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। স্বামীজী তাঁকে ‘জো’ বা ‘জয়া’ বলে সম্বোধন করতেন। মিস ম্যাকলাউডের অন্তরে স্বামীজীর জন্য গভীর শ্রদ্ধা ছিল। পরবর্তী সময়ে প্যারিস থেকে স্বামীজীর সঙ্গে তিনি ইংল্যাণ্ডে গিয়ে উপস্থিত হলে সেখানেই নিবেদিতার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল এবং ক্রমেই তাঁরা পরস্পরের অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন। আর তখন থেকেই তাঁদের উভয়ের জীবনধারা একই আচার্যকে কেন্দ্র করে প্রবাহিত হতে শুরু করেছিল। স্বামীজীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পরে মিস ম্যাকলাউড যখন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন—‘এখন আমি কি করব?’ তখন প্রত্যুত্তরে স্বামীজী তাঁকে বলেছিলেন—‘ভারতবর্ষকে ভালোবাসো।’ স্বামীজীর এই নির্দেশ তিনি আজীবন পালন করে গিয়েছিলেন। বস্তুতঃ নিবেদিতা ও ম্যাকলাউড—এঁদের উভয়েরই মনোরাজ্য ভারত ও ভারতবাসীর কল্যাণচিন্তা অধিকার করে ছিল।
পরবর্তী সময়ে, ১৮৯৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি তারিখে মিস ম্যাকলাউড ও মিসেস বুল স্বামী সারদানন্দের সঙ্গে ভারতে আগমন করেছিলেন। এরপরে বেলুড় মঠের জন্য কেনা জমিতে অবস্থিত একটি পুরোনো বাড়িতে তাঁরা যখন বাস করছিলেন, তখন নিবেদিতাও সেখানে তাঁদের সঙ্গিনী হয়েছিলেন। সেই বছরেরই ২২শে ফেব্রুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথিতে এবং ২৭শে ফেব্রুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের সাধারণ উৎসবে তাঁরা যোগদান করেছিলেন। ১৮৯৮ সালের ১১ই মে তারিখে স্বামীজী এই তিনজন নবাগতা বিদেশিনীকে সঙ্গে নিয়ে উত্তর ভারতের পথে যাত্রা করেছিলেন। তবে নিছক ভ্রমণই তাঁদের সেই যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল না, বরং অখণ্ড ভারতাত্মার সঙ্গে তাঁদের পরিচয় সাধন করিয়ে দেওয়াই স্বামীজীর সেই ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল। সেই যাত্রাপথের অবিস্মরণীয় দিনগুলিতে অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত নিবেদিতার অপরিসীম মনোবেদনা দূর করতে, এবং গুরু-শিষ্যার মধ্যেকার পারস্পরিক বোঝাপড়ার প্রসঙ্গ সমাধা করতে মিস ম্যাকলাউড সাহায্য করেছিলেন।
মিস ম্যাকলাউডকে নিবেদিতা ‘য়ম’ (Yum) বলে ডাকতেন। আর এই ‘য়ম’–কে লেখা নিবেদিতার পত্রাবলীর মধ্যে তাঁদের উভয়ের মধ্যেকার অন্তরঙ্গতার সুরটি গভীরভাবে বেজে উঠেছিল বলে দেখা যায়। বস্তুতঃপক্ষে নিবেদিতা নিজের এই প্রিয় বান্ধবীর সম্মুখে তাঁর হৃদয়দ্বারটি সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ‘য়ম’ ছাড়া তখন অন্য কেউই ছিলেন না, যিনি নিবেদিতার ভাল-মন্দ সব ব্যাপারে একান্ত সহানুভূতির সঙ্গে যোগদান করতে পারতেন।
ম্যাকলাউড প্রথমবার ভারত দর্শন করবার প্রায় ১৪ বছর পরে দ্বিতীয়বার এবং ১৯৩০ সালে তৃতীয়বারের জন্য ভারতে এসেছিলেন। সেই বছরের ৮ই এপ্রিল তারিখে সিস্টার কৃস্টিনের দেহত্যাগের সংবাদ পেয়ে নিবেদিতা প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে গিয়ে তিনি তাঁর প্রতি নিজের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেছিলেন। এরপরে ১৯৩৮ সালে তিনি চতুর্থবারের জন্য ভারতে পুনরাগমন করে সেবারে বেলুড় মঠের অতিথিশালায় অবস্থান করেছিলেন।
স্বামীজীর প্রতি অশেষ শ্রদ্ধাসম্পন্না ম্যাকলাউড তাঁর বেদান্ত প্রচারকার্যে প্রধান সহায়ক ছিলেন এবং নিজের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হলিউডের বেদান্ত সমিতির কাজে নিজেকে নিযুক্ত রেখেছিলেন। একবার স্বামীজী তাঁর কাজের জন্য ম্যাকলাউডকে নিজের অর্থাভাবের কথা জানালে তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁকে তিনশো ডলার দান করেছিলেন এবং তারপরে প্রতি মাসে স্বামীজীর হাতে পঞ্চাশ ডলার তুলে দেবেন বলে অঙ্গীকারবদ্ধও হয়েছিলেন। স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ নবপ্রতিষ্ঠিত উদ্বোধন পত্রিকার জন্য সেই তিনশো ডলার খরচ করেছিলেন।
স্বামীজী তাঁর এই শিষ্যাতুল্যা রমণী সম্পর্কে বলেছিলেন—
“ইনি রত্নস্বরূপা, এঁর অন্তর সদাই দয়ায় বিগলিত। …ইনি রাষ্ট্রনায়কতুল্য—ইনি রাজ্যশাসন করতে পারেন। আমি মানুষের মধ্যে এরূপ সুদৃঢ় অথচ সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি খুব কমই দেখেছি।”
১৯৪৯ সালের ১৪ই অক্টোবর তারিখে ৯১ বছর বয়সে ম্যাকলাউড লস এঞ্জেলসে দেহত্যাগ করেছিলেন।
অন্যদিকে নরওয়েবাসী বিখ্যাত বেহালাবাদক মিঃ ওলা বুলের স্ত্রী মিসেস সারা বুল (Sara Chapman Thorp Bull) শিকাগো ধর্মমহাসভার পরেই স্বামীজীর সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং তাঁর একনিষ্ঠ ভক্তে পরিণত হয়েছিলেন। এই সদাশয়া মহিলাকে স্বামীজী কখনো ‘মা’ তো কখনো আবার ‘ধীরামাতা’ বলে সম্বোধন করতেন।
১৮৯৪ সালের শেষেরদিকে বস্টনে এবং ১৯০০ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্যারিসে স্বামীজী মিসেস ওলা বুলের ভবনেই আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। প্রভূত বিত্তের অধিকারিণী মিসেস ওলা বুলের প্রদত্ত অর্থেই বেলুড় মঠের পুরোনো শ্রীরামকৃষ্ণ-মন্দির ও সন্ন্যাসীদের বাসগৃহ নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছিল।
মিস ম্যাকলাউডের মত মিসেস বুলও ভগিনী নিবেদিতার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পরম নির্ভরস্থল ছিলেন। ভারতের সেবাব্রতে আত্মসমর্পিতা নিবেদিতা নিজের এই স্নেহশীলা বান্ধবীর কাছ থেকে যেমন ভালবাসা পেয়েছিলেন, তেমনি বুদ্ধি-পরামর্শ ও আর্থিক সাহায্যও লাভ করেছিলেন। ১৮৯৮ সালে বেলুড় মঠে বাস ও উত্তরভারত ভ্রমণকালে তাঁদের উভয়ের হৃদ্যতা ঘনিষ্ঠতর হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল।
১৮৯৮ সালের ১৭ই মার্চ তারিখে ভারতে নবাগতা বিদেশিনী ম্যাকলাউড, মার্গারেট নোবল ও মিসেস বুল প্রথমবারের জন্য সঙ্ঘজননী সারদা দেবীর দর্শন লাভ করেছিলেন। পরে এপ্রসঙ্গে নিবেদিতা লিখেছিলে—
“শ্রীমার এই বিদেশিনীগণের সহিত ব্যবহার অপূর্ব। সকলকেই তিনি ‘আমার মেয়ে’ বলিয়া সস্নেহ অভ্যর্থনা করিলেন। কেহই কাহারও ভাষা বোঝেন না, কিন্তু তাহাতে কি আসে যায়! ভাবের প্রকৃত বিনিময় ঘটে হৃদয়ে, ভাষা তাহার কতটুকুই বা প্রকাশ করিতে পারে!”
সেদিন মিস ম্যাকলাউডের অনুরোধে সারদা দেবী তাঁদের সঙ্গে একত্রে আহারও করেছিলেন। ১৮৯৮ সালের ১৩ই নভেম্বর তারিখে ১৬নং বোসপাড়া লেনে সারদা দেবীর দ্বারা নিবেদিতার প্রতিষ্ঠিত মহিলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকার্য সুসম্পন্ন হওয়ার কিছুদিন পরে মিস ম্যাকলাউড ও মিসেস বুল কয়েকটি দিন নিবেদিতার সঙ্গেই সেই বাড়িতে কাটিয়েছিলেন। সেই সময়ে মিসেস বুল সারদা দেবীর ফটো তোলবার ব্যবস্থা করলে প্রথমে তিনি এবিষয়ে কিছুতেই নিজের সম্মতি দেন নি। কিন্তু শেষে মিসেস বুল যখন বিশেষ অনুনয় করে তাঁকে বলেছিলেন—‘মা, আমি আমেরিকায় গিয়ে পুজো করব’—তখন তিনি তাঁকে ছবি তোলার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছিলেন। এরপরে সেদিন সারদা দেবীর পর পর তিনটি ছবি হয়েছিল। সেগুলির মধ্যে প্রথম দুটি বর্তমানে সর্বত্র সুপরিচিত ও পূজিত হয়।
দ্বিতীয়বার পাশ্চাত্য ভ্রমণকালে স্বামীজী যখন রিজলি ম্যানরে অবস্থান করছিলেন, তখন একদিন ভাবাবেগে নিবেদিতা ও মিসেস বুলকে তিনি গৈরিক উত্তরীয় প্রদান করে আন্তরিক আশীর্বাদ করেছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তাঁদের মধ্যে তিনি যে দিব্যশক্তির সঞ্চার করেছিলেন, সেটার দ্বারা ভবিষ্যতে বহু কল্যাণকর কাজ সুসম্পন্ন হবে।
এরপরে নিবেদিতা যখন অর্থসংগ্রহ করবার প্রচেষ্টায় স্বামীজীর সঙ্গে পাশ্চাত্যে গিয়েছিলেন, তখন মানসিক সংগ্রামে ক্ষতবিক্ষত অন্তর ও কর্মক্লান্ত দেহের শান্তি ও শক্তি ফিরিয়ে আনবার জন্য মিসেস বুলের সাদর আহ্বানে ব্রিটানীর অন্তর্গত সমুদ্রতীরস্থ লানিয় নামক মনোরম জায়গায় এবং নরওয়েতে তাঁর ভবনে তিনি কিছুকাল বাস করেছিলেন। সেবার নরওয়েতে বাস করবার সময়েই তিনি ‘The Web of Indian Life’ নামক সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থটি রচনার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। তখন থেকেই নিবেদিতার সব কাজে মমতাময়ী সারার প্রগাঢ় সহানুভূতি এবং প্রত্যেকটি গ্রন্থ রচনায় তাঁর অসীম উৎসাহ ও সাহায্য দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। এমনকি সেই গ্রন্থগুলি প্রকাশিত হওয়ার পরে নিবেদিতা তাঁর বান্ধবীর কাছ থেকে অকপট প্রশংসাবাণী পেয়েছিলেন।
অবশেষে ১৯১০ সালের নভেম্বর মাসে বস্টন থেকে নিবেদিতার কাছে অন্তিমপথযাত্রী মিসেস বুলের ব্যাকুল আহ্বান এসেছিল, আর তাঁর সেই ডাক উপেক্ষা করতে না পেরে তিনি যথাসময়ে নিজের প্রিয় বান্ধবীর শেষ শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত হয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত ১৯১১ সালের ১৮ই জানুয়ারি তারিখে মিসেস বুল পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছিলেন। সেদিন শোকসন্তপ্তা নিবেদিতা ও ম্যাকলাউড সেখানে মিলিত হয়েছিলেন; এবং ম্যাকলাউড তাঁকে সান্ত্বনা ও তাঁর আরব্ধ কাজ সম্পর্কে উৎসাহ দিয়েছিলেন। ফলে নিবেদিতার হৃদয়বেদনা অনেকাংশে লাঘব হয়েছিল। সেই বছরের ২৩শে মার্চ তারিখে তিনি ম্যাকলাউডের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভারতের পথে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু ম্যাকলাউড সেদিন জানতেও পারেননি যে সেটাই তাঁদের শেষ সাক্ষাৎ ছিল!
নিবেদিতার সাধন-ক্ষেত্র বালিকা বিদ্যালয়টির ব্যয় নির্বাহ করবার জন্য মিসেস বুল তাঁর উইলে অর্থদান করে গিয়েছিলেন। দয়াবতী ও দানশীলা বান্ধবীর সেই অর্থ সাহায্য নিবেদিতাকে আর্থিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়েছিল। এই কারণে মিসেস বুলের মৃত্যুর পরে নিবেদিতার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের রিপোর্টে (১৯১৯-২২) তাঁর উদ্দেশ্যে যে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছিল, সেটার অংশ বিশেষ নিম্নরূপ ছিল—
“… এই প্রসঙ্গে আমরা নরওয়ে-নিবাসী প্রসিদ্ধ সঙ্গীতজ্ঞ, পরলোকগত মিঃ ওলি বুলের পত্নী পরলোকগতা মিসেস স্যারা সি. বুলের উদ্দেশ্যে আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি। ইনি শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দের পরম অনুগতা এবং ভগিনী নিবেদিতার শিক্ষাকার্যের প্রধান পরিপোষক ছিলেন। প্রথম হইতেই ইনি সিস্টার নিবেদিতাকে নানাপ্রকারে উৎসাহ দান করিতেছিলেন এবং প্রকৃতপক্ষে ইহারই অর্থে বিবেকানন্দ-পুরস্ত্রী-শিক্ষাকার্যের প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল। জীবনের শেষপর্যন্ত তিনি এই কার্যে বিশেষভাবে সহায়তা করিয়াছিলেন। ১৯১১ খৃষ্টাব্দের ১৮ই জানুয়ারি তারিখে তাঁহার মৃত্যু হয়। ঐ ঘটনার কয়েক বৎসর পরে তাঁহার সম্পত্তি হইতে আমরা এককালে যে টাকা পাইয়াছিলাম তাহাই বিদ্যালয়ের ‘চিরস্থায়ী তহবিলের’ মূল ভিত্তিস্বরূপ। তাঁহার স্মৃতিকল্পে এখনও পর্যন্ত প্রতি বৎসর যে টাকা আমেরিকা হইতে প্রেরিত হয় তাহা দ্বারাই এই কার্যের অধিকাংশ ব্যয় নির্বাহ হইয়া থাকে। মিসেস বুলের এই সহানুভূতি ও বদান্যতায় নিবেদিতা-বালিকা-বিদ্যালয় তাঁহার নিকট বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ।”
এবারে এখানে মিস ম্যাকলাউড ও মিসেস ওলি বুলকে লেখা ভগিনী নিবেদিতার দুটি চিঠির দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে—যেগুলো থেকে তাঁদের মধ্যেকার সম্পর্কের কথা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারা যায়। চিঠিদুটির প্রতিলিপি নিম্নরূপ—
“ক্যাসল কারনান্
২০শে জানুয়ারি, ১৯০৩
প্রিয় মিস ম্যাকলাউড,
আজ স্বামীজীর জন্মদিন। সারা সকাল পূজায় কেটেছে, এবং ঘণ্টাখানেক ধরে আমি বিশ্রাম উপভোগ করছি। আগামীকাল কলকাতা যাত্রা করছি আর বাড়ি পৌঁছাব মনে করে খুব ভাল লাগছে। স্বামী সদানন্দ চমৎকার লোক। … আমি নূতন করে স্বামীজীর অভিমতের প্রত্যেকটির অর্থ হৃদয়ঙ্গম করছি আর সদানন্দ সম্পূর্ণভাবে তাতে নিবিষ্ট হয়েছেন। তিনি এখন ব্যক্তির পরিবর্তে নীতির কথা বলেন; সর্বোপরি, ভয় কাকে বলে তা তিনি জানেন না। ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট অবিরাম প্রশ্ন করে করে নিজেদের মাথা খারাপ করে, তিনি কিন্তু এতটুকু বিচলিত হন না, বরং তেমনি শান্তভাবে আমাকে বেশ ঝাঁঝালো বক্তৃতা দেওয়ার ইঙ্গিত করেন। খুব চমৎকার নয়?
কিন্তু এবার আমরা পাড়ি দেব। আমি বাগবাজারে মাসিক বারো বা পনের টাকায় একটি ছোট বাড়ি নিয়ে সেখানে ছেলেদের রেখে নিজে ট্রেনিং দেব। যে শক্তি থেকে স্বামীজীর উদ্ভব সেখান থেকেই আমার প্রয়োজনীয় অর্থ আসবে। আমি তো ঐ কল্পনা নিয়ে মেতে উঠেছি। আমি দেখছি, যে ছেলেদের স্বামীজীর বলে ভেবেছিলাম তাঁদের অধিকাংশই স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের আহ্বানে এসেছে, আর তাঁরা শ্রীশ্রীমার কাছে মন্ত্র নিয়েছে। স্বামীজী কেবল আমাদের পাঁচজনকে আহ্বান করেছিলেন। তিনি আরও কয়েকজনকে গ্রহণ করলেন না কেন? তিনি তো ইচ্ছা করলে শতশত জনকে গ্রহণ করতে পারতেন। সদানন্দ বলেন শেষেরদিকে তাঁর অর্থাভাব হয়েছিল। নিজের আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় ভিক্ষাজীবী সাধুর অপবাদকে ভয় করতেন। তাহলে দেখ, এখানে আমরা জীবনের প্রতি স্বামীজীর নিষ্ক্রিয় মনোভাবের এক নতুন দৃষ্টান্ত পাচ্ছি। তুমি আরও জেনো, যে পাঁচজনকে তিনি আহ্বান করেছিলেন—সদানন্দ ও আমার মত আর কেউ তাঁর সঙ্গে এত বেশিদিন কাটায়নি। এই ব্যাপার আমাকে নতুন আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। এবং সদানন্দ আমাকে মঠের পরিকল্পনাটি কাজে পরিণত করবার জন্য বিশেষ উৎসাহ দিচ্ছেন, যার ফলে নতুন ধরনের একটি মঠ হবে। আমার উদ্দেশ্য হবে একদল ছেলেকে ছ’মাস কাছে রাখা এবং পরবর্তী ছ’মাস পর্যটনে পাঠানো। আবার ছ’মাস অধ্যয়নে নিযুক্ত রাখা ইত্যাদি। অবশ্য অর্থ নিঃশেষ হলে মঠটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এক মার্কিন মহিলা আমার কাছে আসবার জন্য লিখেছেন। যদি তিনি অর্থ ব্যয় করতে পারেন, আমি খুশি মনে তাঁকে গ্রহণ করবো। আমার খুব ইচ্ছা ১৭নং বাড়িটি একটি প্রকৃত আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। কিন্তু আমার কাছে যাঁরা আসবে তাঁদের সম্বন্ধে লোকে যেন খবরদারি করতে না আসে। আমি চাই না যে আমার কাছে আসবার আগে কেউ তাঁদের পরীক্ষা করুক, বা উৎসাহ দিক বা নিরুৎসাহ করুক। অনেকেই বাতিল করে দিয়েছে এমন উপাদান থেকেই আমি গৃহ গড়ে তুলতে পারি এবং যতক্ষণ তাঁরা আমার নিজের লোক থাকবে ততক্ষণ আমি অন্য কিছু গ্রাহ্য করি না। অধিকন্তু আর্থিক সঙ্গতি সমস্ত পরিকল্পনাকে নিরাপদ করবে। … সুতরাং প্রথমে আমি একজন কর্মীকে গ্রহণ করবো, তাঁকে ভাল করে শিক্ষা দেবো (ছেলে বা মেয়ে যেই হোক), তারপরে তাঁদের অন্যত্র পাঠাবো। তাঁরা প্রথমেই অপর কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এলে আমার সেই উৎসাহ থাকবে না। ১৭নং থেকে দক্ষিণেশ্বরে এবং বেলুড় মঠে এত সহজে যাওয়া যায় যে তার মধ্যে নিশ্চিতই একটা আকর্ষণ আছে। সেই সঙ্গে পারিশ্রমিক না দিয়ে একজন ইংরেজ মহিলাকে নেব। আমি তার করে ১৭নং বোসপাড়া লেনের বাড়ি সংলগ্ন জমিটি নিতে বলেছি, যদিও ভাড়া বেড়ে এখন মাসিক পনেরো টাকা হয়েছে কিন্তু সমস্ত পল্লীর জন্যই ওখানে একটি বাগান করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
মনে ক’রো না আমি একটি যন্ত্রমাত্র; যদিও আমি সবকিছুর প্রতি অদ্ভুতভাবে নিরাসক্ত, কেবল কাজ ছাড়া যে কাজের কোনও শেষ নেই। প্রায় একান্তভাবে নিরামিশাষী হলেও বর্তমানে আমি কোনও দ্বিধা না করে যে প্রকার আহার পাই তাই গ্রহণ করি।
ইতি—
নিবেদিতা
কলিকাতা
৮ই মার্চ, ১৯০৫।”
“প্রিয় মিসেস বুল,
আজ বুধবার। আজ শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথি। সকালে গোলাপ ফুল নিয়ে মঠে গিয়েছিলাম। তারপরে দুপুর পর্যন্ত কেবল কাজ আর কাজ—আমি একেবারে পরিশ্রান্ত। মনে হয়, সেসব তোমাকে বলতে গেলে কেবল কাজের কথা বলা হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার প্রাণ একটু প্রেমভক্তির কথা বলবার জন্য আকুল।
মন্দ খবরগুলি তুমি নিজেই শুনতে পাবে। বর্তমানে বলবার মত সংবাদ সবই মন্দ। সংগ্রাম প্রতিদিন তীব্রতর হচ্ছে। মানুষের দুর্নীতি দিন দিন বাড়ছে এবং অসাধুতারই জয় হচ্ছে। ফলে তিক্ততার সৃষ্টি। হায়! মা, আমরা কি করতে পারি? এ যেন হাত দিয়ে মহাসাগরের প্রবাহ রোধের ব্যর্থ চেষ্টা। সেইরকম—ঠিক যেন সেইরকমই মনে হচ্ছে।
কিন্তু তবু আধ্যাত্মিক দিক থেকে আজ শ্রীরামকৃষ্ণ একটি শিশু। শিশুর কাছে আমরা কিছুই চাই না। আমরা তাঁকে সব দিই—তাই বাতাসও পূজার ভাবে পরিপূর্ণ, আর এই মুহূর্তে সন্ধ্যারতির ঘণ্টার শব্দ কি মধুর। জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই—এই চিন্তা এখন কি স্বস্তির! সন্ধ্যাবেলা তারার আলো, দ্বিতীয়ার চাঁদ আর প্রার্থনা এ সবই যেন শ্রীশ্রীমায়ের সান্নিধ্যের মত। সেও তো গোধূলির প্রগাঢ় মাধুর্যের মত—বিশেষ করে যখন তিনি পূজারতা। আহা, কি অপরূপ! কিন্তু অন্য সবদিকে স্বাধীনতার উপর ক্রমাগত আঘাত আসছে—এবং তার ফল ক্রমশঃ মন্দ ও নৈরাশ্যব্যঞ্জক। এই যে কার্জন নামে ব্যক্তিটি—যেন ঔদ্ধত্য আর দুষ্টামির প্রতিমূর্তি।
অন্যরকম কিছু একটার মধ্যে আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন আরও বেশী। আমার কত না ইচ্ছা হয় যে গভীরতর শান্তি নিয়ে আসি। আমার জন্য এই শান্তির প্রার্থনা করতে তুমি বিরত হয়ো না; অপরের জন্য সেই স্থির আলোকশিখার জন্য প্রার্থনা করতেও বিরত হয়ো না, যা কখনো কল্পিত হয় না—যেখানে সকলই বীর্য ও মাধুর্যের সঙ্গে বিবৃত।
তোমার
এম (M)।”
স্বামী বিবেকানন্দের কণ্ঠে সনাতন ভারতের শাশ্বত বাণীর অপূর্ব ব্যাখ্যা শুনে এবং তাঁর বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসে রত্নস্বরূপা যে ক’জন বিদেশিনী ভারতকে ভালবেসে এদেশের নিজেদের কল্যাণার্থে মন ও প্রাণ নিয়োজিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে নিবেদিতার সাথে মিস ম্যাকলাউড ও মিসেস ওলি বুলের নামও কিন্তু ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। আর স্বামীজীকে কেন্দ্র করেই নিবেদিতা, ম্যাকলাউড ও মিসেস বুল প্রগাঢ় প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হতে পরেছিলেন।#