“দুপুর ঝাঁপিয়েছিল ফুলের চাবুকে!
এই যে বিষণ্ণ পথ, কবির পোশাক
রুমালে চাবির গন্ধ, ছুরির পাহাড়
তুমি কি হালকা শাড়ি, দূরের বাতাস?
করবীর রক্ত দিয়ে আমাদের চাষ!”
পড়ছিলাম দেবগুরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জলের ঈশ্বর’ (ডিসেম্বর ২০২৩) কাব্যগ্রন্থটি। বাংলা কবিতার বৈচিত্র্যময়তায় বারবার বাঁক বদল ঘটেছে আর ঘটিয়ে চলেছেন সচেতন বাঙালি কবিরা। হ্যাঁ, দেবগুরু তাঁদেরই অন্যতম। নির্মেদ কাব্যের ৪০টি কবিতাতেই তিনি যে জাদু বাস্তবের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন এবং কবিতাকে ভিন্নমাত্রায় পৌঁছে দিতে পেরেছেন একথা বলাই বাহুল্য। যে বিশেষণ প্রয়োগ এতদিন ঘটেছে, যে উপমার ব্যবহার হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই এই কাব্যে তা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। উল্লেখিত অংশেই ফুলের চাবুক, বিষণ্ণপথ, রুমালে চাবির গন্ধ, ছুরির পাহাড়, হালকা শাড়ি ঘরের বাতাস, করবীর রক্ত এক অনস্বাদিত ব্যবহার। সম্পূর্ণ ভিন্ন উপমা , ভিন্ন রূপকের চাল প্রতিটি কবিতায় রয়েছে। ‘মাটির পালক’ নামে আরেকটি কবিতায় লিখেছেন:
“সাঁতারের অপচয়ে ছলনা শোকায় রোদ
আর পাশ ফিরে শুয়ে থাকে
পলাশের লাল হাহাকার—
অপেক্ষার কষ্ট দিয়ে তুমি
খোঁপা করে বাঁধো অন্ধকার”
সাঁতারের অপচয় কতটুকু অনুভব করা যায়? রোদের ছলনা শুকানো আমরা কি জানি? পাশ ফিরে শুয়ে থাকা পলাশের লাল হাহাকারকে কি নিরীক্ষণ করা সম্ভব? অপেক্ষার কষ্ট দিয়ে খোঁপা করে অন্ধকার বাঁধাও উপলব্ধি করা যায় না। অথচ এসবই বাস্তবতার ভিতর দিয়ে চলে গেছে জাদুবাস্তবের পর্যায়ে। তাহলে জাদুবাস্তবতা কেমন ভাবে কবিতায় প্রয়োগ হতে পারে আমরা একটু জেনে নিই।
জাদুবাস্তবের প্রভাবে দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবসম্মত বর্ণনাও জাদুকরী বা কাল্পনিক উপাদানের সাথে একত্রে মিশে যায়। কবি অতিপ্রাকৃত উপাদানের সাথে বাস্তবসম্মত বর্ণনাকে মিশ্রিত করেই একটি অনন্য আখ্যান নির্মাণ করেন। বিস্ময় ছাড়াই তা খুব স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসে। প্রতীকবাদ এবং রূপকের মধ্যে দিয়েই জাদু-বাস্তব গভীর অর্থ, থিম এবং আবেগ প্রকাশ করার জন্য উপাদানগুলি ব্যবহৃত হয়। সমৃদ্ধ কল্পনাপ্রসূত জগৎ তৈরি করতে সাংস্কৃতিক লোককাহিনি, পৌরাণিক কাহিনি এবং কুসংস্কারের প্রতিও কবি আকৃষ্ট হন। বিস্ময় এবং মুগ্ধতার অনুভূতি তৈরি করতে প্রাণবন্ত স্বপ্নের মতো চিত্রকল্পও ব্যবহার করেন। অনন্য পাঠের অভিজ্ঞতা তৈরি করতে রূপ, কাঠামো এবং ভাষা নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন।
দেবগুরু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকা এক জলের ঈশ্বরকে চেতনা প্রবাহে জাগিয়ে তুলেছেন, যে ঈশ্বর জীবনের গভীর রহস্যময়তাকে তুলে ধরেছে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে বাস্তবের চেনা শব্দগুলিও অচেনায় রূপান্তরিত হয়েছে এবং সেটাতেই কবির মুক্তি। ‘বাস্তুদোষ’ কবিতায় লিখেছেন :
“শঙ্খ লাগে দুটি বুকে ভিতু আত্মরতি
তবু তো দূরত্ব আঁকো ফণা বাস্তুদোষে
তোমার চোখের কোণে দরজা ভাঙা ঘর
আমার রক্তের ফোঁটা অবিকল জলের ঈশ্বর”
রক্তের ফোঁটাতেই জলের ঈশ্বর আবিষ্কার হলেও রক্তের তারল্যে আমরা সম্পর্কের গভীরতাকে খুঁজে পাই। সর্প ধর্মের ভেতর জীবনের অন্বয়ও অনেকখানি বহন করে চলে। এই কবিতাতেই আছে সংস্কৃতি, চর্যাপদের লুইপা এবং সহজিয়া রোদের কথা। ডোমনীর শরীরও। তেমনি আছে পদাবলির কৃষ্ণ-কুঞ্জের চন্দ্রাবলীর উল্লেখও। এই কাহিনি উল্লেখের মধ্য দিয়েই এক অনন্যতার পাঠ দিতে চেয়েছেন। ছন্দের মধ্য দিয়েই এই অনন্যতা। তখন বিশেষণকেও সেই অনন্যতার মধ্য দিয়েই প্রকাশ ঘটান। কাব্যের শেষ কবিতা ‘ফেরা’তে তিনি লিখেছেন:
গোঁজ হয়ে আজ উঠল সকাল জারুল গাছে বক
তোমার দিনটি হলুদ হলে সকাল মারাত্মক
মৃত চিঠির ছাই উড়ে যায়, ভিজতে থাকি রোদে—
পাপড়িগুলো ফুটতে থাকে ফেরার অনুরোধে।”
সবকিছুই বাস্তবতার সীমানার মধ্যে থাকলেও উপলব্ধির এক ভিন্নতা জাদুবাস্তবের ক্রিয়ায় নতুন রূপ পায়।নতুন আখ্যানের সম্ভাবনা অন্বেষণ করতে সাহায্য করে, অনন্য এবং কল্পনাপ্রসূত জগৎ তৈরি করে।বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে, তাদের নতুন এবং অপ্রত্যাশিত উপায়ে বিশ্ব দেখতে উৎসাহিত করে। যেমন ‘প্রণাম মন্ত্র’ কবিতায় লিখেছেন:
“মাটির গন্ধে চাঁদ ভেঙেছিল শোক
অথচ ব্যথায় পালক এঁকেছে পাখি
জলে ভিজেছিল কান্নার দীপাধার
তবু সেই জলে প্রণাম মন্ত্র রাখি।।”
‘বাবা’ কবিতায় লিখেছেন:
“সকালবেলায় একটুখানি রোদ
রাখাল সাজে গোরুর পিঠে যদি
তখন দেখি ভেজা মাটির স্রোতে
বাবা মানেই উঠোনজুড়ে নদী।।”
‘নির্ভরতা’ কবিতায় লিখেছেন:
“বুকের চাদরে তুমি ছেঁকে নাও শোক।
মাঠ, কাদা, ময়ূরাক্ষী আর অনুনয়;
নূপুরের ছন্দে শুয়ে থাকে চরাচর
শ্মশানেরা ভিক্ষাজীবী, মরণ-নির্ভর।”
কবিতার সব অংশগুলিতেই রয়েছে বাস্তবতার এক চ্যালেঞ্জিং প্রয়োগ। বাস্তবতার মধ্যেও এক নতুন বাস্তবের উপস্থাপন। বিশ্বকে নতুন করে দেখানোর আয়োজন। অথচ এর মধ্যেও গভীর কোনো সত্যের ধারণাকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। কবিতা হয়েছে আরও সমৃদ্ধ, কল্পনাপ্রসূত জগতের এবং চিন্তা-উদ্দীপকের সম্মোহনে রহস্যময়।
পাবলো নেরুদার “দ্য ক্যাপ্টেন’স ভার্সেস” সংগ্রহে জাদুবাস্তবের এরকমই উপাদান রয়েছে, যা প্রেম, প্রকৃতি এবং রাজনীতির মিশ্রণে এক নতুন উপস্থাপন। তেমনি ইসাবেল অ্যালেন্ডের কবিতাতেও জাদুবাস্তবের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে। চিলির লোককাহিনি এবং পুরাণের প্রভাব সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জাদুবাস্তবের অনন্যতা দেখিয়েছেন গ্যাব্রিয়েলে গার্সিয়া মার্কেজ, অক্টাভিও পাজ এবং জিয়ানিনা ব্রাশিও। বাংলা কবিতায় জাদুবাস্তবের প্রয়োগ দেবগুরু বন্দ্যোপাধ্যায় অসাধারণভাবেই সম্পন্ন করেছেন। বাংলা সাহিত্যে ‘জলের ঈশ্বর’ কবিতার দিগদর্শনে এক নবতর প্রতিনিধিত্বের পরিচয় হয়েই বিরাজ করবে।
জলের ঈশ্বর: দেবগুরু বন্দ্যোপাধ্যায়, সিগনেট প্রেস, মূল্য ২৫০ টাকা।