ধারাবাহিক উপন্যাস উত্তাল ১৮

।।পর্ব – ১৮।।

আঁধারগ্রাম নিয়ে যাঁরা বিচলিত, সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই যাঁরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন এবং যাঁরা এক্ষুনি এই অবস্থার অবসান চান, তাঁরা এক ছাতার নীচে এসে জড়ো হয়েছেন। সেখানে যেমন আছেন কবি, লেখক, শিল্পী, নাট্যকার, অভিনেতা, অধ্যাপক, সমাজসেবী, তেমনি আছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও।
একদিন দুপুরবেলায় ধর্মতলার মোড় থেকে কয়েকটি ম্যাটাডরে চেপে তাঁরা রওনা হয়ে গেলেন আঁধারগ্রামের দিকে। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে সোজা শ্যাওড়াফুলি-তারকেশ্বর ট্রেন লাইনটাকে টপকে আরও একটু এগিয়ে গেলেন তাঁরা। বাঁ হাতে নেমে গেছে আঁধারগ্রাম বাজার হয়ে তারকেশ্বর যাওয়ার রাস্তা।
পাশে বসা সুজাত ভদ্রকে ম্যাটাডর চালক বললেন, কাউকে জিজ্ঞেস করে নিন না, কোথা দিয়ে যেতে হবে। বলেই, স্লো করে এক ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলেন। সুজাত এ দিকে ও দিকে তাকালেন। দেখলেন, সামনে দিয়ে এক গ্রামবাসী তাঁদের ম্যাটাডরের দিকে এগিয়ে আসছেন। তিনি জানালা দিয়ে মুখ বার করে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আঁধারগ্রামে যাব। কোন দিক দিয়ে ঢুকতে হবে গো?
লোকটা বললেন, আরও এট্টু আগাইয়া যান। দেখবেন, বাঁ হাতে একটা বড় কারখানা আছে। শান্তি সেরামিক। তার পাশ দিয়া একটা রাস্তা নাইমা গেছে কোণে অশ্বত্থতলার দিকে। যেখানে টাটাগো কারখানা হওয়ার কথা। সেইখান দিয়া ঢুকতে পারেন…
ম্যাটাডর এগিয়ে চলল। হঠাৎ ‘দাঁড়ান দাঁড়ান’ বলে চিৎকার করে উঠলেন সুজাতর পাশে কোনও রকমে চেপেচুপে বসা অজিত নস্কর। তিনি আঙুল তুলে বললেন, ওই দেখুন মাইল স্টোন।
সুজাত দেখলেন, রাস্তার ধারে বাটনা বাটা শিলের মতো দাঁড় করানো একটা পাথরের ফলকের উপরে লেখা– দুর্গাপুর ১২৯। আর তার নীচে– বর্ধমান ৬৭। তার পাশ দিয়ে নেমে গেছে একটা মাটির রাস্তা। কিন্তু এ দিকে ও দিকে তাকিয়েও আশপাশে ওঁরা কোনও বড় কারখানা দেখতে পেলেন না। দু’-তিন জন চাষি পিছন দিক থেকে এসে বাঁ দিকের ওই মেঠো রাস্তায় ঢুকতে যাচ্ছিলেন, গাড়িতে বসেই মুখ বাড়িয়ে সুজাত তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, এই রাস্তাটা কোন দিকে গেছে গো?
ওঁদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলেন, ই রাস্তাটো সুজা চুলি গিছে রতনপুর মুড়ের দিকে। ইখান থিকা মুধ্য গোপালপুর খুবই কাছে।
সুজাতর প্রায় কোলের ওপর ঝুঁকে কোনও রকমে জানালার কাছে মুখ নিয়ে অজিত নস্কর বললেন, ও, আচ্ছা। বুঝেছি। আচ্ছা, এখান থেকে শান্তি সেরামিক কারখানাটা কত দূরে?
ওঁদের মধ্যে থেকে অন্য আর একজন দু’পা এগিয়ে এসে বললেন, আর এট্টু আগাইয়া যান। সামনেই।
চালকের দিকে তাকিয়ে সুজাত বললেন, ‘সামনে’ বলেছে যখন আস্তে আস্তে চালাও । আবার ছাড়িয়ে না যাই।
অজিত নস্কর একটানা বেশিক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে পারেন না। তিনি বলতে শুরু করলেন, গ্রামের লোকের কাছে ‘সামনে’ মানে কি জানেন তো? ওঁরা দশ মাইলকেও সামনে বলে। একবার বহুড়ুর কোন একটা গ্রামে যেন গিয়েছিলাম। জায়গাটার নাম এখন আর মনে নেই। স্টেশনে নেমে ওই জায়গাটার নাম বলতেই এক গ্রামবাসী বলেছিলেন, এই তো সামনেই। এই রাস্তা ধরে আর একটু এগিয়ে যান, পেয়ে যাবেন। তার কথা শুনে আমি হাঁটছি তো হাঁটছি। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট। আধ ঘণ্টাও পার হয়ে গেল। ওই গ্রাম আর পাই না। তার পর আর এক গ্রামবাসীকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, এই তো এসে গেছেন। সামনেই। ক’পা হেঁটে যান, দেখতে পাবেন। আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। আমার তো অত হাঁটার অভ্যাস নেই। পা আর চলছে না। মনে হচ্ছে একটু বসতে পারলে ভাল হত। তবু হাঁটছি। এসে পড়েছি যখন, একেবারে তাঁর বাড়িতে গিয়েই বসব। আরও কুড়ি-পঁচিশ মিনিট হাঁটার পর ও দিক থেকে সাইকেল-রিকশা করে আসতে থাকা এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতেই, তিনি বললেন, হেঁটে যাবেন কি মশাই? পারবেন? আরও ঘণ্টাখানেকের পথ। আমি চমকে উঠে বললাম, সে কী! যে-ক’জনকে জিজ্ঞেস করলাম, তারা যে বলল সামনেই।
আমার কথা শুনে ভদ্রলোক হেসে ফেলেন আর কী। তার পরে বললেন, আমি যখন এখানে প্রথম আসি, আমারও এ রকম দশা হয়েছিল। এঁদের কাছে দশ-বিশ মাইলটা কিছুই না। খুবই কাছে। একেবারে দোরগোড়ায়।
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কি এখানকার নাকি?
তিনি বলেছিলেন। না না, আমি এখানে থাকি না। বাঘাযতীনে থাকি। এখানে আমার শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু এখানকার আশপাশের সব ক’টা গ্রামই আমি চিনি। বলেই, রিকশায় বসেই আঙুল তুলে উনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন ক’হাত দূরের একটি সরু মেঠো পথ। বলেছিলেন, আপনি বরং ওই গলিটা দিয়ে একটু এগিয়ে যান। দেড়-দু’মিনিট হাঁটলেই একটা বড় রাস্তা পাবেন। বাঁ হাতে দেখবেন, অনেকগুলো ভ্যানরিকশা দাঁড়িয়ে আছে। ওই ভ্যানরিকশাওয়ালাদের বললেই, ওরা আপনাকে ঠিক পৌঁছে দেবে।
ভাগ্যিস, ওই লোকটার সঙ্গে সে দিন দেখা হয়েছিল। না হলে যে আরও কত মাইল হাঁটতে হত, কে জানে! উফ্, সে বার যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ফলে ওঁদের এই ‘সামনে’ মানে কিন্তু আপনি আবার ভাববেন না, সত্যি সত্যিই সামনে। আমার মনে হয়, এখনও কিন্তু অনেকটা পথ বাকি।
অজিত নস্কর অদ্ভুত টাইপের মানুষ। এমনিতে খুবই চুপচাপ থাকেন। কিন্তু একবার কথা বলতে শুরু করলে তাঁকে থামনো মুশকিল। সেটা সুজাতও জানেন। তাই তাঁর কথায় কোনও উচ্চবাচ্য করলেন না। কারণ, তাঁর কথার পিঠে কোনও কথা বললেই হল। তাঁর বকবকানি আরও বেড়ে যাবে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জড়াতে থাকবে এই কথা সেই কথা। উনি একটানা কথা বলেই যাচ্ছিলেন। সুজাত বললেন, আস্তে আস্তে আস্তে।
অজিত প্রথমে ভেবেছিলেন, উনি বুঝি তাঁকে আস্তে কথা বলতে বলছেন। তার পরেই বুঝতে পারলেন, না, তাঁকে নয়। উনি চালককে বলছেন। কারণ, ‘আস্তে আস্তে আস্তে’ বলা শেষ হতে না হতেই বাঁ দিকের একটা রাস্তা দেখিয়ে উনি বললেন, এই রাস্তাটা হতে পারে। ড্রাইভারের কেবিনে আরও যে দু’জন ঠাসাঠাসি করে আগুপিছু হয়ে বসেছিলেন, তাঁরাও দেখলেন, রাস্তার বাঁ দিক দিয়ে একটা পথ নেমে গেছে। আর তার মুখেই একটা চালাঘর। দূর থেকেই মনে হল, ওখানে লোকজন আছে।
ম্যাটাডরে বসে চিৎকার করে বললে হয়তো ওঁরা শুনতে পাবেন, কিন্তু উত্তর দেবেন কি না সন্দেহ আছে। গ্রামের লোকেরা এ ধরনের ব্যবহারে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেন। ম্যাটাডর হোক বা মার্সিডিজ, ওঁদের কাছে দুটোই গাড়ি। ভাবেন, বড়লোক তো… গাড়িতে বসে আছেন বলে বড় দেমাক। দু’পা নেমে আসতে পারেন না।

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস উত্তাল ১৭

এটা সুজাতও জানেন। গ্রামেগঞ্জে কাজ করতে গিয়ে এ রকম অভিজ্ঞতা তাঁর বহু বার হয়েছে। তাই ম্যাটাডরের পাল্লা খুলে লাফ দিয়ে নেমে ওই চালাঘরের সামনে গেলেন তিনি। দেখলেন, ওটা একটা চায়ের দোকান। দোকানের ভিতরে চার-পাঁচ জন লোক বসে আছেন। কেউ চা খাচ্ছেন। কেউ আবার এমনিই বসে আছেন। একজন বয়স্ক মতো লোক ঘুঘনি-পাউরুটি খাচ্ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করতেই, তিনি বললেন, ইখান থিকা পায়ে হেঁটে গেলে ঠিক আছে, কিন্তু গাড়ি নিয়া গেলে তো আর মেঠো পথে যাওয়া যাবে না। অনেক ঘোরা হবে গো বাবু। রাস্তাও খুব সরু। কোথাও কোথাও রাস্তার ধার এতটাই দেবে গেছে যে, গাড়ি নিয়ে যাওয়া মুশকিল। আপনারা বরং… গাড়ি আছে তো… আর একটু আগাইয়া যান। সামনেই জয়মোল্লাপুর। দেখবেন, ওখানে গাড়িরাস্তার পাশেই একটা মন্দির। সেই হরকালী মন্দিরের পাশ দিয়া একটু ঢুকলেই শুধু আঁধারগ্রাম না, খাসেরভেড়ি, গোপালনগর, পশ্চিমপাড়া, বাজেমেলিয়া– সবই কাছে পড়ব।
গ্রামগুলোর নাম শুনে সুজাত মাথা নাড়ালেন। এখানকার যে ক’জন প্রত্যক্ষদর্শী সে দিন ওঁদের ওই সভায় গিয়েছিলেন, তাঁদের মুখেই উনি শুনেছিলেন, এক্সপ্রেসওয়ের ওপর রতনপুর মোড় থেকে জয়মোল্লাপুর পর্যন্ত পুরো জমিটাই টাটাদের গাড়ি কারখানার জন্য সরকার নির্ধারণ করেছে। তাই আর না দাঁড়িয়ে ম্যাটাডরে উঠে পড়লেন তিনি। বুঝতে পারলেন, এ বার সত্যি সত্যিই তাঁরা খুব কাছে এসে গেছেন।
জয়মোল্লাপুরে নেমে ম্যাটাডরের উপরে থাকা লোকজনদের হাত দিয়ে ইশারা করে সুজাত ডাকতেই, সবাই হইহই করে নেমে পড়লেন। তার পর হরকালী মন্দিরে প্রণাম করে মন্দিরের গা ঘেঁষা রাস্তা দিয়ে ওঁরা হাঁটতে শুরু করলেন। চারিদিক কী শান্ত। চুপচাপ। কিছুটা যেতেই দেখলেন, দু’পাশে পাকা ধান খেতের হলদে রং আর সম্ভবত ওই ধান লাগানোর অনেক পরে রোয়া অন্য জাতের হাতখানেক লম্বা কিশোরী ধানশীষের সবুজ রং মিলেমিশে একেবারে একাকার হয়ে আছে। মাঝে মাঝে হুহু করে বয়ে যাওয়া বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ তাঁদের শরীর শুধু জুড়িয়েই দিচ্ছে না, কানের কাছে যেন সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের সঙ্গে বেশ কয়েক জন মহিলাও রয়েছেন। তাঁরা কেউ কেউ জিনসের প্যান্ট-শার্ট কিংবা সালোয়ার কামিজ পরলেও বেশ কয়েক জন শাড়ি পরে আছেন। হঠাৎ হঠাৎ দমকা বাতাসে তাঁদের আঁচল পতাকার মতো পতপত করে উড়ছে। সামলে রাখা যাচ্ছে না।
পথের দু’পাশে ক’হাত দূরে দূরে বড় বড় গাছ। তাদের ঝাঁকড়া মাথাই বলে দিচ্ছে, তাদের বয়স অনেক। দীর্ঘ দিন ধরেই তারা এখানে আছে। কিন্তু তাদের দিকে তাকাতেই জয় গোস্বামীর মনে হল, গাছগুলোর মুখ খুব মলিন। কেমন যেন দুঃখী দুঃখী। মন-মরা হয়ে আছে তারা। তার পরেই মনে হল, এই গ্রামের মানুষদের মতোই এই গাছগুলিও আজ বিপন্ন। আর কত দিন তারা এখানে এ ভাবে পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কে জানে!
মেঠো পথ ধরে যেতে যেতে কৌশিক সেনের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল বর্ষীয়ান খেত মজুর তারাপদ মৈত্রের। কথায় কথায় কৌশিক বললেন, আপনারা কত দিন ধরে এখানে আছেন?

আরও পড়ুন: নাই মেন ইজ গহরজান

উনি কপাল-টপাল কুঁচকে, অনেক ভেবে, স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে মনে করে বলতে লাগলেন, বাবার মুখে শুনেছি, পশ্চিম দিকে চাঁদবিল নামে যে জায়গাটা আছে, প্রায় দুশো বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা সেখান থেকে এখানে এসেছিলেন। ঠাকুরদা ছিলেন রামগড়ের রাজার দেওয়ান। তাঁরা দল বেঁধে চাষের কাজ করতে এসে সবাই এখানেই থেকে গেলেন। বাসা বাঁধলেন। চারদিকে তখন ফাঁকা জমি। ধুধু করছে সব। সেই জমিতে শাকপাতা, লাউ-কুমড়ো, আলু, ধান, যা-ই পোঁতেন, তা-ই সোনা হয়ে ফলে। মাঝখানে শুধু একটাই গ্রাম দ্বীপের মতো মাথা তুলে আছে। তার নাম দোবাঁদি। বাউড়িরা নাকি ওই গ্রামে তারও অনেক অনেক বছর আগে থেকে বসবাস শুরু করেছিল। সে যাই হোক, আমাদের যে বাপ-ঠাকুরদারা এখানে এসেছিলেন, আস্তে আস্তে তাঁদের ছেলেপুলে-নাতিনাতনি হতে লাগল। পরিবার বাড়তে থাকল। তখন ওই একই বাসস্থানে আর কুলিয়ে উঠল না। ফলে তাঁদের কেউ কেউ ক্রমশ উত্তরের দিকে বসতি গড়তে গড়তে এখন তো বাঁধের ওপরে এসে পৌঁছেছে।
যাঁরা ম্যাটাডরে করে গিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই একটা জায়গা পর্যন্ত একসঙ্গে গিয়ে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়লেন। কোনও দল গেলেন বেড়াবেড়ি, কোনও দল মালিকপাড়া, আবার কোনও দল পূর্বপাড়া, বারোহাত কালীতলা, দুর্গাপুর, সাহানাপুরে। ওখানে গিয়েই স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা জানতে পারলেন, টাটাদের গাড়ি কারখানা করার জন্য যে জমিটা সরকার অধিগ্রহণ করতে চাইছে, সেই ন’শো আটানব্বই একর জমির মালিক মোট এগারো হাজার ঊনত্রিশ জন। সেখানে নাকি আট বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে টাটারা কারখানা বানাবেন।
কিন্তু চাষিদের তিন ভাগের মধ্যে দু’ভাগ মানুষই কোনও মূল্যেই তাঁদের জমি ছাড়তে রাজি নন। যাঁরা রাজি নন, তাঁদের হাতেই প্রায় অর্ধেকেরও বেশি জমি। অথচ ক’দিন আগেই সি পি এমের মুখপত্র গণশক্তির প্রথম পাতায় ফলাও করে ছাপা হয়েছে, ওই জমির নব্বই শতাংশই নাকি সরকারের হাতে এসে গেছে!
ওখানকার গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করতেই কেউ বললেন, জমি আমাদের মা। জমি আমাদের সন্তান। কেউ যদি আপনাকে বলে, দশ লাখ টাকা দিচ্ছি, আপনার একটা ছেলে দিন। আপনি কি দেবেন?
কেউ বললেন, যারা জমি দেবে বলছে, তারা তাদের মা-বউ-মেয়েকেও বেচে দিতে পারে।
আবার কেউ বললেন, আমরা শিল্পের বিরোধী নই। যেখানে ফাঁকা জমি আছে, অনুর্বর জমি আছে, সেখানে ওরা শিল্প করুক। ওরা বলছে, শিল্প কি আকাশে হয়? তা হলে আমি বলি? ধান, শাকসবজি কি কারখানায় হয়?
আর একজন তো অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গেই রেগে গিয়ে বললেন, এখান থেকে আর দেড় কিলোমিটার বর্ধমানের দিকে সরে যাক না। ওখানে তো এক ফসলি কত জমি পড়ে আছে। যত পারে কারখানা করুক। কে বারণ করেছে? মন্ত্রী হয়েছে! মন্ত্রী না হাতির মাথা। ঠান্ডা ঘরে বসে বলে দিলেই হল, চাষে কোনও লাভ নেই। উনি কোনও দিন চাষ করেছেন? জানেন, তিন ফসলি জমি মানে কি? খালি বড়লোকদের তাঁবেদারি করা, না?
বারোহাত কালীতলার দিকে যে দলটা গিয়েছিল, তার মধ্যে ছিলেন কবীর সুমন। তিনি তখন গলা ছেড়ে গান ধরেছেন, হাল ছেড়ো না বন্ধু… তাঁর সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন বাকিরাও। হাততালি দিয়ে তাল দিচ্ছেন তাঁরা। আর কবীর সুমন হাঁটতে হাঁটতে আরও উদাত্ত কণ্ঠে একটার পর একটা গান গেয়ে যাচ্ছেন। কখনও নিজের, কখনও অন্যের গাওয়া গান। দলটার পিছন দিকে পড়ে গিয়েছিলেন বোলান গঙ্গোপাধ্যায়। ক’দিন ধরেই তাঁর পায়ে একটা ব্যথা হচ্ছে। একটু হাঁটলেই যন্ত্রণা হয়। তাই ওঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাঁটতে পারছেন না। ওঁরা মধ্যপাড়ার মধ্যে ঢুকতেই এ বাড়ি ও বাড়ির ভিতর থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে এলেন ছেলে-বুড়োরা। বাদ গেলেন না মেয়ে-বউরাও। কেউ বললেন, আমাদের দাওয়ায় বসেন। কেউ ওঁদের দেখেই বসার জন্য উঠোনে তাড়াতাড়ি চট বিছোতে লাগলেন। আবার কেউ ঘটি করে খাওয়ার জল নিয়ে এলেন। কেউ বললেন, মুড়ি মেখে দেব নারকোল দিয়ে?
এ গ্রামে প্রায় একশো ঘরের মতো বাগদি, মানে বর্গক্ষত্রীর বসবাস। তার মধ্যে পঞ্চাশ-ষাট ঘর ভূমিহীন। কয়েক ঘর ভাগে চাষ করে। সংখ্যাটা কম হলেও, তাঁদের কারও কারও নামে বর্গা রেকর্ড করা আছে। সত্যিই যদি সরকার শেষ পর্যন্ত জোর করে জমি নিয়ে নেয়, তা হলে ওঁরা ক্ষতিপূরণ পাবেন। তবে বেশির ভাগেরই বর্গা রেকর্ড করা নেই। তাঁরা জমির ওপর প্রত্যক্ষ ভাবে খুব একটা নির্ভরশীলও নন। ওঁদের পুরুষদের জীবিকা বলতে মূলত জমির ফসল বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা। আর মহিলাদের একটা বড় অংশ পেট চালান ঘোষদের মতো বড়লোকদের বাড়িতে কাজ করে। এই গ্রামে দশ-বারোটা ঘরে নিজস্ব ভ্যানরিকশাও আছে।
বাগদিপাড়ায় শিক্ষার আলো সে ভাবে পৌঁছয়নি। বেশির ভাগেরই শিক্ষা প্রাথমিক স্কুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কারণ, এখানকার লোকদের পক্ষে পড়াশোনার খরচ চালানো খুবই মুশকিল। শুধু স্কুলে দিলেই তো হবে না। তাদের পড়াতে হবে। কিন্তু বাবা-মায়েরা তো নিজেদের নামই সই করতে পারেন না। পড়াবেন কী? পড়াতে গেলে শিক্ষক রাখতে হবে। তার খরচ চালাবে কে? স্কুলে মাইনে দিতে না হলেও বইখাতা-পেনসিল তো কিনতে হবে! তার চেয়েও বড় কথা, এখানকার পরিবারদের সংসারের খরচ তো শুধু মা-বাবার আয়ে চলে না। বয়স যা-ই হোক না কেন, হাতে-পায়ে বড় হলেই ছেলেমেয়েদেরও কাজে লেগে যেতে হয়। ওরা যদি পড়াশোনা করে, স্কুলে যায়, তা হলে সংসার চলবে কী করে? তবু এরই মধ্যে দু’-একজন অবশ্য মাধ্যমিক পাশ করেছে।
এ পাড়ায় একটা পুরনো পাঠাগারও আছে। এলাকার বর্ধিষ্ণু পরিবার সাহাদের‌নামে। ওঁরাই তৈরি করেছিলেন এটা। ওঁরাই রক্ষণাবেক্ষণ করেন। কিছু বইপত্রও আছে। কিন্তু পড়ার লোক নেই।

আরও পড়ুন: অনন্ত বিকেলের রূপকথারা  

গ্রামে ঢোকার আগেই এ সব খবর পেয়ে গিয়েছিলেন কবীর সুমন, অজিত নস্কর, বোলান দেবীরা। সে দিন ওঁদের ওই সভায় এখানকার যে ক’জন লোক এবং এই অঞ্চলের নানা ঘটনার যে গুটিকয় প্রত্যক্ষদর্শী গিয়েছিলেন, তাঁরাই আজ ওঁদের ভাগ হয়ে যাওয়া ছোট ছোট দলের এক-একজন গাইড।
ওঁদের দলটাকে যিনি পথ দেখিয়ে মধ্যপাড়ায় নিয়ে এসেছেন, তিনি আগেই এখানকার লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলেন। সময় অল্প, তাই তাঁদের যা যা অভিযোগ আছে, দাবি আছে, তাঁরা যা চান এবং চান না, সেগুলো যেন আগে থেকেই তাঁরা ভেবেটেবে নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলে, ওঁদের কী বলবেন সব ঠিক-ঠাক করে রাখেন। যাতে ওঁরা এলেই, ঝপাঝপ করে তাঁরা সব বলে ফেলতে পারেন। সেই মতো তাঁরা তৈরি হয়েই ছিলেন। বিশাল উঠোনের উপরে পাতা চটের মধ্যে যে যাঁর মতো কবীর সুমনরা বসতেই, তাঁরা ওঁদের ঘিরে কথা বলতে লাগলেন। কিন্তু তাঁদের কারও কথাই বোলান দেবীর কানে ঢুকছিল না। মনে হচ্ছিল, এঁদের যেন কোথায় দেখেছেন! কিন্তু কোথায়! কবে!
হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে গেল, আঁধারগ্রামের লোকজনদের উপর অকথ্য অত্যাচার হচ্ছে, রীতিমত নিপীড়ন চালানো হচ্ছে শুনে, উনি এতটাই বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন যে, আর থাকতে না পেরে এর মধ্যে একদিন একা-একাই আঁধারগ্রামে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েছিলেন। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের উপরে গাড়ি থেকে নেমে তিনি একেবারে থ’। কত বার এই রাস্তা দিয়ে গেছেন। কিন্তু কই, এ ভাবে তো তাঁর চোখে এগুলো কখনও পড়েনি। ঝকঝকে নীল আকাশ আর সবুজ ধান খেত মিশে যাওয়া প্রান্তরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখছিলেন। হঠাৎ খেয়াল হল, তিনি তো এটা দেখতে আসেননি। তাঁকে তো আঁধারগ্রামে যেতে হবে। ওই অসহায় মানুষগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তাঁদের সঙ্গে একটু কথা বলতে হবে। কিন্তু ওখানে যে কী ভাবে যেতে হয় উনি জানেন না। কাউকে যে জিজ্ঞেস করবেন, তারও উপায় নেই। আশপাশে কাউকেই দেখতে পাচ্ছেন না। কী করবেন যখন ভাবছেন, ঠিক তখনই কোথা থেকে এক বৃদ্ধ আচমকা তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় হঠাৎ উনি দেখেন, তাঁদের থেকে মাত্র বিশ-পঁচিশ হাত দূরে ঢালু জমির এ দিক ও দিক থেকে কতকগুলো মাথা যেন উঁকিঝুঁকি মারছে। সচকিত হয়েছিলেন তিনি। আগেই শুনেছিলেন, গোটা গ্রামটাকে ঘিরে রাখার জন্য শুধু এ রাজ্যের দাগি আসামি বা দুষ্কৃতীদেরই নয়, ভিন রাজ্য থেকেও বিভিন্ন অপরাধীদের ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়েছে। ওটা মনে পড়া মাত্রই তিনি চমকে উঠেছিলেন। তা হলে কি ওরাই ফলো করছে তাঁকে।
তাঁর চোখ-মুখ দেখে বোধহয় ওই বৃদ্ধ কিছু বুঝতে পেরেছিলেন। তাই বলেছিলেন, ভয়ের কিছু নাই। ওরা আমাগো লোক। নতুন লোকের সঙ্গে কথা কইতে দেখছে তো, তাই লুকাইয়া লুকাইয়া দেখতাছে। বলেই, উনি ওঁদের উদ্দেশে হাঁক পেড়েছিলেন, আয়রে, ইদিক পানে আয়। ভয়ের কিছু নাই। উনি ভাল মানুষ। আয় আয়।
ওঁরা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর কাছে। তিনি একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন। আর ওঁরা উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। উত্তর দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে শুধু এ দিকে ও দিকে তাকাচ্ছিলেন। তাঁদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছিল এক ভয়ানক আতঙ্কের কালো ছায়া। বোলান দেবী সে দিনই টের পেয়েছিলেন, মানুষ কতখানি অত্যাচারিত হলে সামান্য কিছুতেই এত কুঁকড়ে যান। আতঙ্কে দিন কাটান। কেমন আছেন ওঁরা? ওদের পরিবারের লোকজনেরা? উনি সেটা নিজের চোখে দেখতে চেয়েছিলেন। তাই সে দিনই তাঁদের গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য উনি তাঁদের কাছে পীড়াপীড়িও করেছিলেন। কিন্তু ওঁরা নিয়ে যেতে চাননি। বলেছিলেন, এখন গ্রামে ঢুকবেন না। শুনলাম, খানিকক্ষণ আগেই নাকি বাইক-বাহিনী ঢুকসে। নতুন লোক দেখলে ওরা যে কী করব, তার কোনও ঠিক ঠিক-ঠিকানা নাই। আপনারেও নিশ্চয়ই ছাড়ব না। আর আমাগো তো কথাই নাই।
নিজের প্রাণের ভয়ে নয়, উনি সে দিন ওঁদের গ্রামে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিলেন শুধুমাত্র ওঁদের কথা ভেবেই। ওঁদের ওপরে যাতে কোনও রকম অত্যাচার না হয়। তবু ওঁদের বলেছিলেন, আমি এখন চলে যাচ্ছি ঠিকই। কিন্তু এর পর যে দিন আসব, সে দিন কিন্তু আমি তোমাদের গ্রামে যাব। যাবই। তাতে যা হয় হবে। তাঁর কথা শুনে ওঁরা অসহায়ের মতো শুধু তাঁর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলেন।
সে দিন বেশিক্ষণ কথা হয়নি। কারও মুখই সে ভাবে দেখা হয়নি। তবু বুঝতে পেরেছিলেন, যেটুকু দেখেছেন, তাতেই ওঁদের ভয় আর আতঙ্ক মেশানো মুখগুলো উনি কোনও দিনই ভুলতে পারবেন না। ভুলতে পারেননি দেখেই উনি আজ অনায়াসে শনাক্ত করতে পারলেন, এঁরাই ওঁরা। ঠিক তখনই ওঁদের মধ্যে থেকে একজন অবাক মেশানো গলায় বলে উঠলেন, দিদিমণি আপনে?

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!