ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ২১

।। পর্ব – একুশ।।

এত জায়গা থেকে এত নামী-দামি লোক আঁধারগ্রামে এসে খোঁজখবর নিয়ে যাচ্ছে, অথচ যে-লোকটা তাদের ওই অসহায়তা, মুখ-বন্ধ করে সরকারি এবং সরকারি মদতপুষ্ট কিছু দানবের তাণ্ডব সহ্য করা, পড়ে পড়ে মার খাওয়াটাকে সহ্য করতে না পেরে এগিয়ে এসেছিল, প্রতিবাদ করার শক্তি জুগিয়েছিল, পুরো ব্যাপারটাকে একটা আন্দোলনের চেহারা দিয়েছিল, আর পাঁচ জনের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল এখানকার দুর্বিসহ-মর্মান্তিক ঘটনার কথা, সেই তেরো নম্বরের কোনও হদিশ নেই। তবে কি ওদের তালিকা অনুযায়ী আর তেরো নম্বরে নয়, তার অনেক আগেই ওর নামটাকে খতম তালিকায় নিয়ে এসে চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছে তাকে! দিতেই পারে। ওরা যা! ওদের বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু তেমন কিছু ঘটলে তো তার দেহটা অন্তত পাওয়া যেত! অনেক দিন হয়ে গেল, কোনও ঝোপঝাড় কিংবা নির্জন পুকুর পাড়ে কারও ক্ষত-বিক্ষত কিংবা ঝলসে বিকৃত হয়ে যাওয়া, শনাক্তেরও অযোগ্য কোনও দেহ তো পাওয়া যায়নি! যদিও একটা আশার কথা শুনিয়েছে তার বউ।
ছোট্ট মেয়েকে বুকে জড়িয়ে সে বলেছে, ভয়ের কিছু নেই। আমার মনে হয়, ও ঠিকই আছে। আসলে দিন কতক আগে সুভাষগ্রামের নবীন মাস্টারের জরুরি তলব পেয়ে সেই যে ও গেছে, গেছে তো গেছেই, এখনও কোনও খবর নেই। নবীন মাস্টারের ফোন নম্বরটা দিয়ে গেলে না হয় একটা ফোন করে খবর নেওয়া যেত কিংবা ঠিকানা থাকলেও না হয় একবার গিয়ে দেখে আসা যেত, ও কোনও খবর দিচ্ছে না কেন। কিন্তু সে সব কিছুই রেখে যায়নি। আর সুভাষগ্রাম তো একটুখানি জায়গা নয় যে, গেলেই তাঁর খোঁজ পাওয়া যাবে। তা ছাড়া আমি ঠিক জানিও না, ও কি সুভাষগ্রামেই আছে, না অন্য কোথাও! কোথায় যে আছে কে জানে!

আরও পড়ুন: পরব ভাঙা হাটের হাটুরে ২

জাপানের কাইয়ুশরের পশ্চিম সমুদ্র উপকূলের একটা ছোট্ট গ্রাম– মিনামাটা। বিংশশতাব্দীর গোড়ার দিকে জাপানের বিখ্যাত কোম্পানি নিপ্পন কেসসো সেখানে গড়ে তুলেছিল একটা কার্বাইড কারখানা। কিন্তু শুধু কার্বাইড তৈরি করে যথেষ্ট লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছিল না দেখে, তারা আস্তে আস্তে কার্বাইড থেকে তৈরি করতে শুরু করে ক্যালসিয়াম সালফাইড। তাতে মুনাফা বাড়তেই, আরও আরও আরও টাকার মুখ দেখার জন্য তারা বানাতে শুরু করে অ্যামেনিয়াম সালফেট-সমৃদ্ধ রাসায়নিক সার। কয়েক বছরের মধ্যে অত্যন্ত দ্রুত তালে কোম্পানিটি ফুলে-ফেঁপে উঠতেই ওই কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ব্যবসা বাড়াতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পৃথিবীর আর একটি বৃহৎ কোম্পানি– মিৎসুবিসি।
ওই কোম্পানি ১৯৩০ সাল থেকে পৃথিবীর সেরা রসায়নবিদদের দিয়ে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে পারদের যৌগ ব্যবহার করে এক সময় অ্যাসেটিলিন তৈরির প্রযুক্তি আয়ত্ত করে নেয় এবং কালবিলম্ব না করেই বানাতে শুরু করে দেয় অ্যাসেটিক অ্যাসিড, অ্যাসিটোন, বিউটালন-সহ বিভিন্ন জৈব। আর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ওই কোম্পানি অ্যাসেটিলিন কেমিস্ট্রিতে গোটা দুনিয়ার ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে। শুধু নিজেদের দেশেই নয়, কোরিয়া-সহ বিশ্বের নানা দেশে একের পর এক নিপ্পন কেসসোর সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে থাকে।
ওই কোম্পানির এই আকাশছোঁয়া সাফল্যয় মিনামাটার চেহারাটাও বদলে যেতে থাকে। কোম্পানির কর্মচারীদের জন্য গড়ে উঠতে থাকে প্রচুর রাস্তাঘাট, বড় বড় সেতু, যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্কুল, কলেজ, অত্যাধুনিক হাসপাতাল, বাজার, রেলওয়ে স্টেশন। একেবারে গণ্ডগ্রামটি মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই প্রথমে নগর, তার পরে পুরোদস্তুর মহানগর হয়ে ওঠে।
কিন্তু বাইরের ওই চোখ-ধাঁধানো চাকচিক্য আর বিলাস-বৈভবের নীচে ঢাকা পড়ে যেতে থাকে অনেক না‌ বলা কাহিনি। লোকচক্ষুর আড়ালে তিলে তিলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে থাকে মৎস্যজীবী সম্প্রদায় থেকে শুরু করে কৃষক সম্প্রদায়। অতি দ্রুত ভেঙে পড়তে থাকে কৃষি ব্যবস্থাও।
কেউ জানতেই চাইল না, ওই আলোর রোশনাইয়ের নীচে কোনও অন্ধকার চাপা পড়ে আছে কি না। কেউ জানতেই পারল না, ওই কারখানা থেকে বার হওয়া অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য পদার্থ নালা দিয়ে এসে সমুদ্রে পড়ে কেমন করে বিষাক্ত করে তুলছে সমুদ্রের জল। সেই জলে দূষিত হয়ে উঠছে জলজ উদ্ভিত থেকে সামুদ্রিক প্রাণী, এমনকী মাছও। সেই মাছ খাওয়ার ফলে, ওই সমুদ্রের জলে স্নান করার ফলে শেষ পর্যন্ত যা ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে শুরু করেছে মানুষের শরীরে।

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ২০

অবস্থাটা ভয়াবহ রূপ নেয় ১৯৫৬ সালে। একদিন হঠাৎ একটা অদ্ভুত উপসর্গ নিয়ে মিনামাটার হাসপাতালে ভর্তি হলেন চার জন রোগী। তার পর থেকে একে একে আরও অনেকে। আসার পর থেকে মাঝে মাঝেই তাঁরা মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলেন। হঠাৎ হঠাৎ শুরু হচ্ছিল খিঁচুনি ধরা। থেকে থেকেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। কেউ কেউ থরথর করে কাঁপছিলেন। তার মধ্যে কেউ কেউ তো আবার কোমায়ও চলে যাচ্ছিলেন। এমনকী, চিকিৎসা শুরুর আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিলেন অনেকে।
এ রকম রোগের কথা তার আগে কেউ কোনও দিন শোনেনি। ফলে, ওই রোগাক্রান্তদের ঠিক কী কী ওষুধ দেওয়া উচিত, শরীরের কী কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন, কী কী বিধিনিষেধ মানা দরকার। ওটা আদৌ ছোঁয়াছে রোগ কি না, তাও বুঝে উঠতে পারছিলেন না চিকিৎসকেরা। তাই স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগে তড়িঘড়ি একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে তাঁরা আলোচনায় বসলেন– এই রোগ নিরাময়ে আমাদের কী কী করণীয়, এই রোগ যাতে আর না ছড়ায়, তার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি এবং এই রোগ মোকাবিলা করার জন্য কী কী আগাম ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যিক।
একজন বয়স্ক ডাক্তার বললেন, কী করা উচিত, এক্ষুনি বলা যাবে না।
তাঁর পাশেই বসে ছিলেন সদ্য ডাক্তারি পাশ করে আসা এক তরুণ ডাক্তার। তিনি জানতে চাইলেন, কেন?
উনি বললেন, এই রোগ সম্পর্কে আমরা এখনও একেবারে অন্ধকারে। ফলে কোনও কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের দশ বার ভাবতে হবে।
তরুণ ডাক্তারটি বললেন, আমাদের হাতে কি অত সময় আছে? তত দিনে যে আরও বহু রোগী মারা যাবেন!
উনি বললেন, তবুও, কী করা যাবে! আন্দাজে ভুলভাল চিকিৎসা করার চেয়ে না করাই ভাল। আমরা ওদের গিনিপিগ বানাতে পারি না।
– তা হলে আমাদের কী করা উচিত?
– উনি বললেন, এটা তখনই বলা যাবে, যখন জানা যাবে, কী থেকে এই রোগ হচ্ছে, কেন হচ্ছে এবং কাদের হচ্ছে।
– তা হলে কাদের হচ্ছে, সেটা আগে দেখি?
এই ‘কাদের হচ্ছে’ খোঁজ করতে গিয়েই জানা গেল, যাঁরা ওই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁরা সকলেই সমুদ্রে মাছ ধরেন এবং নিয়মিত সেই মাছ খান।

আরও পড়ুন: কোটা সংস্কার হলেই কি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হবে?

এই খবর শুনে নড়েচড়ে বসলেন কুমামোতো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক। তাঁরা নাওয়াখাওয়া ভুলে শুরু করে দিলেন খোঁজখবর এবং গবেষণা করে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই জানিয়ে দিলেন, এই মারাত্মক রোগের একমাত্র উৎস সমুদ্রের জলে পড়া নিপ্পন কেসসো কোম্পানির বর্জ্য পদার্থে থাকা মাত্রাতিরিক্ত পারদ।
এই রিপোর্ট জানাজানি হতেই গোটা জাপান জুড়ে হইচই শুরু হয়ে গেল। আগামী দিনের ভয়াবহ ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠল, এক্ষুনি বন্ধ করে দেওয়া হোক নিপ্পন কেসসো। কেউ কেউ বললেন, প্রকৃতিকে দূষিত করার কোনও অধিকার নেই ওদের। কেউ কেউ বললেন, যে মারণ-ব্যাধি ওরা সৃষ্টি করল, তার জন্য পৃথিবীর কাছে চিরকাল দায়ী থাকবে ওরা। কেউ কেউ বললেন, এতগুলো লোকের মৃত্যুর জন্য নিপ্পন কেসসোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দেশ থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চিরকালের জন্য চলে যেতে হবে। অথচ ওই কোম্পানি অত লোকের অত অভিযোগ, অত ক্ষোভ, অত হুমকি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে উৎপাদন চালিয়েই যেতে লাগল।

যাদের বিশাল বড় কোম্পানি, যাদের বিপুল পরিমাণ পুঁজি, সরকারকে পাশে পেতে তাদের কখনও কোনও দেশে কি বিন্দুমাত্র কোনও অসুবিধে হয়েছে? তাদেরও হল না। এবং সে জন্য তাদের বিশেষ কোনও কাঠখড়ও পোড়াতে হল না। ফলে এত বড় একটা অভিযোগ ওঠার পরেও, অন্তত কিছু দিনের জন্য উৎপাদন বন্ধ রাখা তো দূরের কথা, পরিবেশকে বিষমুক্ত করার জন্য ওই কোম্পানি সামান্যতম কোনও উদ্যোগও নিল না। উলটে ওই গবেষকদের রিপোর্টটিকেই তীব্র ভর্ৎসনা করে তুলোধনা করল তারা। তাদের পাশে এসে দাঁড়াল ও দেশের সরকার। নিপ্পনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা স্থানীয় মৎস্যজীবীদের যাবতীয় বিক্ষোভ, সমাবেশ, মিছিলের ওপরে নেমে এল রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন। পুলিশের মারমুখী লাঠিচার্জ, মুহুর্মুহু কাঁদানে গ্যাস। বিশাল পুলিশ বাহিনী দিয়ে ব্যারিকেট গড়ে তুলেও যখন আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করা যাচ্ছে না, তখন প্রয়োগ করা শুরু হল, বহু বছর আগেই ওই দেশ থেকে বাতিল হয়ে যাওয়া, আদিম-আইন। যা কেবল হিংস্র বন্যপ্রাণীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হত।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!