ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ২৩

।।পর্ব – তেইশ।।

রুদ্ধদ্বার বৈঠক বসল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে। সি পি এমের রাজ্য দফতরে। কে নেই সেখানে? বামফ্রন্টের সমস্ত শরিক দলের শীর্ষনেতারা হাজির। বিরোধী দলের লোকেরা এই রাজ্যের মানুষকে এমন সব উলটোপালটা বোঝাচ্ছেন যে, সাধারণ মানুষ তাঁদের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছেন। সন্দেহ প্রকাশ করছেন, তাঁরা বুঝি রাজ্যবাসীকে ঠকাচ্ছেন। ভাঁওতা দিচ্ছেন। আর সেটাকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরা যে ভাবে সাধারণ মানুষকে উসকে দিচ্ছেন, খেপিয়ে তুলছেন, তাঁদের পাল্লায় পড়ে গুটিকতক বুদ্ধিজীবী যে ভাবে তাঁদের নানান কাজকর্মের ন্যক্কারজনক ভাবে সমালোচনা করছেন, তাতে তাঁদের নিজেদের অবস্থানটা ভাল করে বুঝে নেওয়া এবং কী ভাবে তার পালটা জবাব দেবেন, সেই কর্মসূচি ঠিক করার জন্য এই ভাবে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে না বসে তাঁদের কোনও উপায় ছিল না।
বুদ্ধদেব বললেন, চাষে এখন কোনও লাভ নেই। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো বলছে, দেনার দায়ে, অনাহারে আমাদের দেশে প্রতি আধ ঘণ্টায় অন্তত একজন কৃষক আত্মহত্যা করছেন। এত দিন আমাদের রাজ্যে এ সব ছিল না। এখন পশ্চিমবঙ্গেও কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। আমরা চাই না, আর একজন কৃষকও আত্মহত্যা করুক। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী এ রাজ্যে গড়ে প্রতি দশ জনের মধ্যে একজন অনাহারে থাকেন। আধ পেটা খেয়ে দিন কাটানোর ক্ষেত্রে ওড়িশার সঙ্গে যৌথ ভাবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আমাদের রাজ্য। শহরে না‌ খেয়ে থাকার ক্ষেত্রে এ রাজ্য এখন সারা দেশের মধ্যে এক নম্বরে। কেন? কেন এমন হবে? আমি চাই না, আর একটা মানুষও অনাহারে থাকুক। তার জন্য যা করার, তা করতে হবে। যাঁদের কাজ নেই, তাঁদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে হবে।
মুখোমুখি বসে ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা অশোক ঘোষ। তিনি আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি যে দলে আছেন, তার প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু। সেই সুভাষচন্দ্রকে কালিমালিপ্ত করার জন্য তাঁর যাবতীয় কাজকর্মকে অপব্যাখ্যা করে, প্রতিটা ক্ষেত্রেই তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করার জন্যই ভূপেশ গুপ্ত, হীরেন মুখোপাধ্যায়ের মতো লোকজনদের দিয়ে স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই সি পি আই পার্টিকে কাজে লাগিয়েছিল ইংরেজরা। তার বিনিময়ে সেই পার্টি ইংরেজদের কাছ থেকে শুধু টাকা-পয়সাই নিত না, নিত নানা রকম সুযোগ-সুবিধাও। আর তার জন্য কী না করেছেন তাঁরা!
প্রতিনিয়ত শুধু নেতাজির কুৎসাই নয়, তাঁদের ‘নিউ এজ’ পত্রিকার প্রথম পাতায় নেতাজিকে হেয় করার জন্য নিয়মিত ছাপা হত কার্টুন। একবার একটা কার্টুনে গলায় বকলেস পরানো কুকুর হিসেবে দেখানো হয়েছিল নেতাজিকে।
শুধু ‘নিউ এজ’-এই নয়, তাঁদের সাহিত্য পত্রিকা ‘পরিচয়’ও বাদ যায়নি সেই ধারা থেকে। শুধু দলের প্রতিষ্ঠাতা বলে নয়, গোটা দেশ যাঁকে সবচেয়ে বেশি সম্মান করে, ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে, নয়নের মণির মতো আগলে রাখে, স্বাধীনতার জন্য যিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেই নেতাজিকে যারা প্রতিপদে খাটো করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল, সেই সি পি আই ভেঙেই তো এই সি পি এম। তাদের সঙ্গে ফরোয়ার্ড ব্লকের মতো একটি দল যে কী করে গাঁটছড়া বাঁধল, কে জানে!
রাজনৈতিক কারণে হাজার সমঝোতা করে তাঁরা যতই ফ্রন্টের মধ্যে থাকুক, হ্যাঁ-তে হ্যাঁ, না-তে না মেলাক, কিছু দিন ধরেই ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা অশোক ঘোষ কিন্তু খুব বিচলিত ছিলেন। সরকার যা করছে, তা তিনি মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। অথচ মুখে কিছু বলতেও পারছিলেন না। ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিলেন। তাই বুদ্ধদেব যখন বললেন, আমি চাই না, আর একটা মানুষও অনাহারে থাকুক। তার জন্য যা করার, তা করতে হবে। যাঁদের কাজ নেই, তাঁদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। তখন তিনি ফোঁস করে উঠলেন। বললেন, কাজের ব্যবস্থা করতে হবে, সে তো আমরাও জানি। কিন্তু কী ভাবে? ওরা যে ভাবে বিরোধিতা করছে…
সে তো করবেই। যখন কোনও বিনিয়োগকারী আসছিল না। তখন তো ওরাই বলছিল, সরকার কী করছে? নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে নাকি? যখন হাজার চেষ্টা করে, নানান টোপ দিয়ে, বিদেশি বিনিয়োগ আনছি, তখন বলছে, আমরা নাকি দেশটাকে বিদেশের হাতে বিকিয়ে দিচ্ছি। আমার যখন দেশি পুঁজিপতিদের আমাদের রাজ্যে টানার চেষ্টা করছি, তখনও সেটাকে কী ভাবে বানচাল করা যায়, তার জন্য উঠেপড়ে লাগছে। জনগণকে ভুলভাল বোঝাচ্ছে। আমরা কাজ করব, না ওদের বিরোধিতার জবাব দেব!
বুদ্ধদেব বলতেই অশোকবাবুও তাঁর সুরে সুর মেলালেন। বললেন, ওটা তো ওদের কাজ।
– তা বলে রাজ্যের যাতে ভাল হবে, উন্নয়ন হবে, সেখানেও বাধা দিতে হবে? রাজনীতি আগে, না রাজ্যের মানুষের মঙ্গল চাওয়া আগে? টাটাদের এত বড় একটা প্রজেক্ট, কত কষ্ট করে ওদের রাজি করিয়েছি, একলাখি গাড়িটা যাতে আমাদের রাজ্যে করে, যাতে এ রাজ্যের ছেলেমেয়েরা সেখানে চাকরি পায়, তাদের যাতে রুজি-রোজগারের জন্য অন্য রাজ্যে ছুটে যেতে না হয়, সেখানেও রাজনীতি?
অশোক বললেন, দেখুন, আঁধারগ্রামের লোকেরা যদি জমি দিতে না চায়…
– না চায় মানে? আমরা কি বিনে পয়সায় জমি নিচ্ছি নাকি? যা দাম, তার থেকে অনেক বেশিই দিচ্ছি। আর তা ছাড়া বড় কোনও কিছুর জন্য অনেক ছোটখাটো ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়।
এতক্ষণ ওঁদের কথা চুপচাপ শুনছিলেন গৌতম দেব। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তিনি বললেন, আমরাও তো নিউটাউনের জন্য জমি নিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের তো কোনও বিরোধিতার সামনে পড়তে হয়নি। আমাদের প্রজেক্ট ছিল শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন। আমার তো মনে হয়, ওই মডেলটা আঁধারগ্রামে কাজে লাগালে এতটা সমস্যায় পড়তে হত না।
অশোকবাবু ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিলেন। রাজারহাট-নিউটাউন মডেলটা জ্যোতি বসু আর গৌতমবাবুর মস্তিষ্কপ্রসূত। তাই সময় সুযোগ পেলেই তিনি যে কত বড় কাজ করেছিলেন, সেটা জাহির করার চেষ্টা করেন। এ বারও সেটা করলেন দেখে গৌতমবাবুর দিকে তাকিয়ে অশোক বললেন, আপনারাও ঠিক কাজ করেননি। অনেক অন্যায় করেছেন। এ জন্য ভবিষ্যৎ আপনাদের কখনও ক্ষমা করবে না।
– কেন?
গৌতম যত কথা বলেন, নার্ভের অসুস্থতার কারণে তার চেয়ে অঙ্গভঙ্গি করেন অনেক বেশি। বলার পরেই, ভুল বলেছেন বুঝতে পারলেও কিছুতেই ভুল স্বীকার করেন না। উলটে সেটাতেই স্টিক করে থাকেন। হাত-টাত নাড়িয়ে বেশ জোরের সঙ্গে তিনি প্রশ্নটা করতেই অশোক বললেন, রাজারহাট শুধু পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই নয়, সারা ভারতের মধ্যে সবচেয়ে উর্বর জমিগুলোর মধ্যে ছিল একটি। অত ভাল মাটি আর হয় না।
– শুধু মাটি? ওখানে লোকজন থাকতেন না?
– থাকতেন না তা তো বলছি না। কিছু লোকজন থাকতেন। তাঁদের কিছু বসতজমি বাদ দিলে বেশির ভাগ জমিটাই ছিল তিন থেকে চার ফসলি।
গৌতম বললেন, হ্যাঁ, তিন থেকে চার ফসলি জমি… তাই যদি হত, তা হলে বলার সঙ্গে সঙ্গে ওখানকার লোকেরা সুরসুর করে জমি ছেড়ে দিতেন না।
অশোক বললেন, বাজে কথা বলবেন না। কেউ জমি দেননি। আপনারা জোর করে, কৌশল করে কেড়ে নিয়েছেন। আপনি কি জানেন, ওখানে সরকারি সেচের যাবতীয় ব্যবস্থা থাকলেও, চাষের জন্য ওখানে কোনও সেচেরই দরকার হত না। কেষ্টপুর, বাগজোলা খাল আর তার আশপাশের তিনটি পাস খাল থেকে চাষিরা যা জল পেতেন, তাতেই তাঁদের খুব ভাল ভাবে চাষ হয়ে যেত।
– আমি তো শুনেছিলাম, বীজ-ধানও নাকি ছড়াতে হত না। এমনি এমনিই সব ফসল ফলে যেত।
গৌতম তির্যক মন্তব্য করছেন বুঝতে পেরেও অশোক বললেন, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। বলতে গেলে প্রায় সে রকমই। ওখানে ফলন বাড়ানোর জন্য সারেরও খুব একটা দরকার হত না। খুব কম খরচে, অল্প পরিশ্রমে অনেক বেশি ফসল ফলত ওখানে। আউস, আমন ছাড়াও বিভিন্ন জাতের রবি, খারিফ শষ্য চাষ হত। তা ছাড়াও নানান মরশুমের বিভিন্ন ফসলের সঙ্গে অনেক ধরনের শাক-সবজি, ফলমূল, ফুলেরও চাষ হত।
গৌতম বললেন, আপনি এমন করে বলছেন, যেন পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেক ফসল ওখানেই ফলত।
– অর্ধেক না হলেও অনেকটাই ফলত। সেখানে এত ফসল হত যে, ওখানকার চাহিদা মিটিয়েও স্থানীয় চাষিরা কলকাতা ও কলকাতার আশপাশে সেগুলো রফতানি করত। শুধু চাষ নয়, আশপাশের ভেড়ি আর খালবিল থেকে ভেসে আসা বিভিন্ন রকমের জিওল মাছ এলাকার তো বটেই, চারপাশের অন্যান্য গ্রামের গরিব মানুষদেরও কম পয়সায় মাছ খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিত।
– কাদের করে দিত?
অশোক বললেন, কাদের আবার? খোঁজ নিয়েছেন কখনও?
– না, সেটা বড় কথা নয়। আপনি কাদের কথা বললেন যেন?
– আমি বলছি, গরিব মানুষের কথা।
বলার মতো যেন একটা পয়েন্ট পেয়েছেন গৌতম, এমন ভাবে বললেন, সেটা বলুন। গরিব মানুষদের কথা। তার মানে ওখানে চাষবাস করেও মানুষ গরিব ছিলেন। ঠিক মতো দু’বেলা খেতে পারতেন কি না সন্দেহ। যাঁদের হাতে সামান্য টাকা-পয়সাও নেই, জমির বিনিময়ে তাঁদের হাতে অতগুলো করে টাকা তুলে দিয়েছি, সেটা দিয়ে কি ওঁরা নতুন কিছু করতে পারেননি? দোকানপশার কিংবা ছোটখাটো কোনও ব্যবসা?
– না, পারেননি। পারার কথাও নয়। ওখানকার বেশির ভাগ মানুষই ছিলেন ছোট কৃষক কিংবা পরের জমিতে জনখাটা লোক। বংশপরম্পরা ধরে কৃষিকাজের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন তাঁরা। চাষ ছাড়া অন্য কোনও কাজ জানতেন না। সুতরাং জমি অধিগ্রহণের ফলে শুধু জমি নয়, জীবিকা থেকেও তাঁদের উৎখাত করে ছেড়েছেন আপনারা। কারণ, চাষ ছাড়া আর কোনও কাজই ওঁরা জানতেন না। বুঝতেনও না। আর আপনি বলছেন, ওঁরা জমি বিক্রির ওই টাকা দিয়ে দোকানপশার কিংবা ব্যবসা করেছে! যাঁদের জমি নিয়েছেন, এখন তাঁদের কী দশা হয়েছে, একবার নিজের চোখে দেখে আসুন গিয়ে।
– কী অবস্থা হয়েছে?
অশোক বললেন, বললেই তো বলবেন, আমরা ওদের মতো কথা বলছি।
– তা তো বলেনই। তাও বলুন না, শুনি।
– যে টাকা ওঁরা পেয়েছিলেন, সেই টাকা বসে খেতে খেতে এখন তাঁদের হাত একদম খালি। অভাব-অনটন আর দারিদ্রতার মধ্যে কোণঠাসা হতে হতে একদম খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছেন। যে কোনও সময় ওরা দল বেঁধে আত্মহত্যা করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। দেশটাকে আপনারা যে দিকে ঠেলে দিয়েছেন…
গৌতম বললেন, তাই যদি হত, তা হলে কি ওঁরা নিজেদের ভালটা নিজেরা বুঝতে পারতেন না? জমি দেওয়ার আগে একবারও প্রতিবাদ করতেন না?
– প্রতিবাদ করেননি?
– প্রতিবাদ করলে কি রাজ্যের লোকেরা জানতে পারতেন না?
অশোক বললেন, জানতে দেননি। তাঁরা গলা তোলার আগেই তাঁদের গলা টিপে স্তব্ধ করে দিয়েছেন।
– একদম বাজে কথা বলবেন না।
– বাজে কথা! আপনি বাজে কথা বলছেন। এই যে কিছু দিন আগে এত দিনের পুরনো একটা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প, বেঙ্গল ইন্ডিয়া আপনারা একেবারে জলের দরে বেচে দিলেন, সেটা কি ঠিক করেছেন?
– জলের দরে! কে বলেছে আপনাকে?
– যে-ই বলুক, আপনি বলুন, আমি কি ভুল বলছি?
গৌতম বললেন, না, জলের দরে মোটেই বিক্রি করা হয়নি।
– তা হলে কীসের দরে বেচেছেন? সোনার দরে?
– কেনার লোক পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই…
অশোক ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, তা বলে মাত্র একান্ন লক্ষ টাকায় বেচে দেবেন?
– ওর থেকে বেশি দাম দিতে কেউ রাজি হচ্ছিল না…
– রাজি হচ্ছিল না, না নিজেদের লোককে পাইয়ে দেওয়ার জন্য এই গল্পটা ফেঁদেছেন। তারাতলার মতো অমন একটা জায়গায় দশ একরের উপর কারখানা, যার দাম কম করেও পঁচিশ কোটি টাকা হওয়া উচিত, সেটা কিনা বিক্রি করলেন মাত্র একান্ন লক্ষ টাকায়! টেন্ডার ডেকেছিলেন?
গৌতম বললেন, তার প্রয়োজন হয়নি।
– তা হবে কেন? তা হলে যে ঝোলার ভিতর থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়বে।
– আবার বাজে কথা বলছেন। আপনি কি জানেন, এটা সরকারের কত বড় একটা মাথাব্যথার কারণ ছিল। প্রতিদিন কত টাকা ঘাটতি গুনতে হচ্ছিল। আমরা ভেবেছিলাম, টেন্ডার ডাকব। কিন্তু তার আগেই আমরা আমাদের এস্টিমেট অনুযায়ী ক্রেতা পেয়ে গেলাম, তাই…
অশোক বললেন, ক্রেতা পেয়ে গেলেন? ওখানকার এক কাঠা জমির দাম কত জানেন? আপনারা তলে তলে ঊষা কোম্পানি বেচে দিয়েছেন। বেঙ্গল ল্যাম্পে তালা ঝুলিয়ে ছেড়েছেন। কত কর্মচারী যে অনাহারে, রোগে ভুগে, বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন, তার কোনও হিসেব রাখেন?
– তাতে আমরা কী করব?
– ওই কোম্পানির মালিকদের বলুন কারখানাগুলো খুলতে…
– আমরা বহু বার বলেছি। কিন্তু ওরা শুনছে না।
– না শুনলে আপনারা ওগুলো অধিগ্রহণ করুন। নিজেরাই চালান। ওখানেও তো প্রচুর কর্মসংস্থান হতে পারে…
গৌতম বললেন, আমরা কি চেষ্টা করছি না? কিন্তু আইন বলে তো একটা কথা আছে, নাকি? দুমদাম একটা ডিসিশন নিয়ে নিলেই হল?
রুখে উঠলেন অশোক, তা বলে সব বেচে দেবেন?
গৌতম বললেন, আমরা অনন্তকাল কোনও জমি খালি ফেলে রাখতে দেব না।
– এটা ঠিক হচ্ছে না।
ফের হাত-টাত নাচিয়ে মুখভঙ্গি করে গৌতম বললেন, কোনটা ঠিক?
– সুষ্ঠু ভাবে, দরকার হলে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
– সর্বদলীয়! ওদের সঙ্গে? কক্ষনো না। জনগণ আমাদের পাশে ছিল এবং আছে। আমাদের বিশ্বাস করে। তাদের সেই বিশ্বাসের মর্যাদা আমাদের দিতে হবে। তাদের জন্য ভাবতে হবে। কিছু করতে হবে।
অশোক বললেন, করতে হবে? মানে, তাদের উচ্ছেদ করে করতে হবে, তাই তো?
– কাউকে উচ্ছেদ করে কিছু করা হচ্ছে না। তাঁরা যে ভাবে আছেন, তার থেকে আরও ভাল ভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে।
– তাঁরা যেতে না চাইলে, পৃথিবী থেকে তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
গৌতম বললেন, বাজে কথা।
– অত্যাচার তো করা হচ্ছে।
অশোকবাবু আর গৌতমবাবুর বাকবিতণ্ডা চলছিল। তাঁদের দিকে হাত তুলে শান্ত হওয়ার ভঙ্গিমা করে বুদ্ধদেব বললেন, বাচ্চারা যদি নিজের ভাল না বোঝে, তা হলে সন্তানের ভালর জন্যই বাবা-মায়েদের একটু কড়া হতে হয়। পড়তে না বসলে বকাঝকা করতে হয়। দরকার হলে দু’ঘা কষাতেও হয়। কঠিন রোগে ভুগতে থাকা কোনও বাচ্চা যদি তেতো লাগে দেখে কোনও ওষুধ খেতে না‌ চায়, তার বাবা-মা কি তাকে চেপেচুপে ঠেসে ধরে জোর করে তার মুখে ওষুধ গুঁজে দেয় না?
– বাবা মা?
– নিশ্চয়ই। এ রাজ্যের সমস্ত লোকই আমার কাছে আমার সন্তানতুল্য। তাদের ভাল, আরও ভালর জন্য যে কোনও উদ্যোগ আমি কড়া হাতে নেব।
ও দিকে বসে ছিলেন সুন্দরবন-মন্ত্রী কান্তি গাঙ্গুলি। তিনিও এই সরকারের নানান কাজকর্মে বেশ কিছু দিন ধরেই তিতিবিরক্ত। তিনি ফুঁসে উঠলেন, হ্যাঁ, সে তো নিচ্ছেনই। কৃষ্ণাগ্লাসের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি কোম্পানি অধিগ্রহণ করার পরেও বন্ধ করে ফেলে রেখে দিয়েছেন। বারুইপুরের কারখানাটায় তো এ বার লাল ঝান্ডা পুঁতে নামমাত্র টাকায় ক্যাডারদের বসাতে শুরু করে দেবেন মনে হচ্ছে। যে ছকে পদ্মপুকুর মোড়ের ওই উকিলের রাস্তার ওপরের বিশাল জমিটা দখল করে সি টি সি-র বাসগুমটি বানিয়েছেন। যে ভাবে স্কুল থেকে ইংরেজি তুলে দিয়েছেন…
– সে সময়টা ছিল আলাদা। ইংরেজির ভয়ে তখন অনেক ছেলেমেয়েই স্কুলের দিকে পা মাড়াত না। তাই আরও বেশি সংখ্যক ছেলেমেয়েকে স্কুলে টানার জন্য ইংরেজির ভয় দূর করতেই তখন ওই পদক্ষেপ নিয়েছিলাম।
– তাতে কী হল? টানা প্রায় তিরিশ বছর ধরে পর পর বেশ কয়েকটা প্রজন্ম ইংরেজি না জেনে মূর্খ হয়ে রইলেন। জনগণ সেটা বুঝতে পেরে, এখানে সেখানে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে, খেতে পাক ছাই না পাক, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা মাইনে দিয়ে বাচ্চাদের পাঠাতে শুরু করলেন। যাতে তাঁদের বাচ্চারা অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিতে পারে। কিন্তু অত খরচ করার সামর্থ্য যাঁদের নেই, সেই সব বাবা-মায়ের বাচ্চারা বাংলা মাধ্যমে পড়ে প্রতিযোগিতার বাজারে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে লাগল। এ দেশে তৈরি হল দুটো সমাজ। একটা ইংরেজি জানা আর একটা ইংরেজি না জানা।
– আমরা তো আবার ইংরেজি ফিরিয়ে এনেছি।
– হ্যাঁ, ফিরিয়ে এনেছেন। কিন্তু ক’দশক পরে?
– যে ক’দশকই হোক। ফিরিয়ে এনেছি তো।
– তত দিনে কয়েকটা প্রজন্ম পিছিয়ে পড়েছে প্রায় একশো বছর।
– হয়েছে। আমাদের ভুল হয়েছে। যে কাজ করে, তারই ভুল হয়। আর ভুল থেকেই তো মানুষ শিক্ষা নেয়। এর পর এ রকম ভুল আর হবে না।
– আপনারা এক-একটা পদক্ষেপ নেবেন আর সেটা ফেল করলেই বলবেন আমরা ভুল করেছি। আপনাদের ভুলে-ভুলে যে দেশটা রসাতলে যেতে বসেছে, সেটা একবারও ভেবে দেখেছেন কি? আপনাদের ভুলে আপনাদের কোনও খেসারত দিতে হয় না। দিতে হয় এ দেশের খেটে খাওয়া গরিব মানুষদের। আর ভুল স্বীকার করাটা আপনাদের এখন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
– আপনারাও তো আমাদের শরিক, যখন কোনও সিদ্ধান্ত নিই, তখন বলেন না কেন?
– আপনি শোনেন? শুনলে তো বলব।
– বলুন আপনার বক্তব্য কী?
– অনেক হয়েছে। মানুষ এখন ক্ষোভে ফুঁসছে। ভাল চাইলে, এখনও সময় আছে। সময় থাকতে থাকতে, আঁধারগ্রাম থেকে হাত গুটিয়ে নিন।
– এখন আর তা হয় না।
– কেন হয় না?
– তা হলে ওঁরা চলে যাবেন।
– কারা?
– টাটারা।
– চলে যাবেন কেন? আঁধারগ্রাম ছাড়া কি এ রাজ্যে আর কোনও জায়গা নেই? ওঁদের অন্য জায়গা দিন।
– না, ওঁরা অন্য জায়গায় যাবেন না। ওই জায়গাটাই ওঁদের পছন্দ।
– একবার বলে দেখুন না…
– শুনবে? জানেন, বিভিন্ন রাজ্য থেকে ওঁদের কত টোপ দিচ্ছে? জমি দিচ্ছে। রাস্তাঘাট করে দিচ্ছে। এটা দিচ্ছে। ওটা দিচ্ছে। বিভিন্ন রকম ছাড় দিচ্ছে। সে তুলনায় আমরা তো প্রায় কিছুই দিচ্ছি না। এর পরেও যদি একবার এটা, একবার ওটা বলি, ওঁরা হয়তো এই রাজ্য ছেড়েই চলে যাবেন।
– না পোষালে চলে যাক।
নিরুপম সেন অনেকক্ষণ ধরে সবার কথা শুনছিলেন। খুব কম কথা বলার মানুষ তিনি। কান্তি যে-ই বললেন, ‘না পোষালে চলে যাক’, অমনি যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি। বললেন, যাক মানে? কিছু দিন আগেও তো ওরা বলছিল, আমরা নাকি এই রাজ্যে কোনও বিনিয়োগ আনতে পারি না। আমরা নাকি অপদার্থ। আর যে-ই হাতে-পায়ে ধরে, অনেক অনুনয় বিনয় করে এক-একটা বিনিয়োগ নিয়ে আসছি, তখন শুধু বিরোধীরাই নয়, আমাদের জোট সরকারের বন্ধু-দলগুলিও নানা রকম কথা বলছে। বাধার সৃষ্টি করছে।
কান্তি ক্ষেপে উঠলেন, কী বলছেন? আমরা বাধার সৃষ্টি করছি?
কথার চাপানউতোর যখন তুঙ্গে ওঠার উপক্রম, তখন বেগতিক বুঝতে পেরে তাঁদের থামাতে বুদ্ধদেব বলে উঠলেন, আপনারা নিজেদের মধ্যে কী ছেলেমানুষি করছেন! এ রকম একটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। কোথায় নিজেরা একটু ভেবেচিন্তে একটা পথ বার করব, তা নয় উলটে আপনারা নিজেরাই… শুনুন, আমি একটা কথা বলি, আমি কোনও বাধা মানব না। আমি একটাই শব্দ বুঝি। উন্নয়ন, উন্নয়ন আর উন্নয়ন। রামায়ণ পড়েছেন?
কান্তি বললেন, কী বলতে চান বলুন।
বুদ্ধদেব বললেন, রাবণ কেন সীতাকে হরণ করেছিলেন জানেন?
– সেটা সবাই জানে।
– তবু বলুন।
কান্তি বললেন, লক্ষ্মণ সূর্পণখার নাক কেটে দিয়েছিল দেখে।
– না, মোটেও না। তাই যদি হত, তা হলে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সীতারও নাক কেটে দিত রাবণ।
– ও রকম একজন সুন্দরীর কেউ নাক কেটে দিতে পারে? তার চেয়ে বরং…
– বুদ্ধদেব বললেন, আপনি যা ভাবছেন, তা নয়। তা হলে বহু আগেই রাবণ সেটা করতে পারত।
কান্তি বললেন, না, তার কোনও উপায় ছিল না।
বুদ্ধদেব বললেন, কেন?
কান্তির সাফ জবাব, কারণ, অভিশাপ ছিল। রাবণ যদি কোনও মহিলার ইচ্ছের বিরুদ্ধে– অন্য সব বাদ দিন। যদি তাঁকে স্পর্শও করে, তা হলে তৎক্ষণাৎ তার দশটা মুণ্ডুর ন’খানাই খসে যাবে।
বুদ্ধদেব বললেন, বাজে কথা।
– তা হলে কী?
কান্তির প্রশ্নের জবাবে বুদ্ধদেব বললেন, রাবণ জানতেন, সীতা আসলে লক্ষ্মী। ধন আর ঐশ্বর্যের দেবী। যে ভাবেই হোক, যেন-তেন প্রকারেণ তিনি যদি লক্ষ্মীকে তাঁর লঙ্কায় আটলে রাখতে পারেন, তা হলে তাঁর সোনার লঙ্কা আরও আরও সমৃদ্ধ হবে। ফুলে-ফলে-শষ্যে ভরে উঠবে তাঁর রাজ্য। তাঁর প্রজারা আরও ভাল থাকবেন। কোনও নারীকে তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে আটকে রাখা মহাপাপ, সেটা জেনেও শুধুমাত্র প্রজাদের মঙ্গলের জন্যই তিনি অত বড় পাপ নিজের মাথায় তুলে নিয়েছিলেন। সীতাকে অপহরণ করেছিলেন। তাতে হয়তো আপাতদৃষ্টিতে অনেকের মনে হবে, রাবণ একটা দানব। মনে হবে রাবণ একটা লম্পট। কিন্তু যাঁরা বোঝার, তাঁরা ঠিকই বুঝতে পারবেন, উনি কতটা প্রজা বৎসল ছিলেন। প্রজাদের জন্য কতটা ভাবতেন। আমার তো মনে হয়, আজ পর্যন্ত যত রাজা পৃথিবীতে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল এবং মহান রাজা ছিলেন ওই রাবণ।
কান্তি বললেন, কিন্তু রাবণকে তো কেউ ভাল চোখে দেখে না। তার প্রতিদ্বন্দ্বী রামকেই সবাই পুজো করে।
– সে করুক। রাম জিতেছে দেখেই মানুষ রামকে পুজো করে। ওই যুদ্ধে যদি শেষ পর্যন্ত রাবণই জিতে যেত, তা হলে রাম নয়, লোকে রাবণকেই পুজো করত। আমার কাজকে যদি কারও খারাপ মনে হয়, তো হোক। আমি জানি, আমি কী করছি। আজ নয়, ইতিহাস একদিন স্মরণ করবে, আমি কী করেছি।
– কী করেছেন, সেটা তা হলে জনগণকে বলুন, বোঝান।
বুদ্ধদেব বললেন, আমার অত সময় নেই। আমি লোককে বোঝাব, না কাজ করব? আমাদের প্রচুর কাজ করতে হবে। জানেন, রাতে আমি ঘুমোতে পারি না। মনে হয়, রাজ্যের লোক কাঁদছেন। তাঁরা খুব কষ্টে আছেন। যে ভাবে হোক, তাঁদের ভাল, আরও ভাল করতেই হবে। আর সেটা করতে পারে একমাত্র উন্নয়ন। উন্নয়নই পারে রাজ্যের সমস্ত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। আমি সেটাই করতে চাই। এবং করবও। এটা আমার চ্যালেঞ্জ।

চলবে...

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ২২

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!