।।পর্ব- ২৮।।
২০০৬-এর গোটা অক্টোবর মাস জুড়ে আঁধারগ্রাম উত্তপ্ত। প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু হচ্ছে। এখানে সমাবেশ, ওখানে জমায়েত, তো সেখানে ধরনা কিংবা ঘেরাও। তার রেশ আছড়ে পড়ল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। শহর থেকে শহরতলিতে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে ফলাও করে ছাপা হতে লাগল সেই সব খবর। তারই জেরে নড়েচড়ে বসলেন সমাজের নানা স্তরের সচেতন মানুষ। উন্মুখ হয়ে উঠলেন তাঁরা। ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে ঠিক কী কী ঘটেছিল, তা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানার জন্য কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও কয়েকটি রাজনৈতিক দল মিলে নভেম্বরের ২ তারিখ থেকে শুরু করল তথ্য সংগ্রহ অভিযান। সেটা করতে গিয়েও পুলিশের কাছে বারবার বাধা পেতে লাগলেন তাঁরা। সরাসরি না বললেও, আকার-ঈঙ্গিতে প্রশাসন বুঝিয়ে দিল, এ সব করার তোমরা কে হে?
ব্যস। আগুনে যেন ঘি পড়ল। গোটা নভেম্বর মাস জুড়ে চলতে লাগল একের পর এক ঘটনা।
কিছু করতে পারুক, ছাই না পারুক, সব ব্যাপারেই যারা ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং পড়ে-পড়ে মার খেয়ে খবরের শিরোনাম হয়, সেই এস ইউ সি আই তার পর দিনই, অর্থাৎ ৩ নভেম্বরে ডাকল এক বিশাল জনসভা। সেই সভায় আঁধারগ্রামের এই অদ্ভুত পরিস্থিতির দ্রুত অবসান চাইলেন প্রভাস ঘোষ।
আর ওয়াই এ-র নেতৃত্বে শুধু স্থানীয় নয়, আশপাশের সমস্ত গ্রামের লোকজনদের নিয়ে ৪ নভেম্বরে বেরোল বিশাল মিছিল। পাশাপাশি এ দিন থেকেই সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে ওই গ্রামের ৩ জায়গায় শুরু হল আই এন টি ইউ সি-র ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পে শুধু অভিযোগ নথিভুক্ত করাই নয়, সেই অভিযোগ খতিয়ে দেখে, তার সত্যতা যাচাই করে, সম্পূর্ণ বিনে পয়সায় নানা রকম আইনি সাহায্যও দিতে লাগল তারা। দায়িত্ব নিল তাদের নিরাপত্তার। এবং যাঁরা জমির মালিক নন, কিন্তু এই গ্রামের কৃষিকাজের সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, সেই সব দুর্বল মানুষকে দিতে লাগল বিভিন্ন আর্থিক সাহায্য।
আঁধারগ্রাম কৃষিজমি বাঁচাও কমিটির ডাকে বিরাট এক সমাবেশ হল ৫ নভেম্বর। সেখানে তাঁদের জমি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকজনকে রুখে দাঁড়াতে বললেন ওই জনসভার প্রধান বক্তা, বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বললেন, আপনারা একদম ভয় পাবেন না। আপনারা এগিয়ে যান। আমি আপনাদের সঙ্গে আছি।
যখন ওই সভা চলছে, তখন অত লোক না হলেও, আঁধারগ্রাম থেকে খানিকটা দূরে আর একটি পালটা জনসভা করল সি পি আই (এম এল) লিবারেশন।
রাজনৈতিক দলের লোকেরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ক্যাম্প খুললেও, যথেষ্ট ভালবাসা ও দায়িত্ব নিয়ে প্রাণপণে কাজ করলেও, এই গ্রামের ভুক্তভোগীরা যে ভাবে আর একজন ভুক্তভোগীর সমস্যা হৃদয় দিয়ে বুঝতে পারবে, শহর থেকে আসা কোনও লোকেরা কি ঠিক সে ভাবে বুঝতে পারবে? তাই ৭ নভেম্বর দু’জায়গায় ক্যাম্প খোলে আঁধারগ্রাম কৃষিজমি বাঁচাও কমিটি। পাশাপাশি এ দিনই সারা ভারত কৃষি মজুর কমিটির উদ্যোগে গোপালনগরের বারোহাত কালীতলাতেও খোলা হয় আর একটা ক্যাম্প।
৮ নভেম্বর সি পি আই (এম এল) নিউ ডেমোক্র্যাসির জনসভায় বক্তব্য রাখেন পল্টু সেন থেকে শুরু করে বারুইপুরের একচ্ছত্র সম্রাট সুজন চক্রবর্তী। তিনি আসছেন শুনে রথীন অবাক। কারণ, কলকাতা থেকে বাসরুট ধরে বারুইপুরে ঢোকার মুখে পদ্মপুকুরে নেমে, সি টি সি বাসস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে নর্মাল বেথুন সরণি ধরে এঁকেবেঁকে গ্রামীণ ক্যানসার হাসপাতালের উলটো দিকে যে কৃষ্ণা গ্লাস ফ্যাক্টরিটা দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে, তার গা দিয়ে রেল লাইন বরাবর মল্লিকপুরের দিকে শ’দুই মিটার গেলেই, বাঁ হাতে একটা খাটাল। তার পাশেই মা পরমেশ্বরী পারুল সিংহের খুব জাগ্রত দেবস্থান– ত্রিমাতৃ মন্দির। তাদের প্রধান কার্যালয় চেতলার আলিপুর রোডে। আর চেতলা-আলিপুর অঞ্চলটা যেহেতু তৃণমূলের ঘাঁটি, সম্ভবত সেই সূত্রেই ওই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাত্রী আগে সেবাদলের সক্রিয়কর্মী থাকলেও, এখন তৃণমূলের অন্ধ সমর্থক।
উনি খুব বড় করে মনসা পুজো করেন। শুধু বারুইপুরই নয়, সেখানে বহু দূর-দূরান্ত থেকেও লোকেরা আসেন। প্রচুর লোকের সমাগম ঘটে। রথীনও সেখানে একবার গিয়েছিল। কথায় কথায় সুজন চক্রবর্তীর কথা উঠতেই, মা পরমেশ্বরী বলেছিলেন, রাজনীতিক হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে সুজন অনেক বড়। লোকের জন্য করে। লোকের জন্য ভাবে। সব সময় লোকের সঙ্গে আছে। যে কোনও লোকের যে কোনও বিপদে-আপদে ও কোনও দিন-রাত দেখে না। ঝড়-জলও দেখে না। একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: দুর্গাপূজায় বেশ্যাদ্বারের মাটি: গূঢ়তত্ত্ব
তাই সুজন চক্রবর্তী আসছেন শুনে রথীন অবাক। তাঁর গুরুমা, মা পরমেশ্বরীর কাছে ও যা শুনেছে, তাতে তো ওই লোকটা একদম নিপাট ভাল মানুষ। মা-মাটির মানুষ। ওঁর তো তৃণমূল হওয়ার কথা। অথচ… অমন একজন মানুষ যে কী করে সি পি এম হন! কারণ, সি পি এম বললেই যাঁদের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, উনি ঠিক তাঁদের মধ্যে পড়েন না। অত্যন্ত শিক্ষিত, রুচিশীল, ভদ্র, অমায়িক, সত্যিকারের একজন বড় মাপের মানুষ। তা হলে উনি আসছেন কেন? তা হলে কি পার্টির চাপে পড়ে! হতে পারে! তাঁর পার্টির লোকেরাও তো জানে, লোকে তাঁকে বিশ্বাস করে, ভরসা করে। তাই-ই কী…
এ দিনই সংহতি উদ্যোগের তিন প্রতিনিধি দল আঁধারগ্রাম কৃষিজমি বাঁচাও কমিটির নেতাদের সঙ্গে বসলেন। পরবর্তী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করলেন।
১০ নভেম্বরে কানোরিয়া জুট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়নের পনেরো জনের একটি প্রতিনিধি দল আঁধারগ্রামের আন্দোলনকারী নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তাঁরাও বললেন, আমরা আপনাদের এই সংগ্রামের পাশে আছি।
তার পর দিনই সারা ভারত কৃষি মঞ্জুর কমিটির ক্যাম্পে গণ শুনানি হল।
মহাত্মা গাঁধী যেটা করে ইংরেজ শাসকদের টনক নড়িয়ে দিয়েছিলেন, সাধারণ মানুষকেও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই একই পথ বেছে নিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৭ নভেম্বর কলকাতার গাঁধীমূর্তির পাদদেশ থেকে তৃণমূলের ডান্ডি অভিযান শুরু হল।
এ দিকে, গ্রামে পুলিশ-ক্যাম্প বসানোর বিরুদ্ধে আঁধারগ্রাম কৃষিজমি বাঁচাও কমিটির বড়সড় একটি প্রতিবাদ মিছিল বেরোল ১৯ তারিখে।
তার পর দিনই, নানা পথ ঘুরে চার দিনের পদযাত্রা সেরে ২০ নভেম্বর আঁধারগ্রামে এসে পৌঁছল তৃণমূলের ডান্ডি অভিযান। যখন পদযাত্রা শুরু হয়েছিল, তখন যত লোক ছিল, বিভিন্ন জায়গা থেকে সেই মিছিলে শত শত লোক সামিল হয়ে যখন মিছিলের মাথাটা আঁধারগ্রামে এসে পৌঁছল, তখন তার লেজটা যে কোথায়, কেউ বলতে পারল না।
৩০ নভেম্বর আঁধারগ্রাম কৃষিজমি বাঁচাও কমিটির ডাকে দলমত নির্বিশেষে সহযোগী বন্ধু, ব্যক্তি, সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে আগামী কর্মসূচী সম্পর্কে নানান আলাপ-আলোচনা হল। সভার শেষে বেরোল একটি বিশাল মিছিল। আর তখনই ১৪৪ ধারা জারি করে আঁধারগ্রামের ত্রিসীমানার মধ্যে শুধু মঞ্চ করে সভা নয়, ছোটখাটো মিছিল, ঘরোয়া বৈঠক, এমনকী কয়েক জন একসঙ্গে হওয়ার অধিকারও গ্রামবাসীদের কাছ থেকে কেড়ে নিল প্রশাসন। বানচাল করে দিল তাঁদের সমস্ত কর্মসূচী।
সরকারি এই নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করার জন্য দলবল নিয়ে রওনা হতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ সব নেতা-নেত্রীকে জোর করে আটকে দেওয়া হল আঁধারগ্রামে ঢোকার আগেই। এবং কেউ যাতে কোনও ঝামেলা করতে না পারে, সে জন্য প্রশাসনের তরফ থেকে সেখানে মোতায়েন করে দেওয়া হল এক বিশাল পুলিশ বাহিনী।
সেটা দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন তৃণমূলের লোকেরা। তাঁরা বললেন, এই ১৪৪ ধারা সম্পূর্ণ বেআইনি। অসংবিধানিক। এটা আমরা মানি না। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ৩০ নভেম্বর উত্তেজনা চরমে উঠতেই বিধানসভার ভিতরে ব্যাপক ভাঙচুর চালান তৃণমূলের বিধায়কেরা।
সরকারের এই অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারির প্রতিবাদে ১ ডিসেম্বর পালিত হল বারো ঘণ্টার বাংলা বনধ। তার মধ্যেই আঁধারগ্রামের অধিগৃহীত জমিতে বেড়া দেওয়ার কাজ শুরু হল। বাধা দিতে ছুটে এলেন গ্রামবাসীরা। তাই তার পর দিনই, ডিসেম্বরের ২ তারিখে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নির্দেশে এক বিশাল পুলিশ বাহিনী আঁধারগ্রামে ঢুকে জমিতে চাষের কাজ করতে থাকা চাষি-ভাগচাষি-প্রান্তিক চাষিদের মারধর করতে লাগল। শুধু সেটা করেই ক্ষান্ত হল না তারা। গ্রামের ভিতরে ঘরে ঘরে ঢুকে কৃষক-রমণী থেকে শুরু করে বাচ্চাদের ওপরেও অকথ্য অত্যাচার চালাল। শুধু অত্যাচারই নয়, নির্বিচারে বাড়িঘর ভাঙচুর করল তারা। ধানের গোলায় আগুন ধরিয়ে দিল। কেউ বাধা দিতে গেলেই যথেচ্ছ ভাবে লাঠি চালাল। কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে এবং রাবার বুলেট মেরে স্তব্ধ করে দিতে চাইল তাদের প্রতিরোধ-প্রতিবাদ।
গ্রামের লোকেরা মরিয়া হয়ে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই, তাঁদের কাউকে মারতে মারতে, কাউকে টেনে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে, কাউকে চুলের মুঠি ধরে, কাউকে আবার চ্যাংদোলা করে ভ্যানে তুলতে লাগল পুলিশ। ছেলে-বুড়ো, কিশোর-কিশোরী, শিশু-বৃদ্ধ কাউকেই রেয়াত করল না। গ্রেফতার করে নিয়ে গেল মোট একশো বাইশ জনকে।
এই ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দমন করার জন্য ৩ ডিসেম্বর জরুরি সভা ডাকল আঁধারগ্রাম কৃষিজমি বাঁচাও কমিটি। এ দিনই ব্রিগেডের সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বললেন, আমি বিরোধীদের সঙ্গে বসতে চাই। কিন্তু সে কথায় কোনও কর্ণপাত না করে ৪ ডিসেম্বর অনির্দিষ্টকালের জন্য কলকাতার ধর্মতলার মেট্রো সিনেমার উলটো দিকে অনশন শুরু করলেন মমতা। তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন আরও চার জন নেতা-নেত্রী। ওই একই সময়ে আঁধারগ্রামের পৃথক পৃথক পাঁচটি জায়গায় পাঁচ জন করে মোট পঁচিশ জন কৃষক ও কৃষক-রমণী শুরু করলেন অনশন। মমতার অনশন মঞ্চে এসে হাজির হলেন রাজনাথ সিং থেকে শুরু করে সুনন্দ সান্যালেরা।
২০০৬-এর ৫ ডিসেম্বর এস ইউ সি-র ডাকা বনধে নৈতিক সমর্থন জানালেও তাদের কর্মসূচিতে সক্রিয় ভূমিকা নিল না তৃণমূল কংগ্রেস। তবু সেই বনধ সর্বার্থক সফল হল। কারণ, আঁধারগ্রামকে কেন্দ্র করে সরকারের বিরুদ্ধে যে কোনও কর্মসূচিকেই মানুষ তখন কোনও কিছু না ভেবেই আবেগে আপ্লুত হয়ে সমর্থন করছিল। এ দিনই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করলেন আঁধারগ্রাম কৃষিজমি বাঁচাও কমিটির বাছাই করা কয়েক জন প্রতিনিধি।
তার পর দিন, অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর বেলা বারোটা থেকে দুটো অবধি, টানা দু’ঘণ্টা সারা রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় দফায় দফায় চালানো হল রেল রোকো, রাস্তা রোকো অভিযান। তারই মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অনশন মঞ্চে দেখা করতে এলেন জর্জ ফার্নান্ডেজ, সুমন্ত হীরা, মেধা পাটেকরেরা।
পাশাপাশি স্টুডেন্ট হলে বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ সভার আয়োজন করলেন। সেখানে উপস্থিত হলেন মহাশ্বেতা দেবী থেকে শঙ্খ ঘোষ। আন্দোলনের জেরে তখন চাষবাস মাথায় উঠেছে গ্রামবাসীদের। এর পরে তাঁরা কী খাবেন? কী পরবেন? তাই গ্রামের মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলার জন্য ওই বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগেই ৬ ডিসেম্বর সেলাই প্রশিক্ষণ শিবির চালু করা হল আঁধারগ্রামে।
৭ তারিখে ডাক দেওয়া হল আঁধারগ্রাম চলো অভিযান। সেখানে নিজে থেকেই হাজির হলেন কাতারে কাতারে মানুষ। কিন্তু সরকারি নির্দেশে বৈদ্যবাটিতেই তাঁদের আটকে দিল পুলিশ।
এ দিকে দিনের পর দিন একটানা অনশনে তখন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেকেই। যে কোনও সময় তাঁদের শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটতে পারে। এটা টের পেয়ে বেড়াবেড়ি বাজার থেকে বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য-সহ সমস্ত অনশনকারীকে জোর করে তুলে হাসপাতালে ভর্তি করে দিল পুলিশ। তাঁদের মুখে খাবার গুঁজে দিলেও তাঁরা তা থু থু করে ফেলে দিচ্ছেন দেখে নিশ্ছিদ্র পুলিশি পাহারায় তাঁদের শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল স্যালাইনের সিরিঞ্জ।
ও দিকে, ধর্মতলায় তখন আমরণ অনশনে দিনের পর দিন ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছেন মমতা। উদ্বিগ্ন গোটা দেশ। উদ্বিগ্ন সরকারও। তাঁর অনশন এক্ষুনি ভাঙতে না পারলে সামনে আরও বড় সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে।
তবু দেশ যে ভাবে ফুঁসছে, তাতে হুটপাট করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অন্তত দশ বার ভাবতে হচ্ছে রাজ্য সরকারকে। সামান্য একটু ভুল হলেই হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই তাঁরা শুধু আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে বসে রোজ আলোচনাই করে যাচ্ছেন। কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
ও দিকে মমতাকে দেখতে গ্রামগঞ্জ থেকে দলে-দলে আসছেন দলের নেতা-নেত্রী থেকে শুরু করে দলের সাধারণ সমর্থকেরা। এমনকী বিদগ্ধ মানুষজনেরাও। এরই মধ্যে অনশন মঞ্চে এলেন একদম অন্য জগতের মানুষ, অর্জুন ও দ্রোণাচার্য পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাক্তন খেলোয়াড় এবং কোচ– নঈম।
১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে আঁধারগ্রাম-সহ সারা রাজ্য জুড়ে গ্রামে গ্রামে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রতিবাদে বাড়ি বাড়ি পালন করা হল অরন্ধন ও গণ অনশন।
মূল অনশন মঞ্চে এক হাজারেরও বেশি মানুষ একটানা দশ ঘণ্টা অনশনে সামিল হলেন। সেই মঞ্চে এসে তাঁদের পাশে দাঁড়ালেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন-এর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী আশালতা সরকার।
তার পর দিন সেই মঞ্চেই হল বিশাল জনসভা।
ওই সমাবেশে নেওয়া নানা কর্মসূচি অনুযায়ী ১৩ ডিসেম্বর ওই মঞ্চেই ঘটল মহিলা সমাবেশ। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইংরেজদের তৈরি সামগ্রী বয়কটের মতো শুরু হল টাটার পণ্য বয়কটের প্রতীকী আন্দোলন। সেখানে আওয়াজ তোলা হল, আমরা টাটার জিনিস কিনব না। টাটার জিনিস মাখব না। টাটার জিনিস খাব না। অথচ তার পর দিন গুটিকতক সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেল বারবার দেখাতে লাগল, টাটার জিনিস বয়কট করার কথা মুখে বললেও আন্দোলনকারীরা কিন্তু টাটার জিপ, টাটার চারশো সাত, টাটাসুমো আর টাটার ম্যাটাডর করেই এসেছিল।
এ দিনই মঞ্চে এলেন বিভিন্ন কোর্টের আইনজীবীরা। কথা দিলেন, তাঁরা ওঁদের পাশে থাকবেন এবং ওঁদের হয়ে লড়বেন।
সারা রাজ্য টালমাটাল। অস্থির। কিছুতেই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। দিনকে দিন ক্রমশ তা আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে। যে কোনও দেশের পক্ষেই এ রকম পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ংকর। তাই লাগাম টানার জন্য তার পর দিনই দিল্লি থেকে ওই মঞ্চে উড়ে এলেন স্বয়ং ভি পি সিং।
২০০৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর শুরু হল আঁধারগ্রামের শিশু-কিশোরদের সমাবেশ, সভা ও গণ অনশন। এত দিনের এত আন্দোলন যা করতে পারেনি, শিশু-কিশোরদের এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশ নেওয়াটা সরকারের আসন টলিয়ে দিল।
আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস উত্তাল ২৭
এমনিতেই জমি অধিগ্রহণ, রাজকুমার ভুলের মৃত্যু এবং সেটা নিয়ে সমস্ত স্তরের লোকজনকে কায়দা করে খেপিয়ে তুলে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের একটার পর একটা পদক্ষেপ গোটা প্রশাসনের চোখের ঘুম একেবারে কেড়ে নিয়েছিল। এত দিন বড়রা আন্দোলন করছিল, ঠিক আছে। কিন্তু এ বার খুদে খুদে বাচ্চারা তাতে অংশ নিতেই অন্য একটা মাত্রা পেয়ে গেল সেই আন্দোলন।
নতু সে কথা ফোনে জানাতেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, এই গ্রামের লোকজন ও তাদের নাছোড়বান্দা আন্দোলন নিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে থাকা সি পি এমের সেই তুখোড় নেতা। তিনি বললেন, কী হল? তোমাদের সুহৃদ কী করছে?
নতু আমতা আমতা করছে দেখে তিনি বললেন, এখনও ওর সঙ্গে যোগাযোগ করোনি? তোমাকে সে দিন কী বললাম? এক্ষুনি ওকে খবর দাও। আমি কোনও কথা শুনতে চাই না। ওপর থেকে ভীষণ চাপ আসছে। আজ-কালের মধ্যেই ওকে এমন কিছু একটা করতে বলো, যাতে ওরা শায়েস্তা হয়। একটা পজেটিভ কিছু হয়।
নতু তার দলবল নিয়ে হাজির হল সুহৃদের বাড়ি। এখন এই গ্রামের কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। কে যে নিজের লোক, আর কে যে নিজের লোকের আড়ালে আসলে ওদের লোক, ইনফর্মার, কিছুই সহজে বোঝা যায় না। কে কোথা থেকে কান খাঁড়া করে কী শুনে নেবে, তাই দাওয়ায় না বসে, ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল ওরা। দরজা আটকে চাপা গলায় চুপিচুপি শলা-পরামর্শ করতে লাগল। এতটাই চাপা গলায়, যেন দেওয়ালেরও কান আছে। সুহৃদের কথা শুনে নতু বলল, কে করবে? তুমি?
সুহৃদ বলল, না করার কী আছে?
– তোমার এখনও দাঁড়ায়?
– তোর বউদির সামনে হয়তো দাঁড়াবে না। কিন্তু নতুন ডবকা কাউকে পেলে…
– সে কী গো… এই বয়সেও?
– আবার? আবার আমার বয়স তুলে কথা বলছিস? তোরা এমন করছিস, আমি যেন বুড়ো হয়ে গেছি।
ও পাশ থেকে রাম বলল, চুল পেকে গেছে। দাঁত পড়ে গেছে। এর পরেও বলবে, বুড়ো হওনি?
– না, হইনি। সেটা আমি নিজের মুখে আর বলতে চাই না। ফলেন পরিচয়।
– কিন্তু কাকে?
– যাকেই হোক, তবে কোনও বুড়িটুড়িকে করতে পারব না। করবই যখন, একটা ডবকা ছুঁড়িকেই করব। অবশ্য আমার যা কপাল! ডবকা না পেলে… অন্তত আনকোরা তো চাই, নাকি?
ও পাশ থেকে একজন বলে উঠল, বুড়োর রস দ্যাখো।
সুহৃদ খেপে গেল, উঁহু উঁহু, বলছি না, একদম বুড়োটুড়ো বলবি না। আমি এই বয়সেও যা করতে পারি, তোরা তা ভাবতেও পারবি না।
পাশেই ছিল তিলু। সে বলল, কিন্তু খুড়ো, তোমার যা বয়েস, ডবকা সামলাতে পারবে? আমি তো তোমার হাঁটুর বয়সি। এই বয়সেই আমার মনে হয় আমি পারব না।
ও পাশ থেকে রাম হেঁই হেঁই করে উঠল, সে কী রে? এটা কী বলছিস তুই? আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি। পঁচিশ তারিখে ওই গণ্ডগোলের মধ্যে তুই কাকে কোলপাঁজা করে ওই ঝোপের দিকে নিয়ে গিয়েছিলি। পর দিন তুই যা বলেছিলি, তার সঙ্গে তো আজকের এই কথাটার কোনও মিল নেই। কী ব্যাপার রে?
ওর কথা শুনে খিকখিক করে হাসতে লাগল তিলু।
সেটা দেখে অন্য আর একজন বলল, দ্যাখো খুড়ো, তুমি পারবে তো? শেষ পর্যন্ত কিন্তু ডুবিও না।
সুহৃদ বলল, আবার সেই খুড়ো? একটা ডবকা দিয়ে দ্যাখ না।
রাম বলল, তখন থেকে খালি ডবকা ডবকা করছ। এই গ্রামে কোনও ডবকা মাল আছে নাকি?
– আছে আছে। একটু চোখ-কান খোলা রাখ। সব দেখতে পাবি।
পুরু বলল, দ্যাখ রাম, লোক অনুযায়ী দেখাটাও পালটে যায়। সুহৃদদার কাছে যেটা ডবকা, তোর কাছে সেটাই হয়তো আধবুড়ি। কী করবি বল…
– সে নয় ঠিক আছে। কিন্তু করবে কোথায়?
রাম বলল, এটা ঠিক বলেছিস। ওই কৃষিজমি বাঁচাও কমিটির লোকেরা যে ভাবে সব সময় সতর্ক হয়ে সারা গ্রাম পাহারা দিচ্ছে, সেখানে কোনও কিছু করা…
নতু মাঝখান থেকে ফোড়ং কাটল, খুব সাবধান। ধরা পড়লে কিন্তু মহাবিপদ। কোনও মার আর বাইরে পড়বে না। আমি বারবার করে একটা কথা বলে দিচ্ছি, কেউ যদি ধরা পড়িস, মার খেতে খেতে মরে গেলেও, ভুল করেও কিন্তু কেউ কারও নাম বলবি না। মনে থাকবে? সুহৃদ বলল, জানতে পারলে তো মারবে। এমন সময় করতে হবে, যখন গোটা গ্রাম অঘোরে ঘুমোচ্ছে, বুঝেছিস?
– মানে রাতে?
সুহৃদ বলল, না না, রাতে না। ভোররাতে।
– কারও বাড়ি থেকে তুলে আনতে হবে? তিলু জিজ্ঞেস করতেই রাম বলল, এখন তো শীতকাল। সবাই দরজা-জানালা দিয়ে শোয়। ঘরে ঢুকতে গেলেই তো শব্দ হবে…
সুহৃদ বলল, না না, শব্দ করা যাবে না। কারও বাড়িতেও যাওয়া যাবে না।
– তা হলে? নতু বলতেই সুহৃদ বলল, ওত পেতে অপেক্ষা করতে হবে। আমি একবার সুন্দরবনে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানে শুনেছিলাম, বাঘেরা নাকি একটা শিকারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওত পেতে বসে থাকে। আর যাকে টার্গেট করে, তাকেই ধরে।
– তা, তুমি কোথায় অপেক্ষা করবে?
সুহৃদ বলল, কারও বাড়ির কাছাকাছি। কোনও গাছের আড়ালে বা ঝোপঝাড়ের পিছনে।
– কখন?
– ওই যে বললাম, ভোররাতে।
রাম বলল, ভোররাতে? গভীর রাতে নয় কেন?
সুহৃদ বলল, কারণ গভীর রাতে কেউ বেরোতে না-ই পারে, কিন্তু সকালে সবাইকে বেরোতেই হবে। মাঠে যেতে হবে না?
– কিন্তু কোনও মেয়ে না এসে যদি ছেলে আসে?
– ছেলে এলে মেয়েও আসবে।
– যদি স্বামী-স্ত্রী বা বাবা-মেয়ে হয়?
– ছেলেটাকে হাত-পা বেঁধে মাঠে ফেলে রাখব বা কোনও গাছের সঙ্গে বেঁধে দেব। ব্যস, তার পর… ওর চোখের সামনেই একেবারে… উদোম–
কথা শেষ করতে দিল না রাম, ছেলেটা যদি পরে সবাইকে বলে দেয়?
সুহৃদ বলল, তুই না একটা আস্ত গাধা। আমাদের কাছ থেকে বেঁচে ফিরলে তো বলবে…
– কিন্তু তখন তো প্রচুর লোক।
– আরে মূর্খ, প্রচুর লোক তো আর একসঙ্গে দল বেঁধে আসবে না। এক-এক করে আসবে। সেই জন্যই তো বলছি, ভোর রাতে। প্রথমে যে আসবে, তাকেই টার্গেট করতে হবে।
– কিন্তু তখন কি অত সময় পাওয়া যাবে?
সুহৃদ বলল, বেশি সময় কে চেয়েছে? যেটুকু পাব, তাতেই হবে।
– কিন্তু কাকে?
– সুযোগ-সুবিধে মতো যাকে পাব, তাকে।
তিলু বলল, তা হলে আমাদের মূল কাজটা কী হবে, খুন, না ধর্ষণ?
সুহৃদ বলল, খুন তো হচ্ছেই। কিন্তু তাতে কি কোনও সুরাহা হচ্ছে? ওপর মহল থেকে বলছে, ধর্ষণ করতে। ওটা নাকি যে কোনও আন্দোলনকে শায়েস্তা করার জন্য মোক্ষম দাওয়াই। সে দিন কে যেন বলছিল, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ও নাকি নকশাল আন্দোলনটাকে দমন করার জন্য ওদের কিছু পেটোয়া ছেলেকে নকশাল স্কোয়াডে ঢুকিয়ে দিয়ে আন্দোলনকারীদের যাবতীয় গতিবিধির খবরাখবর নিত। আর নকশালদের ধরার পর, ছেলেদের যা করার, তা তো করতই। এক-একটা মেয়েকে উলঙ্গ করে থানার অফিসার থেকে হাবিলদারেরা পর্যন্ত রেপ করত। তার পর দীর্ঘকাল বন্দি থাকা কুখ্যাত দুষ্কৃতীদের লক আপে সেই সব মেয়েকে ঢুকিয়ে দিত। যখন বার করে আনত, তখন তারা হয় রক্তাক্ত কিংবা সংজ্ঞাহীন। আর তার পরেও যদি কোনও মেয়ের জ্ঞান থাকত, তাদের নাকি ওইখান দিয়ে খোসা-ছাড়ানো সেদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দিত।
শুধু এ দেশে নয়, যে কোনও আন্দোলনকে পিষে দেওয়ার জন্য গোটা পৃথিবীর সমস্ত প্রশাসনই নাকি এটাকে হাতিয়ার করে। এই সরকারও তার ব্যতিক্রম নয়। ফলে এটা আমাদের করতেই হবে। অন্তত দলের জন্য করতে হবে।
সুহৃদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে নতু ফের ফোড়ং কাটল, একা কবজা করতে পারবে তো?
সুহৃদ বলল, একা কেন? তোরাও তো থাকবি।
– ও, তুমি খাবে, আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব?
সুহৃদ বলল, তোদের দেখতে কে বলেছে? তোরাও খাবি।
– বলছ?
সুহৃদ বলল, বলছি। কারণ, ওপর মহলের অর্ডার পেয়ে গেছি। আজকেই সন্ধ্যাবেলায় আমার সঙ্গে ওদের কথা হয়েছে।
সুহৃদের কথা শুনে সবার চোখ-মুখ কেমন যেন চকচক করে উঠল।
চলবে…




