।। পর্ব- ৩৭।।
নবীন মাস্টারের স্পষ্ট মনে আছে, এই তো সে দিনের কথা, ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর দুই ব্যক্তিগত দেহরক্ষী বিয়ন্ত সিং এবং সতবন্ত সিং আচমকা গুলি চালিয়ে হত্যা করে তাঁকে। প্রধানমন্ত্রীকে রক্ষা করার কথা যাদের, তারাই এ ভাবে হত্যা করল তাঁকে! সারা দেশ সে দিন ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। অফিস-কাছারি-স্কুল– সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল গাড়িঘোড়াও। রাস্তার মোড়ে মোড়ে জটলা। এখানে সেখানে গাড়ির টায়ার পুড়ছিল।
আরও অনেকের মতো ট্রেন লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। তখনই শুনেছিলেন, ঘাতকরা জাতিতে যেহেতু শিখ, তাই বাড়ি বাড়ি থেকে শিখ সম্প্রদায়ের লোকদের টেনে টেনে বার করে রাস্তায় ফেলে নৃশংস ভাবে মারছে উত্তেজিত জনতা। বাদ দিচ্ছে না বাচ্চাকাচ্চাদেরও। শুধু অচেনা-অজানা লোকদের হাতেই নয়, যাঁদের সঙ্গে রোজ দু’বেলা দেখা হয়, মুখোমুখি হলে কুশল বিনিময় হয়, সেই সব প্রতিবেশীদের হাতেও হেনস্থা হচ্ছে শান্ত, গোবেচারা, কোনও সাতেপাঁচে না থাকা ইন্দিরা-ভক্ত শিখরাও। বেছে বেছে তাঁদের বাড়িতে-গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। ফলে বহু শিখ প্রাণ বাঁচাতে নাকি মাথার পাগড়ি খুলে ফেলছে। কেউ কেউ বাড়িঘর ফেলে রাতারাতি পাড়ি দিয়েছে পাঞ্জাবে। কেউ কেউ আবার বউ-বাচ্চাদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে গুরুদুয়ারায়। কিন্তু উত্তেজিত জনগণ সেখানেও হুড়মুড় করে ঢুকে কলুষিত করছে ধর্মীয়স্থান। করছে রক্তাক্ত।
সে দিন শিখ-বিরোধী দাঙ্গায় আক্রান্ত হয়েছিলেন কম করেও পঞ্চাশ হাজার মানুষ। প্রশ্ন উঠেছিল, দু’জন দুষ্কৃতীর জন্য একটা পুরো জাতি কেন ভাগিদার হবে। এলাকায় এলাকায় দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে নিয়ে বেরিয়েছিল শান্তি মিছিল। সেই মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরা। সারা রাজ্য জুড়ে যখন এ রকম একটা অস্থির সময়, তখন সাধারণ মানুষের পাশে না থেকে কংগ্রেস-সহ অন্যান্য দলের ছোট-বড়-মাঝারি নেতারা সোজা ছুটে গিয়েছিলেন দিল্লি। সদ্য মাতৃহারা রাজীব গাঁধীর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
কিন্তু রাজীব যে কত বড় মাপের রাজনীতিবিদ, সে দিনই নবীন মাস্টারেরা বুঝে গিয়েছিলেন। কারণ, কোনও নেতাকেই জটলা পাকাতে দেননি তিনি। অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মতো ঘুঁটি চেলেছিলেন। বলেছিলেন, আপনারা যে যার রাজ্যে চলে যান। এই মুহূর্তে দেশের যা পরিস্থিতি, শক্ত হাতে সামাল দিতে না পারলে কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটে যাবে। আপনারা আর সময় নষ্ট করবেন না।
তখনও মোবাইল আসেনি। এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে ফোনে কথা বলতে গেলে ট্রাংকলে কথা বলতে হত। আর সে লাইন পাওয়া ছিল বড় হ্যাপার এবং সময় সাপেক্ষ। একটা লাইনের জন্য টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আবেদন জানিয়ে তীর্থের কাকের মতো হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতে হত। আর পেলেও, সেই লাইনে কথা বলতে গেলে এত জোরে জোরে বলতে হত যে, গলা চিরে যাওয়ার জোগাড় হত। ফলে রাজনীতির পাকা মাথারা এ ওর সঙ্গে ফোন-মারফত যোগাযোগ করে এক হওয়ার অনেক আগেই গোটা কংগ্রেস দলের বৃদ্ধ, অতি-বৃদ্ধ নেতারা আবেগপ্রবণ হয়ে, রাজনীতি থেকে শতহস্ত দূরে থাকা, বিমানচালক রাজীব গাঁধীকেই রাতারাতি কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন করে ফেললেন।
তার দু’মাসের মধ্যে লোকসভা নির্বাচন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে নির্বাচনী ক্ষেত্র-সীমানা পুনর্বিন্যাসের ফলে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের জন্ম হয়। ১৯৭৭ এবং ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে সি পি এমের সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ওই আসনে তাঁর নিকটবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস প্রার্থীকে এত বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন যে, তখন থেকেই ওই কেন্দ্রটি বামদুর্গ বা লালদুর্গ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়।
তাই ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় তো বটেই, জামানতও জব্দ হতে পারে, ধরে নিয়ে কোনও প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেস নেতাই যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি হচ্ছিলেন না।
তেমন জুতসই কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না দেখে, শেষ পর্যন্ত মহিলা ছাত্রনেত্রী কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর নাম দক্ষিণ কলকাতা কংগ্রেসের ছাত্র-যুব কর্মীরা ছাড়া আর প্রায় কেউই শোনেননি, তাঁকেই নির্বাচনী টিকিট দিয়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী কাম কংগ্রেসের সভাপতি স্বয়ং রাজীব গাঁধী।
এবং অবাক কাণ্ড! যে-দলের বিরুদ্ধে মমতা দাঁড়িয়েছেন, সেই সি পি এমের সর্বময় কর্তা, তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বাড়ি গিয়ে, তাঁকে প্রণাম করে, তাঁরই আশীর্বাদ নিয়ে এলেন তিনি। তার পর অশোক চক্রবর্তী, সোনালি গুহর মতো বেশ কয়েক জন ছাত্র ও যুব কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। শুরু করলেন এক অভিনব নির্বাচনী প্রচার।
সি পি এমের স্থানীয় নেতারা অল্প কিছু দিনের মধ্যেই টের পেলেন, এ মেয়ে বড় সাংঘাতিক। অত্যন্ত সাদামাঠা, আটপৌরে এই মেয়েটি ভোটারদের ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ছে। একে ভাই ডাকছে। তাকে মাসিমা ডাকছে। যে কোনও বাড়িতে ঢুকে চা খাচ্ছে। রুটি-তরকারি খাচ্ছে এবং দেখতে দেখতে কী করে যেন প্রত্যেকের ঘরের মেয়ে হয়ে উঠছে। এমনকী, অদ্ভুত এক কায়দায় সি পি এমের পোড়খাওয়া ক্যাডারদের পর্যন্ত টালমাটাল করে দিচ্ছে। দোনোমোনো করে দিচ্ছে। তাঁদের ভাবতে শুরু করাচ্ছে, তাঁরা সি পি এমকেই ভোট দেবেন, নাকি কংগ্রেসকে।
তাঁদের মধ্যে অনেকেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার চালানোর জন্য সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে বারবার অনুরাধ করলেন। কিন্তু সি পি এমের উচ্চপর্যায়ের নামযশওয়ালা নেতা, বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার সোমনাথবাবু তাঁদের অনুরোধ-উপরোধ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন। অত্যন্ত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে অবজ্ঞামিশ্রিত গলায় বললেন, আমি যাদবপুরের দু’বারের সাংসদ। এলাকার লোকেরা আমাকে চেনে। আমাকে কি শিঙা ফুঁকে ভোট চাইতে হবে?
মুখে যা-ই বলুন না কেন, যখন ভোটের ফলাফল ঘোষণা হল, শুধু সোমনাথবাবুই নন, তাঁর মতো নিশ্চিন্তে ঘুমোতে থাকা আরও অনেক তাবড় তাবড় খরগোশ-মার্কা সি পি এম নেতাদের চক্ষু চড়কগাছ। সে বার ইন্দিরা গাঁধীর ও রকম মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য কংগ্রেস দলের প্রতি জনগণের প্রবল সহানুভূতির ফলে কি না জানা নেই, পশ্চিমবঙ্গের বিয়াল্লিশটি লোকসভা আসনের মধ্যে অভূতপূর্ব ভাবে কংগ্রেস জয়লাভ করেছিল ষোলোটিতে। তবে সবচেয়ে বড় ঘটনা– অবশ্যই লালদুর্গের পতন এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিত উত্থান। গোটা রাজ্য দেখল, সমস্ত সমীক্ষা, সমস্ত হিসেব ওলটপালট করে দিয়ে ৫০.৮৭ শতাংশ ভোট, অর্থাৎ ১৯.৬৬০টি ভোট বেশি পেয়ে অভাবনীয় ভাবে জিতে সোমনাথবাবুকে একেবারে ধরাশায়ী করে দিয়েছেন মমতা।
সে দিনই এক নতুন নক্ষত্রের উদয় হল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে। সূচনা হল নতুন ইতিহাস। পরবর্তী পাঁচ বছর, লোকসভার এই নবীন সাংসদ শুধু যে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন, তাই-ই নয়, কংগ্রেসের এই তরুণ-তুর্কী নজর কেড়েছিলেন বিরোধী নেতা-নেত্রীদেরও।
পশ্চিমবঙ্গের নানা দাবিদাওয়া নিয়ে কখনও শিল্পমন্ত্রী ভেঙ্কট রাওয়ের দফতরের সামনে ধরনায় বসে, কখনও বা সংসদকক্ষের ভিতরে নিজের অবস্থানে অনড় থেকে তিনি খুব তাড়াতাড়ি মন জয় করেছিলেন গোটা রাজ্যবাসীর। কিছুতেই যখন উদ্ধার করা যাচ্ছে না ট্রেকিং করতে গিয়ে তুষারখাদে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কলকাতার বেহালা অঞ্চলের সাত জন যুবকের দেহ, যখন হাল ছেড়ে দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে পড়েছে রাজ্য সরকার, তখন ওই নিখোঁজদের একজনের আত্মীয়, সার্ভে বিল্ডিংয়ের কর্মী, সি পি এমের একনিষ্ঠ সমর্থক রমেন রায় বড় বড় নেতাদের হাজার অনুরোধ-উপরোধ করেও বিফল হওয়ায়, শেষ চেষ্টা হিসেবে সোজা এসে হাজির এলেন মমতার কাছে।
লোকটা কোন দলের কে, সে সব না দেখেই সঙ্গে সঙ্গে মমতা বিশেষ বার্তা পাঠালেন রাজীব গাঁধীকে। তাঁরই সহযোগিতায় প্রশিক্ষিত কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠিয়ে অমন দুর্গম জায়গা থেকে উদ্ধার করে আনলেন ওই দেহগুলো। শুধু তাই-ই নয়, দেহগুলো বাক্স-বন্দি করে বিশেষ বিমানে এনে তিনি নিজেই তুলে দিয়ে এলেন মৃতদের পরিবারবর্গের হাতে।
তখনই বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছিলেন। বলেছিলেন, মমতা না থাকলে এটা কিছুতেই সম্ভব হত না।
শুধু নিজের নির্বাচনী এলাকা নয়, গোটা রাজ্যের যেখানেই কোনও সমস্যা দেখা দিয়েছে, দিন নেই রাত নেই, সেখানেই মমতা গিয়ে হাজির হয়েছেন। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই এই রাজ্যের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
তবু শেষ রক্ষা হল না। না, তাঁর জন্য নয়, আসলে পাঁচ বছর পরে, ১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের মুখে দেশের সুরক্ষার জন্য অস্ত্র কেনার সময় প্রচুর টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছিল রাজীব গাঁধীর বিরুদ্ধে। তার ফলে বোফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে সমস্ত প্রচার মাধ্যম মুখর হয়ে ওঠে। যে-ভাবে এক সময় আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত ‘ইন্দিরা একাদশী’ লিখে ধরাশায়ী করে দিয়েছিলেন ইন্দিরা গাঁধীকে। ‘মারুতি কেলেঙ্কারি’ লিখে বিপাকে ফেলে দিয়েছিলেন ইন্দিরা-পুত্র সঞ্জয় গাঁধীকে। সেই একই চালে কুপোকাত হয়ে গেল কংগ্রেস। মুখ ফিরিয়ে নিল দেশবাসী। পশ্চিমবঙ্গেও তার অন্যথা হল না। সাংসদ সংখ্যা ষোলো থেকে কমে এক ধাক্কায় চারে এসে ঠেকল। হেরে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
হেরে গেলেও মমতা কিন্তু তাঁর সি পি এম বিরোধী আন্দোলন চালিয়েই যেতে লাগলেন। রাজ্য কংগ্রেসের অধিকাংশ নামী-দামি নেতা যখন সি পি এমের সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ রেখে নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন, তখন একমাত্র মমতাই প্রায় প্রত্যেক দিন রাস্তায় নেমে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
এ রকমই একদিন, ১৯৯০ সালের ১৬ আগস্ট, মিছিল করে হাজরা মোড়ে এসে পৌঁছতে না-পৌঁছতেই, পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য মমতার মাথা লক্ষ্য করে সি পি এমের ক্যাডার কাম এক সময় জেল-খাটা দাগি আসামি লালু আলম সজোরে চালিয়ে দেয় লোহার রড। প্রায় অচৈতন্য, রক্তাক্ত মমতাকে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। খবর পেয়ে দিল্লি থেকে উড়ে আসেন কংগ্রেস সভাপতি রাজীব গাঁধী। এ রকম জেদি, লড়াকু মেয়েই চেয়েছিলেন তিনি। তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর নির্বাচন ভুল হয়নি। তাই সে দিনই শয্যাশায়ী মমতাকে পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি করে দিলেন তিনি।
দু’বছর পরে, ১৯৯১ সালে আবার যখন নির্বাচন হল, তখন কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি দক্ষিণ কলকাতার আসনে ৫২ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেন মমতা। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলেন না। হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছিলেন, সি পি এম যদি ওই রকম ব্যাপক হারে ছাপ্পা ভোট না দিত, তা হলে ভোটের ব্যবধান আরও বাড়ত। কিন্তু কী করা যাবে! অবশেষে নরসিংহ রাও মন্ত্রীসভার ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দফতরের প্রতিমন্ত্রী হয়ে গেলেন তিনি।
কিন্তু যে মেয়ে একদম সস্তার শাড়ি আর অত্যন্ত কম দামের হাওয়াই চটি পায়ে দিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে চান, কোনও লাভের আশা না করে শুধুমাত্র মানুষের জন্য, মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যেতে চান, তাঁকে কি কখনও মন্ত্রিত্ব দিয়ে ঠান্ডা ঘরে আটকে রাখা যায়! যায় না বলেই হয়তো এক বছরও কাটল না। উনি মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিয়ে দিলেন।
১৯৯২ সালের ২৪ নভেম্বর যুব কংগ্রেসের উদ্যোগে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বিশাল এক জনসভা করে বামফ্রন্টের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস, যদি স্বচ্ছ নির্বাচন হয়, তা হলে এখনই পশ্চিমবঙ্গ থেকে সি পি এম একেবারে ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাই ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই মহাকরণ অভিযান করলেন তিনি। মূল দাবি একটাই– নো আইডেনটিটি কার্ড, নো ভোট। কিন্তু পরিচয়পত্র ছাড়া ভোট দিতে না দিলে ভুতুড়ে ভোটাররা ভোট দেবে কী করে! আর ভুতুড়ে ভোটাররা ভোট না দিলে সি পি এম জিতবে কী করে! আর সি পি এম না জিতলে তারা সিংহাসন দখলে রাখবে কী করে! তাই শলা-পরামর্শ করে উপর মহল থেকে নির্দেশ দিতেই, সে দিন শান্তিপূর্ণ ওই মিছিলের ওপরে আচামকা ফায়ারিং শুরু করে দিল সি পি এমের পুলিশ। একের পর এক ধুপধাপ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তরতাজা তেরোটি প্রাণ।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর থেকেই রাজ্য কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতা-নেত্রীরা মমতার ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী জনপ্রিয়তাকে মন থেকে আর মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁরা তাঁকে তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করার নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মমতাও বুঝে গিয়েছিলেন, সি পি এমকে রাজ্যছাড়া করবার যুদ্ধে রাজ্য কংগ্রেসই শুধু নয়, কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্বও তাঁর পাশে তো নেই-ই, বরঞ্চ তাঁর বিরুদ্ধেই। বুঝতে পারলেন, কংগ্রেস আর সি পি এম– নামে দুটো বিরোধী দল হলেও তাদের দূরত্ব ক্রমশ ঘুচে যাচ্ছে। কাছাকাছি চলে আসছে একে অপরের। দু’জনের মধ্যে খুব ভাল বোঝাপড়া হয়ে গেছে ভিতরে ভিতরে। বাইরে যা-ই বলুক না কেন, আসলে সি পি এমেরই একটা ‘বি’ টিমে পরিণত হয়েছে এই কংগ্রেস দল। তাই কংগ্রেস নয়, তিনি মনে মনে নতুন একটা কিছু করার কথা ভাবতে শুরু করলেন। এমন একটা কিছু, যা দিয়ে এই রাজ্য থেকে সি পি এমকে চিরতরে উৎখাত করা যায়। সে কথা আকার-ইঙ্গিতে খুব ঘনিষ্ঠ কয়েক জনকে বললেনও তিনি।
১৯৪২ সালের ৯ আগস্টের ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’কে স্মরণ করে ১৯৯৭ সালের ৯ অগস্ট কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিতকক্ষে জড়ো হয়েছিল। সেখানে রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি সোমেন মিত্রের উসকানিতে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সভাপতি সীতারাম কেশরী যখন কংগ্রেস থেকে মমতাকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলেন, তখন মমতার ডাকে সাড়া দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জাতীয়তাবাদী যুব-ছাত্র-জনতা কলকাতার মেয়ো রোডে গাঁধী মূর্তির পাদদেশে এক বিশাল সমাবেশে সামিল হয়েছিলেন। দৃঢ় সঙ্কল্প নিচ্ছিলেন সি পি এমের হাত থেকে বাংলাকে মুক্ত করার।
ঠিক তখনই নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের ঠান্ডা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সাংসদ অজিতকুমার পাঁজা। তাঁকে একা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ গাঁধী মূর্তির পাদদেশে আসতে দেখে জমায়েত হওয়া লোকজনেরা জয়ধ্বনী দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানালেন আর মমতা নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে, নির্বাচন কমিশনের বিধিমতো কোনও সংগঠনকে রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে গেলে অবশ্য প্রয়োজনীয় অন্তত দু’জন সাংসদের স্বাক্ষর তাঁর জোগাড় হয়ে গেল।
সেই সময় ইন্দ্রকুমার গুজরালের নেতৃত্বে কেন্দ্রে যে যুক্তফ্রন্ট সরকার চলছিল, সেখান থেকে কংগ্রেস সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতেই, সে সরকারের পতন হয়ে গেল। অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল ফের একটা নির্বাচন। মানে মধ্যবর্তী নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করল– ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮ দ্বাদশ লোকসভার নির্বাচন।
আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস উত্তাল ৩৬
১৯৯৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর কলকাতার শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়ে নেতাজি মূর্তিকে সাক্ষী রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নতুন দল গঠনের কথা ঘোষণা করা হল। তখনও কিন্তু দলের নাম চূড়ান্ত হয়নি। তার ঠিক দু’দিন পরে, ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি দিল্লিতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর অজিতকুমার পাঁজা প্রয়োজনীয় ফর্ম পূরণ করে জমা দিয়ে এলেন।
দলের নাম লেখা হল– তৃণমূল কংগ্রেস। আর দলের নির্বাচনী প্রতীক হল– সবুজ ঘাসের ওপর তিন পাতার জোড়া ফুল। এই ডেইজি ফুলের পাঁপড়িগুলোর রং হল গেরুয়া, সাদা আর সবুজ। দলের তেরঙ্গা পতাকার মধ্যেও এই প্রতীক চিহ্নই বসানো হল।
মমতা জানতেন, এ বার তিনি জিতবেন। জিতবেনই। কারণ, তাঁর সঙ্গে মানুষ আছে। আর যাঁর সঙ্গে মানুষ আছে, তাঁকে আটকাবে কে? তাই তিনি বলেই দিলেন– হয় এ বার, নয় নেভার। শুধু মমতা নন, দলের সবাই জানতেন, তাঁরা আসছেন। শুধু দলের লোকজনই নয়, বাঘা বাঘা রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও তা-ই মনে করতেন। বিখ্যাত সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায় তো লিখেই ফেললেন চিরস্মরণীয় সেই ঐতিহাসিক লাইন– ‘চুপচাপ ফুলে ছাপ’।
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরাও অবাক হয়ে গেলেন, দলের প্রচারে বেরোনো গাড়িতে যেতে যেতে নেওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়ের ও রকম একটা সাক্ষাৎকার পড়ে। লোকে বুঝতে পারলেন, মমতা এ বার আসছেনই।
নির্বাচনের তখন মাত্র দু’মাস বাকি। হাতে একদম সময় নেই। প্রাণপণ লড়তে হবে। অথচ চারদিকে মারণফাঁদ পেতে রেখেছে সি পি এমের জল্লাদ বাহিনী। হিসেবে একটু ভুলচুক হলেই সাড়ে সর্বনাশ। তাই সময় নষ্ট না করে ভারতীয় জনতা পার্টির সঙ্গে নির্বাচনী আসন সমঝোতা করে ফেললেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বময় কত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি অজিতকুমার পাঁজা। ঠিক হল, লোকসভার বিয়াল্লিশটি আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস লড়বে আঠাশটিতে আর চোদ্দোটিতে লড়বে ভারতীয় জনতা পার্টি।
কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে ভোট কাটাকাটির ফলে বামফ্রন্টের প্রার্থীরা বহু জায়গায় জিতে গেলেও, মাত্র দু’মাসের প্রস্তুতিতে নির্বাচন লড়ে সদ্যোজাত তৃণমূল কংগ্রেস ছিনিয়ে নিল কলকাতার তিনটি আসন ছাড়াও যাদবপুর, বারাসত, হাওড়া এবং শ্রীরামপুর আসন। অর্থাৎ দখল করে নিল কলকাতা ও আশপাশের সব ক’টি আসনই।
ব্যস, শুরু হয়ে গেল তৃণমূল কংগ্রেসের জয়যাত্রা। বিরোধীরা বুঝতে পারল, মাত্র দু’মাসে যারা এতগুলো আসনে জিততে পারে, হাতে সময় পেলে তারা কী কাণ্ড ঘটাবে! তাই আর দেরি না করে তারা নতুন রাস্তা ধরল। ঠিক করল, যে ভাবেই হোক, তৃণমূলীদের কোমর ভেঙে দিতে হবে।
গড়বেতার একচ্ছত্র অধিপতি সুশান্ত ঘোষও সতর্ক হয়ে গেলেন। কেউ তাঁর রাজনৈতিক সীমানার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠুক, তিনি তা চান না। তাই ১৯৯৮-‘৯৯ সাল থেকে কিংবদন্তি হয়ে ওঠা প্রভাবশালী মাওবাদী নেতা মাল্লাজুল্লা কোটেশ্বর রাও, লালগড়ের কল্যাণে যাঁকে সবাই কিষানজি ওরফে রামজি বলেই এক ডাকে চেনে, যিনি মাঝে মাঝেই ঝাড়খন্ড থেকে এক দল জনযোদ্ধাকে নিয়ে বেলপাহাড়ি-বাঁশপাহাড়ি-জামবনি-সারেঙ্গায় ঢুকে পড়েন। ওই সব অঞ্চলে শিবির করে মাওবাদীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তাঁর শরণাপন্ন হওয়ার কথা ভাবলেন সুশান্ত ঘোষ।
কিন্তু দলের মাথা যাঁরা, তাঁরা তাঁর এই কাজে সায় দেবে কী! কারণ, যেখানে উন্নয়ন হয়নি, সেখানেই মাওবাদী প্রভাব বেড়েছে। আর মাওবাদীরা শুধু খুনখারাপি, মাইন বিস্ফোরণ, তোলা আদায় কিংবা প্রতি পদে পদে আতঙ্কই সৃষ্টি করছে না, জেহানাবাদ, নালন্দা, ঔরঙ্গাবাদ, পূর্ণিয়া, আবারিয়া, বাঙ্কা, কিষানগঞ্জ, কাথিয়ার, ভাগলপুর, খাগাড়িয়া-র মতো এই পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলেও শুরু করে দিয়েছে শতাব্দী প্রাচীন নিষিদ্ধ পপি চাষ। যার নেতৃত্বে আছে মূলত জনসাধারণের কমিটি এবং নারী ইজ্জত বাঁচাও কমিটির কিছু মহিলা সদস্য।
আর বেআইনি এই পপি চাষের রমরমা এতটাই বেড়েছে যে, অফিমের মতো এই নেশার কবল থেকে যুব সমাজকে বাঁচাতে, বাধ্য হয়ে কেন্দ্র সরকারের সেন্ট্রাল নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর অধীনে আলাদা একটা শাখা খুলতে হয়েছে।
অজ্ঞ কৃষকরা জানেন না, ওটা কী! তাই নতুন সরষে দানা বলে ওরা তাঁদের দিয়ে চাষ করাচ্ছে। কেউ করতে না চাইলে ফলন ফললেই প্রচুর টাকায় সেগুলো কিনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। মোটা টাকার লোভ দেখাচ্ছে। তাতেও রাজি না হলে সপরিবার জানে মেরে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছে। শুধু ভয় নয়, কাউকে কাউকে যে একেবারেই খতম করছে না, তাও নয়, করছে। কারণ, স্থানীয় বাজারে পপির তেমন কোনও চাহিদা না থাকলেও, এক কেজি আফিম বীজ, বিদেশের কথা না হয় বাদই দিলাম, এ দেশেই অঞ্চল, জোগান আর পপির মান অনুযায়ী বিক্রি হয় পঁয়তাল্লিশ হাজার থেকে সত্তর হাজার টাকায়। আর এর মাধ্যমেই মাওবাদীদের হাতে আসে বিপুল পরিমাণ টাকা। যা দিয়ে তাঁরা অস্ত্র কেনেন। দলের রসদ জোগান। তাই এদের দমন করার জন্য শুধু কেন্দ্রই নয়, রাজ্য সরকারও উঠেপড়ে লেগেছে।
সেই রাজ্যের একজন মন্ত্রী হয়ে তিনি ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, সেটা শুধু তাঁর দল কেন, কোনও দলই সমর্থন করবে না। কিন্তু উপায় কী! তিনি যোগাযোগ করবেন। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছবেন কী করে। ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল, গড়বেতার দু’নম্বর সন্ধিপুর অঞ্চলের প্রাক্তন সি পি এম পঞ্চায়েত অসিত সরকারের কথা।
বাড়ির অমতে ভিন্ন জাতে বিয়ে করায়, তাঁকে শুধু তাঁর বাড়ির লোকেরা বাড়ি থেকে বারই করে দেয়নি, স্থানীয় ক্যাডাররা তাঁকে সি পি এম দল থেকেও বিতাড়িত করেছে। অগত্যা তিনি তাঁর নতুন বউকে নিয়ে চলে গেছেন ঝাড়খন্ডে। সেখানে গিয়ে জনযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। অস্ত্রশস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছেন। ওখানে গিয়ে তিনি নতুন নাম নিয়েছেন– মঙ্গল সিং।
সুশান্ত ঘোষ আর অমিয় পাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করে বললেন, জনযোদ্ধারা যদি তাঁদের আধুনিক লং-রেঞ্জ আর্মস সাপ্লাই দিয়ে তৃণমূল সমর্থকদের ভয় দেখিয়ে, দরকার হলে মেরে গ্রাম ছাড়া করে দেওয়ার কাজে সি পি এমকে সাহায্য করে, তা হলে সি পি এমও তাঁদের প্রচুর অর্থ তো দেবেই, তার সঙ্গে মেদিনীপুর আর বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলে শিবির করে তাঁদের যোদ্ধাদের ট্রেনিং দেওয়ারও বন্দোবস্ত করে দেবে।
মধ্যস্থতা করার জন্য মঙ্গল সিং ওঁদেরকে কিষানজির কাছে নিয়ে গেলেন। এ কাজের জন্য কিষানজি ওঁদের কাছে প্রতি মাসে দশ লক্ষ টাকা দাবি করেন। সুশান্ত ঘোষ সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। কারণ উনি জানতেন, গড়বেতা ব্লকে রাজত্ব ফিরে পেলে বন দফতরের ঠিকেদারদের কাছ থেকে এই সামান্য টাকা জোগাড় করাটা তাঁর কাছে কোনও ব্যাপারই না।
মৌখিক চুক্তি হয়ে গেল, সি পি এমের বাইক-বাহিনীর প্রতিটি বাইকের পিছনের আসনে একজন করে জনযোদ্ধা মুখে কালো কাপড় বেঁধে বসে থাকবে। হাতে থাকবে এ কে ফর্টিসেভেনের মতো অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। গ্রামে ঢুকেই তারা এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকদের এমন ভয় পাইয়ে দেবে যে, তারা দলে দলে গ্রাম ছেড়ে পালাবে। আর এই সময় যদি কোনও তৃণমূল সমর্থক গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, তা হলে তো কথাই নেই, একেবারে সোনায় সোহাগা। এই ভাবে যে ক’জন তৃণমূল সমর্থককে এলাকা ছাড়া করা যায়, ততই তাদের লাভ। সেই হিসেবে যে-রাতে যে-গ্রামটি আক্রমণ করে তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের তাড়িয়ে গ্রাম দখল করার আগাম পরিকল্পনা থাকত, সে দিন দুপুরে এক দল পুলিশ সেই গ্রামে ভুয়ো এক গ্রেফতারি-তালিকা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এমন ভয় দেখাত যে, গ্রেফতার এড়াবার জন্য বেশির ভাগ সমর্থকই বাড়ি ছেড়ে, এমনকী কেউ কেউ গ্রাম ছেড়েও পালাত।
এই ভয় দেখানোর কাজ শেষ করে সেই পুলিশ-বাহিনী সন্ধ্যাবেলা থানায় গিয়ে রিপোর্ট জমা দিলেই রাতের বাহিনী প্রস্তুত হয়ে যেত। পুলিশের এই বাহিনীর নেতৃত্ব দিত অন্য এক দারোগা। এই বাহিনী রাত বারোটা নাগাদ একসঙ্গে অনেকগুলো গাড়ি নিয়ে গ্রামে ঢুকত। প্রত্যেকটি গাড়ির হেডলাইট জ্বালানো থাকত। তাতেই গ্রামের নিরীহ মানুষেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ত। গাড়িগুলো জোরে জোরে হর্ন বাজিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়ে সেই আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিত।
তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নেমে তাদের দরজায় দমাদ্দম ধাক্কা দিত। লাথি মারত। সেই নেতার নাম ধরে ডাকাডাকি করত। ভালয় ভালয় বেরিয়ে আসতে বলত। না হলে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকবে বলে হুমকি দিত। কিন্তু খুব স্বাভাবিক ভাবেই, তার অনেক আগেই সেই সব নেতা বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যেত।
বাড়ির কোনও বয়স্ক পুরুষ বা মহিলা কোনও উপায় না দেখে দরজা খুললেই হুড়মুড় করে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ত পুলিশ। পলাতক নেতাকে খোঁজার নামে বাড়ির জিনিসপত্র তছনছ করত। লাঠি উঁচিয়ে ভয় দেখাত বাড়ির লোকজনদের। পুরুষদের মারধর করত, কমবয়সি মেয়েদের হাত ধরে টানাটানি করত। অশ্লীল ইঙ্গিত করত। কারও কারও শ্লীলতাহানিও করত।
গ্রামে দু’-তিন ঘণ্টা দাপাদাপি করে, পুলিশ-বাহিনী আবার ফিরে আসার ভয় দেখিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই গ্রাম ছাড়ত। তারা গ্রাম ছাড়ার একটু পরেই গভীর রাতে গ্রামে ঢুকত, আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকা সি পি এমের বাইক-বাহিনী। একসঙ্গে পঁচিশ-ত্রিশ, এমনকী কখনও সখনও চল্লিশ-পঞ্চাশটা মোটরবাইকও গ্রামে ঢুকত। বাইক চালাত সি পি এমের ক্যাডাররা, যারা গ্রামের রাস্তাঘাট মোটামুটি চেনে। গ্রামে ঢুকলেই পিছনের সিটে বসা মুখে কালো কাপড় বাঁধা জনযোদ্ধারা এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করত। পঁচিশ থেকে পঞ্চাশটি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের অনবরত গুলির শব্দে গোটা গ্রাম মুহুর্মুহু সচকিত হত। কেউ ঘর ছেড়ে বেরোতেন না। শুধু অকুতভয় দু’-একজন তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী বা সমর্থক গাছে উঠে কিংবা পুকুরে ডুবে থেকে প্রাণ বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। দু’-এক ঘণ্টা তাণ্ডব চালিয়ে সকালের আলো ফোটার একটু আগেই বাইক-বাহিনী গ্রাম ছেড়ে চলে যেত।
তারও পরে, ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে ঢুকতে শুরু করত সি পি এমের লুঠেরা-বাহিনী। এই বাহিনীতে থাকত স্থানীয় নয়, মূলত বেশ খানিকটা দূরের কয়েকটি গ্রামের অন্তত দু’-তিনশো লোক। প্রত্যেকের হাতে থাকত লাঠি, টাঙ্গি, ধারালো দা জাতীয় অস্ত্রশস্ত্র। আর থাকত বেশ বড়সড় একটা চট বা পলিথিনের বস্তা।
শুধু পুরুষ নয়, ওই দলে কিছু মহিলাও থাকত। লুঠপাটের দামি দামি জিনিস পাওয়ার লোভ দেখিয়ে তাদের জড়ো করত স্থানীয় সি পি এমের নেতারা। এরা সবাই মিলে গ্রামে ঢুকে বিভিন্ন পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে বাড়ি বাড়ি ঢুকে হামলা চালাত। সোনাদানা, টাকাপয়সা, বাসনপত্র, কাপড়চোপড় ছাড়াও ধান-চাল, সারের বস্তা, আলুর বস্তা, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, পুকুরের মাছ, গাছের কলা, নারকেল, ফলমূল, সুপারি, নলকূপের মাথা, মোটরপাম্প– যা পেত, তা-ই লুঠ করে নিয়ে যেত। শুধু নিয়েই ক্ষান্ত হত না, আক্রান্তদের আরও বিপাকে ফেলার জন্য যাওয়ার আগে গাছপালা কেটে বাগান তছনছ করে দিত। পুকুরে ফলিডল জাতীয় বিষ ঢেলে দিত, যাতে শেষ মাছটা পর্যন্ত মারা যায় এবং সেই মাছ যাতে বাজারে বিক্রি করতে না পারে বা কেউ খেতেও না পারে।
তবু তারই মধ্যে সাহস করে গড়বেতা পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত গড়বেতা ৩ নম্বর ব্লকের এক প্রান্তিক কৃষক– সামশের মল্লিকের ছেলে শহিদুল্লা মল্লিকের বউ ছবিলা বিবি সে বার তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোটে দাঁড়ান। কিন্তু সি পি এমের হুমকির ফলে, ওই এলাকার গ্রামবাসীরা বাধ্য হয়ে তৃণমূলকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। ফলে ছবিলা বিবি নির্মম ভাবে হেরে যান।
জায়গাটা ছিল সি পি এমের জাঁদরেল নেতা কাম মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষের খাসতালুক। সেখানে তাঁর দলের বিরুদ্ধে তৃণমূলের প্রতীকে এক গরিব মুসলমান গৃহবধূর ভোটে দাঁড়ানোর দুঃসাহস দেখে তিনি এমনিই ফুঁসছিলেন। তাই ছবিলা বিবি হেরে যেতেই তাঁকে সবক শেখানোর জন্য মন্ত্রীর হুকুমে স্বামী-সহ তাঁকে তুলে নিয়ে আসে সি পি এমের ক্যাডাররা।
প্রথমে স্বামী শহিদুল্লাকে প্রচণ্ড মারধর করে রাস্তার ধারের একটা গাছে বেঁধে ফেলা হয়। কী হচ্ছে দেখার জন্য গ্রামবাসীরা জড়ো হতেই বেধড়ক পেটানো শুরু হয় ছবিলা বিবিকেও। রাস্তায় ফেলে চুলের মুঠি ধরে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে টেনে এনে লাথি, কিল, চড় মারতে মারতে খুলে নেওয়া হয় তাঁর শাড়ি।
অমন বীভৎস কাণ্ড দেখেও কেউ একটা টুঁ শব্দ করতেও সাহস পাননি। প্রতিবাদ তো দূরের কথা। কারণ চারদিকে তখন ঘিরে ছিল সি পি এমের ক্যাডারবাহিনী। তার উপরে শাস্তি দিচ্ছেন স্বয়ং মন্ত্রীমশাই। যাঁকে দেখলে গড়বেতার মানুষ থরথর করে কাঁপতে থাকেন। বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়।
তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে নিরীহ গ্রামবাসীরা দেখলেন, রাস্তায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনকে সাক্ষী রেখে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র এক যুবতী মুসলমান গৃহবধূকে ঘণ্টাখানেক ধরে কী ভাবে প্যারেড করানো হল। গাছে বাঁধা প্রায় অর্ধমৃত স্বামীর চোখে-মুখে বারবার জল ছিটিয়ে কী ভাবে তাঁকে বাধ্য করা হল সেই দৃশ্য দেখতে।
খবর পেয়েও পুলিশ আসেনি। কারণ সুদৃশ্য নরম চেয়ারে বসে হিটলারের মতো চেখে চেখে তখন এ দৃশ্য পরখ করছিলেন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ। এটা করে এলাকার লোককে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে যাওয়ার ফল। তৃণমূলের হয়ে দাঁড়ানোর পরিণতি।
সে দিন তিনি এমন একটা শিহরন জাগানো ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, যার ভয়ে শিহরিত হয়ে পড়েছিলেন শুধু ওই অঞ্চলই নয়, তার আশপাশের অঞ্চলও। আর শুধুমাত্র এই কারণেই, তার পাঁচ বছর পরেও, ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাঁর বিধানসভা এলাকার কোথাও আর কোনও বিরোধী দলের প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যায়নি। যার জন্য সি পি এমের প্রার্থীরা সব আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন।
কিন্তু সুশান্ত ঘোষের এই অত্যাচার আর নিপীড়ন যে কেউ ভাল ভাবে নেননি, তার প্রমাণ ১৯৯৯ সালের ঘটনা। তার আগে ১৯৭৭ থেকে একটানা সি পি এমের দখলে ছিল ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত গড়বেতা পূর্ব বিধানসভা। এবং ১৯৯৬ সালেই ৬৬.৬৬ শতাংশ, অর্থাৎ দুই তৃতীয়াংশ ভোটে জিতে রাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন সুশান্ত ঘোষ। ১৯৯৮ সালে সি পি এম প্রার্থী রূপচাঁদ মুর্মু ৬৪.৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সামায় মান্ডিকে হারিয়েছিলেন ৪০ হাজার ৫৭৩ ভোটে। অথচ ঠিক তার দেড় বছর পরে, ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ছবিটা আমূল পালটে গেল। তৃণমূলের দামিন মুর্মু তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, সেই একই লোক, রূপচাঁদ মুর্মুকে ১৫ হাজার ২৬৯টি ভোটে হারিয়ে সি পি এমের টনক নড়িয়ে দিল।
বোঝা যাচ্ছিল, সি পি এম যত অত্যাচারী হয়ে উঠছে, মানুষ ততই… না, কংগ্রেসের দিকে নয়, কংগ্রেসকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না কেউ। তাই তৃণমূলের দিকে ঝুঁকছে। তৃণমূলকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে।
নবীন মাস্টার তেরো নম্বরের দিকে তাকালেন। তেরো নম্বরও নবীন মাস্টারের দিকে। দু’জনেই বুঝতে পারলেন দু’জনের মনের কথা। হ্যাঁ, পারলে মমতাই পারবেন। এই রাজ্যকে দুর্নীতি আর অত্যাচারের কবল থেকে রক্ষা করতে একমাত্র মমতাই পারবেন। মমতাই।
চলবে…