ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ৯

।।নয়।।

ও এখন বুঝতে পারে, তখন সবেমাত্র জঙ্গলের মধ্যে বসতি গড়ে উঠছে। চারদিকে সাপখোপ। বাচ্চারা যাতে একা-একা জঙ্গলের দিকে না যায়, রাত-বিরেতে হিসি করতে গেলেও যাতে বড় কাউকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়, সে জন্য বাপ-ঠাকুরদারা ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের জুজুর ভয় দেখিয়ে এসেছে। তার পরে কত কী পালটে গেছে। সেই জঙ্গলও আর নেই। বিষাক্ত সাপ তো নেই-ই, এমনি সাপও আছে কি না সন্দেহ। তবু সেই জুজুর ভয় দেখানোর চলটা আজও রয়ে গেছে। আর সেই ভয়েই বাচ্চাদের জীবন নিয়ে যখন সংশয় শুরু হয়, তখন মুহূর্তের মধ্যে সেই বাপ-ঠাকুরদারাই পুরো একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যায়। বলে, ওই সব জুজু-টুজু সব বাজে কথা।
জঙ্গলের সেই অভিজ্ঞতার সাক্ষী, ওর ছোটবেলাকার সব চে’ প্রিয় বন্ধু, সেই বীজেশ এখন বহু দূরে। শুধু রেখে গেছে তার খাঁচাটা। সেই খাঁচাটা নাকি পচে-গলে এখন গন্ধ ছড়াচ্ছে।
নিজের মনেই বিড়বিড় করল তেরো নম্বর, ওর তো যাওয়ার কথা ছিল না। ছিল তার। তারই নাম লেখা হয়েছে ওদের খতম তালিকার তেরো নম্বরে। তা হলে কি ওরা সেই তালিকা অদলবদল করল!
ও গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল সেই ভিড়ের দিকে। এ দিকে যারা দাঁড়িয়ে, তাদের সবার মুখই ও দিকে। আর ও দিকে যারা দাঁড়িয়ে, তাদের প্রত্যেকের মুখই এ দিকে। তার মানে দু’দলের মাঝখানে আছে বীজেশের দেহ।
যারা ও দিকে দাঁড়িয়ে ছিল, তাদেরই কেউ বুঝি প্রথম দেখতে পেয়েছিল ওকে। তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে সে চিৎকার করে উঠল– ওই তো…
‘ওই তো…’ বলল ঠিকই, কিন্তু ওকে সবাই তেরো নম্বর বলে বলে এমন হয়ে গেছে যে, ওর আসল নামটা কী, সেটাই অনেকে ভুলে গেছে! সেও নিশ্চয়ই ভুলে গেছে। সে ভুলুক, কিন্তু ওর অমন বিকট চিৎকার শুনে ওর আশপাশে যারা ছিল, তারা তার দিকে তো তাকালই, যারা ও দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তারাও মুহূর্তের মধ্যে পিছন ফিরে তাকাল। দু’মিনিটও লাগল না, ওই জটলা থেকে বেশ কয়েক জন তার দিকে এগিয়ে এল। ওদের মধ্যে রতনও ছিল। সে বলল, কী রে, কেমন আছিস?
ও কিছু বলতে যাওয়ার আগেই কার্তিক বলল, এত দিন পর কোত্থেকে? কোথায় ছিলি?
ও উত্তর দেবে কী, তার আগেই শিবু বলল, শুনেছিস এখানকার খবর?
ও একা এ দিকে। ও দিকে সাত-আট জনের একটা দল। একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে।
ও বলল, বীজেশকে নিয়ে গেছে?
রতন বলল, না, এখনও নেয়নি। এ বার বোধহয় নেবে। দেখলাম তো দু’জন লোক স্ট্রেচার নিয়ে আসছে। বডি তো সেই থেকে ওই একই রকম ভাবে পড়ে আছে।
‘বডি’ শব্দটা শুনেই থতমত খেল ও। একটা মানুষ মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কেমন নামগোত্রহীন হয়ে যায়। তখন সে কারও সন্তান নয়, বাবা নয়, দাদা-কাকা-মামা, কেউ নয়। এমনকী নামটা পর্যন্ত উবে যায়। সে তখন শুধু একটা বডি। ও অবাক। এখনও নেয়নি।
– নেবে কী? এই তো সবে পুলিশ এল।
কার্তিক বলল, বডি পেতে পেতে বোধহয় কাল দুপুর গড়িয়ে যাবে।
শিবু বলল, সে তো হবেই। পোস্টমর্টেম হবে না? মার্ডার কেস তো।
তেরো নম্বর বলল, শুনলাম পচে গেছে। কাল হলে তো… কাউকে ধরে-টরে একটু আগে পাওয়া যায় না?
রতন বলল, কাকে ধরবি? আমাদের কথা কে শুনবে বল? নেতা-টেতা তো সব ওদের হাতে।
শিবু বলল, শুনলাম ওরা আজ গ্রামে ঢুকছে না ঠিকই, তবে ওরা নাকি গ্রাম থেকে বেরোনোর সব ক’টা রাস্তার মোড়ে মোড়ে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে।
– তাতে কী হয়েছে? তেরো নম্বর কথাটা বলতেই রতন বলল, তাতে কী হয়েছে মানে? ওদের ক্ষমতা জানিস? ওরা কী করতে পারে তোর কোনও ধারণা আছে? গোটা প্রশাসন ওদের হাতে।
শিবু বলল, ওরা গুন্ডা-বদমাস। ওদের কাছে আর্মস আছে। আমরা কি ওদের সঙ্গে পারব?
কার্তিক বলল, সবাই শক্তের ভক্ত। আমাদের পাশে কেউ এসে দাঁড়াবে না।
তেরো নম্বর চোয়াল শক্ত করে বলল, দাঁড়াবে। এমন অনেক মানুষ এখনও পৃথিবীতে আছেন, যাঁরা বিকিয়ে যাননি। মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে জানেন। মানুষের পাশে দাঁড়ান। তাঁরা এই সব খুচখাচ দু’-চার পয়সার গুন্ডাকে ভয় পান না।
শিবু, রতন, কার্তিক সবাই ওর মুখের দিকে হাঁ করে তাকাল। তুই কি তেমন কাউকে চিনিস?
তেরো নম্বর বলল, চিনি।

চলবে…

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ৮ 

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!