।।দশ।।
তেরো নম্বরের উলটো দিকে যারা দাঁড়িয়েছিল তাদের চোখ-মুখ চকচক করে উঠল। – চিনিস? কে?
– নবীন মাস্টার।
‘মাস্টার’ শব্দটা শোনামাত্র ওদের মুখগুলো ফের ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একটা মাস্টার আর কী করতে পারে! এম পি, এম এল এ, কাউন্সিলর, নিদেনপক্ষে গ্রামের একজন পঞ্চায়েত প্রধান না হোক, অন্তত ছোটখাটো একটা নেতা হলেও না-হয় কথা ছিল। কিন্তু মাস্টার! তার দৌড় আর কতটুকু!
তার কথা শুনে ওদের ফিউজ হয়ে যেতে দেখে, যে-কথাটা নবীন মাস্টারের সাহিত্য আড্ডায় ও একদিন প্রথম শুনেছিল। শুনে সারা রাত চিন্তা করেছিল। এবং বুঝেছিল, কথাটা মোটেই ফেলনা নয়। খুব মূল্যবান। সেই কথাটাই উগড়ে দিল ও।
– জানবি, একটা তলোয়ারের চেয়ে একটা কলমের ক্ষমতা অনেক বেশি।
ওর কথাটায় কেউ আমল দিল বলে ওর মনে হল না। তার মধ্যেই শিবু হঠাৎ বলে উঠল, কোন স্কুলের?
তেরো নম্বর আমতা আমতা করে বলল, এখন আর পড়ান না। শিয়ালদার কাছে আমহার্স্ট স্ট্রিটে একটা কলেজ আছে, সিটি কলেজ। আগে নাকি সেখানে পড়াতেন। কয়েক বছর হল অবসর নিয়েছেন।
কার্তিক নিরাশ গলায় বলল, রিটায়ার্ড পার্সেন! তার মানে তো বুড়ো হয়ে গেছে।
– বয়স হলেই বুড়ো হয় না। উনি মনেপ্রাণে তোর চেয়ে বেশি ইয়ং। প্রচুর লোকের সঙ্গে ওনার জানাশোনা আছে। আমার মনে হয়, ওনাকে ধরতে পারলে নিশ্চয়ই একটা রাস্তা বেরোবে। বেশ জোরের সঙ্গেই বলল তেরো নম্বর। কিন্তু মনে মনে বলল, এই জন্যই না আগ বাড়িয়ে কারও জন্য কিছু করতে যাওয়া উচিত নয়।
– কিন্তু উনি আমাদের জন্য করতে যাবেন কেন? ওনার লাভ? প্রশ্নের ঢঙে কথাটা বলল রতন।
একটু বিরক্তই হল ও। বলল, তোরা সেই কুয়োতেই পড়ে আছিস, না? একটু বাইরে বেরো। চারদিকে চেয়ে দেখ। তা হলেই দেখতে পারবি, পৃথিবীটা কত বদলে গেছে। সবাই লাভ-ক্ষতির হিসেব করে পা ফেলে না। বহু লোক আছেন, যাঁরা নিজেরা যেটাকে ঠিক মনে করেন, তার জন্য লড়ে যান। প্রাণ দিতেও পিছ-পা হন না।
– না না, সে রকম লোক তো থাকতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু না। আর তুই যখন বলছিস…
রতন মৃদুস্বরে কথা ক’টা বলতেই কার্তিক বলল, মাস্টার যখন, তখন তো সারা জীবনে প্রচুর ছেলেমেয়েকে পড়িয়েছেন, তাদের মধ্যে থেকে এখন নিশ্চয়ই কেউ পুলিশ হয়েছে, কেউ নেতা হয়েছে, আবার কেউ হয়তো এম এল এ, এম পি-ও হয়েছে। তা, উনি গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ালে কাজ হবে না? মাস্টার বলে কথা। শুনিসনি, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মাস্টারদা সূর্য সেনের কথা? উনিও তো মাস্টার ছিলেন, সেই জন্যই তো সবাই তাঁকে মাস্টারদা মাস্টারদা বলে ডাকত। ওনার এক ডাকে তাঁর ছাত্ররা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দেশের জন্য কি না করেছে তারা? প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছে। আর এই মাস্টারের ছাত্রছাত্রীদের তো প্রাণ দিতে হবে না, একটু ইনিসিয়েটিভ নিলেই যথেষ্ট।
শিবু হাঁ করে শুনছিল। বলল, দ্যাখ, আমাদের তো কারও সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। তেরো নম্বর যখন বলছে, তখন একবার কথা বলে দেখতে অসুবিধে কোথায়?
রতন বলল, অসুবিধের কী আছে? গেলেই হয়।
– গেলেই হয়? এই গ্রাম থেকে বেরোতে পারলে তো যাবি। ওরা যে ভাবে গোটা গ্রামটাকে ঘিরে রেখেছে, না-দিচ্ছে গ্রামের কাউকে বাইরে যেতে, না-দিচ্ছে বাইরের কাউকে গ্রামে ঢুকতে। যাবি কী করে? কার্তিকের কথায় শুধু ক্ষোভই নয়, অসহায়তাও ফুটে উঠল।
ওর কথা শুনে শিবু বলল, শোন, আমি একটা কথা বলি। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। আমরা যদি চাই, ওনার সঙ্গে দেখা করব, একটা ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে। তুই শুধু বল, কখন আমাদের নিয়ে যাবি?
– কোথায়?
– তোর ওই… কী নাম যেন বললি? কী মাস্টার? তার কাছে।
তেরো নম্বর বলল, দেখছি, কথা বলে নিই।
রতন বলল, দেখছি বলে ফেলে রাখিস না। যত দেরি করবি, বডি পেতে কিন্তু তত দেরি হয়ে যাবে। যা করার তাড়াতাড়ি কর। যদি সত্যিই তোর সঙ্গে কারও কোনও যোগাযোগ থেকে থাকে, সময় নষ্ট করিস না।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ তেরো নম্বরের চোখ চলে গেল, ওই ভিড়ের দিকে। ভিড়টা যেন মাঠের মধ্যে দিয়ে হইহই করে ছুটছে ইটবাস্তায় দাঁড়ানো পুলিশ ভ্যানটার দিকে। ও বলল, কী হল! ওরা কোথায় যাচ্ছে?
ওর কথা শুনে মুহূর্তের মধ্যে পিছন ফিরল কার্তিক-রতন-শিবুরা। তার পর মাত্র কয়েক সেকেন্ড– চল চল, ওই তো বডি নিয়ে যাচ্ছে। চল চল… ওদের মধ্যে থেকে কে যে কথাটা বলল, ও দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলার জন্য ও বুঝতে পারল না। ওরা হাঁটা শুরু করতেই ও-ও ওদের সঙ্গে পায়ে পা মেলাল। হাঁটা তো নয়, যেন ছোটা।
কিছুক্ষণের মধ্যে ওই ভিড়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল ওরা। তেরো নম্বর ওদের অনেকের থেকেই হাইটে খাটো। তা ছাড়া একদম পিছনে। তাই মাথা উঁচু করে উঁকিঝুঁকি মেরে ও দেখতে লাগল। দেখল, স্ট্রেচার নয়, একদম সামনে একটা পলিশিটের মধ্যে বীজেশকে নিয়ে চার জন পুলিশ চার দিকের চারটে কোণ এক হাতে ধরে, অন্য হাতে কেউ রুমাল দিয়ে, কেউ বা শুধু হাত দিয়েই নাক-মুখ চেপে, মৃতদেহ থেকে যতটা ও দিকে পারা যায়, ঝুঁকে, পড়ি কি মরি করে ছুটছে। যেন গাড়িতে তুলে দিতে পারলেই বাঁচে। আর তাদের পিছনে পাল্লা দিয়ে ছুটছে পুরো ভিড়টা।
ওরাও ছুটছিল। ছুটতে ছুটতে তার পাশে ছুটতে থাকা একজনকে তেরো নম্বর জিজ্ঞেস করল, ছবি-টবি সব তোলা হয়ে গেছে?
– ছবি! লোকটা যেন আকাশ থেকে পড়ল। ওর কি বিয়ে হচ্ছে নাকি যে ছবি তুলবে? এ রকম একটা মুখভঙ্গি করে সে বলল, কই? না তো!
লোকটা যতটা অবাক হয়েছে, তার চেয়ে আরও অনেক বেশি অবাক হয়ে গেল ও। সে কী! ছবি তোলেনি!
চলবে…