ধারাবাহিক উপন্যাস: এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ৪)

পুলিশ-লাইনের মূল কথা হল, আগে আসামিকে মেরে ঘায়েল করে দাও। শারীরিক দুর্বলতায় কাঁপতে থাকলে মৃত্যুর ভয় দেখাও, তখন সে নিজের মুখে সব কিছু বলে দিতে বাধ্য হবে। কিছুই লুকোতে সাহস পাবে না। ওসি আকাশ সেই তত্ত্বে কঠোর বিশ্বাসী। দুজন কন্সটেবলকে ডেকে সোজাসাপটা হুকুম দিল, শালাকে হাতলহীন চেয়ারের সঙ্গে আড়মোড়া করে বাঁধো। তারপর দেখছি কতক্ষণ সহ্য করতে পারে। একটু পরে নিজেই সেলের ভিতরে ঢুকে পেটাতে শুরু করল। মারতে মারতে একসময় নিজেই হাঁপিয়ে উঠল কিন্তু তখনও আসামির মুখ থেকে পছন্দের স্বীকারোক্তি বের করে নিতে পারল ন। বদনকে ডেকে বলল, ব্যাটারছেলে মস্ত ধাকুড়, এত মেরেও তো হল না, তুমি বরং ভিতরে ঢুকে একটু বোঝাও। তাতে কাজ হয়ে যেতে পারে। আমি ততক্ষণ এককাপ গরম চা খেয়ে নিই। কাজ না হলে বাধ্য হয়ে আবার শুরু করতে হবে।

বদন সেলের ভিতরে ঢুকে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বেদম মার খাওয়ার ফলে সারা শরীরে কালসিটে পড়ে গেছে। বোধ হয় ভিতরে ভিতরে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। গাল হাঁ করে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বদন বলতে শুরু করল, সত্যি কথা বলে দিলে তো তোমাকে এভাবে মার খেতে হয় না। দেখে খুব দুঃখ লাগছে ভাই। পুলিশ হলেও আমরা তো মানুষ। চাকরির মূল শর্ত হল, যে কোনো মূল্যে সত্যিটা বের করে আনা। সেজন্যেই তোমার উপর এভাবে লাঠি চালানো হচ্ছে। আবার মার খেতে শুরু করলে একেবারে মারা পড়বে। তার চেয়ে লোকটাকে কে খুন করেছে, সেটুকু বলে দিতে পারলে তো তোমার কোনো দায় থাকে না। সেটুকু করতে পারছ না কেন?

লোকটার কান্না বেড়ে গেল। কিছুতেই থামাতে পারছে না বদন। কেন এভাবে কাঁদছে, তা নিয়ে বদনের মধ্যে নতুন কৌতূহল জাগছে। প্রশ্ন করল, এত করে বুঝিয়ে বলার পরে এভাবে কাঁদছ কেন বলবে?

আমি খুন করি নি স্যার। আমাকে মারা হচ্ছে যাতে আমি খুনি হিসেবে নিজের নামটা প্রকাশ করে দিতে বাধ্য হই।

তাহলে কে খুন করল ওই লোকটাকে?

স্যার, শামু গুন্ডা।

বদন চমকে উঠল লোকটার অভিনব বিবৃতিতে। এসব কী বলছে ও? তাহলে কী ভিতরের রহস্য অন্য কোনো সূত্রে আটকে রয়েছে? নিজস্ব কৌতূহলে বদন ভেসে যেতে লাগল। খুন করল একজন, অথচ ধরে আনা হয়েছে অন্য আরেকজনকে। তাকে বেদম পেটানো হচ্ছে যাতে সে নিজেকে খুনি হিসেবে নিজের মুখে নিজের নাম প্রকাশ করে দিতে পারে। তাহলে কী পিছনে বড়ো কন্ট্যাক্ট রয়েছে? কোনো ব্যবসায়ী তা ডিল করছে? আরেকটা গোপন সন্দেহে দোল খেতে লাগল বদনের মন। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলনায় বিহ্বল বদন চাপা স্বরে বলল, তুমি শামুগুন্ডাকে চেনো?

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে লোকটা বলল, ভালো করেই চিনি স্যার। বাবু বোসের কথায় সে সবকিছু করতে পারে। এলাকার সকলে জানে, বাবু বোস তার গডফাদার।

বদন নতুন করে ভাবিত হল। এসব কী বলছে লোকটা! বাবু বোস, গডফাদার, প্রসঙ্গ দুটো লাট খেতে লাগল বদনের ভিতরে। আবার ভাবল, বেচারা, এত মার খাবার পরে এভাবে মিথ্যে বলতে যাবে কেন? কেমন যেন গভীর রহস্যের গন্ধ রয়েছে ভিতরে। বলল, এসব প্রসঙ্গ তুলে নিজের বিপদ নিজেই বাড়িয়ে দিচ্ছ না তো?

লোকটার গলায় কঠিন প্রত্যয়। —আমার কথা শুনুন স্যার। খুন করার সময় আমি শামুগুন্ডাকে দেখে ফেলেছিলুম, তাই আমার মুখ বন্ধ করতে এসব করা হচ্ছে।

কন্সটেবল বদন মনের খুশিতে ভাসল। ভাবল, একটা অনেক বড়ো দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে সে। স্বয়ং ওসি যা জানতে পারেন নি, তার পক্ষে তা জানা সম্ভব হয়েছে। কম্পিত হতে থাকল এই ভেবে যে নিজেই একটা বড়ো রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারল। লোকটার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, আর তো ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই ভায়া। স্যারের কাছে সাহস নিয়ে ভিতরের রহস্য খুলে বলতে পারলেই অন্য খেলা শুরু হয়ে যাবে। তুমি জানো না, স্যার কত বেশি ক্ষমতা ধরেন। নিজের মতো করে প্রয়োগও করতে পারেন। সত্যি ঘটনা জানলে স্যার কত খুশি হবেন, তা তুমি ভাবতে পারবে না। স্যারের সঙ্গে রাতদিন ছায়াসঙ্গী হিসেবে লেগে রয়েছি। তাই জানি, সত্যের প্রকাশে স্যার কত বেশি খুশি হতে পারেন।

লোকটার মুখে আতঙ্কের ছায়া তরতর করে বেড়ে চলেছে। তা খেয়াল করতে পারে নি বদন। আত্মতুষ্টি নিয়ে বলল, তুমি কী ভাবছ, ওসিসাব আমার কথা বিশ্বাস করবেন না? আমাকে এভাবে সরল মনে বিশ্বাস করার অনেক কারণ আছে হে। অনেক বড়ো বড়ো ঘটনায় আমি ওসির সঙ্গে থেকেছি। তাই জানি, বাস্তব ঘটনা সামনে টেনে আনতে কতটা সাহস দেখাতে পারেন। বাবু বোসকে থানায় এনে প্রথম যেদিন ডায়েরি লিখিয়েছিলেন স্বয়ং ওসি, সেদিন আমি নিজেই উপস্থিত ছিলাম। তাতে শ্রীবোসের স্বীকারোক্তি অনুসারে পরিস্কার করে লেখা ছিল, বাবু বোস লোক লাগিয়ে ওই লেবারটাকে খুন করিয়েছেন। এবার বলো, মনে মনে একটু সাহস পেলে তো?

তা পাচ্ছি স্যার।

এটুকু  বলতে পারবে।

তাহলে যা দেখেছি, সেটাই বলে দেব স্যার?

বলছি তো, কেবল সেটুকু বলতে হবে। নাহলে তো….।

আকাশ চা খাওয়া শেষ করে সেলের সামনে এসে বদনকে উদ্দেশ্য করে বলল, হারামিটা কী বলতে চাচ্ছে শুনি?

সম্পূর্ণ রাজি হয়ে গেছে স্যার। আপনার কাছে সব সত্যি কথা বলে দেবে। অনেক করে বোঝানোর পরে রাজি হয়ে গেল।

আকাশের গলায় রাসভ হুমকি, সত্যি না বললে ছাড়ব নাকি ওকে? ভুলে যেও না বদন, আমার নাম আকাশ, আসামি পিটিয়ে কীভাবে সত্যিটুকু বের করে আনতে হয়, তা ভালো করেই জানি।

বদনের অনুরোধ, এখন আর কোনো অসুবিধা নেই স্যার। ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলে সব তথ্য পেয়ে যাবেন। যা জেনেছে, সবটাই প্রকাশ করে দেবে।

আকাশ গম্ভীর হয়ে ভিতরে ঢুকল। বদন বিশেষ কৌতূহল নিয়ে সেলের বাইরে দাঁড়িয়ে। আকাশ হুঙ্কার দিল, বদনের কাছে যা বলেছ, আমার কাছে তা খুলে বলো।

আমি খুন করি নি দারোগাবাবু।

আকাশের মাথায় আগুন চড়তে শুরু করল। তার পক্ষে এত বড়ো স্পর্ধা মেনে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। রাগে থর থর করে কাঁপতে শুরু করল। লোকটার চুলের মুঠি ধরে হুঙ্কার দিল, আমার কাছে ফের মিথ্যে বলছিস? তুই আমাকে ঠিক চিনিস নারে। যা ঘটেছে নিজের মুখে না বললে তোকে আজ মেরেই ফেলব, কী মনে করেছিস তুই? আবার মারতে শুরুও করে দিল।

বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বদনের পা কাঁপছে। অনুভূতির তীব্রতায় ভিতরের কাঁপুনি আরও বেড়ে চলেছে। এসব কী করছেন ওসিসাব! বুদ্ধির ঘরে ধোঁয়াশা কিছুতেই কাটছে না। তাহলে কী বড়বাবু নিজেই মূল ঘটনার রহস্য জানতে চান না? লোকটা আমার কাছে যা বলল, সেটাই তো প্রকাশ করে দিল ওসির কাছে। আর তো কোনো অসুবিধা থাকার কথা নয়, নাকি বড়বাবু নিজেই এ ঘটনা নিয়ে অন্য কোনো ছক কষে রেখেছেন? তা মিল হচ্ছে না বলেই লোকটার উপর এভাবে….।

আর ভাবতে পারল না বদন। অধস্তন কন্সটেবল হিসেবে মনের কথা খুলে বলার সাহসও হল না। দারোগাবাবু নিজেই ব্যাপারটা ট্যাকেল করছেন। মূল সমস্যা সেখানেই। নিজে গিয়েই লোকটাকে ধরে নিয়ে এসেছেন। রুল দিয়ে নিজেই লোকটাকে বার বার আঘাত করছেন, তবুও রাগ কমছে না ওসিসাবের। তাহলে!

লোকটার প্রবল চীৎকারে বদন আরেকবার কেঁপে উঠল। আতঙ্কের ধূসর ছায়ায় বার বার দুলতে লাগল। কেমন যেন সব অবিশ্বাস্য ঘটনা পর পর ঘটে চলেছে। তাকেও সাক্ষী হিসেবে সেসব প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। ভিতরের বিড়ম্বনায় বার বার কম্পিত হতে থাকল বদন। একটাই প্রশ্নের কাঁটা বিঁধে রয়েছে তার মনে। তাহলে কেন তাকে বুঝিয়ে সত্যিটা বের করে আনার দায়িত্ব দেওয়া হল?

মারের ধকল সহ্য করতে পারছে না বলেই লোকটার শারীরিক অসহনীয়তা ক্রমে তীব্র হয়ে উঠছে। বদনের ধারণা, নিজের জানা সত্য থেকে সরে আসতে চায় না বলেই এভাবে তীব্র প্রহার মেনে নিচ্ছে। কিন্তু সহ্যের একটা নির্দিষ্ট সীমা থাকে। তা পার হলেই লোকটার মধ্যে আত্মরক্ষার তাগিদ বড়ো হয়ে উঠবে। এ নিয়ে প্রচলিত প্রবাদবাক্য হল, নিজে বাঁচি তো বাপের নাম। আর একটু পরে বদন দুচোখ বিস্ফারিত করে দেখল, লোকটার দু’পা টলছে। শরীর আরও নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। সেভাবে আর কথা বলতে পারছে না। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আর মারবেন না স্যার, আপনি যেভাবে চাচ্ছেন, সেভাবেই বলব।

বদনের প্রতি আকাশের কড়া নির্দেশ, আমার টেবিল থেকে এখনিই কাগজ কলম নিয়ে এস। আসামি যা বলছে, লিখে নিতে হবে। বিবৃতির নীচে ওকে দিয়ে সই করিয়ে নিও।

এতটুকু দেরি করল না বদন। সাদা কাগজ আর পেন নিয়ে সেলের ভিতরে ঢুকে বলল, কী লিখব বলুন?

আকাশ আবার গর্জে উঠল, এভাবে চুপ করে থাকলি কেন?

বলছি স্যার বলছি, আমি গরিব মানুষ, আমাকে টাকার লোভ দেখিয়ে খুন করতে পাঠিয়েছিল।

ওসির রুমে ল্যান্ডফোনের রিং বেজে চলেছে। আকাশ ভালো করেই জানত, এই সময়ে কে ফোন করতে পারেন। বদনকে বলল, তুমি ততক্ষণ ওকে সামলাও, আমি ফোনটা রিসিভ করে আসছি।

সেলের ভিতরে দাঁড়ানো বদনের বুদ্ধির ঘরে ধোঁয়াশা বেড়েই চলেছে। লোকটা শামুগুন্ডার নাম বলে দিতে পারল না কেন? নাকি মার খাওয়া বা মরে যাওয়ার ভয়ে নিজেকে খুনি হিসেবে তুলে ধরতে চাচ্ছে? নিজের চোখে শামুগুন্ডাকে দেখার পরে এত বড়ো কঠোর বাস্তবকে অস্বীকার করতে চাচ্ছে লোকটা? স্রেফ মৃত্যুভয় জীবনের গতিমুখকে এতখানি পাল্টে দিতে পারে? ত্রস্ত লোকটার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, তুমি আমার কাছে অন্যরকম বলছিলে, এখন শামুগুন্ডার নাম বাদ দিতে চাচ্ছ কেন? নিজেকে কেন খুনি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে চাচ্ছ?

এভাবে না বললে তো আরও বড়ো বিপদে পড়ে যাব স্যার। দারোগাবাবু অন্য কিছু ভাবছেন।

তাই শামুগুন্ডার নাম চেপে দিতে চাচ্ছ?

এ ছাড়া পথ আছে কী?

একবার চেষ্টা করে দেখতে পারতে।

কী যে বলেন স্যার। মারের বহর দেখে কী বুঝতে পারছেন না, দারোগাবাবু ঠিক কী চাচ্ছেন। ধরা পড়ার কয়েকদিন পরে বুঝতে পেরেছিলাম, বাবু বোসকে ছাড় দিতে আমাকে ধরে এনেছেন। আমার শরীরের উপর এত উপদ্রব কেবলমাত্র সেই কারণে। এমনও হতে পারে স্যার, বাবু বোসের কথা শুনে দারোগাবাবু শেষ পর্যন্ত আমাকে মেরে ফেলতে পারেন।

আকাশ তখন নিজের চেম্বারে কানের পাশে রিসিভার ধরে গভীর কথোপকথনে ব্যস্ত। —বাবু বোস বলছেন তো?

ইয়েস।

বলুন বলুন।

লোকটার স্বীকারোক্তি কী আদায় করে নেওয়া সম্ভব হয়েছে?

সে তো এখনও উল্টো কথা বলে চলেছে।

কী রকম?

আপনার টাকা খেয়ে সে খুন করতে বাধ্য হয়েছে।

তার মানে আমি ফেঁসে যেতে পারি?

শেষ পর্যন্ত লোকটাকে ধরে রাখলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না।

বাবু বোস কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন।

হ্যাঁলো, এভাবে চুপ করে গেলেন যে? আকাশ আন্তরিক তাগিদ দিল।

বাবু বোসের কণ্ঠস্বর তখন তলানিতে নেমে গেছে। থেমে থেমে বললেন, একটা গেমপ্ল্যান আপনাকে বের করতেই হবে, তাতে যদি টাকার মিটার চড়াতে হয় হবে।

I mean, থানার সকলকে ম্যানেজ করে নিয়ে কাজটা সারতে বলছেন কী?

তাহলে তাই করুন।

আপনি সাজেশন দিলে সেই পথে এগোবো।

এ ছাড়া তো গত্যন্তর নেই।

অঙ্কটা অনেক বেড়ে যাবে স্যার।

এ নিয়ে ভাবছেন কেন? টাকা দিয়ে জীবন কেনার অভ্যেস আমার ক্ষেত্রে  অনেক পুরনো প্রসঙ্গ।

চাপা কণ্ঠস্বরে আকাশ একটু হাসল। গভীর আত্মতৃপ্তির হাসি। তারপর ফিসফিস শব্দে বলল, এত ভাববেন না স্যার, আমি তো রয়েছি। মিটার চড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন যখন ঘটনাস্রোত যেদিকে যাক, তা আপনার দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারব। একটা কঠোর বাস্তবতা ভুলে যাবেন না, থানার সকলকে একজোট করতে পারলে মাথার উপরকার দায়ভার অনেকখানি কমে যাবে। ভয় পাবেন না, দায়িত্ব যখন নিয়েছি, শেষ না করে ছাড়ব না।

আকাশের সব কথা শুনে বদন সেলের ভিতরে হতভম্ভের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। ওসিকে এসব কী বলছেন বাবু বোস? তাতেই ওসি রাজি হয়ে গেলেন? তাহলে স্রেফ টাকার প্রশ্নে ভিতরের রহস্য অন্য খাতে বইছে? খামাখা একটা নিরীহ লোককে ধরে এনে এভাবে….। কেমন যেন একটা চাপা অসন্তোষ মনের দু’কূল ছাপিয়ে যেতে লাগল। থানার কন্সটেবল হিসেবে এসব কী দেখতে হচ্ছে তাকে? মানুষ এখানে আসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিকার পেতে কিন্তু দু’চোখের সামনে যা ঘটছে, তার ভিতরে বাবু বোসকে বাঁচানোর ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই নেই। সবচেয়ে যেটা বড়ো ব্যাপার, একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে একই কারণে থানায় ধরে আনা হয়েছে যে বাবু বোসের শিকার হতে বাধ্য হচ্ছে। থানার ভিতরে এভাবে মিরাক্যাল ঘটতে পারে! সাধারণ মানুষ কোন ভরসায় থানায় আসবে? তাদের সামনে আমরা এক কথা বলব আর পিছনে ঠিক বিপরীত কাজ করব? এতে আম-মানুষের দুর্গতি বাড়বে বই এতটুকু কমবে না।

কান থেকে রিসিভার নামিয়ে আকাশ হন্ হন্ পায়ে এগিয়ে চলল লক-আপের দিকে। মুখে হিংস্র বাঘের ছায়া। মনের গভীরে অন্য বিভীষিকা। যে কোনো উপায়ে এ কাজ হাসিল করতেই হবে। ভেবে নিয়েছেন, বদনকে জড়ালে অন্য প্রসঙ্গ এসে যেতে পারে। তার চেয়ে ভালো হবে, নিজের কাঁধে দায়িত্ব নিয়ে পছন্দসই স্বীকারোক্তি আদায় করে নেওয়া। সেলের ভিতরে ঢুকে রাসভ স্বরে বললেন, কেন খুন করেছিস বল্? মগের মুল্লুক পেয়েছিস নাকি? হাতের লাঠি সপাসপ পড়ছে লোকটার গায়ে। আরও জোরে মারার কসরত চলছে। অসহনীয় যন্ত্রণায় মেঝেতে শুয়ে পড়ে কাতরাতে শুরু করল লোকটা। তাতেও ভ্রূক্ষেপ নেই আকাশের। বদন প্রাণের দায়ে ছুটে এসে সেলের ভিতরে ঢুকল। —আবার মারছেন কেন স্যার? লোকটা তো সত্যি ঘটনা বলে দিতে চাচ্ছে।

দুচোখ লাল করে আকাশ গম্ভীর স্বরে বলল, ভুলে যেও না বদন, আমিই থানার ওসি। তুমি অধীনস্ত কন্সটেবল, কোন ঘটনা কীভাবে ট্যাকেল করতে হবে, তা তোমার কাছ থেকে জেনে নিতে হবে নাকি? আবার মারতে শুরু করল। সহে নেওয়ার শেষ শক্তিটুকু বোধ হয় ততক্ষণ হারিয়ে ফেলেছে লোকটা। শুধু গোঁঙাচ্ছে। কথা বলার শক্তিটুকু নেই। তবুও আকাশের এ্যাকশন থামছে না। মারের চোটে শরীর এলিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়তে বাধ্য হল। আর কথা বলতে পারছে না। আকাশও নিজেই হাঁপিয়ে উঠেছে।

সেলের বাইরে দাঁড়িয়ে অমানবিক দৃশ্য দেখতে দেখতে বদনও হাঁপিয়ে উঠল। তাহলে ভিতরের রহস্য এত গভীর? অবৈধ আর্থিক লেনদেনের কারণে ওসি কী করতে পারেন, তা নিয়ে বদনের মধ্যে আর কোনো সংশয় থাকল না। মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার জায়গায় শুধু শুধু হেতুহীন নিরাপদে কালো টাকা প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনা শেষ হলে হয়তো আম-মানুষ ওসির বিবৃতিমতো খবরের কাগজ পড়ে যা জানার জানবে। অমুক থানার ওসি আকাশ একটা খুনের কিনারা করতে গিয়ে যে কৃতিত্ব অর্জন করতে পারলেন, তাকে হয়তো সংবাদপত্রে একটা অবিস্মরণীয় ঘটনা হিসেবে দেখানো হবে। কপালে সরকারি পুরস্কারও জুটে যেতে পারে কিন্তু তার চোখে ওসি আকাশ একজন দাগি আসামি হিসেবে চিরদিনের জন্যে চিহ্নিত হয়ে গেল। ভাবনার গতিপথে কন্সটেবল বদনের ভিতরের ছটফটানি দ্রুতগামী জোয়ারের মতো উত্তাল হয়ে উঠছে।#

চলবে…

এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ৩) 

 

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!