নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নে কন্যাশিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত জরুরী

নারীদের প্রতি ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতে নারীর মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বার্তা নিয়ে প্রতিবছর নারী দিবস পালিত হয়। ২০২৫ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য- অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন নারী ও কন্যার উন্নয়ন। জলবায়ু সংঘাত, দারিদ্র্য, মানবাধিকার এবং লিঙ্গ সমতার জন্য লড়াই বেহাত, কারণ যে কোনো বৈশ্বিক সংকটের প্রান্তিকতম ভুক্তভোগী হচ্ছে কন্যাশিশু ও নারী। আজও অসংখ্য নারী ও কন্যাশিশুকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, তাদের ইচ্ছাকে দমন করা হয় এবং তাদের ভবিষ্যতের সম্ভাবনা সীমিত করা হয়। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী নারী দিবস উপলক্ষ্যে সভা, সেমিনার, র‍্যালি, প্রচারণা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নারী দিবস উদযাপন করা হলেও কন্যাশিশু ও নারীর সামাজিক দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থার কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে?

বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় থাকা বাংলাদেশের নারীরা পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র সহ সর্বক্ষেত্রেই বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হন। নারীর প্রতি সহিংসতা বিশেষ করে ধর্ষণ, পর্নোগ্রাফি, বাল্যবিবাহ, পারিবারিক নির্যাতন ও সামাজিক নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে কন্যাশিশু ও কিশোরীদের উপর নির্যাতনের হার বেড়ে চলেছে। আদমশুমারির তথ্যমতে, বর্তমান বাংলাদেশে বছরে শূন্য থেকে ১৭ বয়স বয়সী ২ কোটি ৯১ লাখ ৮১ হাজার কন্যাশিশু রয়েছে। সরকারি তথ্যে জানা যায়,বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫% ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু এবং এদের মধ্যে ৪৮% কন্যাশিশু। লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের কারণে আমাদের সমাজের কন্যাশিশুরাই বেশি অবহেলা, বঞ্চনা এবং নির্যাতনের শিকার। আধুনিক শিক্ষিত সমাজেও ছেলেসন্তানকে বংশের প্রদীপ মনে করা হয়। বৈজ্ঞানিক মতে, কন্যাসন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে একজন নারী বা পুরুষের ভূমিকা কতটুকু- সে সত্য বেশিরভাগ মানুষই মানতে চান না। যার ফলে অসংখ্য নারীকে কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার অভিযোগে পরিবারের সদস্যরা (নারী-পুরুষ) তথা আপনজনদের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। পরিবারে, একাধিক কন্যাসন্তান জন্ম নেয়ার কারণে একাধিক বিয়ে বা বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাও ঘটছে। পুত্রসন্তান না হওয়ার ক্ষোভে পারিবারিক কলহে কখনো মা কখনো বাবা কন্যাসন্তানকে হত্যা করতেও দ্বিধা বোধ করেন না- সাম্প্রতিককালে দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদই দেশের লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও সহিংসতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

এছাড়াও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৩১ লাখ কন্যাশিশু অসহায়ত্বের শিকার। হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া কন্যাশিশুর সংখ্যা ৮৩ লাখ। অপুষ্টিজনিত কারণে নানা প্রকার রোগব্যধিতে ভুগছে তারা। সুষম খাবার ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত কন্যাশিশুরা একদিন প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তারাও একদিন মা হয় এবং অপুষ্ট, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দেয়। ফলে সমাজের এর বিশাল প্রভাব পড়ে। ‘বাংলাদেশে পথশিশুদের পরিস্থিতি-২০২৪’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দেশের ৩৪ লাখ পথশিশু বাবা-মায়ের যত্নের বাইরে।’ পথেঘাটে বেড়ে ওঠা কন্যাশিশুরা পতিতবৃত্তিতে যুক্ত হচ্ছে এবং তারা অপরাধ জগতে পা বাড়াচ্ছে।

১৩ জুন ২০২৪, ইউনিসেফ বাংলাদেশ এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে উদ্বেগজনকভাবে প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৯ জন শিশু প্রতি মাসে সহিংস পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। এটা প্রতি মাসে সাড়ে চার কোটি শিশুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শিশু সুরক্ষায় অগ্রগতি সত্বেও সহিংসতা, নিপীড়ন ও শোষণ-বঞ্চনার কারণে লাখ লাখ শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

আজকের কন্যা আগামী দিনের নারী। কিন্তু সামাজিক অসচেতনতা, অশিক্ষা, ধর্মীয় অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারের কারণে জন্মের পর থেকেই কন্যাশিশু সুস্থ মানবিক বিকাশের ধারা থেকে বঞ্চিত হয়ে বেড়ে ওঠে। ফলে প্রাপবয়স্ক নারীতে পরিণত হলেও তিনি তার পেছনের দীর্ঘ জীবনের সামাজিক কুসংস্কারের শিক্ষা থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারেন না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিক নারীরাও ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে না।

ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে সকল আন্দোলনে নারীরা স্বতঃস্ফুরতভাবে অংশগ্রহণ করেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে নারীরা ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ১৯৭১ সালে পুরুষের নারীরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। এরপরে স্বাধীন বাংলাদেশ দুইজন নারীকে আমরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পেয়েছি। সংসদের স্পীকার নারী, বিরোধীদলের নেতা নারী, মন্ত্রী হিসেবে নারী, ৬০জন নারী সাংসদ, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মক্ষেত্র সহ শিল্প-সাহিত্য, ব্যবসা-বাণিজ্যে কোথায় নেই নারীর সম্পৃক্ততা! নারী শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও সেই হারে ঘটেনি নারীর মনোজগতের পরিবর্তন। ধর্মীয় কুসংস্কার ও সামাজিক প্রথা নারীর মানবিক স্বাধীনতায় শেকল পরিয়ে দিয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষ যা দেখে অভ্যস্ত নয় এবং তারা যা দেখতেও চায় না- সেসব কোন বিষয় অবতারণা হলে নারীকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।

গতবছরের জুলাই মাসের কোটা বিরোধী আন্দোলনে আমরা দেখলাম, কিছু নারী শিক্ষার্থী নারীর কোটার বিরোধিতা করেছে। আপাদমস্ত কালো পোশাকে আবৃত হয়ে একদল নারী ছবিবিহীন জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার দাবী জানিয়েছে এবং এটাকে তারা তাদের মানবিক অধিকার বলে দাবী করেছে। এসব নারীরা পুরুষের একাধিক বিয়েকে সমর্থন করেছে। ফোলে বহুগামিতা বেড়েছে। একাধিক নারী এক ব্যক্তির সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে এবং পুরুষের একাধিক বিয়ে করতে উৎসাহ দিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

গত কয়েক মাসে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে নারীর প্রতি সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র চোখে পড়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, নারায়ণগঞ্জে দায়িত্ব পালনকালে প্রকাশ্যে এক সাংবাদিককে শারীরিক নির্যাতন, সাংবাদিক মুন্নি সাহার উপরে আক্রমণ, রাজনৈতিক নারী নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উপর প্রকাশ্যে শারীরিক আক্রমণ। ধূমপানের কারণে রাস্তায় নারীর উপর আক্রমণ। ঘরে ঘরে প্রবেশ করে কন্যাশিশু, কিশোরী ও নারী ধর্ষণ, ধর্ষণের পরে হত্যার শিকার হয়েছে অনেক শিশু-কিশোরী-নারী। দলবদ্ধ ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পায়নি বৃদ্ধা নারীও।

নারীর পোশাক, নারীর চলাফেরা কেমন হওয়া উচিত- এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে ধর্মীয় কট্টর মৌলবাদীরা ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে বৈষম্যমূলক বক্তব্য প্রচার করে। ফলে এধরণের বক্তব্য শুনে শুনে পুরুষেরা এটাকেই ধর্মের বিধান মনে করে ঘরের নারী সদস্যদের প্রতি কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করে; নিজেদের হাতের মুঠোয় বন্দী করে রাখার চেষ্টা করে। শুধু ঘরেই নয়, পুরুষেরা বাইরে বের হওয়া অনাত্মীয় নারীকেও সবক দিচ্ছে। প্রকাশ্যে তারা নারীর শরীরে স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিচ্ছে। মেট্রোরেলে নারীদের জন্য নির্ধারিত কম্পার্টমেন্ট ১০/১২জনের পুরুষের একটি দল দ্বারা কন্যাশিশু ও নারীরা শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছ।

ওয়াজ শুনতে আসা নারীদের ধর্মীয় মৌলবাদী বক্তা রফিকুল ইসলাম মাদানি প্রকাশ্যে নারীদের সভাস্থল থেকে লাথি মেরে বের করে দিতে বলেছেন। অন্যান্য অনেক ধর্মীয় বক্তারাও এবং বক্তব্য দেন- যা নারীর মানবিক অধিকার লঙ্ঘন করে। নারীর ইচ্ছে ও তার প্রকাশকে অবদমিত করতে বাধ্য করে। পারিবারিক নির্যাতন ও সহিংসতা এড়াতে কিছু নারী বাধ্য হয়েই পুরুষের পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরিধান করছে। সে কথাটি তারা মুখ ফুটে বলতে পারছে না বরং তারা প্রকাশ করছে আমার স্বেচ্ছায় এই পোশাকটি পরেছি।

বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থাটা এমন যে শুধু ঘরের পুরুষ লোকেরাই নয়, রাস্তার অপরিচিত লোকও যেন নারীর অভিভাবক- যে ব্যক্তির সঙ্গে নারীর পারিবারিক বা কোনও প্রকারে পরিচয় পর্যন্ত নেই।

সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এক নারী শিক্ষার্থীকে পোশাক নিয়ে হেনস্থা করেছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত এক ব্যক্তি। ওই শিক্ষার্থীর অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করলেও একদল লোক থানার ভেতরে সারারাত ওই নারীকে উদ্দেশ্য করে অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করে এবং দোষারোপ করে। সকালবেলা আদালত থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে এনে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়। অন্যদিকে হেনস্থার শিকার ঐ নারীকে অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য চাপ প্রয়োগ করাহচ্ছে; ধর্ষণ ও হত্যার হুমকী পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে। এ কারণে তিনি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করবেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন।

একইদিনের রাতের বেলা আরও একটি ভয়াবহ চিত্রে দেখতে পাই, মাগুরা নিজনান্দুয়ালীতে ৮ বছরের শিশু বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মেয়েটিকে হাসপাতালে নেয়া হলে মেয়েটি মারা যায়। এ বিষয়ে এখন অবধি পরিবার থেকে কোন মামলা করেনি।

২৫ নভেম্বর ২০২৪, প্রথম আলো, পুলিশ সদরদপ্তরের বরাতে নাজনীন আখতারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে সারা দেশের থানা ও আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০–এর যৌতুক, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ ও অপহরণ ধারায় মোট ১২ হাজার ৭৬৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু নারী নির্যাতনের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৬টি। বাকিগুলো শিশু নির্যাতনের অভিযোগে। নারী নির্যাতনের মামলায় মোট আসামি করা হয়েছে ২৪ হাজার ৩৩৯ জনকে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র ৭ হাজার ৮৩৫ জন। অর্থাৎ ওই ৯ মাসে প্রায় ৬৮ শতাংশ বা দুই–তৃতীয়াংশের বেশি আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।’

২৮ নভেম্বর ২০২৪, যুগান্তর, সিরাজুল ইসলামের রিপোর্টে বলা হয়, গত দুই মাসে (সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর) সারা দেশের থানাগুলোয় মামলা হয়েছে ২৫ হাজার ৪৫৬টি। এর মধ্যে খুন ও ধর্ষণের মামলা হয়েছে ১ হাজার ২৯৬টি। ধর্ষণের ঘটনায় ৭৭৪টি মামলা হয়েছে। ৫২৯টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।

মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রেরিত ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন ফেব্রুয়ারি, ২০২৫’–এ তথ্য তুলে ধরে ইনডিপেন্ডেন্ট এর খবরে বলা হয়েছে, ‘ফেব্রুয়ারি মাসে ২৯৫টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যা গতমাসের তুলনায় ২৪টি বেশি। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ৫৭টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণ ও হত্যার ২টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫ জন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারী। ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী, অপরদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩ জন কিশোরী ও ১৪ জন নারী এবং ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন ২ জন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে।’

বর্তমান সময়ে সামাজিক অস্থিরতা আর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় আইনকে নিজের মতো করে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা চলতি বছরে বেড়ে যাওয়ার কারণে অন্য সব অপরাধের পাশাপাশি নারী ও শিশু প্রতি সহিংসতা অনেক বেড়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে সাধারণ মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েও নিয়ে থানা পুলিশ বা আদালতে যায় না। ধর্ষণের শিকার নারীকে সামাজিকভাবে অপবিত্র হিসেবেই দেখা হয়। ফলে একটা বিশাল অংশ ধর্ষণের শিকার হলেও সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ের কারণে চুপ থাকে। ধর্ষণের শিকার অনেক নারী আত্মহত্যা করে থাকে। তারপরেও নারী নির্যাতনের মামলা হলেও বেশীরভাগ আসামী রয়ে যায় আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য বাদীকেকে দেওয়া হয় পুনরায় ধর্ষণ কিংবা হত্যার হুমকী। ধর্ষণ মামলার বিচার চাইতে গিয়ে ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ের রায় দিয়েছে আদলতের বিচারক। এরকম ঘটনা অনেক, ফলে বিয়ের কয়েক মাস যেতেই ধর্ষক ওই নারীকে পরিত্যাগ করে। স্বামী পরিত্যক্ত নারীকে আবার সমাজ কুদৃষ্টিতে বিবেচনা করে। নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণের মামলার প্রায় সিংহভাগই পুলিশ বা আদালত পর্যন্ত যায় না। সামাজিকভাবে লজ্জার কারণ, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার প্রতি অনীহা এবং প্রতিপক্ষের ভয়েও নির্যাতনের শিকারের একটি বড় অংশ কোথাও অভিযোগ করে না। এর কারণে প্রকৃত অপরাধ যতগুলো সংঘটিত হয় তার চাইতে মামলার সংখ্যা কম হয়। ফলে মামলার সংখ্যা বা পত্রিকার সংবাদ দেখে সঠিক পরিসংখ্যান বের করা অসম্ভব।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন তাদের এক জরিপে জানিয়েছে, ‘এমন অনেক মামলা রয়েছে, গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টা পর হতে ১৫ দিনের মধ্যেই অভিযুক্তরা জামিন পেয়ে যান। এরা জামিনে মুক্ত হয়ে মামলাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। আবার এমনও দেখা গেছে, পনের-বিশ বছর আগে চার্জশিট হয়েছে এমন অনেক মামলাও রয়েছে যেগুলোর এখনও বিচার হয়নি। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারীর সংস্থার সদিচ্ছার অভাব এসবের জন্য দায়ী। অনেক মামলার এখনও মেডিকেল টেস্ট হতে কালক্ষেপণ করা হয়। বেশিরভাগ মামলায় সাক্ষী হাজির না হওয়াতে তারিখ পিছিয়ে যায়। ফলে বাদী বা অভিভাবকরা হতাশ হয়ে আর কোর্টে যেতে চান না। আবার দরিদ্র অভিভাবকরা আর্থিক অসুবিধার জন্য মামলা চালাতে অনীহা প্রকাশ করেন।’

যেদেশে কন্যাশিশু মানবিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত ও অরিক্ষত সেদেশে নারীর উন্নয়ন তথা ক্ষমতায়ন কিভাবে সম্ভব?

সমাজে নারীর অবস্থান যাচাই করলে দেশের প্রকৃত অবস্থা স্পষ্ট বোঝা যায়। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সমাজ ও দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। নেপোলিয়ন বলেছিলেন, Give me a good mother I will give you a good nation.’ – একজন মা একদিনে তৈরি হয় না। আজকের কন্যাশিশু আগামীদিনের মা। নারীর ক্ষমতায়নের পূর্বশর্ত হিসেবে কন্যাশিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে মানব সভ্যতার পুরুষতন্ত্র দ্বারা নারী নির্যাতন করার যে ঐতিহ্য টিকে আছে- তা নিমূলে সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদিতাকে পরিহার করে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করতে হবে এবং নারীদের সম্পদ ও সম্পত্তিতে সমানাধিকার দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি সুস্থ সমাজ গঠনের স্বার্থে কন্যাশিশু ও নারী মানবিক মূল্যবোধের প্রকাশ থেকে বঞ্চিত না হয়।

বিশ্বের সকল সুখীদুঃখী নারীর প্রতি রইল নারী দিবসের শুভেচ্ছা ও ভালবাসা।

তথ্যসূত্র:
১। ইউনিসেফ বাংলাদেশ প্রতিবেদন
২। দেশের ৩৪ লাখ পথশিশু বাবা-মায়ের যত্নের বাইরে: গবেষণা
৩। কন্যাশিশু: সেলিনা আক্তার, সহকারী তথ্য অফিসার
৪। প্রথম আলো: নারী নির্যাতনের ৬৮% আসামি গ্রেপ্তার হয়নি
৫। যুগান্তর: দুই মাসে খুন ৫২২টি ধর্ষণের ঘটনা ৭৭৪
৬। ফেব্রুয়ারি মাসে ২৯৫টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে: এমএসএফ

 

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!