কবি জীবনানন্দ দাশের পদবীর হচ্ছে ‘দাশ’, ‘দাস’ নয়। তাঁর পদবীর বানানে ‘শ’ হয়, ‘স’ নয়। যাঁরা জীবনানন্দের মহা ভক্ত তাঁদের সাধারণতঃ এই বিষয়টাতে খুব একটা ভুল হয় না। তবে, অন্যদের যে ভুল হয় না, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। জীবনানন্দ দাশের পদবীর বানানে এখন তেমন একটা ভুল না হলেও, তাঁর জীবিত থাকার সময়ে অনেকেই তাঁর পদবীর বানান লিখতে গিয়ে ভুল করতেন। জীবনানন্দ নিজেও তাঁর পদবীর বানান নিয়ে খুবই স্পর্শকাতর ছিলেন। শুধু জীবনানন্দ কেনো, প্রায় সব মানুষই তাঁর নামের বানান নিয়ে স্পর্শকাতর হয়ে থাকেন। কেউ ‘শ’ এর বদলে ‘স’ লিখলে, জীবনানন্দ খুবই বিরক্ত হতেন, চটে যেতেন, মনে কষ্ট পেতেন। কবি ‘কিরণশংকর সেনগুপ্ত’ লিখেছিলেন,
“জীবনানন্দের নাম লিখতে গিয়ে কেউ তাঁর পদবীটা দাশ না লিখে দাস লিখলে, তিনি বিরক্ত হতেন। একদিন তিনি এ প্রসঙ্গত আমাকে বললেন, – দেখুন না সাহিত্যিকদের অনেকেই আমার নামটা ঠিক করে লিখতে পারেন না। পদবীর বানানটায় তাঁরা প্রায়ই ভুল করেন।”
অথচ মজার বিষয় হল, জীবনানন্দের পদবী আসলে ‘দাস’ই। তিনি কলেজ জীবন পর্যন্ত ‘দাস’ই ছিলেন। এমনকি তাঁর ‘এম এ’-র সার্টিফিকেটেও পদবী হিসাবে ‘দাস’ লেখা আছে। তাঁর মা ‘কুসুমকুমারী দেবী’ও কবিতা লিখতেন। ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকায় তাঁর যে সব কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলোতে তাঁর নাম লেখা ছিল ‘কুসুমকুমারী দাস’। সেই ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকায় জীবনানন্দেরও কবিতা ছাপা হয়েছিল। সেখানেও তাঁর নাম লেখা ছিল ‘জীবনানন্দ দাস’।
প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি ‘দাস’ থেকে ‘দাশ’ হলেন কবে? এখানেও প্যাঁচ আছে। তিনি ‘দাস’ থেকে আসলে ‘দাশ’ হননি। বরং হয়েছিলেন ‘দাশগুপ্ত’। কলেজ জীবনের শেষ দিকে তিনি যে সমস্ত লেখা পাঠাতেন, সেখানে তিনি নিজের নাম লিখতেন ‘জীবনানন্দ দাশগুপ্ত’। শুধু লেখাতেই নয়, নিজের নাম হিসাবেও তিনি ‘জীবনানন্দ দাশগুপ্ত’ই বলতেন। জীবনানন্দের বিয়ে হয়েছিল ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে। বিয়ের আগে তিনি তাঁর ভাবি স্ত্রী ‘লাবণ্য’কে দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানেও তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন ‘জীবনানন্দ দাশগুপ্ত’ হিসাবে। ‘লাবণ্য দেবী’ তাঁর ‘মানুষ জীবনানন্দ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন,
‘‘জ্যাঠামশায় আমাকে বললেন – এই যে মা এসো আলাপ করিয়ে দিই। এঁর নাম জীবনানন্দ দাশগুপ্ত। দিল্লী থেকে এসেছেন।’’
এখন তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ালো, এই ‘দাশগুপ্ত’ আবার এলো কোথা থেকে? আসলে ‘জীবনানন্দ দাশ’দের মূল ‘পারিবারিক পদবী’ ছিল ‘দাসগুপ্ত’। সেখান থেকেই এই ‘দাশগুপ্ত’ এসেছিল। এই প্রসঙ্গে ‘জীবনানন্দের ছোট ভাই’ ‘অশোকানন্দ’ লিখেছিলেন,
‘‘আমার ঠাকুরদা ব্রাহ্ম হয়ে জাতিভেদ মানতেন না বলে নিজের পদবী থেকে বৈদ্যত্বসুচক গুপ্তটা বাদ দিয়েছিলেন। দাদাও অনেকটা ঐ একই যুক্তিতে আবার এক সময় আমাদের পদবির সঙ্গে গুপ্তটা বসিয়েছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন – আগে আমরা বৈদ্যই থাকি, আর যাই থাকি, এখন তো আর আমরা জাতিভেদ মানি না। অতএব শুধু শুধু মূল পদবীটাকে বদলেই বা লাভ কি? এই বলে তিনি ঠাকুরদার আমলের ত্যাগ করা গুপ্তটাকে আবার পদবীর শেষে বসিয়েছিলেন। তবে দাদা ওই সময় দাসগুপ্ত না লিখে দাশগুপ্ত লিখতেন। এর কারণ, আমার মনে আছে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ একবার বৈদ্যজাতির লোকদের বলেছিলেন – বৈদ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁদের পদবী দাস অথবা দাসগুপ্ত তাঁরা দাস, দাসগুপ্তের বদলে দাশ, দাশগুপ্ত লিখলেই ভাল হয়। দেশবন্ধু নিজেই বৈদ্য ছিলেন বলে নিজেও নাম লিখতেন – চিত্তরঞ্জন দাশ।’’
তা বোঝা গেল তিনি কীভাবে ‘দাস’ থেকে ‘দাশগুপ্ত’ হয়েছিলেন। এইবার শেষ প্রশ্ন, ‘দাশগুপ্ত’ থেকে আবার ‘গুপ্ত’ ছুটে গিয়েছিল কখন? ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে তাঁর নাম ছিল ‘জীবনানন্দ দাশ’। ‘দাশগুপ্তের’ বদলে ‘দাশ’কেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন ‘কীর্তিমান’ হবার জন্যে।
তিনি ‘দাশ’ হলেও ‘দাসের’ হাত থেকে মুক্তি পেতে তাঁর অনেক সময় লেগেছিল। তিনি ‘দাশ’ লিখলেও ‘প্রেসের কম্পোজিটার’, ‘প্রুফ রিডার’ বা ‘সম্পাদক’ প্রায় সময়ই ‘দাশ’ কেটে ‘দাস’ বানিয়ে দিতেন। ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় তাঁর ‘ক্যাম্পে’ নামের কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে তাঁর নাম লেখা হয়েছিল ‘জীবনানন্দ দাস’। এখন অবশ্য ভদ্রলোককে আর এই ‘বিড়ম্বনা’য় পড়তে হয় না। বিখ্যাত হলে এই এক সুবিধা আছে।
‘জীবনানন্দ দাশের গল্প বা উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য’ উন্মোচন করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা ধরা পড়ে সেটি হচ্ছে, তাঁর রচনাগুলো প্রায়ই ‘আত্মজৈবনিক উপাদান’ এবং ‘দাম্পত্য ও দাম্পত্যবহির্ভূত সম্পর্কের টানাপোড়েনে’, ‘প্রেম-অপ্রেমে’ – ‘দাম্পত্যক্লান্ত নর-নারীর অতৃপ্ত জীবনের যন্ত্রণায়’ বিধুর। ‘অসফল প্রেম’, ‘অতৃপ্ত দাম্পত্য’, ‘বেকারত্ব’ ও ‘দারিদ্র্য’ তাঁর গল্পগুলোকে পৌনঃপুনিকতায় ক্লান্ত করলেও পাঠক তাঁর ‘জীবনবেদনার’ আরেকটি দিকের সন্ধান পান, যা সাধারণত জীবনীকারেরাই দিতে পারেন। জীবনানন্দের কবিতার বাইরে তাঁর ‘ব্যক্তিজীবন’ সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁদের অজানা নেই যে ১৯৩০ সালে বিয়ে করার পর থেকে টানা কয়েক বছর ‘বেকার’ ছিলেন তিনি। সে সময় যেকোনো উপায়ে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টায় মরিয়া জীবনানন্দ কবিতা লেখার পাশাপাশি গল্প-উপন্যাস লিখে কিছু আয় করতে চেয়েছিলেন। কারণ, কবিতা লিখে যে আয় হয়, তার চেয়ে গল্প-উপন্যাসের বাজারদর সে সময়ও ছিল অনেক বেশি। ১৯৩১ সালে ‘বেকার’ অবস্থায় তাঁর মেয়ে ‘মঞ্জুশ্রী’র জন্মের পরই তিনি গল্প লেখা শুরু করেছিলেন এবং তিন বছরে শ’খানেক গল্প ও আটটি উপন্যাসও লিখে রেখেছিলেন। তবে সেগুলোর কোনোটিই কেন কোথাও ছাপতে দেননি, সে এক বিস্ময়! যেখানে কবিতা লেখা হলেই সেটি ‘পত্রস্থ’ করার বিষয়ে তাঁর কোনো কুণ্ঠা বা দ্বিধা ছিল না, সেখানে দীর্ঘদিনের শ্রমের ফসল গল্প বা উপন্যাসগুলো নিভৃতে রেখে দেওয়া কি তবে ছিল তাঁর সংশয়জাত? কোথাও প্রকাশিত না হলেও কিছু লেখা তিনি নিশ্চয়ই কাউকে পড়তে দিয়েছিলেন, তেমনই কেউ হয়তো তাঁকে বলেছিলেন যে তাঁর গল্পে কোনো প্লট থাকে না। সে কারণেই ১৯৩২ সালের ১৪ই এপ্রিলের ‘দিনলিপি’তে ‘সাফাই’ হিসেবে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘আমার গল্প এবং লেখাগুলো প্লটবিহীন এই অভিযোগ প্রসঙ্গে: জীবনটাই তো প্লটবিহীন, কেবল চক্রান্তকারীরাই ষড়যন্ত্র (প্লট) করে।’’ তাঁর দিনলিপির এই মন্তব্য থেকে ধারণা করা যেতে পারে, কোনো ‘নিস্পৃহতা’ কিংবা ‘প্রচারবিমুখতা’ নয়, কারও কোনো ‘বিরূপ মন্তব্যের’ কারণেই হয়তো তিনি তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছিলেন। অথচ জানা যায় যে, উপন্যাস প্রকাশের উদ্দেশ্যে ‘দেশ’ পত্রিকার ‘সম্পাদক’ ‘সাগরময় ঘোষের’ সঙ্গে দেখাও করেছিলেন জীবনানন্দ। জানা যায়, ‘দেশ’ পত্রিকার ‘সম্পাদক’ জীবনানন্দের লেখা ছাপতে রাজি থাকলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কখনোই সেই লেখা পাঠাননি তিনি। ‘প্রবল অর্থকষ্টের’ সেই দিনগুলোয় ভালো ‘সম্মানী’ দেওয়া পত্রিকায় কেন তিনি তাঁর গল্পগুলোর কোনোটিই ছাপতে দেননি, এর কারণ বোধ হয় সেগুলোর ‘গুণগত মান’ নিয়ে তাঁর নিজের সংশয় ছিল। তাঁর হয়তো ধারণা হয়েছিল, ‘দেশ’ পত্রিকার ‘সম্পাদক’ ‘মৌখিকভাবে’ রাজি হলেও পড়ার পর সেগুলো ছাপবেন না। ‘ভূমেন্দ্র গুহ’র লিখিত বই ‘আলেখ্য জীবনানন্দ’ ও ‘সঞ্জয় ভট্টাচার্য’র লিখিত বই ‘কবি জীবনানন্দ’ থেকে জানা যায় যে, কবির মৃত্যুর পর তাঁর লেখা ‘মাল্যবান’ উপন্যাসটি ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু ‘সাগরময় ঘোষ’ পাণ্ডুলিপিটি কয়েক মাস ধরে নেড়েচেড়ে দেখে বলেছিলেন, “জীবনানন্দ বড় কবি, কিন্তু ঔপন্যাসিক নন।” মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে নতুনভাবে আবিষ্কৃত জীবনানন্দের একটা প্রধান উপন্যাস সম্পর্কে সম্পাদকের এই মন্তব্যই প্রমাণ করে, নিজের লেখা নিয়ে ‘কবির সংশয়’ একেবারেই অমূলক ছিল না।
তবে তাঁর গল্পগুলো পড়তে পড়তে নিজের অজান্তে পাঠককে ঢুকে পড়তে হয় এক ‘বিষণ্ন জগতে’, সেখানে গোলকধাঁধার মতো ঘুরপাক খেতে হয় ‘ব্যর্থ প্রেম’, ‘দারিদ্র্য’ আর ‘অতৃপ্ত দাম্পত্যের’ নিরানন্দ পরিবেশে। লেখকের কাছে ‘প্রেমের মাহাত্ম্য ও আবেদন’, ‘স্বাদ ও পরিপূর্ণতা’ – কিছুই চরিতার্থ না হওয়ার যে ‘অন্তর্জ্বালা’, সেই ‘বঞ্চনাবোধ’ তিনি কখনোই বিস্মৃত হননি। তাঁর বেশির ভাগ গল্পেই স্বামীটি ‘বেকার’ কিংবা ‘দরিদ্র’, স্ত্রী ‘সচ্ছল পরিবারে’ লালিতা, স্বামীর প্রতি ‘উদাসীন ও সদা অভিযোগপ্রবণ’। স্বামীটির ‘বিবাহ-পরবর্তী অভিজ্ঞতা’ কখনোই সুখকর হয় না, ফলে সেও হয়ে পড়ে ‘সংসারবিমুখ’। এমনকি ‘স্ত্রীর দুর্ব্যবহারে’ দাম্পত্য প্রেমের মোহভঙ্গের পর স্বামীটি তার ‘প্রাক্তন প্রেমিকা’র সঙ্গে ‘অতৃপ্ত প্রেমের কথা’ ভেবে দগ্ধ হয় ‘মর্মবেদনায়’।
জীবনানন্দের ‘ব্যক্তিজীবন’ সম্পর্কে যাঁদের জানা, সেই পাঠকেরা তাঁর গল্পের ‘স্বামী চরিত্র’ ও ‘ব্যক্তি জীবনানন্দ’কে আলাদা করতে চেয়ে ব্যর্থ হতে পারেন। কারণ, সেই গল্পগুলোয় নিজেকে লুকোনোর কোনো চেষ্টাই তিনি করেননি, কিংবা তাঁর স্ত্রী ‘লাবণ্য’র জন্য তিনি কোনো ছদ্মবেশের সুযোগ রাখেননি। এখানে অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন যে, জীবনানন্দের বিয়ে হয়েছিল ১৯৩০ সালে, আর তিনি নিভৃতে গল্প লেখা’ শুরু করেছিলেন ১৯৩১ থেকেই। সেই কারণেই তাঁর কিছু গল্পের শুরু হয় ‘তিক্ত বাসর রাত’ দিয়ে, কয়েকটি গল্পে থাকে তাঁর ‘প্রাক-বিবাহ প্রেমের’ সরাসরি ইঙ্গিত, আবার কোনোটিতে থাকে ‘যৌনতার খোলামেলা সন্নিবেশ’।
এখানে বলা প্রয়োজন, জীবনানন্দের ‘প্রাক-বিবাহ প্রেমে’ তিনজন নারী তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন। একজন ‘মনিয়া’ নামের এক কিশোরী, আরেকজন ‘তাঁর মামাতো বোন’ ‘লীলাময়ী’। তবে তাঁর সবচেয়ে ‘পরিপূর্ণ প্রেম’, ‘সামাজিকভাবে অগ্রহণীয়’ হলেও, তা উদ্ঘাটিত হয়েছিল ‘তাঁর কাকা’ ‘অতুলানন্দের দ্বিতীয় কন্যা’ ‘শোভনা’র সঙ্গে। তাঁর ডাকনাম ছিল ‘বেবি’। তাঁর ‘দিনলিপি’তে জীবনানন্দ বহুবার তাঁকে উল্লেখ করেছিলেন ‘বি-ওয়াই’ নামে, পরে আরও সংক্ষিপ্তভাবে লিখেছিলেন শুধু ‘ওয়াই’। সেই ‘ওয়াই’কেই ‘ঝরা পালক’ বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন ‘কল্যাণীয়েষু’ সম্বোধনে। ‘শোভনা’র সঙ্গে জীবনানন্দের মেলামেশা কখনোই পছন্দ করেননি ‘শোভনার মা সরযূবালা’। ‘ম্যাট্রিক’ পাশ করার পরে ‘শোভনা’ যখন কলেজে ভর্তি হয়ে হোস্টেলে চলে গিয়েছিলেন, তখনও সেই ‘খুড়তুতো বোনের’ সঙ্গে দেখা করতে যেতেন জীবনানন্দ। একটি ‘হিন্দু’ কিংবা ‘ব্রাহ্ম’ পরিবারে খুড়তুতো বোনের সঙ্গে প্রেম বা বিয়ের কথা ভাবাই যায় না। অথচ জীবনানন্দ এই ‘সামাজিক বাধা’ মেনে নিয়েও ভুলতে পারেননি ‘শোভনা’কে, তাই ‘সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য শোভনা’ ঘুরেফিরে এসেছিলেন তাঁর গল্পে।
জীবনানন্দের গল্পের সেই ‘একতরফা আত্মজৈবনিক উপাদান’ পুনরাবৃত্তিতে ভারাক্রান্ত হলেও পাঠকের ওপর তুলে দেয় ‘এক অতৃপ্ত পুরুষের জীবনের যন্ত্রণার ভার’। তাঁর ‘বিবাহিত জীবন’ গল্পের ‘সতী’র সঙ্গে ‘শোভনা’ বা ‘বেবি’র দুর্দান্ত মিল দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হতে হয় পাঠককে। ‘শোভনা’ আর ‘সতী’ সেখানে যেন মিলেমিশে এক হয়ে আছেন। ‘সমাজনিষিদ্ধ’ এই বিয়ের প্রসঙ্গে ‘বিবাহিত জীবন’ গল্পে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘সতীর সঙ্গে বিয়ের প্রশ্ন প্রথম থেকেই উঠতে পারে না।’’ সেখানে ‘সতী’ও তাঁদের মধ্যে বিয়ে যে অসম্ভব, সেটা স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘‘… তোমার বিয়ে আমার সঙ্গে হতে সমাজে যখন ঠেকে, অন্য যে কোনো ভালো জায়গায় যাতে তা হয়, সব সময়ই আমি সেই কামনা করেছি …।’’ তাঁর ‘আকাঙ্ক্ষা-কামনার বিলাস’ গল্পেও ‘ওয়াই’ তথা ‘শোভনা’ লুকিয়ে আছেন ‘কল্যাণী’র ভেতরে, ‘‘… কল্যাণী তাঁকে খুবই ভালোবাসে বটে কিন্তু তবু সামাজিক বিধি-ব্যবস্থাকে প্রমথ অনেকবার উপেক্ষা করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত একবারও সাহস পেল না …।’’ তাঁর ‘গ্রাম ও শহরের গল্প’-এর ‘শচী’ যে ‘ওয়াই’, সেটি তিনি তাঁর এক উপন্যাসের ভেতরের মলাটে লিখেও রেখেছিলেন। সেখানে ‘শচী’ কলকাতাবাসী এক সফল ব্যবসায়ীর ‘অসুখী স্ত্রী’, আর অবিবাহিত সোমেন’ ‘বেকার দরিদ্র কবি’। সেই গল্পে ‘শচী’ ‘সোমেন’কে প্রস্তাব দিয়েছিল শহরের জনারণ্য থেকে গ্রামের আগের সেই রোমান্টিক জীবনে পালিয়ে যেতে; অবশ্য গল্পে সেটি আর ঘটেনি।
জীবনানন্দ তাঁর ‘অসফল প্রেমের’ খণ্ডিত স্বপ্নের বাতায়নের ভেতর দিয়েই দেখতে চেয়েছিলেন একসময়কার ‘প্রেমিকা ও প্রেমকে’। অবশ্য কলকাতায় ‘ওয়াই’র সঙ্গে পরবর্তী সময়ে তাঁর আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। তাই ১৯৩১ সালের ১৫ই আগস্টে লেখা ‘দিনলিপি’তে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘ওয়াই: তাঁর খবর কী? … কোনো চিঠি নেই, কিছু নেই … একটা রোমান্টিক পরিবেশে তাঁকে কল্পনা করতে পারি আমি: চুমু এবং সে রকম কিছু – এমনকি দুই বছর আগেও (সে) আমার কাছে ছিল জীবনমৃত্যু: কিন্তু এখন!’’ স্মরণ রাখতে হবে, যেদিন ‘দিনলিপি’তে এই কথা লেখা হয়েছিল, এর ঠিক এক বছর তিন মাস আগে বিয়ে করেছিলেন জীবনানন্দ। তাঁর আরেক দিনের ‘দিনলিপি’তে পাওয়া যায়, ‘ওয়াই’-এর মতো গ্রামের এক মেয়ের ভালোবাসা তাঁর জীবনকে ভরিয়ে দিতে পারত, কিন্তু সে যে অনেক দূরে।
জীবনানন্দ একদিকে যেমন ‘নিজের প্রেমিকা’কে তাঁর গল্পে বিভিন্ন নামে বারবার উপস্থিত করেছিলেন, অন্যদিকে তাঁর ‘অসুখী দাম্পত্যের মূল পাত্রী’ ‘লাবণ্য’কে কোনো রাখঢাক না করে সন্নিবেশ করেছিলেন নানাভাবে। তাঁর ‘মাল্যবান’ উপন্যাসের ‘উৎপলা’র বাইরেও তাঁর গল্পের অনেকগুলোতেই বারবার হানা দিয়েছিলেন ‘লাবণ্য দাশ’, একই ভূমিকায়। ‘মাংসের ক্লান্তি’ গল্পের ‘হেম’, ‘মা হবার কেনো সাধ’-এর ‘শেফালী’, ‘শাড়ি’-এর ‘উষা’, ‘কোনো গন্ধ’-এর ‘কাঞ্চনমালা’, ‘বত্রিশ বছর পর’-এর ‘স্বর্ণ’, ‘চাকরি নেই’-এর ‘নির্মলা’ – এমন বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে, যেখানে সেসব স্ত্রীরা ‘স্বামী উৎপীড়নকারী চরিত্র’ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছেন। এমনকি ‘নষ্ট প্রেমের কথা’-তে ‘মোহিতের বউ’ হয়ে আসার দিন থেকেই ‘সুরূপা’ নিজমূর্তি ধারণ করেছিল, কিংবা ‘বাসর রাত’-এর ‘মনিকা’ প্রথম দিন থেকেই স্বামীর সঙ্গে শুরু করেছিল দুর্ব্যবহার; কিংবা ‘সুখের শরীর’ গল্পে ‘‘বউকে ঘরে আনার পর থেকেই’’ যেমন ‘‘নিরুপম এ রকম পথহারা পথ-উদাসী হয়ে’’ গিয়েছিল।
নিজের গল্পের ‘স্বামী-উৎপীড়ক ও স্থূল রুচিসম্পন্ন স্ত্রী-চরিত্রগুলো’কে তিনি এঁকেছিলেন ‘নিদারুণ নির্মমতা ও প্রবল বিদ্বেষে’। একজন ‘নিরুপায় মানুষ’ যখন কলমের মতো একটা ‘ক্ষুরধার অস্ত্র’ চালাতে পারেন, সেই অস্ত্র নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব প্রতিপক্ষের ওপর। জীবনানন্দ ঠিক এই কাজটি করেছিলেন তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে। ‘মা হবার কোনো সাধ’ গল্পের ‘শেফালী’, ‘পাতা-তরঙ্গের বাজনা’–এর ‘টিবি রোগী’ ‘মালতী’ বা ‘তিমিরময়’ গল্পের ‘জ্যোৎস্না’ চরিত্রের বেলায় এ রকমই দেখা যায়। ‘মাংসের ক্লান্তি’ গল্পের ‘হেম’ ‘ইডেন কলেজের ছাত্রী’, তাঁর জ্যাঠামশাই স্বচ্ছল, বিয়ের পর তাঁর জন্য আলাদা স্নানঘর তৈরি করে দেন তাঁর স্বামী ‘অমূল্য’, অথচ ‘অমূল্য’র নিজের সেই স্নানঘর ব্যবহারের অনুমতি নেই! সেই আক্রোশ থেকেই ‘হেম’কে পরিণত করা হয় ‘কুরূপা’ হয়ে যাওয়া এক ‘সূতিকা-রোগী’তে, তাঁকে দেখায় ‘কৃমির মতো’, ‘মাকড়সার পায়ের মতো’, ‘কুয়াশার পেত্নীর মতো’। ‘হেম’ গানের চর্চাও করত, তখন ‘‘গায়িকার এপাশে-ওপাশে চারপাশে তাই পঁচিশ-ত্রিশ হাতের ভেতর কোনো লোকজনের গন্ধ নেই, দুটো বাছুর, একটা শিংভাঙা গোরু, একটা পাঁচ কিলো ছাগল আর দু-চারটা শালিক ইতস্তত চরছে মাত্র।’’ গল্পে স্ত্রীর প্রতি এমন ‘তাচ্ছিল্যপূর্ণ ব্যঙ্গ’ করার পর, এমনকি ‘মুসলমান’ বা ‘খ্রিষ্টান’ হয়ে ‘হেম’কে ‘ডিভোর্সের হুমকি’ও দিয়েছিল তাঁর স্বামী। স্মর্তব্য, ‘জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য’ও ‘ইডেন কলেজের ছাত্রী’ ছিলেন, পিতৃহীনা মেয়েটির অভিভাবক ছিল তাঁর জ্যাঠামশাই এবং ‘লাবণ্য’ও গান গাইতেন। ‘হেম’কে ‘লাবণ্য’র জায়গায় ‘টোটেমের মতো’ স্থাপন করে জীবনানন্দ উপর্যুপরি যেন তিরবিদ্ধ করেছিলেন তাঁকে। এ রকম বিদ্বেষ আরও টের পাওয়া যায়।
‘সমাজতত্ত্ববিদেরা’ হয়তো লক্ষ করছেন যে আজকাল ‘অসুখী দাম্পত্যের’ চেয়ে ‘বিচ্ছেদ’ শ্রেয়তর বলে আলাদা জীবন বেছে নিচ্ছেন অনেকেই, কিংবা তার বিকল্প হিসেবে ‘পরকীয়া প্রেমের’ মধ্যে কেউ খুঁজে নিচ্ছেন ‘নিরুপায় আশ্রয়’। অথচ সেই সময়কার সমাজে এর কোনোটিই সহজ ছিল না।
‘অতৃপ্ত প্রেম আর অসুখী দাম্পত্যের’ এ রকম ‘জীবন্ত খতিয়ান’ বলেই কি তাহলে জীবনানন্দ তাঁর গল্প ও উপন্যাসগুলো ‘বাক্সবন্দী’ করে রেখে গিয়েছিলেন, নাকি সেগুলোর ‘গুণমান’ নিয়ে সংশয় ছিল তাঁর? তবে এ ক্ষেত্রে সেসব খামতি শোধরানোর চেষ্টা না করে একই ধাঁচে প্রায় একই বিষয় নিয়ে একের পর এক গল্প লিখে ফেলে রাখার ব্যাপারটিও যুক্তির বিচারে টেকে না। কবিতার তুলনায় তাঁর ‘কথাসাহিত্য’ নিয়ে খুব বেশি কাজ হয়নি; কিন্তু তাঁর ‘কাব্যের দুর্ভেদ্যতা’র বিপরীতে তাঁর গল্প-উপন্যাসের অধিকতর বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে, ‘বর্তমান সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষাপটে’ হয়তো পরিপূর্ণভাবে আবিষ্কার করা যায় জীবনানন্দের ‘জীবনবেদ ও বোধের নিরানন্দ ভূমি’।
জীবনানন্দ দাশ, যাঁর জীবনকালে তাঁর প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা দুশো’র একটু বেশি, অথচ তাঁর মৃত্যুর পরের ষাট বছরে তাঁর ‘তোরঙ্গ’ থেকে উদ্ধার হয়েছিল অসংখ্য ‘অসূর্যম্পশ্যা কবিতা’! সেগুলোর পাতার পর পাতা থেকে সেই হস্তাক্ষর, সেই কণ্ঠস্বর, সেই শৈলী, সেই মানুষ আর তাঁর নির্জনতা ঝরে পড়ছে। তাঁর প্রিয় ‘ইয়েটস’-এর ভাষায় এও এক ‘সেকেন্ড কামিং’, ধর্ম বা ঈশ্বরে বিশ্বাসহীন জীবনানন্দের এক অভিনব ‘সম্ভবামি’। তবে এও সত্যি যে, কবির মরণোত্তর জীবনই ঢের বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ১৯৫৪ সালের ২২শে অক্টোবর তাঁর অকাল প্রয়াণের পর। ১৯৪৮ সালের মে-জুন মাসে রচিত তাঁর দুই উপন্যাস ‘মাল্যবান’ ও ‘সুতীর্থ’ প্রকাশনার আলো দেখেছিল তাঁর মৃত্যুর পর। লেখার দু’বছরের মধ্যে এর একটি প্রকাশ পেলেও পেতে পারত, কিন্তু পায়নি। সেটা ১৯৫০-এ ‘পূর্বাশা’ সম্পাদক ‘সঞ্জয় ভট্টাচার্য’কে লেখা একটা চিঠিতে ধরা পড়েছে। কবি তাঁকে লিখেছিলেন – ‘‘বেশি ঠেকে পড়েছি, সে জন্য বিরক্ত করতে হল আপনাকে। এখুনি চার-পাঁচশো টাকার দরকার; দয়া করে ব্যবস্থা করুন। এই সঙ্গে পাঁচটি কবিতা পাঠাচ্ছি, পরে প্রবন্ধ ইত্যাদি (এখন কিছু লেখা নেই) পাঠাব। আমার একটি উপন্যাস (আমার নিজের নামে নয় – ছদ্মনামে) পূর্বাশায় ছাপতে পারেন; দরকার বোধ করলে পাঠিয়ে দিতে পারি, আমার জীবনস্মৃতি আশ্বিন কিংবা কার্তিক থেকে পূর্বাশা’য় মাসে মাসে লিখব। সবই ভবিষ্যতে, কিন্তু টাকা এক্ষুনি চাই – আমাদের মতো দু-চারজন বিপদগ্রস্ত সাহিত্যিকের এ রকম দাবি গ্রাহ্য করবার মতো বিচার বিবেচনা অনেক দিন থেকে আপনারা দেখিয়ে আসছেন – সে জন্য গভীর ধন্যবাদ।’’ চিঠির ‘সবই ভবিষ্যতে’ কথাটা ব্যঞ্জনাময়। কত কিছুই যে লেখার পরিকল্পনা মাথায়, অথচ লেখা হয়ে গেছে এমন অজস্র কিছু সম্পর্কে কী নির্ভার (নাকি গুরুভার?) উদাসীনতা! তাঁর পাণ্ডুলিপির ছবি দেখলেই স্পষ্ট হয় ওঁর ওই অপরূপ মরমি পঙ্ক্তি সব কত সচেতন কাটাকুটি পেরিয়ে, প্রায় সীতার মতো অগ্নিপরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে কবিতায় এসেছে; তা হলে এত কিছুর পরও তারা কেন, কী ভাবে কুমারী, অন্তরালবর্তিনী রইল?
জীবনানন্দ নিজের চাকরি জীবনে কখনও কোথাও থিতু হতে পারেন নি। অভাব কি ভাবে তাঁকে জর্জরিত করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর নিজের ডাইরির এন্ট্রিগুলো থেকে। নিজের ডাইরির পাতায় ২৭. ৭. ৩১ তারিখে তিনি লিখেছিলেন – ‘‘দুপুরটা কাটল চাকরির আবেদন লিখে লিখে ডাকে পাঠাতে, খেলা দেখে যে একটু আরাম স্বস্তি পাব তা আর কপালে নেই: জীবন থেকে বহু কিছুই উবে গেছে।’’ তার পর লিখেছিলেন – ‘‘ঢ্যাঁড়শই বাঁচিয়ে রেখেছে আমাকে। একই সঙ্গে মাধুর্য ও পরিহাস।’’ লিখেছিলেন – ‘‘বেজায় গরম, ঘুমনো গেল না। একবারটি চায়ের দোকান হয়ে আসতে হবে, তবে তিন পয়সার বেশি খরচের মুরোদ নেই। অভাবে থেঁতলে দিচ্ছে, ভাবছি খবরের কাগজ রাখা বন্ধ করে দেব।’’ এছাড়া ‘পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকুরী’ পঙ্ক্তিটির রচয়িতা ৯.৮.৩১ তারিখের রোজনামচায় তিক্ততা ঝরিয়ে লিখেছিলেন – ‘‘চাকরি নেই, লোকে প্রশ্ন করছে, ‘বসে আছ?’ …’’ … ‘‘… on ‘বসে থাকা’ – বেকার কখনও বসে থাকে না – they stand and run, throb and palpitate; it is only the well-placed who have the external charm of the easychair or cushions, sofas and bed for themselves.’’
‘পারিবারিক অশান্তি’, ‘আর্থিক অনটন’ – শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দকে কোন পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল তা এখন সকলেই প্রায় জানেন। তাঁর মৃত্যু ‘আত্মহত্যা’ ছিল, নাকি ‘নিছক দুর্ঘটনা’ – তা নিয়ে পাতার পর পাতা গবেষণা হয়েছে। কিন্তু, তবু মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, আর কোনও কবি-লেখকের যাতে অনটনে পড়ে অকাল মৃত্যুর পরিণতি না হয়, সেজন্য আমরা তেমন কিছু করে উঠেছি কি?
(তথ্যসূত্র:
১- মানুষ জীবনানন্দ, শ্রীমতী লাবণ্য দাশ।
২- আলেখ্য জীবনানন্দ, ভূমেন্দ্র গুহ।
৪- কবি জীবনানন্দ দাশ, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, কবি প্রকাশনী।
৫- অনন্য জীবনানন্দ: জীবনান্দ দাশের সাহিত্যিক জীবনী, ক্লিন্টন বি সিলি, প্রথমা প্রকাশন।
৬- জীবনানন্দ দাশ: বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং।)