প্রাচীন থেকে আধুনিকযুগে বাঙালির পত্রচর্চা

বাঙালির পত্র রচনার ইতিহাস কম প্রাচীন নয়। বর্তমানে বিজ্ঞানের অবদানের জন্য চিঠিপত্রের প্রয়োজন অনেকটাই কমে গিয়েছে। কিন্তু এখন থেকে কিছুকাল আগেও বাঙালি চিঠি লিখত, এমনকি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পত্র-সাহিত্য বলে একটি আলাদা বিভাগও রয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে অতীতের বাঙালির পত্রচর্চার কিছু ইতিহাস তুলে ধরবার চেষ্টা করা হল।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটি চিঠিতে লিখেছিলেন— “মেঘদূত পড়তে পড়তে আর একটা চিন্তা মনে উদয় হয়। সেকালেই বাস্তবিক বিরহী বিরহিণী ছিল এখন আর নেই। পথিকবধূদের কথা কাব্যে পড়া যায় কিন্তু তাদের প্রকৃত অবস্থা আমরা ঠিক অনুভব কর্ত্তে পারিনে। পোষ্টঅফিস এবং রেলগাড়ি এসে দেশ থেকে বিরহ তাড়িয়েছে।”

যদিও প্রাচীনকালের ভারতে বিরহিণীরা তাঁদের কেশ এলিয়ে আদ্রতন্ত্রীবীণা কোলে করে ভূতলে পড়ে থাকতেন কিনা— এবিষয়ে ইতিহাসে কোন তথ্য পাওয়া যায় না, কিন্তু তবুও অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভারত তথা বাংলায় যে পত্রচর্চার প্রচলন ছিল, একথার ঐতিহাসিক প্রমাণ বররুচি লিখিত ‘পত্রকৌমুদী’ নামক গ্রন্থটি থেকে পাওয়া যায়। এই গ্রন্থটি থেকে জানা যায় যে, তখন জ্ঞাতব্য কথা ছাড়াও পত্রে উৎকৃষ্ট এবং অপকৃষ্ট বা তুল্য ব্যক্তির ইতরবিশেষ জ্ঞাপনার্থে পাঠাপাঠের নির্দেশ থাকত, যেটাকে সেযুগে ‘প্রশস্তি’ বলা হত। আর ‘পত্রকৌমুদী’ গ্রন্থটি সম্পর্কে রাজেন্দ্রলাল মিত্র তাঁর সম্পাদিত পত্রকৌমুদীর ভূমিকায় লিখেছিলেন—
“বররুচিকৃত ‘পত্রকৌমুদী’ নামক সংগ্রহই অধুনা সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। তদৃষ্টে স্পষ্টই প্রতীত হয় যে, প্রশস্তি রচনা বিষয়ে তাঁহার পূর্ব্বে হিন্দুদিগের বিশেষ মনোযোগ হইয়াছিল এবং তাদ্বারা তাঁহারা বিশেষ ঔৎকর্ষও সাধন করিয়াছিল।”

প্রাচীনকালের এই গ্রন্থটিতে পত্র রচনার জন্য যেসব নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, রাজেন্দ্রলাল মিত্রের ভাষায় তা এরকম ছিল—
“উক্ত গ্রন্থের মতানুসারে পত্রলেখনের অঙ্গমধ্যে ব্যক্তিভেদে পত্রের পরিমাণ, পত্রের ভাঁজ, পত্রের রঞ্জন, পত্রের কোণ কর্তন, পত্রে শ্রীশব্দবিন্যাস, পত্রের পাঠ এবং শিরোনাম, এই কয় বিষয়ের উল্লেখ আছে। পত্রের পরিমাণ বিষয় লিখিত আছে যে উত্তম পত্র একহস্ত ছয় অঙ্গুলী, মধ্যম পত্র একহস্ত এবং সামান্য পত্র মুষ্টিহস্ত (মুঠম্ হাত) দীর্ঘ হওয়া কর্ত্তব্য। এই পত্রকে তিন ভাঁজ করিয়া তাহার উর্দ্ধের দুই ভাগ ত্যাগকরত শেষ ভাগে পত্র রচনা করিবে।
পত্রের রঞ্জন-বিষয়ে বর্ণিত আছে উত্তমের পত্র স্বর্ণদ্বারা, মধ্যমের পত্র রৌপ্য দ্বারা এবং সামান্য পত্র রাং, তামা, সীসা প্রভৃতি দ্বারা রঞ্জিত করিবে, এতদ্ভিন্ন ভদ্র নিয়ম রক্ষা হয়না।
পত্রের কাগজ এইরূপ প্রস্তুত হইলে তাহার অধোভাগের দক্ষিণ কোণের এক অঙ্গুলি পরিমাণ কাটিয়া পত্রের উপরিভাগে মঙ্গলার্থে অঙ্কুশাকার এক রেখা ও তাহার মধ্যদেশে একবিন্দু, তাহার নীচে সাতের অঙ্ক, তাহার অধোভাগে ‘স্বস্তি’ এই শব্দের বিন্যাস করিয়া বিহিত প্রশস্তি লিখনান্তর পত্রের বক্তব্য রচনা করত ‘কিমধিকমিতি’ লিখিয়া পত্রপ্রেরণের সংবৎসর মাস ও দিনের অঙ্ক দিয়া পত্র সমাপন করিবেক।
তৎপরে পত্রের পৃষ্ঠে শ্রীবিন্যাস ও পত্রোর্দ্ধভাগে পত্রচিহ্ন নিয়োগ করা আবশ্যক। ব্যক্তিভেদে ঐ চিহ্ন এবং শ্রীসংখ্যার অন্যথা করিতে হয়। আদিষ্ট আছে যে, গুরুর পত্রে ৬শ্রী, স্বামীর পত্রে ৫শ্রী, রিপুর পত্রে ৪শ্রী, মিত্রের পত্রে ৩শ্রী এবং পুত্র স্ত্রী ও ভৃত্যের পত্রে ১শ্রী লেখা কর্তব্য।
পত্রের চিহ্ন বিষয়ে কথিত আছে যে, রাজপত্রের ঊর্দ্ধ হইতে ছয় অঙ্গুলি পরিমাণ স্থান নিম্নে চন্দ্রমণ্ডলের সদৃশ বর্তুলাকার কস্তুরী কুঙ্কুম দ্বারা চিহ্নিত করিবেক। মন্ত্রি ও যতির পত্রে কুঙ্কুমের চিহ্ন, এবং পণ্ডিত ও গুরু ও পিতা ও পুত্র ও সন্ন্যাসীর পত্রে চন্দনের চিহ্ন, স্বামীর পত্রে সিন্দুরের চিহ্ন, স্ত্রীর পত্রে অলক্তের চিহ্ন, ভৃত্যবর্গের পত্রে রক্ত চন্দনের চিহ্ন এবং শত্রুর পত্রে রক্তের চিহ্ন নিরূপিত আছে।”

যদিও একথা বলাই বাহুল্য যে, প্রাচীনযুগে পত্র রচনার এসব নিয়মের অধিকাংশই বেশিদিন পর্যন্ত বজায় থাকেনি, কিন্তু তবুও পত্রে প্রশস্তিচর্চা যে এরপরেও চালু ছিল, একথার বহু প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায়।

অতীতে বাংলা সাহিত্যের গবেষকরা বাংলা গদ্যের উৎসের সন্ধান করতে গিয়ে ইতিহাস হাতড়ে এখন থেকে প্রায় চারশো-সাড়ে চারশো বছর আগেকার এক রাজসভায় গিয়ে পৌঁছেছিলেন, যেখানে বসে কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণ আহোমরাজ চুকাম্ ফা স্বর্গদেবকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। ১৫৫৫ সালে নরনারায়ণের লেখা এই বৈষয়িক চিঠিটিই এখনও পর্যন্ত প্রাচীনতম বাংলা গদ্যের ঐতিহাসিক নিদর্শন বলে গবেষকদের কাছে গ্রাহ্য। যেহেতু মধ্যযুগের একজন রাজা আরেকজন রাজাকে এই চিঠিটি লিখেছিলেন, সেহেতু এতে রাজকীয় সম্বোধনের আড়ম্বরে কোন ঘাটতি হয়নি বলেই দেখা যায়। অবশ্য এই চিঠিটি যতই রাজকীয় হোক না কেন, বর্তমান সময়ের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে এটি বিশেষণ-বহুল বলেই মনে হবে। এই চিঠির শুরুতে নরনারায়ণ নিজের জন্য যেসব সম্বোধন ব্যবহার করেছিলেন, সেসব নিম্নরূপ ছিল— “স্বস্তি সকল-দিগদন্তি কর্ণতালাষ্ফল সমীরণ প্রচলিত হিমকর-হার-হাম-কাশ-কৈলাস-প্রান্তর-যশোরাশি-বিরাজিত-ত্রিপিষ্ট-ত্রিদশ তরঙ্গিনী-শলিল-নিৰ্ম্মল-পবিত্র-কলেবর ভীষণ প্রচণ্ড ধীর-ধৈর্য-মর্য্যাদা-পারাবার সকল দিক-কামিনী-গীয়মান-গুণ সন্তান শ্রীশ্রীস্বর্গনারায়ণ মহারাজ প্রতাপেষু।”

কোচবিহাররাজের আলোচ্য চিঠির সম্বোধন অংশটুকু প্রশস্তির মধ্যে গণ্য করা হয়ে থাকে। তবে এরও অনেক পরে—এখন থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগেকার বৈষয়িক চিঠিপত্রের প্রশস্তি চর্চা কেমন ছিল, এর ঐতিহাসিক নমুনা ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন লিখিত ‘প্রাচীন বাঙ্গলা পত্র সংকলন’ নামক একটি গ্রন্থে পাওয়া যায়। যদিও এই বইতে উল্লিখিত কোন পত্রেই কোচবিহারের রাজার মত সুদীর্ঘ বিশেষণমালার উল্লেখ অবশ্য পাওয়া যায় না, কিন্তু তবুও ‘৺মহামহিম মহিমা শ্রীযুতে বড়সাহেব জিউ’, ‘ইয়াদদাস্ত ও দরখাস্ত শ্রীরূদ্ররাম বড়ুয়া’ ইত্যাদি সম্বোধনে পত্রোদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে সন্মান দেখানো হয়েছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া এই বইতে থাকা অনেক চিঠিতেই তৎসম শব্দের পাশেই আরবি-ফারসি শব্দ যেমন লক্ষ্য করা যায়, তেমনি আবার পত্র লেখকের স্বাক্ষরের সঙ্গেও কোথাও ফারসি সাল, তো কোথাও আবার শকাব্দ, সন, শকাবত, মোতাবেক ইত্যাদি নানাধরণের সালের উল্লেখও দেখতে পাওয়া যায়।

প্রাচীনযুগের মত মধ্যযুগের বাংলাতেও চিঠির পরিমাণ, রঞ্জন ইত্যাদি কিরকম হওয়া উচিত— সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে পারসী ভাষায় ‘দস্তুর সিবিযান’ নামে পত্ররচনা পদ্ধতির একটি গ্রন্থ লেখা হয়েছিল। এই গ্রন্থে, সেযুগে প্রচলিত থাকা একশো রকমের চিঠি ও প্রশস্তির আদর্শ লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। এছাড়া মধ্যযুগের বাংলায় কেন্দ্রীয় শাসক ও জমিদারদের মধ্যে পত্রালাপের জন্য যে আদর্শ গ্রন্থটি প্রচলিত ছিল, সেটার নাম ছিল ‘আলকাপ’। এর পরবর্তীসময়ে, কোন জমিদার জাতিতে মুসলমান হলে তাঁকে কিভাবে সম্বোধন করা হত, এর ঐতিহাসিক নমুনা ‘শিশুবোধক’ নামক গ্রন্থে পাওয়া যায়, যা নিম্নরূপ—
“দেশের জমিদার যদি হয় মুসলমান।
বন্দের চাকর বলি লিখিবে সেলাম॥”
এছাড়া ‘শিশুবোধক’ গ্রন্থে স্বামীকে লেখা স্ত্রীর আদর্শ কিছু পত্রের নমুনাও পাওয়া যায়, যেগুলির মধ্যে থেকে একটি নমুনা নিম্নরূপ—
“সাবিত্রী ধৰ্ম্মাশ্রিতা—
গুণাধিকা স্বধম্ম পরিপালিকা শ্রীমতী মালতী মঞ্জরী দেবী—
ঐহিক পারত্রিক নিস্তারপূর্ব্বক ভবার্ণবনাবিক শ্রীযুক্ত প্রাণেশ্বরভট্টাচার্য্য মহাশয়ের পদপল্লবে নিবেদন করিতেছেন—
শ্রীচরণসরসী দিবানিশি সাধন প্রয়াসীদাসী শ্রীমতী মালতীমঞ্জরী দেবী প্রণম্যপ্রিয়বর প্রাণেশ্বর নিবেদনঞ্চাদৌ মহাশয়ের শ্রীপদসরোরুহ স্মরণ মাত্রে অত্র শুভ বিশেষ।”

বাংলায় কোম্পানির রাজত্বের সময়ের ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি তাঁদের কর্মচারীদের দেশীয় ভাষা শেখানোর জন্য ১৮০০ সালের মে মাসে কলকাতায় ফোর্ট উইলয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা করেছিল। আর এর ঠিক দু’বছর পরে কোম্পানির সিভিলিয়ানদের সহজে সেযুগের দেশীয় মানুষদের বৈষয়িক ব্যবহার শেখানোর জন্য রামরাম বসু তাঁর ‘লিপিমালা’ নামক গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত এই পুস্তকের প্রথম ধারায় ১৫টি এবং দ্বিতীয় ধারায় ২৫টি আদর্শ বাংলা পত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেগুলো তখন প্রচলিত ছিল। তবে লিপিমালার পরেও বাংলা পত্ররচনারীতি সম্বন্ধে আরও কিছু বই লেখা হয়েছিল বলে জানা যায়। সেগুলির মধ্যে ১৮৪০ সালে রাজনারায়ণ ভট্টাচার্যের ‘বিজ্ঞানাঞ্জন’ এবং ১৮৪৭ সালে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের ‘পত্রকৌমুদী’ নামক গ্রন্থটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরমধ্যে ‘বিজ্ঞানাঞ্জন’ নামক গ্রন্থটিতে সেকালের নায়ক নায়িকার জন্য আদর্শ বাংলা পত্রের যে নমুনা দেওয়া হয়েছিল, সেটা এখনকার দিনের জন্য শুধু অচল নয়, নিতান্ত কৌতুককর বলেই বোধ হয়। এই গ্রন্থে উল্লিখিত নায়িকাকে দেখবার পরে নায়কের লেখা দ্বিতীয় পত্রের কিছু অংশের নমুনা নিম্নরূপ ছিল—
“স্বস্তি খঞ্জনগঞ্জনাক্ষি শ্রীমতী কামলতা গুপ্তা
মহাভাবিকা কামনায়িকাসমেষু।
৺স্বস্তি প্রেমাভিলাষিণ শ্রীচন্দ্রমোহন বৰ্ম্মণঃ তব সন্তোষে মদীয় হৃষ্টঃ পরং তব রূপ গুণানুরাগ শ্রহণে মনোজবাণে ব্যথিত চিত্তে স্থির করিয়াছিলাম যে দর্শনমাত্র গাত্রজ্বালা অদর্শন হইবে, পরে আপনার সাঙ্কেতিক পত্র পাইয়া আশে-পাশে বদ্ধ হইয়া শ্রবণানুরূপ রূপরঞ্জনে কিছুকাল হরণকরতঃ বারি প্রত্যাশায় বারিবাহ প্রতীক্ষায় নভোমণ্ডলে চাতকপ্রিয় তব দর্শনাকাক্ষায় কল্য সুখসাগরে সুরনিম্না-তীরে তপস্বীবৎ নিরাহারে প্রচণ্ড মার্তণ্ডতাপ সহিষ্ণু হইয়া উদয়াস্ত করিয়া সায়ংপ্রাক্কালে ভাগ্যফলে তব লাবণ্য দর্শনকরতঃ জ্ঞানহত হইয়া এই মত বিতর্ক করিয়াছি। …”

অন্যদিকে দাসী মারফৎ উপরোক্ত পত্রটি পেয়ে নায়িকা এর উত্তরে লিখেছিলেন— “পরচিত্তমধুর ভাষক প্রেমোপাসক শ্রীযুক্তবাবু চন্দ্রমোহন রায় মহাশয় যুবতীজন-মনোরঞ্জকেষঃ ভাবানুভাবিকা শ্রীকামলতা গুপ্তায়াঃ।
রাম রাম নিবেদনমিদং উভয় হিতৈষিনী দাসী কস্তূরীমঞ্জুরী দ্বারা পত্র পাত্রে সুধাভিষিক্তা হইলাম অব্যবহিত গতে সায়াহ্নে কি কুক্ষণে তব সন্দর্শনে হতচিত্তা গতবুদ্ধ্যা হইয়া চঞ্চলাবৎ চঞ্চল আছি এবং স্বভাবানুভাবে তব ভাব বুঝিয়াছি এতদ্বিষয়ে হর্ষবিষাদে জড়ীভূত হইয়া বুঝি দুর্য্যোধনের অকালে কালপ্রাপ্তি হয় যেমন রাম রাবণ বিরোধ উত্থানে মারীচ উভয় সঙ্কটে পতিত হইয়া নিহত হইল তেমন আমিও মিলনামিলনের উভয় সঙ্কটে পড়িয়াছি অমিলনে কটাক্ষানল-দহনে প্রাণরক্ষা ভার এবং মিলনেও কলঙ্ক দুনির্বার পশ্চাৎ বিচ্ছেদানলে সংহার তাহার এড়ান নাই। …”

তবে বাংলায় ইংরেজ রাজত্বের সূচনাকালে বাঙালির পারিবারিক পত্র রচনা রীতি যে ঠিক কিরকমের ছিল, এর ঐতিহাসিক নজির মহারাজ নন্দকুমারের (১৭০৫-১৭৭৫) মত সেযুগের কৃতবিদ্য রাজপুরুষের চিঠিতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায় যে, সেকালের শিক্ষাব্যবস্থা অনুযায়ী নন্দকুমার টোলে ব্যাকরণ, সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদি তো পড়েছিলেনই, একইসাথে সেযুগের সরকারি ভাষা ফারসিও ভাল করেই শিখেছিলেন। প্রসঙ্গতঃ এখানে নিজের পুত্র গুরুদাসকে লেখা নন্দকুমারের একটি চিঠির কিছুটা অংশ নমুনা হিসাবে তুলে ধরা যেতে পারে যা নিম্নরূপ—
“প্রাণপ্রতিমেষু পরম শুভাশীর্ব্বাদ শিবঞ্চ বিশেষঃ—
তোমার মঙ্গল সর্ব্বদা বাসনা করণক অত্র কুশল পরন্তু শ্রীযুক্ত মিস্তার মেদনটিন সাহের ৯ই পৌষ সোমবার দুই প্রহর দিবসকালে এখান হইতে রাহীহর হইয়াছেন তাঁহার সহিত সকল কথোপকথন হইয়াছে তাহা কার্য্য দ্বারা বুঝিতে পারিবে তুমি কোন বিষয় অসন্তোষ করিবে না তোমার নামে ওয়াজীবন আরজ লিখাইয়া শ্রীযুক্ত বড় সাহেবের মিস্তার মেদনটিন সাহেব দিয়া দস্তখত করিয়া লইয়াছি শ্রীযুক্ত লালা সুবংস রায় অল্প দিবসের মধ্যেই যাইবেন ইহাঁর মারফৎ পাঠাইব ইহা তোমাকে দিবেন তাহার এক পরামর্শ ঠাওরাইছি লালা মজকুবের প্রমুখাৎ জ্ঞাত হইয়া তাহার মত কার্য্য করিবে জে জে বিপক্ষতা করিতেছে তাহারা পোশমান হবেক দাস্যমানের দফা এবং আর আর সবিশেষ সকল পশ্চাৎ লিখিব তাহাতে ওয়াকিফ হইবে। …”
লক্ষ্য করবার বিষয় হল যে, উপরোক্ত চিঠির ভাষা প্রচুর ফারসি শব্দ ঘেঁষা এবং এতে বাক্যশেষে বিরতি চিহ্নেরও কোন বালাই নেই।

অতীতে এপ্রসঙ্গে রাজেন্দ্রলাল মিত্র তাঁর সম্পাদিত ‘পত্রকৌমুদী’ গ্রন্থে লিখেছিলেন—
“এতদ্দেশীয় মুসলমানেরা পত্রের পরিমাণ ও রঞ্জন বিষয়ে অদ্যপি মনোযোগী আছে, কিন্তু হিন্দুসমাজে তাহার আর কোন অনুধাবন নাই। বিলাতি চিঠির কাগজে পত্রের প্রাচীন পরিমাণ লুপ্ত করিয়াছে। চন্দন হরিদ্রাদি দ্বারা পত্রচিহ্নকরণ কেবল বিবাহের সম্বন্ধ-পত্রে দেখা যায়; অন্যত্র তাহার ব্যবহার একেবারে রহিত হইয়াছে। প্রাচীন ভদ্র বাঙ্গালীদিগের পত্রে অ্যপি কোণ কর্ত্তন ও শ্রীমুখের রীতি আছে; কিন্তু ত্বরায় তাহার লোপ পাইবার সম্ভাবনা; যেহেতু এই কালে পত্র লিখিবার আবশ্যক নানাপ্রকারে বর্দ্ধিত হইয়াছে, অনেককে প্রত্যহ ৩০-৪০-৫০ খানি পত্র লিখিতে হয়; তাহাদিগের পক্ষে পত্র রঞ্জন-চিহ্ন স্বস্তি শ্রীমুখ কোল কর্তনাদির নিয়ম রক্ষা করা কোনমতে সুসাধ্য নহে; অধিকন্তু তাহার পরিত্যাগে কোন অভিষ্টের হানি হয় না, সুতরাং লোকে তাহার প্রতি সম্যক অনাস্থা প্রকাশ করিতেছেন। আমাদিগের বিবেচনায় সকল পাঠ উঠিয়া গিয়া পত্রারন্তে একটি মাত্র সম্বোধন রাখিলেই যথেষ্ট হয়।”

রাজেন্দ্রলালের এই মন্তব্যের পরেই বাঙালির আদর্শ পত্র-রচনার জন্য ‘জ্ঞানকৌমুদী’ নামের আরেকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, এবং এর অনেক পরে বিংশ শতকের প্রথমদিকে আনন্দলাল সেনগুপ্ত ‘আদর্শ লিপিমালা’ নামক যে সঙ্কলন গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিলেন, তাতে সামাজিক ও বৈষয়িক পত্রের প্রশস্তি ও আদর্শ রীতিগুলো দেখানো হয়েছিল।

১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাংলা ভাষায় পত্ররচনা পদ্ধতির ইতিহাসে ব্রাহ্মসমাজের একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। কারণ, বাংলা ভাষায় লেখা চিঠিতে সম্বোধন হিসেবে—শ্রদ্ধাস্পদ, ভক্তিভাজন, প্রিয়দর্শন প্রভৃতি পাঠ ব্রাহ্মরাই সর্বপ্রথম লিখতে আরম্ভ করেছিলেন। চিঠির ভাষা ভাবগম্ভীর হওয়া সত্ত্বেও যে কতটা সুন্দর ও মিষ্টি হতে পারে, এর ঐতিহাসিক নিদর্শন—ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর ব্রাহ্মসমাজের মানুষদের লেখা চিঠিপত্রে পাওয়া যায়।
ঊনিশ শতকের বাংলা পত্রাবলীকে গবেষকরা সাধারণ চিঠি এবং সাহিত্যগুণান্বিত পত্র—মোটামুটিভাবে এই দু’ভাগে ভাগ করেছেন বলে দেখতে পাওয়া যায়। তাঁদের মতে, সেযুগের সাধারণ চিঠিগুলি বৈষয়িকতাশূন্য হলেও অল্পবিস্তর তথ্যপূর্ণ ছিল বলে সমসাময়িক সমাজ ও সাহিত্যের ইতিহাস রচনার পক্ষে বিশেষ প্রয়োজনীয়। যদিও এধরণের চিঠিগুলিকে সাহিত্যগুণান্বিত বলা চলে না, কিন্তু তবুও রচনারীতি এবং ভাষার সৌকর্যের কথা বাদ দিলে ঊনিশ শতকের সাধারণ চিঠিগুলির সাহিত্যিক মূল্যের থেকে ঐতিহাসিক মূল্যই বেশি। আসলে সেযুগের বাঙালি জাতির পরিচয়, সংস্কৃতির রূপ এবং পত্রলেখকের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের এমন নিখুঁত পরিচয় চিঠি ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া শক্ত।

গবেষকদের মতে, অতীতের বাংলার সাহিত্যগুণান্বিত চিঠিগুলি শুধু পত্রলেখকের ব্যক্তিত্বেরই নয়, হৃদয়েরও স্পর্শবিজড়িত। তখন এধরণের পত্রের সৃষ্টি বাইরের প্রয়োজন মেটানোর জন্য করা হয়নি। এই চিঠিগুলি সৃষ্টিধর্মী ছিল এবং আত্মপ্রকাশের এক নবভঙ্গিরূপে কাজ করেছিল। সৃষ্টিতেই স্রষ্টার আনন্দ থাকে। একারণেই সাহিত্যপদবাচ্য চিঠির কথাপ্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন—
“যে চিঠিতে ভরতি মনের অবস্থায় জরুরী কথা ছাপিয়েও মুখরতা উদ্বৃত্ত থাকে—সেই চিঠিই প্রকৃত সাহিত্যপদবাচ্য।”

আসলে যে কোন সৃষ্টি প্রেরণার মূল কথাই হল মনের মুখরতা। যে মুখরতা থেকে ভাবের নানাচারী অভিব্যক্তি ও কবিতার স্ফুরণ ঘটে—সেসব থেকেই অতীতের সাহিত্যগুণান্বিত চিঠিগুলির জন্ম হয়েছিল। একারণেই রূপগত বৈশিষ্ট্য ছাড়া অতীতের ভাল একটি পত্রের সঙ্গে ভাবের গাঢ়তা বা প্রকাশের ব্যঞ্জনায় একটি নিটোল গীতিকবিতার তেমন কোন পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায় না। সেযুগের অনেক খ্যাত-অখ্যাত মানুষের জীবনে এমন অনেক সময় এসেছিল, যখন তাঁরা কবিতার মাধ্যমে এসব কথা বলতে না পারলেও, একটি ভাল চিঠি লিখতে পেরে তাঁদের মন খুশি হয়েছিল এবং অন্তরের ব্যাকুলতা প্রশমিত হয়েছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই এরকম অনেক চিঠি লিখেছিলেন, যা একেবারে লিরিক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু একইসাথে একথাও ঠিক যে—
“রীতিমত ভাল চিঠি লেখা খুব একট দুরূহ কাজ।”

এমনকি রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলেছিলেন— “যাঁরা ভালো চিঠি লেখে তাঁরা মনের জানালার ধারে বসে লেখে—আলাপ করে যায়—তার কোন ভার নেই, বেগও নেই, স্রোত আছে। এই সব চলতি ঘটনার ’পরে লেখকের বিশেষ অনুরাগ থাকা চাই, তাহলেই তাঁর কথাগুলি পতঙ্গের মতো হালকা পাখা মেলে হাওয়ার উপর দিয়ে নেচে যায়। অত্যন্ত সহজ বলেই জিনিষটি সহজ নয় ভারহীন সহজের রসই হচ্ছে চিঠির রস। সেই রস পাওয়া এবং দেওয়া অল্প লোকের শক্তিতেই আছে।” তাই একথা ইতিহাসগতভাবে সত্যি যে, চিঠিতে এই সহজের রস পরিবেশন করে অতীতের পৃথিবীর যে ক’জন মানুষ যশস্বী হতে পেরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে আবার নারীদের সংখ্যাই বেশি।

গবেষকদের মতে, সাহিত্যপদবাচ্য চিঠি সব আবার একজাতের নয়। অতীতের কোন কোন চিঠি অন্তহীন নীল আকাশের মত স্নিগ্ধ ও অতলস্পর্শী ছিল, সেসব চিঠি ছিল ভাবসমৃদ্ধ ও মননধর্মী। আবার কোন কোন চিঠি যেন শরতের আকাশের বুকে ভেসে যাওয়া হাল্কা মেঘ ছিল, যাতে নানা ছবি, নানা ভাব ও সুরের প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যেত। একারণেই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছড়া-চিঠির ভাবকল্পনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রের গোত্র মেলানো সম্ভব নয়। আবার রবীন্দ্রনাথের ‘পথে ও পথের প্রান্তের’ চিঠির সঙ্গে প্রমথ চৌধুরীর চিঠির সুর মেলে না। এরকমভাবেই কেদারনাথ বন্দোপাধ্যায় আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়— এঁরা দু’জনেই অনেক হাল্কা, হৃদ্য় চিঠি লিখলেও তাঁদের চিঠির মধ্যে শুধু বাণীভঙ্গিরই নয়, বরং দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যও সুপরিস্ফুট হয়ে উঠেছে বলে দেখতে পাওয়া যায়।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!