পঞ্জিকা— ছোট মোটা একটি লাল বই; প্রায় সকল বাঙালির বাড়িতেই এই বইটির খোঁজ পাওয়া যাবে। বাঙালির বিভিন্ন শুভ অনুষ্ঠান, দিনক্ষণ দেখবার জন্য এই বইয়ের খোঁজ পড়ে। এই বইয়ের হিসাব মেনেই বাঙালির বিভিন্ন মাঙ্গলিক, শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানগুলি করা হয়। পঞ্জিকা হিসাব হয় বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ হিসাবে। সচরাচর আমরা কেউই বঙ্গাব্দের দিনের খোঁজ রাখি না। কিন্তু বঙ্গাব্দ আর পঞ্জিকা জড়িয়ে রয়েছে অঙ্গাঙ্গিভাবে।
বঙ্গের সভ্যতা কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। মিশরের নীলনদ-তীরবর্তী অঞ্চলে যেমন প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা, চীন ও মেসোপটেমিয়ায় যে সভ্যতা তাও নদীতীরবর্তী এবং সুপ্রাচীন। প্রাচীন কৃষি সভ্যতার আনুষঙ্গিক নানা সংস্কার-বিশ্বাসও এই সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। এসব সংস্কার প্রথমে কৃষি উৎসবের অঙ্গীভূত ছিল, পরে নববর্ষ উৎসব চালু হলে এসব সংস্কারমূলক আঞ্চলিক উৎসব তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। বাংলার প্রাচীন এমন একটি সংস্কারমূলক উৎসবের নাম ‘আমানি’ উৎসব। আমানি ছিল মেয়েলি উৎসব, এর লক্ষ্য ছিল পরিবারের কল্যাণ ও পারিবারিক কৃষির সমৃদ্ধি কামনামূলক। এই পারিবারিক উৎসবের আচার সম্পন্ন করতেন বাড়ির মহিলাকর্ত্রী। কৃষি আবিষ্কারে নারীর পথিকৃতের ভূমিকা এবং তারই ফলে নারীতান্ত্রিক বা মাতৃতান্ত্রিক সমাজের স্মৃতিচিহ্নবাহী বলে কেউ কেউ এই আচারমূলক অনুষ্ঠানটিকে চিহ্নিত করেন।
এছাড়া সমাজে শত্রুনিধনের আচার পালন করার রীতি ছিল বছরের প্রথম দিনে। লোকবিশ্বাস ছিল, এতে সারা বছর শত্রুর আক্রমণ ও অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এর সঙ্গে নববর্ষে উদযাপন করা হতো বিগত বছরের গ্লানি মুছে ফেলার কামনায় কিছু আচার-অনুষ্ঠানও। আজও পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী কোনো কোনো অঞ্চলে এধরণের অনুষ্ঠানের খবর পাওয়া যায়। অন্যদিকে চৈত্রসংক্রান্তি বা পহেলা বৈশাখের দিনে গাজন বা চড়ক অনুষ্ঠানের সঙ্গেও নতুন বছরের শুভ কামনা জড়িয়ে রয়েছে। লোকবিশ্বাস অনুসারে, অতীতে চড়কের বাণফোঁড়ের ক্লেশের মধ্য দিয়ে বিগত বছরের পাপক্ষয়ের আরাধনা এবং নতুন বছরের সুখ কামনা করা হত। আবার এর অন্য একটা চিত্রও পাওয়া যায়। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বলেছিলেন— “প্রাচীনকালে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে নববর্ষের উৎসব হতো। দোলযাত্রা বা হোলি সেই উৎসবেরই স্মারক।”
দোলযাত্রা ও হোলি হল আনন্দোৎসব, অন্যদিকে চড়ক ক্লেশ ও বেদনার। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষকে জোড়া উৎসব বলে ধরা হলে এটা একইসঙ্গে আনন্দ ও বেদনা দু’ধরণের উৎসবকেই অঙ্গীভূত করেছে।
বাংলা নববর্ষের উৎসব এখন বাংলা বর্ষপঞ্জির বোশেখ মাসের প্রথম দিনে অনুষ্ঠিত হয়। বহু আগে নববর্ষ যে অন্য সময়ে হত—একথার কিছু ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়। অতীতে যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি ফাল্গুনী পূর্ণিমার তিথিতে নববর্ষের কথা উল্লেখ করেছিলেন। অন্যদিকে মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর কবিতায় অগ্রহায়ণ মাসকে বন্দনা করতে গিয়ে বলেছিলেন—
“ধন্য অগ্রহায়ণ মাস, ধন্য অগ্রহায়ণ মাস। বিফল জনমতার, নাই যার চাষ।”
কবির এভাবে অগ্রহায়ণ বন্দনার কারণ ইতিহাস থেকে যতদূর জানা যায়, সেটা হল যে, তখন অগ্রহায়ণ মাসেই নববর্ষ পালিত হত। তবে কখন কিভাবে বৈশাখ মাস থেকে নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়েছে—একথা ইতিহাস থেকে জানা যায় না। কিন্তু মুকুন্দরামের সময়ে অগ্রহায়ণ মাস থেকে যদি নববর্ষ হয়ে থাকে তাহলে ভারতচন্দ্রের সময়ে যে বৈশাখ মাস নববর্ষ হয়ে গিয়েছিল, একথার প্রমাণ তাঁরই কবিতায় পাওয়া যায়— “বৈশাখে এ দেশে বড় সুখের সময়। নানা ফুল গন্ধে মন্দ গন্ধবহ হয়।” তাছাড়া বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এবং আলিবর্দী খাঁ বৈশাখের প্রথম দিনে পুণ্যাহ করতেন। অতীতে এদেশের কবিদের কবিতা ও গানে নববর্ষের নানা আবহ ফুটে উঠেছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা নববর্ষের উৎসবকে ভিন্ন তাৎপর্য ও নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছিলেন। ফলে বাংলা নববর্ষ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিক মিলনমেলা হয়ে ওঠে। স্বার্থহীন বা লোভ-লালসাহীন মানবমৈত্রীর গভীরতর দ্যোতনায় বৈশাখের এই অনুষ্ঠান সর্বসম্প্রদায়ের সম্প্রীতি ও ঐক্যচেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে। বর্তমানে এই উৎসবটি ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে বাঙালি জাতির এক সর্বজননীন মহান উৎসব; সকল বাঙালির মিলনমেলা। বস্তুতঃ রবীন্দ্রনাথের যুগ থেকেই অতীতের কৌম, গোত্র বা সম্প্রদায়ের আঞ্চলিক ক্রিয়াকরণধর্মী (Ritualistic) আঞ্চলিক নববর্ষ উৎসব—আচারের জায়গায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির ঐতিহ্যভিত্তিক নতুন এক জাতীয় দিবস—বাংলা নববর্ষ, বাঙালির নববর্ষ হয়ে উঠেছিল।
এবারে বাঙালির বর্ষপঞ্জি বা পঞ্জিকা বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা যাক। নববর্ষ উৎসব সব দেশেই সর্বজনীন উৎসব। আর এজন্যই সমাজ বিকাশের ধারায় একটা উন্নত পর্যায়েই কোনো জাতির নববর্ষ উৎসব ও তার পঞ্জিকার উদ্ভব ঘটে, তাই এর একটা ধারাবাহিক ইতিহাসও রয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের দিক থেকে ব্যাখ্যা করলে বাংলায় বর্ষবরণ ও বাঙালির বর্ষপঞ্জি উদ্ভাবনের যে পরিচয় ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়, সেটা অন্যান্য সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত প্রক্রিয়ারই পরিচয় বহন করে।
ইংরেজি ‘ক্যালেন্ডার’ শব্দটি মূলতঃ ল্যাটিন শব্দজাত। যত দূর জানা যায়, এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘হিসাব-বই’। অন্যদিকে ইংরেজি ‘আলমানাক’ শব্দটি আরবি ভাষা থেকে এসেছে বলে অনুমিত হয়। এই ‘আলমানাক’ যে অর্থ প্রকাশ করে, সেটার বাংলা অর্থ করলে ‘পঞ্জিকা’ বলা যেতে পারে। তবে ক্যালেন্ডার বুলা হোক, বা আলমানাক—দুটোরই জন্মস্থান হল প্রাচীন মিশর। পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন পঞ্জিকা মিশরে প্রস্তুত হয়েছিল বলে পঞ্জিকাকে মিশরীয় সভ্যতার অবদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
ইতিহাস বলে যে, মিশরীয়রাই প্রায় ৬ হাজার বছর আগে চান্দ্র হিসাবের ভুল চিহ্নিত করে সৌর পদ্ধতির গণনা শুরু করেছিলেন। নীলনদ-তীরবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দারা সুদূর অতীতেই প্রায় ৩৬৫ দিনে বছরের হিসাবের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন (The Calendar, David Ewing Duncan, Fourth Estate, London, 1998)। কৃষির সঙ্গে পঞ্জিকার অপরিহার্য সম্পর্ক— এখানে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। বিশ্বের প্রথম ঐতিহাসিক হেরোডেটাস মিশরকে নীলনদের দান বলেছিলেন। নীলনদের একদিক সবুজ কৃষিক্ষেত্র ও অন্যদিকে ধূসর মরুভূমি। নীলনদ না থাকলে মিশর কৃষি সভ্যতার জননীস্বরূপ হতে পারত না। অন্যদিকে পাশ্চাত্যের সমুদ্রতীরবর্তী রোমে রোমান ক্যালেন্ডার (ইংরেজি ক্যালেন্ডার কথাটি ভুল; কারণ, ওই ক্যালেন্ডারের সঙ্গে রোমের ক্যাথলিক ধর্মের সম্পর্ক ছিল—প্রটেস্টান্ট ইংরেজরা তাই ওই ক্যালেন্ডার ১৭০ বছর পর্যন্ত গ্রহণ করেন নি) বা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়ে সেটা খৃষ্টীয় পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত বহাল ছিল। এরপরে সেই ক্যালেন্ডারের ভুলভ্রান্তি শুধরে নিয়ে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়েছিল। সেই ক্যালেন্ডারই এখন সারা পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে।
আরও পড়ুন: উৎসব ও ঐতিহ্য বাংলা নববর্ষ
আগেই বলা হয়েছে যে, কৃষির সঙ্গে পঞ্জিকার সম্পর্ক নিবিড় ও অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ প্রাচীন মিশরীয় ক্যালেন্ডার এবং ইউরোপের জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের কথা বলা যেতে পারে। মিশরীয় সভ্যতায় বিশ্বের প্রথম যে ক্যালেন্ডারটি তৈরি হয়েছিল, তাতে কৃষি উৎপাদন পদ্ধতির প্রভাবই প্রধান ছিল। কারণ—কৃষি বরাবরই ঋতুনির্ভর। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ফসলের বীজ সংগ্রহ, বীজ বপন, ফসলের পরিচর্যা, ফসল কাটা—সবকিছুই সময়মত করতে হয়। তাই চান্দ্র ক্যালেন্ডার কোনদিনই কৃষির জন্য উপযোগী ছিল না। চান্দ্র ক্যালেন্ডারে বছরে সাড়ে ১০ দিনের হেরফের হয়। তাই চান্দ্র ক্যালেন্ডার (হিজরি ইত্যাদি) অনুসরণ করলে এবছরে যখন ফসল বোনা হবে, তিন বছর পরে সেটা প্রায় একমাস পিছিয়ে যাবে। একারণেই অতীতে কৃষি উৎপাদন ও এর ব্যবস্থাপনার জন্য চান্দ্র ক্যালেন্ডারের পরিবর্তে সৌর ক্যালেন্ডারের প্রচলন করা হয়েছিল। মিশরীয় ক্যালেন্ডারেই সর্বপ্রথম এই সংশোধন করা হয়েছিল। এর বহু পরে, ১৫৫২ সালে ইউরোপের জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ত্রুটি দূর করে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে চন্দ্র ও সূর্যের আবর্তনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়েছিল। ফলে তখন থেকেই সমগ্র জাগতিক কর্মকান্ড—সূর্যের আবর্তননির্ভর বা ঋতুনির্ভর আর ধর্মীয় উৎসবাদি চন্দ্রকলার হ্রাসবৃদ্ধির ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। আসলে পঞ্জিকার মধ্যেও মানুষের সমাজ জীবনের ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ দুই সত্তাই একত্রে অবস্থান করবার জন্যই পঞ্জিকা মানব জীবনের পূর্ণতারও প্রতীক।
বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে ২টি মত চালু আছে।
প্রথম মত অনুযায়ী—প্রাচীন বঙ্গদেশের (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খৃষ্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। ইতিহাস বলে যে, খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে শশাঙ্ক বঙ্গদেশের রাজচক্রবর্তী রাজা ছিলেন। আধুনিক বঙ্গ ও বিহার এলাকা তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনুমান করা হয় যে, জুলীয় বর্ষপঞ্জীর বৃহস্পতিবার ১৮ই মার্চ ৫৯৪ বঙ্গাব্দের এবং গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর শনিবার ২০শে মার্চ ৫৯৪ বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল।
দ্বিতীয় মত—অনেকে মনে করেন যে, বাংলা সনের উদ্ভাবক হলেন সম্রাট আকবর। তিনি তাঁর রাজ্য শাসনের ২৯তম বছরে (হিজরি ৯৯২ এবং ইংরেজি ১৫৮৪ সালে) পঞ্জিকা সংস্কারে হাত দিয়েছিলেন। প্রথমে তিনি তাঁর বিখ্যাত নবরত্ন সভার জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ সিরাজির নেতৃত্বে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সনকে সৌর ও চান্দ্র বৈশিষ্ট্যে সমন্বিত করেছিলেন। এরপরে তিনি একটি কেন্দ্রীয় ইলাহি সনের প্রবর্তন করেছিলেন, কিন্তু তারপরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ঋতু ও কৃষি উৎপাদনের দিকে লক্ষ্য রেখে প্রজাদের খাজনা দেওয়ার সুবিধার্থে নানা আঞ্চলিক সনের প্রবর্তন করবার বা আঞ্চলিক সনের কাঠামো তৈরি করবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন সেই কাঠমো-সূত্রকে অবলম্বন করেই কোনো কর্তৃপক্ষ বা আঞ্চলিক অধিপতি বাংলা সন চালু করেছিলেন।
অনেকে আবার মনে করেন যে, নবাব মুর্শিদকুলি খানই হলেন বর্তমান বাংলা সনের প্রবর্তক। অন্যদিকে আকবর অন্যান্য যেসব আঞ্চলিক সনগুলি প্রবর্তন করেছিলেন বলে ইতিহাস থেকে তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলো হল উড়িষ্যার আমলি সন, বিলায়েতি সন, সুরাসানি সন ইত্যাদি। অতীতে এই সনগুলোকে ‘ফসলি সন’ বলা হত। বাংলা সনও ঠিক তেমনি একটি ফসলি সন। আইন-ই-আকবরি থেকে জানা যায়, সম্রাট এমন একটি ত্রুটিমুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত সৌরসনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্যই আদর্শ হবে। বাংলা সনের মধ্যে তাঁর সে আকাঙ্খা পূর্ণ হয়েছিল বলে লক্ষ্য করা যায়। কেননা, বাংলা সন যেমন হিজরি সন নয়, তেমনি এটি আবার ইলাহি সনের উপজাত হলেও মূল ইলাহি সন থেকে ভিন্ন। মূলতঃ হিজরি সনের ওপরে ভিত্তি করা হলেও এর গঠন-পদ্ধতি ভারতীয় শকাব্দের মত, তবে এটি আবার শকাব্দের সমগোত্রীয় নয়। শকাব্দের সঙ্গে এর সম্পর্ক এটুকুই যে, এর মাস ও দিনের নামগুলি শকাব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে।
এবারে এর আগে প্রচলিত থাকা বর্ষপঞ্জি নিয়ে, অর্থাৎ—সনাতন বাংলা বর্ষপঞ্জী বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা যাক।
৫৫০ খৃষ্টাব্দে বরাহমিহির ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’ নামের একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সমগ্র গ্রন্থটি পাঁচটি খণ্ডে সমাপ্ত। অতীতে এই গ্রন্থটিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের সংক্ষিপ্তসার বলে অভিহিত করা হত। এই পঞ্চসিদ্ধান্তিকার পাঁচটি খণ্ডের নাম বা সিদ্ধান্তগুলোর নাম হল—সূর্যসিদ্ধান্ত, বশিষ্ঠসিদ্ধান্ত, পৌলিশ সিদ্ধান্ত, রোমক সিদ্ধান্ত ও ব্রহ্ম সিদ্ধান্ত। এগুলির মধ্যে প্রাচীন দিন, মাস, বছর গণনার ক্ষেত্রে ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। বরাহমিহিরের পরে ব্রহ্মগুপ্ত নামের অন্য একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী (জন্ম—৫৯৮ খৃষ্টাব্দ) আরেকটি সিদ্ধান্ত রচনা করেছিলেন; তাঁর গ্রন্থটির নাম হল ‘ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত’। এই গ্রন্থটি খলিফা আল-মনসুরের আদেশে ‘সিন্দহিন্দ’ নামে আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে সূর্যের গতিপথের উপর ভিত্তি করে সৌর-মাস নির্ধারিত হয়, এবং আকাশের অন্যান্য নক্ষত্রের বিচারে সূর্যের ভিন্ন অবস্থান নির্ণয় করা হয়ে থাকে। প্রাচীনকালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যের বার্ষিক অবস্থান অনুসারে আকাশকে ১২টি ভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন। এর একটি ভাগকে তাঁরা নাম দিয়েছিলেন রাশি; আর এই ১২টি রাশির সমন্বয়ে যে পূর্ণ আবর্তন চক্র সম্পন্ন হয়, সেটার নাম দেওয়া হয়েছিল রাশিচক্র। এই রাশিগুলোর নাম হল—মেষ রাশি, বৃষ রাশি, মিথুন রাশি, কর্কট রাশি, সিংহ রাশি, কন্যা রাশি, তুলা রাশি, বৃশ্চিক রাশি, ধনু রাশি, মকর রাশি, কুম্ভ রাশি ও মীন রাশি। সূর্যের বার্ষিক অবস্থানের বিচারে, সূর্য কোনো না কোন রাশির ভিতরে অবস্থান করে। এই বিচারে সূর্য পরিক্রমা অনুসারে, সূর্য যখন একটি রাশি থেকে অন্য রাশিতে যায়, তখন সেটাকে সংক্রান্তি বলা হয়। এই বিচারে একবছরে ১২টি সংক্রান্তি পাওয়া যায়। একেকটি সংক্রান্তিকে একেকটি মাসের শেষদিন হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।
এই হিসেবে যেদিন রাত্রি ১২টার মধ্যে সূর্য্য শূন্য ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে প্রবেশ করে তার পরদিনই ১লা বৈশাখ হয়। অর্থাৎ—যেদিন রাত্রি ১২টার মধ্যে সংক্রান্তি হয় তার পরদিনই হল নতুন মাসের প্রথম দিন। মূলতঃ একটি সংক্রান্তির পরের দিন থেকে অপর সংক্রান্তি পর্যন্ত সময়কে এক সৌরমাস বলা হয়ে থাকে। লক্ষ্য করবার বিষয় হল যে, পরিক্রমণ পথ অনুসারে সূর্য প্রতিটি রাশি অতিক্রম করতে একই সময় নেয় না। বরং এক্ষেত্রে মাস ভেদে সূর্যের একেকটি রাশি অতিক্রম করতে ২৯, ৩০, ৩১ বা ৩২ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। আর একারণেই প্রতিবছর বিভিন্ন মাসের দিনসংখ্যা সমান হয় না। এই সনাতন বর্ষপঞ্জী অনুসারে বছর কিন্তু ঋতুভিত্তিক নয়; বরং একেকটি মাস ক্রমশঃ মূল ঋতু থেকে পিছিয়ে যায়।
অতীতে শামসুজ্জামান খান এবং নিতীশ সেনগুপ্ত অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে, বাংলা বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি পরিষ্কার নয়; এই উৎপত্তিতে ইসলামী প্রভাব ও বৌদ্ধ বা হিন্দু প্রভাব—দুইই থাকতে পারে। শামসুজ্জামান খানের মতে— “একে বাংলা সন বা সাল বলা হয়। এই সন ও সাল হল যথাক্রমে আরবী ও ফারসী শব্দ। এটা নির্দেশ করছে এগুলো মুসলিম রাজা বা সুলতান কর্তৃক বাংলায় পরিচিত করানো হয়।”
অন্যদিকে নিতীশ সেনগুপ্তের মতে, এর ঐতিহ্যগত নামটি হল বঙ্গাব্দ। আকবরের সময়ে এই বর্ষপঞ্জিকে বলা হত তারিখ-ই-ইলাহি। বর্ষপঞ্জির তারিখ-ই-ইলাহি সংস্করণে প্রতিটি দিন এবং মাসের আলাদা আলাদা নাম ছিল; আর এখন যে মাসের নামগুলো দেখা যায়, তারিখ-ই-ইলাহিতে এরকম মাসের নামের বদলে অন্য মাসের নাম ছিল। কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, আকবরের পৌত্র শাহজাহান রবিবার দিয়ে শুরু হওয়া সাত দিনের সপ্তাহের প্রচলন করবার জন্য এই তারিখ-ই-ইলাহি বর্ষপঞ্জি সংস্কার করেছিলেন। আর একইসাথে কোন এক অজানা সময়ে সেকালে বর্তমান থাকা শকাব্দে (ভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি) থাকা মাসের নামের সাথে মিলিয়ে তারিখ-ই-ইলাহির মাসের নামকরণ করা হয়েছিল। এরফলেই এখন বাংলায় যে বর্ষপঞ্জিটি ব্যবহার করা হয়, তখন এটির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল।
মুঘল আমলে, ইসলামিক হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাঙালিদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হত। সেই বর্ষপঞ্জিটি ছিল একটি চান্দ্র্য বর্ষপঞ্জি, আর তাই সৌর কৃষিচক্রের সাথে সেই বর্ষপঞ্জিটির কোন সমন্বয় ছিল না। কোন কোন ঐতিহাসিক উৎস অনুযায়ী, মুঘল আমলে খাজনা দানের সময়ে যে উৎসবের আয়োজন করা হত, সেই রীতি মুঘল সম্রাট আকবরই তৈরি করেছিলেন; আর তখন থেকেই বাংলা সালকে বঙ্গাব্দ বলা শুরু হয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ পুনরায় স্মরণীয় যে, আকবর তাঁর রাজ-জ্যোতিষী ফতুল্লাহ শিরাজীকে চান্দ্র্য ইসলামিক বর্ষপঞ্জি এবং সৌর হিন্দু বর্ষপঞ্জিকে সমন্বিত করে একটি বর্ষপঞ্জি তৈরি করতে বলেছিলেন। এরপরে আকবরের দেওয়া আজ্ঞা পালন করে ফতুল্লাহ শিরাজী যে বর্ষপঞ্জি তৈরি করে দিয়েছিলেন, সেটা ফশলি সন বা কৃষি বর্ষপঞ্জি নামে পরিচিত ছিল। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, এখান থেকেই বাংলা বর্ষপঞ্জির সূচনা ঘটেছিল। অন্যদিকে শামসুজ্জামান খানের মত ছিল যে, খুব সম্ভবতঃ বাংলার মুঘল গভর্নর নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ সর্বপ্রথম পুণ্যাহর রীতি বা বাকি থাকা খাজনা আদায় করবার জন্য একটি উৎসবের দিন চালু করেছিলেন; আর এটা করবার সময়ে তিনি আকবরের বার্ষিক খাজনা আদায়ের নীতিকেই গ্রহণ করেছিলেন।
আবার এবিষয়ে আরেকটা অস্পষ্ট ধারণাও প্রচলিত রয়েছে যে, আকবর নয়, বাংলা বর্ষপঞ্জি আসলে সুলতান হুসেন শাহ কর্তৃক সর্বপ্রথম গৃহীত হয়েছিল। অনেকের মতে, এই মত একেবারে বাতিলযোগ্য নয়। অতীতে নিতীশ সেনগুপ্ত জানিয়েছিলেন যে, বাংলা বর্ষপঞ্জি হুসেন শাহ শুরু করুন কিংবা আকবর শুরু করুন, এটা আসলে বাংলার ঐতিহ্যগত বর্ষপঞ্জির ভিত্তিতে বসন্তের ফসল সংগ্রহের পরে খাজনা আদায় করবার কাজকে সহজ করে দিয়েছিল। কারণ—ইসলামী হিজরি বর্ষপঞ্জি তখন খাজনা আদায়ের দিন ধার্য করবার ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি করেছিল।
আবার কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন যে, বাংলা বর্ষপঞ্জি মূলতঃ খৃষ্টীয় সপ্তম শতকের হিন্দু রাজা শশাঙ্কের কাছ থেকে এসেছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, অতীতে ঐতিহাসিকেরা আকবরের সময়ের অনেক শতক আগে বাংলায় নির্মিত দুটি শিব মন্দিরে বঙ্গাব্দ শব্দটির উল্লেখ পেয়েছিলেন। সুতরাং এথেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, আকবরের সময়ের আরও অনেক আগেই বাংলা বর্ষপঞ্জির অস্তিত্ব ছিল।
প্রাচীনকালে বৈদিক আচার অনুষ্ঠানের জন্য কোন সময়ে কি কাজ করা হবে—এধরণের ধারণা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বৈদিকযুগের জ্যোতির্শাস্ত্রে পারদর্শীরা তখন মহাকাশের বিভিন্ন জ্যোতিষ্কের চলাফেরা দেখে সময় সম্পর্কিত হিসাব নিকাশ ও এসব আচার অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ নির্ধারণ করবার কাজ করতেন। তখন জ্যোতির্শাস্ত্র বিষয়ক পাঠ ছিল ছ’টি প্রাচীন বেদাঙ্গ বা বেদ সংক্রান্ত ছ’টি প্রাচীন বিজ্ঞানের একটি—যেগুলো হিন্দুধর্মগ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বৈদিক আচার অনুষ্ঠানের জন্য প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি একটি উন্নত ও পরিশীলিত সময় নির্ণয় কৌশল এবং বর্ষপঞ্জি প্রস্তুত করেছিল।
প্রথম হিন্দু বিক্রমী বর্ষপঞ্জির নামকরণ করা হয়েছিল রাজা বিক্রমাদিত্যের নামানুসারে, এটা খৃষ্টপূর্ব ৫৭ অব্দ থেকে শুরু হয়েছিল। আজও ভারত ও নেপালের অনেক জায়গার মত গ্রামীণ বাঙালি সম্প্রদায়ে বাংলা বর্ষপঞ্জির কৃতজ্ঞতা বিক্রমাদিত্যকেই দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলে খৃষ্টপূর্ব ৫৭ অব্দে সেই বর্ষপঞ্জির সূচনা হলেও বাংলা বর্ষপঞ্জি শুরু হয়েছিল ৫৯৩ খৃষ্টাব্দে, যা একথাই নির্দেশ করে যে, অতীতের কোন একটাসময়ে বঙ্গাব্দের আদর্শ বিন্দু বা রেফারেন্স পয়েন্টকে পরিবর্তিত করা হয়েছিল।
সুদূর অতীতে হিন্দু পণ্ডিতরা সূর্য, চন্দ্র এবং অন্যান্য গ্রহসমূহের ক্রমাবর্তনকে পর্যবেক্ষণ এবং হিসাব করে সময়ের হিসাব রাখবার চেষ্টা করতেন। সেযুগে সূর্য সম্পর্কিত এই হিসাবনিকাশ সংস্কৃত ভাষার বিভিন্ন জ্যোতির্শাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল; যেমন—খৃষ্টীয় ৫ম শতকে আর্যভট্ট কর্তৃক রচিত আর্যভট্টীয়, ৬ষ্ঠ শতকে লটদেব কর্তৃক রচিত রোমক এবং বরাহমিহির কর্তৃক রচিত পঞ্চসিদ্ধান্তিকা, ৭ম শতকে ব্রহ্মগুপ্ত কর্তৃক রচিত খাণ্ডখাণ্ড্যক ইত্যাদি। এই গ্রন্থগুলোতে সূর্যসহ ও বিভিন্ন গ্রহ সম্পর্কে লেখা হয়েছিল এবং মহাকাশে এগুলির স্থানান্তর সম্পর্কিত হিসাব-নিকাশ এবং বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছিল। এবিষয়ে অন্যান্য গ্রন্থ, যেমন—সূর্যসিদ্ধান্ত, খৃষ্টীয় ৫ম থেকে ১০ শতকে রচিত হয়েছিল এবং এর অধ্যায়গুলোতে বিভিন্ন গ্রহ এবং দেবদেবী সংক্রান্ত পুরাণ দেখতে পাওয়া যায়।
অনেকের মতে, ভারতীয় রাজ্যগুলো, যথা—পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের বাঙালিদের ব্যবহৃত বাংলা বর্ষপঞ্জি সূর্যসিদ্ধান্ত নামক সংস্কৃত গ্রন্থের উপরে ভিত্তি করে বানানো হয়েছিল। এখানে মাসগুলোর ঐতিহাসিক সংস্কৃত নাম রক্ষা করা হয়েছে বলে দেখা যায়। বর্তমানে এই বর্ষপঞ্জি হিন্দু বর্ষপঞ্জি ব্যবস্থার সাথে শক্তভাবে বন্ধনে আবদ্ধ এবং বিভিন্ন বাঙালি হিন্দু উৎসব এটা দেখেই ঠিক করা হয়। নক্ষত্রমণ্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপরে ভিত্তি করে বঙ্গাব্দের ১২ মাসের নামকরণ করা হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ থেকে এই নামসমূহ গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলা সন অন্যান্য সনের মতোই ৭ দিনকে গ্রহণ করেছে এবং এই দিনের নামগুলো অন্যান্য সনের মতোই তারামণ্ডলের উপরে ভিত্তি করেই করা হয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমী এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২.০০টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু করেছিল।
অন্যদিকে ভারতীয় উপমহাদেশে পঞ্জিকা-সংস্কারের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল মহারাষ্ট্রে। অতীতে বালগঙ্গাধর তিলক, শঙ্করবালকৃষ্ণ দীক্ষিত, ভেংকটেশ বাপুশাস্ত্রী কেতকর, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, ডঃ মেঘনাদ সাহা ও ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রমুখ ব্যক্তিরা বিভিন্ন জায়গায় পঞ্জিকা সংস্কারের কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। (The Indian Calender, Robert Sewell & Sankara Balkrishan Dikshit, M. B. Das Publishers, Delhi, 1995) এঁদের মধ্যে শহীদুল্লাহ্ বাংলা একাডেমীর পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির প্রধান ছিলেন। তাঁর সংস্কারের পরে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি টাস্কফোর্স শহীদুল্লাহ্ কমিটির সংস্কার প্রস্তাবনার যে উন্নয়ন সাধন করেছিলেন, সেটা নিম্নরূপ ছিল—
(১) সাধারণভাবে বাংলা বর্ষপঞ্জির বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাসে ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাসে ৩০ দিন গণ্য করা হবে।
(২) গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষে যে বাংলা বছরের ফাল্গুন মাস পড়বে সেই বাংলা বছরকে অধিবর্ষ গণ্য করা হবে।
(৩) অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস ৩১ দিনের বলে গণ্য হবে।
(৪) আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী রাত ১২টায় তারিখ পরিবর্তিত হবে।
কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবাংলায় বাংলা সন-তারিখের ক্ষেত্রে যে অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে, সে প্রসঙ্গটিও এখানে উল্লেখ করবার দরকার রয়েছে। এই অসামঞ্জস্যের ফলে বর্তমানে নববর্ষ, রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী ইত্যাদি দুই অঞ্চলে একদিন আগে পরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এর দায় বাংলাদেশের নয়। অতীতে শহীদুল্লাহ্ সংস্কারের সময়ে বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহার সংস্কার প্রস্তাবকেই বাংলা একাডেমীর পঞ্জিকা সংস্কারের ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়েছিল। এমনকি পরবর্তীসময়ে ভারতে ডঃ সাহার প্রস্তাবের কিছু অংশ সংশোধন করে এস.পি. পাণ্ডে কমিটি ১৪ই এপ্রিল তারিখকেই পয়লা বৈশাখ বলে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। তখন ভারত সরকার কর্তৃক গৃহীত পাণ্ডে শীর্ষক কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল— “The Year shall start with the month of vaisaka when the sun enters niranayana mesa rasi which will be 14th April of the Gregorian calendar.” (Indian Journal of History of sciences, 4/2004, 519-534)
অন্যদিকে বাংলা একাডেমীর টাস্কফোর্সও একই তারিখকে পয়লা বৈশাখ বলে নির্দিষ্ট করেছিল এবং বাংলাদেশে সরকারিভাবে তা চালু করে দিয়েছিল। কিন্তু ভারতে, পঞ্জিকাকারদের ব্যবসায়িক স্বার্থে পান্ডে কমিটির রিপোর্ট শেষপর্যন্ত আর কার্যকর করা হয়নি।
বাংলায় পঞ্জিকা প্রকাশের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ধারণা করা হয় যে, মধ্যযুগের বাংলার পণ্ডিত স্মার্ত রঘুনন্দনই প্রথম পঞ্জিকা গণনা করেছিলেন। এরপরে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে পঞ্জিকা গণনা আরও প্রসারিত হয়েছিল। ১৮৬৯ সালে সর্বপ্রথম গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা মুদ্রিত হয়েছিল। এরপরে ১৮৯০ সালে সেই পঞ্জিকা সংস্কার করে মাধবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তারপরে ১৯৫৭ সালে ভারত সরকারের অধীনে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সভাপতিত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে পঞ্জিকার সংস্কার করা হয়েছিল এবং এই সংস্কারপ্রাপ্ত পঞ্জিকা বা বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকাই অবশেষে ভারতের রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল।
এসবের আগে, অতীতের ভারতবর্ষে নানারকমের কাল গণনা প্রচলিত ছিল। যেমন—‘বিক্রম সংবত’ শুরু হয়েছিল ৫৮ খৃষ্টপূর্বাব্দ থেকে, ‘শকাব্দ’ শুরু হয়েছিল ৭৮ খৃষ্টাব্দ থেকে, ‘গুপ্তাব্দ’ ৩২০ খৃষ্টাব্দ থেকে, ‘হর্ষাব্দ’ ৬০৬ খৃষ্টাব্দ থেকে, ‘কলচুরি অব্দ’ ২৪৮ খৃষ্টাব্দ থেকে, বাঙলায় ‘লগ্ন সংবত’ শুরু হয়েছিল ১১১৯ খৃষ্টাব্দ থেকে, নেপালে ‘নেওয়ার সংবত’ শুরু হয়েছিল ৮৭৮ খৃষ্টাব্দ থেকে, কেরলে ‘কোল্লম অব্দ’ ৮২৫ খৃষ্টাব্দ থেকে। আগেই বলা হয়েছে যে, বর্তমানে প্রচলিত মতানুযায়ী, মহারাজ শশাঙ্ক প্রবর্তিত বঙ্গাব্দকে রাজকার্যের বা খাজনার হিসেবের সুবিধার জন্য হিজিরা বর্ষের সঙ্গে তৎপরবর্তী সৌর বৎসরে এক সংখ্যা যোগ করে মুঘল সম্রাট আকবরের নির্দেশ নতুনভাবে চালু করা হয়েছিল। অন্যদিকে চৈতন্যচরিতামৃতর সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে জানতে পারা যায় যে, বঙ্গাব্দ সৃষ্টি হওয়ার আগে বাংলায় শকাব্দেরই প্রচলন ছিল। তবে মুসলমান আমলে উত্তর ভারতে ফসলি ও উড়িষ্যায় আমলী ও বিলায়তী অব্দও প্রচলিত ছিল। তখন ফসলি বর্ষ শুরু হত ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা প্রতিপদ থেকে, আমলী ভাদ্র মাসের শুক্ল দ্বাদশী থেকে ও বিলায়তী আশ্বিন মাস থেকে। বর্তমানে উত্তর ভারতে বিক্রম সংবতের শুরু হয় চৈত্র শুক্লা প্রতিপদ থেকে, আর শকাব্দের চান্দ্রবৎসর শুরু হয় চৈত্র শুক্লা প্রতিপদ থেকে ও সৌরবৎসর শুরু হয় কৃষ্ণা প্রতিপদ থেকে। দক্ষিণ ভারতে ‘বাহস্পত্যবর্ষ’ প্রচলিত আছে, সেটা শুরু হয় বৈশাখী কৃষ্ণা প্রতিপদ থেকে। কেরলে ‘কোল্লাম বর্ষ’ শুরু হয় ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা নবমী থেকে। তামিলনাড়ুতে নববর্ষ শুরু হয় বাঙলার নববর্ষের দিন থেকেই। ওখানে নববর্ষকে বলা হয় ‘কুড়িবর্ষম’। গুজরাটে নববর্ষ শুরু হয় কার্তিক মাসের কৃষ্ণা অমাবস্যার পরদিন থেকে। কলকাতাবাসী এসব রাজ্যের মানুষেরা এসব দিন থেকেই তাঁদের নববর্ষ গণনা করেন।
অতীতে পয়লা বৈশাখের দিন বিশেষ কোন শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানের প্রচলন আমাদের দেশে ছিল না। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের আমলে দু’শো বছরের প্রাচীন হিন্দু পর্বের একটি তালিকা অনুসরণ করা হত। সেই তালিকায় বাংলা নববর্ষের কোনও উল্লেখই পাওয়া যায় না। প্রাচীন বাংলা পঞ্জিকায় বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনে কেবলমাত্র ‘ধ্বজা রোপণের’ বিধান লেখা রয়েছে বলে দেখা যায়। কিন্তু বঙ্গদেশে নববর্ষে ধ্বজা রোপণের বিশেষ কোন লক্ষণ কোন দিনই দেখা যায়নি। উত্তর ভারতে অবশ্য এখনও নববর্ষে ‘ধ্বজা রোপণ’ দেখা যায়। তবে সেখানে বর্ষ আরম্ভ হয় চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদে। পুরোনো কলকাতায় এই দিনে পুরোহিত ঠাকুর বাড়িতে এসে নতুন পঞ্জিকা পড়ে মহিলাদের বর্ষফল শোনাতেন ও দক্ষিণা নিয়ে চলে যেতেন। এখন আর আগেকার সেই যুগ নেই। এখন মহিলাদের মধ্যে ব্যাপক শিক্ষার প্রসার হয়েছে। তাই তাঁরা পয়লা বৈশাখের আগে নিজেরাই পঞ্জিকা কিনে নিয়ে বর্ষফলটা নিজেরাই পড়ে নেন। তাই পুরোহিত ঠাকুরের বাড়িতে এসে বর্ষফল শোনাবার পদ্ধতিটা এখন উঠে গেছে। আর আগেকার দিনে নববর্ষের প্রথম দিনে হত ‘হালখাতা’। সেটা অবশ্য এখনও কিছুটা হলেও প্রচলিত আছে, তবে তাতে আগেকার দিনের সেই রেশ ও জৌলুস আর নেই। তখনকার সময়ে হালখাতার দিনে ময়রারা এক রকম বিশেষ ধরণের মিঠাই তৈরি করতেন, যেটার নাম ছিল ‘হালখাতার মিঠাই’। সেই মিঠাই তাঁরা বছরে মাত্র একদিনই তৈরি করতেন। এখন আর সেই মিঠাই তৈরি করা হয় না। তখনকার সময়ে হালখাতার দিনে দোকানদাররা সকালবেলা দোকানে গণেশ পূজা ও খাতা মহরৎ করত। খাতা মহরৎ মানে নূতন খাতায় সিঁদূর দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা ও দেবতার নাম লেখা। এখনও কোন কোন দোকানে এটা করা হয়, কিন্তু বেশির ভাগ দোকানদার হয় কালীঘাটে, আর তা নয়তো দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দিরে গিয়ে তাঁদের নতুন খাতা পূজা করিয়ে নিয়ে আসেন। অতীতে এই দিন বিকালবেলায় দোকানে দোকানে খরিদ্দারদের আমন্ত্রণ জানানো হত। দোকানে সেদিন ফরাস পেতে আসর তৈরি করে নিমন্ত্রিতদের আদর-আপ্যায়ন করা হত। সকলের গায়ে গোলাপ জল ছিটানো হত। আসরের মাঝখানে অভ্যাগতদের তামাক খাবার জন্য রূপোর তৈরি হুঁকোদানের ওপরে দু’-তিনটে রূপো দিয়ে বাঁধানো হুঁকো বসানো থাকত। নতুন খাতা নিয়ে আসরের একধারে দোকানের এক কর্মচারী বসে থাকতেন। অভ্যাগতরা তাঁদের বাকি টাকা, হয় সম্পূর্ণ আর নয়তো আংশিকভাবে তাঁর জমা করতেন। আর যাঁদের কোন বাকির বালাই থাকত না, তাঁরাও টাকা দিতেন এবং নতুন খাতায় তাঁদের নামে সেই টাকা জমা করে নেওয়া হত। প্রত্যেককে এক ‘চ্যাঙ্গ’ ভর্তি করে মিঠাই দেওয়া হত। ১৮৭৮ সালে মহেশচন্দ্র দাস দে ‘প্রণয় পরীক্ষা’ নামে একটি প্রহসন লিখেছিলেন। সেই প্রণয় প্রেমিক-প্রেমিকার প্রণয় ছিল না, সেটা ছিল ধারীবাবু এবং খরিদ্দারদের প্রণয়। ধার দিয়ে দোকানদারের দুশ্চিন্তা, ধার শোধ না হওয়া পর্যন্ত কেমন হয়, সেই ‘প্রণয়’-এর পরীক্ষাই ছিল ওই প্রহসনের মূলকথা।
“ধারীবাবু। ধার ধার ধার! ধারে দুনিয়া চলিতেছে। আপনি না ধার দিলে অপর দোকান খোলা, হাঁকিতেছে, হাতছানি দিতেছে। চলিয়া যাইবার সমস্ত পথ খোলা।
দোকানীবাবু।—ধারও দিব মিষ্টান্নও খাওয়াইব! আপনি প্রণয়িনী আমার। টাকা না দিলে এ বিবাহ ভাঙিয়া দিব। আগে ধার মিটান, তাহার পর জবান ফুটান।”
১৮৮৬ সালে হরিমোহন পাল তাঁর ‘রসিক নাটক’–এ নববর্ষে দোকানে খদ্দেরকে পেট ভরে মিষ্টি খাওয়ানোর একটি বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন—
“গদীবাবু: খালি পেটে আপনি কয়টি মনোহরা খাইতে পারিবেন?
পেটুক: খালি পেটে মহাশয় একটি মাত্র মনোহরা ভক্ষণ সম্ভব। তাহার পর একশতটী।
গদীবাবু: হে-হে। আপনি বুদ্ধিমান বটে। আজি হালখাতার দিনে যতগুলি ইচ্ছা তথা একশতটী মনোহরা খান! বুদ্ধিমান বাঙালি গদীবাবুকে সমুচিত জবাব দিয়ে খুশি মনে মনোহরা খাচ্ছে।”
ঊনিশ শতকের বঙ্গবাসীরা বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষ কীভাবে পালন করতেন, হুতোমের নকশায় সেটার অনবদ্য বর্ণময় বিবরণ পাওয়া যায়— “ইংরেজরা নিউ ইয়ারের বড় আমোদ করেন। … বাঙ্গালিরা বছরটী ভাল রকমেই যাক আর খারাবেই শেষ হক্, সজ্নে খাড়া চিবিয়ে ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধূলো দিয়ে পুরাণকে বিদায় দ্যান। কেবল কল্সি উচ্ছুগ্গু কর্ত্তারা আর নতুন খাতাওয়ালারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন।”
হুতোম বাংলা নববর্ষ উৎসব উদ্যাপনকে দুটি পর্বে ভাগ করেছিলেন, একটি পর্ব ছিল নববাবুদের উৎসব পালনের বিষয়—ধর্মীয় পূর্ণকলস উৎসর্গের মতো নববাবুরা বছর শেষকে বিদায় এবং মদের কলসী উৎসর্গ করে বাগানবাড়িতে নববর্ষকে স্বাগত জানাতেন। অন্য পর্বে ছিল দোকানদারদের হালখাতার মধ্য দিয়ে নববর্ষ উদ্যাপন করা। আজকের দিনের গণসমাজে নববর্ষের দিনে যে উৎসব পালিত হয়, সেটা হচ্ছে আনন্দের উৎসব। মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি থেকে, পুরাতনের প্রতি বিতৃষ্ণা ও নূতনের প্রতি মোহাসক্তি থেকে এই উৎসবের উদ্ভব ঘটেছে। মানুষ ভুলে যেতে চায় পুরাতন বছরের লজ্জা, কলঙ্ক ও গ্লানি। গড়ে তুলতে চায় নববর্ষে জীবনকে নতুন করে—নতুন আশা, আকাঙ্ক্ষা ও ঈপ্সা দিয়ে। জীর্ণতার পরিবর্তে চায় সজীবতা।#